২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ট্রেন আমাকে কাঁদিয়েছে

-


ট্রেন। অধিকাংশ যাত্রীদের কাছে ট্রেন একটি আরামদায়ক যানবাহন। যদি না কোনো সিজন থাকে। কারণ সিজন এলেই ট্রেন আর ট্রেন থাকে না, হয়ে ওঠে মানুষের ঘেরা একটি লম্বা মানবগাড়ি।
আমি ও দাদা গেলাম সকাল সাতটার দিকে এয়ারপোর্ট রেলস্টেশনে। এগারো সিন্ধুর প্রভাতী ট্রেন কমলাপুর থেকে ছেড়ে আসবে। সাড়ে ৭টায় প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়াবে। সাধারণত এদিনগুলোতে ট্রেনে তেমন চাপ থাকে না। থাকার কথাও না। আমরা দাঁড়িয়ে আছি ট্রেনের অপেক্ষায়। টাকা ও টিকিট সবই আমার কাছে। ট্রেন এলো। দাঁড়াল কিছুক্ষণ। দেখি ভেতরে মানুষের ঢল। গেটে উপচে পড়া ভিড়। এত যাত্রী দেখে আমি মূঢ় দৃষ্টিতে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলাম। চতুর হবার আগেই ট্রেন হুইসেল দিয়ে দিলো। সচল হলো চাকা। কোনো রকম ঘেঁষাঘেঁষি করে উঠে ঠেসে দাঁড়ালাম ট্রেনের ভেতর। ঝকঝক চলছে ট্রেন। কিন্তু দাদা, দাদা কোথায়! দাদাকে দেখছি না। তবে তিনি ট্রেনে যে উঠেছেন তা আমি দেখেছি। কিন্তু কোথায় দাদা! মানুষ ঠেসেঠুসে দাদাকে ঝক্কি নিয়ে যে আমি ট্রেনে উঠাব ততটা বড় হইনি তখনো। টিকিটের গায়ের ‘চ’ বগিতে আমি উঠিনি। কিন্তু কোন বগিতে উঠেছি তাও জানি না। ওঠার সময় বগির অক্ষর দেখার জো পাইনি।

আমি ছোট। দাদা বৃদ্ধ। তাই আমি আমার সাথে রাখতে পেরে উঠিনি দাদাকে কিংবা দাদার সঙ্গে থাকতে পারিনি। ট্রেনের ভেতর এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। ধাক্কাধাক্কি আর ঠেলাঠেলিতে কয় বগি পার করেছি তা এখন স্মরণে নেই। ঘণ্টাখানেক পর ঠায় দাঁড়িয়ে আছি খাবারের বগিতে। এদিক-সেদিক নড়ার কায়দা নেই। বলা যায়, ট্রেনের ভেতর তিল ধারণের জায়গাটুকুও নেই। যখন একটু ফাঁকা হতে লাগল তখন টিটিইকে কিছু টাকা দিয়ে বসার দুটো স্থান নিলাম। দাদা কোন বগিতে আছেন জানা নেই। ভাবছি ট্রেন কোনো স্টেশনে দাঁড়ালে বের হবো দাদাকে খুঁজতে। কিন্তু ট্রেন তো কোনো স্টেশনেই দাঁড়াচ্ছে না। তার যেন খুব তাড়া। তবে এটা জানি ভৈরব দাঁড়াবে ট্রেন। কারণ সেখানে ইঞ্জিন চেঞ্জ করবে। পনেরো মিনিট সময় পাওয়া যাবে হাতে দাদাকে খুঁজে বের করার। কিন্তু ভৈরব তো অনেক দূর!
বসার জায়গা পেয়ে বসে রইলাম। কিন্তু শান্তি মেলছে না। মন অস্থির। ছটফটিয়ে ওঠে বারবার। দাঁড়িয়ে ভাবলাম, আমার দাদা কোথায় জানি দাঁড়িয়ে আছেন! মানুষের ঠেসাঠেসিতে আমার যে ভোগান্তি হয়েছে, তাহলে আমার বৃদ্ধ দাদার কী অবস্থা! আল্লাহ-ই ভালো জানেন।

ট্রেন দাঁড়াল ভৈরব এসে। হাতে সময় ১৫ মিনিট। ট্রেন থেকে ভিড় ঠেলে নামতে নামতেই ৫ মিনিট শেষ। প্রত্যেক বগির জানালা দিয়ে দাদাকে খুঁজতে লাগলাম। খুঁজতে খুঁজতে যখন সময় প্রায় শেষ এবং ট্রেনের হুইসেল বেজে উঠল তখন চোখ পড়ল দাদার দিকে। ট্রেনের ভেতর মানুষের ভিড়ে দাদা দাঁড়িয়ে আছেন। আনমনে। বিষণœ বদনে। ক্লান্তির ছাপ তার চেহারায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে ফুটে উঠেছে। আমি দাদা বলে ডাক দিতেই মলিন চেহারায়, অসহায় ও বিষণ্ন মনে আমার দিকে তাকালেন। আমি তাকিয়ে দেখি সভ্য মানুষগুলো বসে আছে। এক বৃদ্ধ লোক দাঁড়িয়ে আছেন কেউ ভ্রুক্ষেপই করেনি। মানবতা বলে তো কিছু আছে। কিছু সময় হলেও তো বসাতে পারত তাকে।

দৌড়ঝাঁপ করেও দাদার বগিতে উঠতে পারলাম না। দাদা ওখান থেকে নড়তেও পারছেন না মানুষের চাপে। ফের হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন চলতে শুরু করল। ঝকঝকা ঝক। দাদা ওখান থেকে বলে উঠলেন, ওঠো... ট্রেনে ওঠো। আমি দৌড়ে হন্তদন্ত হয়ে খাবার বগিতে ফিরে গেলাম। মনমরা করে বসে রইলাম। আমার টিকিটে দুই সিট, বসে আছি আরো দুই সিট নিয়ে। কিন্তু আমার বৃদ্ধ দাদা!
আমি জানি এত মানুষের ভিড় ঠেলে দাদাকে এখানে আনতে টিটিইর কষ্ট হবে। কিন্তু সে কি বোঝেছে আমার কষ্টের কথা। উপলব্ধি কী করতে পেরেছে একজন বৃদ্ধের টানা তিন-চার ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার ক্লান্তির কথা। হয়তো করেছে। কিন্তু আমার ও দাদার কষ্ট তার মনে দাগ কাটতে পারেনি। শুধু টিটিইকে না, আমি আরো অনেককে বলেছি আমার দাদার কষ্টের কথা। কিন্তু লাভ হলো না। আমি রাস্তাজুড়ে দাদার কথা ভেবেছি আর কেঁদেছি। এর বাইরে কি-ই বা করতে পারতাম এতটুকু আমি।

কিশোরগঞ্জ স্টেশনে এসে ট্রেন দাঁড়াল। ভিড় ঠেলে দিই ছুট দাদার বগিতে। মানুষ ঠেসে উঠে দেখি দাদা নিচে বসে আছেন দুই হাঁটু উঠিয়ে। আমাকে দেখে একটু মৃদু হাসলেন। আমিও ঠোঁট ভাঙা হাসি দিলাম। দাদা আমাকে ধরে দাঁড়ালেন। তার এই দীর্ঘসময় দাঁড়িয়ে থাকার কষ্ট লুকাবার ব্যর্থ চেষ্টা করে বললেন, দাদুভাই তোমার অনেক কষ্ট হইছে না? আমি জোর করে ঠোঁটে হাসি টেনে বললাম, না দাদা।
আব্বু আজও জানেন না আমাদের এমন কষ্টদায়ক সফরের কথা। আমি বলিনি ভয়ে। কারণ, দাদার যাতে কষ্ট না হয় তাই তিনি অগ্রিম টিকিট এনে রেখেছিলেন এক সপ্তাহ আগে। আর সে কষ্টই আমি দিয়েছি দাদাকে। আর দাদাও বললেননি হয়তো আমার কথা ভেবে। দাদা ইন্তেকাল করেছেন ১৬ নভেম্বর ২০১৬। ঘটনা ঘটেছিল ২০১২ বা ১৩ সাল। এখন ট্রেন দেখলেই দাদার দাঁড়িয়ে থাকা মলিন চেহারা মনে ওঠে। ‘দাদাভাই তোমার অনেক কষ্ট হয়ছে না?’ শুকনো স্বরের কথাটা কানে বাজে। কাঁটা হয়ে বেঁধে বুকে!
আল্লাহর কাছে দোয়া করি তিনি যেন আমার দাদার কবরকে জান্নাতি সুবাতাস দ্বারা সিক্ত করেন। আমিন।

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement
ইউক্রেনের গুপ্তহত্যার চক্রান্ত ব্যর্থ করে দেয়ার দাবি রাশিয়ার তিব্বতে বিশ্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ বাঁধ তৈরি করবে চীন মির্জাপুরে যৌথ অভিযানে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে বনভূমি উদ্ধার সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ জামায়াতের কাকরাইল মসজিদে সাদপন্থীদের কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ শ্রীনগরে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে যুবকের মৃত্যু ভান্ডারিয়ায় জামায়াতের কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত ট্রাকচাপায় ফায়ার ফাইটার নিহতের ঘটনায় মামলা ইরানের কাছে ৩০০ বিলিয়ন ক্ষতিপূরণ দাবি করল সিরিয়ার নতুন সরকার সচিবালয়ে আগুন : ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে ৩ মন্ত্রণালয়ের কমিটি নিহত ফায়ার ফাইটার নয়নের পরিবারে শোকের মাতম

সকল