১০ জানুয়ারি ২০২৫, ২৬ পৌষ ১৪৩১, ৯ রজব ১৪৪৬
`

জনস্বার্থে চুনতি অভয়ারণ্য

জনস্বার্থে চুনতি অভয়ারণ্য -


চুনতি একটি গ্রাম। এটি চট্টগ্রাম জেলার সর্বদক্ষিণ উপজেলা লোহাগাড়ায় অবস্থিত। ১৯৮৬ সালে গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে চুনতি অভয়াণ্যের জন্ম হয়। নামে চুনতি অভয়ারণ্য হলেও এটা সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, বাঁশখালী ও চকরিয়া উপজেলার ১৯ হাজার ৭০০ একর এলাকা নিয়ে গঠিত। এই অভয়ারণ্য সৃষ্টিতে স্থানীয় জনস্বার্থ ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এলাকায় এই অভয়ারণ্য সৃষ্টির ধারণাটাই ভুল। বিভিন্ন দেশে অভয়ারণ্য বা জাতীয় উদ্যান ইত্যাদি রয়েছে জনবসতি বা ব্যক্তিগত চাষাবাদ করা জমিজমা থেকে অনেক দূরে। এতে জনস্বার্থ বা পরিবেশের কোনো মহৎ উদ্দেশ্যের ক্ষতি হয় না; বরং বন্য জীব-জন্তু প্রদর্শন করে সরকারের বড় আকারের আয় নিয়মিত ব্যাপার। চুনতি অভয়ারণ্য সৃষ্টির আগে প্রস্তাব ছিল পুরা এলাকা পরিমাপ করে বনভূমি বাদে ব্যক্তিগত চাষ বা আবাদি জমিজমা যা আছে, তা বের করে ক্ষতিপূরণ দিয়ে অভয়ারণ্য অন্তভুর্ক্ত করে নেয়া হবে।

বলতে গেলে সদর রাস্তা থেকে কিছু দূরে ঢুকলেই ব্যক্তিগত জমি তারপর আবার আবাদি জমি ও পাহাড়। মাঝেমধ্যে বৈধ-অবৈধ ছোটখাটো জনবসতি ও পানি চলাচলে নালা রয়েছে। প্রতি বছর হাজার হাজার মণ ধান উৎপাদন হতো, বন্যহাতি, শূকর, বানর ইত্যাদির আক্রমণে ক্ষতি সত্ত্বেও চাষিরা কষ্ট করে রাত-দিন পাহারা দিয়ে প্রচুর ধান ঘরে তুলত।

এসব কাজে অনেক লোকের মৌসুমি কর্মসংস্থান হতো, এমনকি বন্য জীব-জন্তুর কিছু খাবার সংস্থানও হতো। বর্তমানে ব্যক্তিগত হাজার হাজার একর ধানিজমি কোনো রকম ক্ষতিপূরণ ছাড়া অভয়ারণ্যের মতো হয়ে ধান চাষ সম্পূর্ণ অযোগ্য হয়ে গেছে। এমনকি দিনে দুপুরে ও বন্যহাতির পাল ধানি জমিতে ঘুরে বেড়ায়। প্রতি বছর হাতির আক্রমণে ৮-১০ জন লোক মারা যায় ও তাদের বসতঘর এবং খামারবাড়ি গুঁড়িয়ে দেয়। এর কোনো ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়নি।
হাতির আক্রমণে কেউ মারা গেলে প্রথমে বন বিভাগে ক্ষতিপূরণের দরখাস্ত করতে হয়; বন বিভাগ DFO কতৃর্ক FORESTER-কে তদন্ত করে রিপোর্ট দিতে বলা হয়। ঘটনাস্থল রিজার্ভ বনাঞ্চলের বাইরে হতে হয়। তারপর আবার UNO কতৃর্ক শনাক্ত করতে হয়। এত কিছু করা সাধারণ জনগণের পক্ষে সম্ভব হয় না।

বর্তমানে ভিক্ষা করা ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় নেই। যুগ যুগ ধরে এই বনাঞ্চলের পরিবেশ যেমন ছিল এখনো তেমনই আছে কোনো রকম হেরফের হয়নি। বনাঞ্চলের সাথে স্থানীয় জনগণের যে আন্তরিক সম্পর্ক ছিল সেটিই নষ্ট হয়েছে। জীবিকার জন্য বা সরকারের রাজস্ব আয়ের জন্য কিছু গাছ কর্তন করা হলেও তার অধিক পরিমাণ রোপণ করা হয়েছে চুনতি অভয়ারণ্য সৃষ্টির পর। এর উন্নয়নে সরকারিভাবে কোনো তহবিল বরাদ্দ হয়নি। সরকারি-বেসরকারি যৌথ প্রচেষ্টায় একটি CMC (কো-ম্যানেজমেন্ট কমিটি) গঠিত হয়। আমার বড় ভাই S A khan প্রথম অনুমোদিত সভাপতি হন, মেয়াদ চার বছর, স্থানীয় রেঞ্জ কর্মকর্তা সদস্যসচিব।
দুই বছর পরে আমার ভাইয়ের মৃত্যু হওয়ায় আমাকে মনোনীত করা হয়। পরে নির্বাচন হয় এবং পরপর আট বছর আমি নির্বাচিত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। CMC অভয়ারণ্য উন্নয়নমূলক বিষদ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে যার জন্য অনেক বড় তহবিলের প্রয়োজন। USAID-এর কাছে তহবিলের জন্য আবেদন করা হয়, কাজ চালাবার CMC-এর পক্ষে থেকে একটি কতৃর্পক্ষ টেন্ডারের মাধ্যমে নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত হয়। টেন্ডারের মাধ্যমে কাজ পায় CODEC নামে একটি এনজিও। USAID থেকে প্রস্তাব অনুযায়ী প্রাথমিক তহবিল অনুমোদন হয়। কোনো অফিস ছিল না, আমার নিজস্ব একটি আধা পাকা ঘরে CMC অফিস শুরু করা হয়।

সবমিলিয়ে ১০ বছর CMC সভাপতি হিসেবে কাজ করেছি। এই সময় চুনতি অভয়ারণ্যের সুনাম ছড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা CNN প্রতিনিধি চুনতিতে এসে অভয়ারণ্য এলাকা ঘুরে দেখে আমার সাক্ষাৎকার নেন। কিছু দিনের মধ্যে ব্রাজিলে আন্তর্জাতিক ধরিত্রী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে চুনতির অভয়ারণ্য CMC-কে টেকসই উন্নয়নে অবদানে স্বিকৃতিস্বরূপ জাতিসঙ্ঘ UNDP Equater prise দেয়া হয়।
যে লক্ষ্য সামনে রেখে চুনতি অভয়ারণ্য সৃষ্টি ও বেড়ে ওঠা তা বর্তমান পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণ হয়নি। লক্ষ্য ছিল টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে সাধারণ অবহেলিত জনগণের জীবনমান উন্নয়ন ও তাদেরকে স্থায়ীভাবে এই কাজে জড়িত রাখা। এ উদ্দেশ্যে বিনাবেতনে বন পাহারাদার হিসেবে নিয়োগ করা হয়। যারা বনাঞ্চলের ক্ষতি বন্ধের জন্য টহল দেবে এবং প্রয়োজনে স্থানীয় বন কর্মকর্তাকে জানাবেন। যারা বিনাবেতনে নিয়োজিত তাদের জন্য কিছু সুবিধা রাখার প্রস্তাব করা হয়। অভয়ারণ্য অঞ্চলকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। CORE ZONE ও BUFFER ZONE ।

CORE ZONE-এ কোনো গাছ কাটা যাবে না, BUFFER ZONE-এ নিয়োজিত টহল দল পরিবেশবান্ধব গাছ লাগাবে, সময়মতো কেটে বিক্রি করবে। আবার লাগাবে বিক্রীত লভ্যাংশ বন বিভাগ ও নিয়োজিত টহল দলের মধ্যে ভাগাভাগি হবে। বর্তমান পর্যন্ত এই প্রস্তাব বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। BUFFER ZONE-এর একটু ব্যাখ্যা দেয়া দরকার মূল অভয়ারণ্যের বেড়ার চার পাশে খালি জায়গা বনায়ন করে মূল CORE ZONE-কে রক্ষা করা। এই কাজে যাদের কিছু লাভ হবে তারা মূল অভয়ারণ্য রক্ষায় স্থায়ী অবদান রাখবে।
অভয়ারণ্যের কাজের সময় বর্তমান বন ও পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান একবার দেখতে এসেছিলেন। আমি ওনাকে আরেকবার আসার জন্য আহ্বান জানাব যে, তিনি এসে যেন চুনতি অভয়ারণ্যের বাস্তব-সত্য অবস্থা স্বচক্ষে দেখেন। বর্তমান অভয়ারণ্য গাছপালা ও জঙ্গলে ভর্তি হয়ে গেছে, বন্যহাতি ও বিভিন্ন পশুপাখি এখন রাস্তার আশপাশেই দেখা যায়, দিন দিন এদের সংখ্য বৃদ্ধি পাচ্ছে।
একসময় বন্যহাতির সংখ্য কম ছিল। অভয়ারণ্য অঞ্চলে ব্যক্তিমালিকানাধীন কৃষি জমিতে প্রচুর ধান উৎপাধন হতো, বন্যহাতি কিছু খাওয়ার পরও অনেক ধান কৃষকের বাড়িতে আসত। বর্তমানে বন্যহাতির সংখ্য প্রায় ১০০।

ঝাঁকে ঝাঁকে কৃষকের চাষাবাদ জমিতে আক্রমণ করে খেয়ে ফেলে। বনের আরো পশু যেমন শূকর ও বানরের অত্যচার অর্থাৎ কৃষিজমি, ক্ষেতখামারে আক্রমণও কম নয়। ফসল নষ্ট করে ও খেয়ে ফেলে। চাষিরা জীবন-ঝুঁকি নিয়ে সারা বছর দিন-রাত কষ্ট করে পাহারা দিয়েও ধান বাড়িতে আনতে পারেন না। প্রায় সময় কৃষক বন্যহাতি ও শূকরের আক্রমণে মারা যান। এ কারণে হাজার হাজার একর ধানি জমি অনাবাদি হয়ে গেছে।
বর্তমানে কৃষক তাদের বাপ-দাদার পুরনো পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশায় জড়িত হচ্ছে ও আরো শত শত তরুণ যুবক বেকারত্বের অভিশাপে ভুগছে। এসব ধানিজমি চাষাবাদে আনা অসাধ্য সাধন করার মতো হবে। যদি দ্রুত কোনো পদক্ষেপ নেয়া না হয় তবে দেশের এই জাতীয় ক্ষতি কোনো দিন পূরণ হবে না। শুধু পরিবেশের দোহাই দিয়ে এত বড় একটা জাতীয় ক্ষতি কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। আর যেহেতু অভয়ারণ্যের ভেতরে হাজার হাজার একর ব্যক্তিমালিকানাধীন খতিয়ানভুক্ত জমি থেকে গেছে তাই তাদের পৈতৃক চাষাবাদকৃত জমিতে আসা-যাওয়া করতে নিষেধ করারও কারো কোনো অধিকার নেই।


আরো সংবাদ



premium cement