১০ জানুয়ারি ২০২৫, ২৬ পৌষ ১৪৩১, ৯ রজব ১৪৪৬
`

ব্যথার খবর

ব্যথার খবর -


ফাস্টফুডে একধরনের আসক্তি আছে আমার। আমার ছোট্ট একটি মফস্বল। এখানে আজকাল অভিজাত খাবারের মানবসভ্যতা এসেছে। অনেক বছর আগে শহরের উন্নত রেস্টুরেন্টে যেসব দামি খাবারের বাহার দেখতাম, সময়ের আবর্তে সেসব রেস্টুরেন্টের খাবার এখন আমার মফস্বলেও পাওয়া যায়। তবে যেহেতু বার্গার, পিৎজা, স্যান্ডউইচ, শর্মা, এসব অভিনব ফুডে আমার লোভ আছে, তাই হরহামেশা এসব খাবারের লোভে আমাকে ফাস্টফুড শপে যেতেই হয়।
যথারীতি একদিন গেলাম পরিচিত এক রেস্তোরাঁতে। বার্গার অর্ডার দিলাম। যথাসময়ে সেটি সামনে নিয়ে এলো যে ছেলেটা, সে খুব ভদ্র। এখানে যখনই আসি, সে আমাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে খাবার সামনে এনে দেয়। আড় চোখে আমি ছেলেটাকে দেখি। এইটুকু ছেলে, অথচ এ বয়সে পেটের দায়ে কর্মজীবী। নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে হল এ কারণে যে, ওর বয়সে আমি সোনার চামচ মুখে নিয়ে না জন্মালেও রাজকীয় একটা জীবন পার করেছি মধ্যবিত্ত সংসারের মানুষ হয়ে। যা-ই হোক, তো রেস্তোরাঁর কর্মচারী ছেলেটি একদিন বার্গার এনে দিলো। আমি আপন মনে বার্গার খেতে খেতে মনে হলো বার্গার থেকে অস্বাভাবিক গন্ধ আসছে।

ক্রমান্বয়ে বুঝতে পারি এই বার্গারটি গতকালের হতে পারে। বিক্রি হয়নি বলে দোকানি চালাকি করে মাইক্রোওভেনে গরম করে আমাকে ধেঁাকা দিয়েছে। কিন্তু প্রতিবাদ করে বাগ্বিতণ্ডায় জড়ানোর ইচ্ছে হয়নি বলে বার্গারের বাকি অংশটি রেখে দিয়ে ক্যাশের সামনে এসে টাকাটা পরিশোধ করার পর হঠাৎ দেখি দোকানের শোকসের আয়নার প্রতিবিম্বে কর্মচারী ছেলেটিকে দেখা যাচ্ছে, যে কিনা আমার উচ্ছিষ্ট বার্গারটি গোপনে কৌশল করে খাচ্ছে। দৃশ্যটি খুব কষ্ট দিলো আমাকে। খাবারের অতি পরিচিত একটি দৃশ্য। কিন্তু সে দৃশ্যে বেদনা জড়িয়ে আছে। আমার দার্শনিক চোখের পাতায় কত দৃশ্য। হয়তো ছেলেটিকে কর্তৃপক্ষ উপযুক্ত খাবার দিচ্ছে না বলে সে বাধ্য হয়ে কাস্টমারের বাসি খাবার মুখে দিচ্ছে! হয়তোবা তাকে খাবার নিয়মিত দেয়া হয় সঠিক সময়ে; কিন্তু এই মুহূর্তে তার পেটে অনেক ক্ষুধা, তাই এমন কাজ করে বসল। তবে ঘটনা যেটাই হোক না কেন, এই ঘটনার সারমর্ম একটাই- অভাব, টানাপড়েন, দারিদে্র্যর কশাঘাত। তা না হলে এই বয়সে একটা ছেলে স্কুলে না গিয়ে পেটের দায়ে ঘর ছেড়ে জীবিকায় নামবে কেন!

কিন্তু আমার উচ্ছিষ্ট বার্গার খাওয়ার সাধারণ দৃশ্যটি অসাধারণ এক বেদনার ছবি হয়ে আমার ক্যানভাসে অঙ্কিত হয়ে রইল।
তারপর কিছুদিন পর আবার সেই রেস্তোরাঁয় যাবার আগে ভাবলাম আজ ছেলেটিকে নিয়ে আমি বার্গার খাবো। পাশাপাশি বসে দুইজনে দুই প্লেটে দু’টি বার্গার খেতে খেতে ছবি তুলব। হয়তো সে আপত্তি তুলবে; কিন্তু আমি আমার সিদ্ধান্তে অনড় থাকব।
কিন্তু সেখানে গিয়ে জানতে পারি ছেলেটি কয়েকদিন আগেই চাকরি ছেড়ে চলে গেছে। কতৃর্পক্ষের কাছে তার ঠিকানা চাইলেও তারা উপযুক্ত ঠিকানা দিতে পারেননি। আমি ব্যথিত হলাম। আমার ব্যথার কথা কেউ জানতে পারল না আর। তাতে কী! এক জীবনে কারণে-অকারণে অনেক ব্যথাই তো জমে আমাদের বুকের কোণে। সব ব্যথার খবর কি সবাইকে জানাতে হয়! হয় না।

 


আরো সংবাদ



premium cement