১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ৩০ পৌষ ১৪৩১, ১৩ রজব ১৪৪৬
`

হঠাৎ দৌড়

হঠাৎ দৌড় -

নাটক শেষ হওয়ার সাথে সাথে পৌর অডিটোরিয়ামের সামনে ভিড় জমে যায়। রাজনের হাত ধরে সজল। আস্তে ধীরে নিচে নামে দুই বন্ধু। তিন তলার সিঁড়ি মেপে নিম্নগমনের পথে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ওদের। রীতিমতো ১২টা বেজে গেছে শরীরের। মনে হচ্ছে দুই বন্ধু কোস্তি করে বাড়ি ফিরছে। আজকের নাটকটি চমৎকার উপভোগ্য ছিল। প্রত্যেক শিল্পীই ভালো অভিনয় করেছে। আজকে নাটক দেখার ইচ্ছে ছিল না রাজনের। সজল জোর করে দেখাতে বাধ্য করেছে।
নারায়ণগঞ্জ হাই স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র রাজন ও সজল। কামাল স্যারের বাসায় প্রতি রাতে ওরা প্রাইভেট পড়তে যায়। কামাল স্যার খুব ব্যস্ত শিক্ষক। একদম সময় দিতে পারেন না। সে কারণে স্যারের সুবিধার কথা চিন্তা করে সন্ধ্যার পরেই পড়তে আসতে হয়। খুবই ভালো পড়ান কামাল স্যার। ইংরেজি ও অঙ্কে ভীষণ রকম দাপুটে শিক্ষক। অনেক দূর-দূরান্তের ছাত্র-ছাত্রীরা তার কাছে প্রাইভেট পড়তে যায়। দূরের ছাত্রদের মধ্যে রাজনও একজন। স্যারের বাসা থেকে প্রাইভেটটা শেষ করেই থিয়েটারে নাটক দেখতে যায় দুই বন্ধু।
দুই নম্বর গেটের সামনে এসে বাস কিংবা রিকশার অপেক্ষায় থাকে ওরা। অন্য জনগণও গাড়ির অপেক্ষায় জটলা বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে। বাস কিংবা রিকশা কোনোটিই দেখা যাচ্ছে না। মাঝে মধ্যে দু-একটি ট্রাক চলছে দ্রুতগতিতে। সম্ভবত এতটা পথ হেঁটেই যেতে হবে। আশপাশে পরিচিত কারো বাড়ি-ঘর নেই যে একটি রাতের জন্য কারো বাড়িতে গিয়ে উঠবে। তাই বাধ্য হয়ে দুই বন্ধু সুখ-দুঃখের আলাপ করতে করতে সামনের দিকে হাঁটতে থাকে।
মাসদাইর কবস্থানের সামনে এসে সজল কেটে পড়ার প্রস্তুতি নেয়। মেইন রোড থেকে একটু ভেতরে ওদের বাড়ি। রাজনকে অনুরোধ করে সজল ওদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য। বাবা-মায়ের অপেক্ষার কথা চিন্তা করে আর যাওয়া হয় না। তাই সজলকে বিদায় দিয়ে রাজন সোজা হাঁটতে থাকে সামনের দিকে।
এখন রাত প্রায় দেড়টার কাছাকাছি। পথঘাট ফাঁকা। খোলা আকাশের নিচে রাজন একা একা হাঁটছে। আজকের এই পরিস্থিতিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ওর। বাড়ি ফেরার আগ পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছে না মোটেই। রাজন মনে মনে ভাবে, জীবনে যতদিন বেঁচে থাকবে আজকের ঘটনা সে মনে রাখবে। এরকম বোকার মতো কাজ আর কোনো দিনও করবে না। রাতের প্রোগ্রাম চিরতরে বাদ দেবে। আজকের এই পরিস্থিতিতে রাজনের অভিজ্ঞতা বেড়েছে। কোনো ভদ্র ঘরের সন্তান এত রাতে রাস্তায় হাঁটে না। আজ বাধ্য হয়ে রাজনকে হাঁটতে হচ্ছে। তাছাড়া বাবা-মায়ের হাত থেকে বাঁচার কোনো কৌশল জানা নেই ওর। পিটিয়ে ঘর ছাড়া করবে। ছোটখাটো একটা ভয় অনুভব করছে রাজন।
পঞ্চবটির মোড় পেরিয়ে ডালটা গেটের সামনে আসে রাজন। মানুষ তো দূরের কথা একটা কুকুর বেড়ালেরও সাড়াশব্দ নেই। রাজন হাঁটছে আর ভাবছে। হঠাৎ এগুতেই পেছন থেকে চোর চোর ধ্বনি শুনতে পায়। সে থমকে দাঁড়ায়! দেখতে পায়, দুই যুবক তার পাশকেটে দৌড়ে যাচ্ছে। চোখের পলকেই ওরা অদৃশ্য হয়ে যায়। ফিরে তাকিয়ে পুনরায় দেখতে পায়, একদল যুবক তার দিকে ছুটে আসছে। ওদের হাতে লাঠি ছোরা ও হকিস্টিক। রাজন ভাবছে, নিশ্চয়ই ওরা চোর মনে করে আমাকে ফলো করেছে। আমি তো চুরি-ডাকাতি কিছুই করিনি। আমার দিকে তেড়ে আসবে কেন ওরা? না, তবু এখানে এক মুহূর্তও দাঁড়ানো সম্ভব নয়। সে পরিস্থিতি বুঝতে পেরে উঠেপড়ে দৌড়...! তার পিছে পিছে যুবক দলও চোর চোর বলে ছুটছে।
রাজন জ্ঞানশূন্য অবস্থায় ঝড়ের বেগে! কিন্তু ধৈর্য হারাচ্ছে না বিন্দুমাত্রও। তার পিছে পিছে উত্তেজিত যুবক দল। সবার হাতে লাঠি ছোরা ও হকিস্টিক। রাজনের হাতে একগাদা বইও খাতা। সে হাত থেকে বই ফেলবে না। মরতে হয় বইগুলো বুকে জড়িয়েই মরবে। এই বইয়ের কারণেও সে যুবকদের হাত থেকে বেঁচে যেতে পারে।
রাজন দৌড়াচ্ছে। ভাগ্য তাকে কোথায় নিয়ে ঠেকাবে সে কিছুই জানে না। তবুও সে এ ভয়াবহ বিপদ থেকে বাঁচার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে চলছে। বাড়ির পথ হারিয়ে সে বিকল্প পথে। কোথায় পালাবে কিছুই জানে না। তবুও যেভাবে হোক তাকে পালাতে হবে। ওদের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতেই হবে। নইলে ওর নিশ্চিত অকাল মৃত্যু। মর্মান্তিক গণপিটুনি থেকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না। এখন নিজের বাঁচার পথ নিজেকেই তৈরি করতে হবে। রাজন আজ বীরসাহসী যুবক। শহরের অলিগলি পেরিয়ে বাতাসের গতিতে ছুটছে সে। যুবক দলও ক্ষিপ্রগতিতে চোর চোর বলে দাওয়া করছে। তারা রাজনের থেকে এখনো অনেক দূরে। রাজন ক্লান্ত প্রাণ এক। আর পারছে না এগুতে। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। মনে হচ্ছে যুবকদের নির্দয় আঘাতে একটু পরেই সে হারিয়ে যাবে চিরতরে। রাজন ব্যর্থ। এই বুঝি যুবকরা ওকে ধরে ফেলছে!
তবুও সে জীবনের সাথে লড়তে চায়। যতক্ষণ দেহে প্রাণ আছে। সে উপায়ন্তর না দেখে সামনের এক সরু গলি দিয়ে ঢুকে পড়েই ডানদিকে মোড় নেয়। যুবক দলও একই গলি দিয়ে ঢুকে পড়েছে রাজনের পিছু পিছু।
রাজনের পিঠ ঠেকে গেছে দেয়ালে। দুদিকে অতিরিক্ত কোনো পথ নেই। তার ঠিক সোজা বরাবর আলিশান এক দোতলা বাড়ি। বাড়ির গেটে লেখা আবদুল্লাহ মঞ্জিল। আব্দুল্লাহ সাহেব অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার। মহল্লার সম্মানিত লোক। তার বাড়ির চারপাশে দেয়াল করা। দেয়ালটা অত উঁচু নয় আবার নিচুও নয়, মাঝামাঝি। রাজন কোনো উপায় না দেখে মুহূর্তের মধ্যে দেয়াল টপকে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে। ফলে আরেক বিপদের সম্মুখীন হয় সে। দেখতে পায়, একটি আপদ তার সামনে এসে ঘেউ ঘেউ শব্দ করছে। সে আবার দেশী আপদ নয়। বিলেতি আপদ। গায়ের লোম খাড়া আর কান দুটি মাটি পর্যন্ত লেছানো। লাইটিং পোস্টে ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে তাতে। রাজনও মওকা মতো পেয়েছে আপদকে। বলছে, ওরে আপদ! তুইও শেষ পর্যন্ত আমার শত্রু হলি? দেখাচ্ছি মজা। এ কথা বলেই দ্রুত একখণ্ড আধনা ইট তুলে সজোরে নিক্ষেপ করে আপদের মাথায়। ইটের আঘাতে আপদরূপী বিদেশী কুকুরটাও টলতে টলতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। মুহূর্তের মধ্যে রাজনও আব্দুল্লাহ সাহেবের বাড়ির পেছন বেয়ে টপকে পড়ে এক খোলা মাঠে এবং সেখান থেকে সহজে সে পালাতে সক্ষম হয়।
আব্দুল্লাহ ও মিসেস আব্দুল্লাহ বাইরের চিল্লাচিল্লি শুনে ঘুম থেকে লাফিয়ে ওঠেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই একদল যুবক দেয়াল টপকে একে একে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করেছে। সবার হাতে লাঠি ছোরা ও হকিস্টিক।
তারা সহজেই ঘাবড়ে যান। যুবকরা বাড়ির ভেতরে ঢুকে ধরধর আওয়াজ করে এদিক-সেদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। মিসেস আব্দুল্লাহ ততক্ষণে থর থর করে কাঁপছে। মেয়ে ও মেয়ের জামাই বাইরের হৈ-হুল্লোড় শুনে রীতিমতো ঘাবড়ে যায়। তারা সামনের রুমের জানালা ফাঁক করে দেখতে পায়, একদল যুবক কী যেন খেঁাজাখুঁজি করছে। ওদের হাতে লাঠি ছোরা ও হকিস্টিক। দৃশ্য দেখে আব্দুল্লাহ ও মিসেস আব্দুল্লাহ যেন দিশেহারা। এ মুহূর্তে কী করবেন আর কী করা উচিত কোনোটিই আন্দাজ করতে পারছেন না। আসলে বিপদে পড়লে বুদ্ধিমানেরাও নাকি বোকা হয়ে যান। পেছন থেকে মেয়ে ও মেয়ের জামাই কাঁপতে কাঁপতে ডাকাত ডাকাত বলে চিৎকার করছে। তাদের সাথে আব্দুল্লাহ ও মিসেস আব্দুল্লাহও কণ্ঠ মিলিয়ে বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার করছেন। তাদের চিল্লাফাল্লাতে আশপাশের লোকজন লাঠি ছোরা নিয়ে বেরিয়ে আসে। সবাই মিলে যুবকদের ঘেরাও করে ফেলছে চারদিক থেকে।
বলা বাহুল্য, মেয়ের অনুরোধে এতক্ষণে আব্দুল্লাহ সাহেব ফোন করছেন স্থানীয় থানায়। ফোন যাওয়া সত্ত্বেও কেউ রিসিভ করছে না। দ্বিতীয়বার চেষ্টা করতেই লাইনটা পেয়ে যান।
হ্যালো- এটা কী সদর থানা?
জি- আপনি কে বলছেন?
আমি ব্রিগেডিয়ার আব্দুল্লাহ বলছি। আশ্রাফ সাহেবকে চাচ্ছিলাম। ওনি থানায় আছেন তো?
না, স্যার এক সপ্তাহের ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে আছেন।
আপনি কে বলছেন প্লিজ?
আমি এস আই এহসান উদ্দিন বলছি।
ও আচ্ছা। এহসান সাহেব শুনুন। আমার বাড়িতে একদল ডাকাত ঢুকেছে। সবার হাতে লাঠি ছোরা ও হকিস্টিক।
হ্যালো, শুনছেন তো? দুদিন আগে আমার একমাত্র মেয়ে ও মেয়ের জামাই লন্ডন থেকে দেশে ফিরেছে। বর্তমানে ওরা আমাদের বাড়িতেই আছে। অনেক মূল্যবান জিনিসপত্র বিদেশ থেকে এনেছে। সেটি টের পেয়ে হয়তো ওরা আমার বাড়িতে ঢুকে পড়েছে। একটি বিদেশী কুকুরও ছিল আমাদের। সেটিকেও মেরে ফেলেছে। আপনি চটজলদি পুলিশ ফোর্স নিয়ে চলে আসুন। এ ভয়াবহ ডাকাত দল থেকে আমাদের উদ্ধার করুন।
- ঠিক আছে স্যার। আমি এখনি এক গাড়ি পুলিশ ফোর্স নিয়ে চলে আসছি। আপনি কোনোরকম চিন্তা করবেন না। রাস্তাঘাট ফাঁকা আছে। কোথাও সমস্যা নেই।
- ধন্যবাদ এহসান সাহেব। আপনি যত তাড়াতাড়ি আসবেন, ততটাই মঙ্গল আমাদের জন্য। মোবাইলে কথা শেষ করলেন ব্রিগেডিয়ার আব্দুল্লাহ।
এতক্ষণে যুবক দল চোর ধরতে না পেরে যে যার পথে পাড়ি দেবে। স্থানীয় লোকজনও ওদের মুখোমুখি। চোখের পলকেই এস আই এহসান উদ্দিন তার পুলিশ ফোর্স নিয়ে হাজির। তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে যুবকদের ওপর। অতর্কিত হামলা চালায় মুহূর্তের মধ্যে। পুলিশের নির্মম আঘাতে যুবক দলও চটে যায় তাদের উপর। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চলতে থাকে পুলিশও যুবকদের মধ্যে। প্রায় আধঘণ্টা অবধি ত্রিপক্ষীয় সংষর্ঘে এলাকা উত্তাল। স্থানীয় জনগণও পুলিশের হয়ে ওদের ওপর মারমুখী হয়।
যুবকদের রক্তে ভেসে যায় ব্রিগেডিয়ারের এলাকা। এস আই এহসান উদ্দিন ১০- ১২ জন যুবককে পিকাপে করে থানায় নিয়ে যায়। চার পাঁচজন পুলিশ সদস্যও মারাত্মক জখম হয় ওই সংঘর্ষে। ব্রিগেডিয়ার আব্দুল্লাহ তার পরিবারের পক্ষ থেকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে পুলিশকে ধন্যবাদ জানায়। দ্রুত সংবাদ ছড়িয়ে যায় শহরের আশপাশে। সাংবাদিকদের আগমন ঘটে ব্রিগেডিয়ারের বাড়িতে। ভোরের বাতাসে আশপাশের পরিবেশ শীতল হয়ে আসে। কাক ডাকে চারপাশে। রাজন এখনো জানে না ওর পরিণতিই ভোগ করেছে একদল নিরীহ যুবক। সে তখন আপন বিছানায় স্বস্তিতে ঘুমে মগ্ন। সামান্য ভুলের কারণেই হয়তো এ পরিস্থিতি। এর সমাধান খেঁাজার কেউ নেই। কথায় আছে, সামান্য ছিদ্রই ডুবিয়ে দিতে পারে মস্তবড় জাহাজকে।


আরো সংবাদ



premium cement
রূপগঞ্জে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ২ গ্রুপের সংঘর্ষে আহত ৭ মুন্সীগঞ্জে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে ১৫ লাখ ৭০ হাজার টাকা ছিনতাই সামাজিক ও আচরণ পরিবর্তনের বিষয় পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্তির আহ্বান খালেদা জিয়া এখন ‘অনেকটা বেটার’ : মির্জা ফখরুল শাটডাউনে অচল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় গতবছরের প্রায় শতভাগ বীমাদাবি পরিশোধ সোনালি লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ব্যাংক শেয়ারের মালিকানা হস্তান্তরে নতুন আইন পাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক ডিসেম্বরে আইসিসির মাস সেরা হলেন যিনি জুলাই ঘোষণাপত্র চূড়ান্তে বৃহস্পতিবার সর্বদলীয় বৈঠক সিরাজদিখানে ডিবি পরিচয়ে ছিনতাই ‘স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসাগুলোকে পর্যায়ক্রমে এমপিওভুক্তির উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে’

সকল