১৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ৪ পৌষ ১৪৩১, ১৬ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

তাজমহল

আগ্রা ফোর্টের গুলবাগিচার পাশে লেখক -

আগ্রা ফোর্ট যমুনার তীরে অত্যন্ত প্রাচীন একটি অবস্থানে অবস্থিত। তাজমহল থেকে দুই কিলোমিটার দূরে ষোড়শ শতাব্দীতে সম্রাট আকবরের তৈরি এই দুর্গ, যার আকর্ষণ তাজের থেকে কোনো অংশেই কম নয়। আগ্রা ফোর্ট ইউনেস্কোর অন্যতম বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত।
আমাদের সাথে একজন গাইড ছিলেন, যিনি ফোর্টের ইতিহাস বলছিলেন ঘুরে দেখাতে দেখাতে। এক সময় এটি ছিল চৌহান রাজপুতদের অধিকৃত ইট-নির্মিত একটি দুর্গ। ১০৮০ খ্রিষ্টাব্দে গজনোভিদের বাহিনীর আওতায় চলে আসে এ দুর্গ। সিকান্দার লোদী (১৪৮৭ থেকে ১৫১৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন) ছিলেন দিল্লির প্রথম সুলতান, যিনি দিল্লি থেকে আগ্রা এসে এই ফোর্টে বসবাস করেন। তিনি এখান থেকে দেশ শাসন করায় আগ্রা দেশের দ্বিতীয় রাজধানীর গুরুত্ব লাভ করে। সিকান্দার লোদী ১৫১৭ খ্রিষ্টাব্দে আগ্রা ফোর্টে মৃত্যুবরণ করেন। তারপর তার পুত্র ইব্রাহিম লোদীর অধিকারে এ দুর্গটি ছিল প্রায় ৯ বছর। ১৫২৬ খ্রিষ্টাব্দে ইব্রাহিম লোদী পানিপথে পরাজিত ও মৃত্যুবরণ করার পর আগ্রা ফোর্ট চলে যায় মোঘলদের অধিকারে। তবে লোদীদের সময়ে এ ফোর্টে পৃথক ক’টি রাজপ্রাসাদ, কূপ ও মসজিদ নির্মিত হয়।
‘কোহিনূর’ নামক বিখ্যাত হীরকসহ বিপুল পরিমাণ ধন মোগলদের করায়ত্ত হয় আগ্রা ফোর্ট তাদের অধিকারে চলে আসার পর। ১৫৩০ খ্রিষ্টাব্দে আগ্রা ফোর্টে সম্রাট হুমায়ুনের রাজ্যাভিষেক হয়। ১৫৩৯ খ্রিষ্টাব্দে চৌসাতে তার পরাজয়ের পর তিনি আগ্রাতে পুনরায় চলে আসেন।
হুমায়ুন নামাতে কথিত আছে, নিজাম নামের এক পানি বহনকারী হুমায়ুনকে ডুবে মরে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করায় তাকে আগ্রা ফোর্টে অর্ধদিবসের জন্য রাজমুকুট পরিয়ে কৃতজ্ঞতাসূচক সম্মান প্রদর্শন করা হয় এবং এর স্মরণে মুদ্রাও প্রচলন করা হয়। ১৫৪০ খ্রিষ্টাব্দে হুমায়ুন বিলগ্রামে পরাজিত হন। এতে আগ্রা ফোর্ট পাঁচ বছরের জন্য শেরশাহের অধিকারে চলে যায়। ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দে পানিপথে মোগলরা চূড়ান্তভাবে আফগানদের পরাজিত করে ১৭০৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ভারতে তাদের দেড় শ’ বছরের নিরবচ্ছিন্ন শাসন কায়েমের দৃঢ়ভিত্তি স্থাপন করে।
মোগল সম্রাট আকবরের শাসনকাল ছিল প্রায় পঞ্চাশ বছর (১৫৫৬-১৬০৫)।
তিনি এটিকে তার রাজধানীতে রূপান্তরের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ‘বাদলগড়’ নামে ইট-নির্মিত আগ্রার এই ফোর্টকে জরাজীর্ণ অবস্থায় দেখতে পেয়ে একে লাল বেলে পাথর দ্বারা পুনরায় নির্মাণের নির্দেশ দেন। অভিজ্ঞ স্থপতিদের দ্বারা এ ফোর্টের ভিত্তি স্থাপন করা হয়। বৃহদায়তনে বেশ স্থূলভাবে এ ফোর্টের সীমানা প্রাচীরের অভ্যন্তর ভাগ ইট দ্বারা নির্মাণ করে এর বহিরাংশে দেয়া হয় লাল বেলে পাথর। ১৫৬৫ থেকে ১৫৭৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় আট বছর পর্যন্ত চলে এ ফোর্ট পুনরায় নির্মাণের কাজ। এ সময়ে প্রতিদিন প্রায় চার হাজার নির্মাণ শ্রমিক এ কাজে নিয়োজিত ছিলেন।
এখন পর্যন্ত এটি লাল বেলেপাথরের চারদিকে পরিখা এবং বাগান ঘেরা দারুণ সুরক্ষিত এক দুর্গ। শত্রুসৈন্য দুর্গের কাছে এসেও যাতে সহজে ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য পরিখায় থাকত কুমিরের মতো হিংস্র জলজ প্রাণী, আর বাগানে থাকত শ্বাপদহিংস্র জন্তু।
এ দু’টো বিপদসঙ্কুল পর্যায় অতিক্রম করে শত্রু যদি দুর্গে প্রবেশও করে তখন ছিল অন্য ব্যবস্থা। প্রধান প্রবেশ পথ ধরে গেলাম ভেতরে। ধীরে ধীরে ওপরে উঠে গেছে সমতল সিঁড়ি (অনেকটা হুইল চেয়ারে চলাচলের জন্য যেমন সিঁড়ি থাকে, সে রকম) ।
রাজারা যেহেতু ঘোড়ায় চলাচল করতেন, তাই পথটা এমন। দুই পাশে বিশাল বিশাল দেয়াল। দেয়ালে এক ধরনের ছিদ্র আছে, শত্রু আক্রমণ করলে যেখান দিয়ে গরম তেল ঢেলে দেয়া হতো। যাতে ঘোড়াগুলো আর এগোতে না পারে। এটা ছিল দুর্গ রক্ষার সব শেষ উপায়। পুরাটাই পাথরের নির্মিত ফোর্ট, কোথাও ইট চোখে পড়ে না। ইতোমধ্যে আমরা দুইটা প্রধান গেট পার করে এসেছি। ভেতরে প্রবেশ করতেই চোখ জুড়িয়ে গেল, নির্মাণ শৈলী অসাধারণ। এখান থেকে তাজমহলও দেখা যায়। মৃত্যুর পরে যার স্থান হয়েছে তাজমহলে, জীবিতকালে সেই মমতাজ নাকি এখানেই থাকতেন। জীবনের শেষ দিনগুলোয় শাহজাহানও এখানেই থেকেছেন ছেলেদের হাতে বন্দী হয়ে।
আগ্রা ফোর্টের সম্মুখে সংরক্ষিত একটি বিরাট শিলালিপিতে উৎকীর্ণ আছে এর প্রকৃত ইতিহাস। এতে লেখা আছে, ‘আগ্রা ফোর্ট হচ্ছে ভারতের সবচেয়ে’ গুরুত্বপূর্ণ ফোর্ট। বাবর, হুমায়ুন, আকবর, জাহাঙ্গীর, শাহজাহান ও আওরঙ্গজেবের মতো মহামতি মোগল সম্রাটগণ এখানে বসবাস করেছেন। এখান থেকেই তারা সমগ্র দেশ শাসন করতেন। সর্ববৃহৎ রাষ্ট্রীয় কোষাগার ও টাঁকশাল ছিল এখানেই। এ ফোর্টটি বিপুলসংখ্যক রাষ্ট্রপ্রধান, বিদেশী রাষ্ট্রদূত, উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গ ও পর্যটক পরিদর্শন করেছেন। আগ্রা ফোর্ট ব্যতীত ভারতের অন্য কোনো ফোর্ট বা দুর্গের এতটা খ্যাতি নেই।
ফোর্টের চার দিকে চারটি গেট ছিল। নদী অভিমুখী গেটটির নাম ছিল খিজরি গেট, যার সম্মুখে নির্মাণ করা হয় বিভিন্ন প্রকারের বহু কূপ।
ইতিহাসবিদ আবুল ফজলের বর্ণনায়, বাংলা ও গুজরাটি সুন্দর নকশায় আগ্রা ফোর্টে পাঁচ শতাধিক অট্টালিকা নির্মাণ করা হয়েছিল, যার কিয়দংশ সম্রাট শাহজাহান সাদা মার্বেলে প্রাসাদ নির্মাণের প্রয়োজনে ভেঙে ফেলেছিলেন। জানা যায়, আকবরসহ অন্যান্য মোগল সম্রাট নির্মিত আগ্রা ফোর্টের অধিকাংশ অট্টালিকা ব্রিটিশ কর্তৃক সৈন্যদের ব্যারাক নির্মাণের প্রয়োজনে ধ্বংস করা হয়। ফোর্টের দক্ষিণ-পূর্বাংশে বড় জোর ৩০টি মোগল স্থাপনা টিকে আছে। দিল্লি গেট, আকবর গেট এবং ‘বেঙ্গল মহল’ নামে একটি প্রাসাদই এখন আকবরের অট্টালিকাসমূহের প্রতিনিধিত্ব করছে। দিল্লি গেটটি ছিল শহরমুখী।
আরোহীসহ হাতীরূপী দু’টি লাইফ সাইজের পাথর অভ্যন্তরীণ গেটে স্থাপিত, যার নাম ‘হাতি-পল’।
দিল্লি গেটকেই সম্রাটের আনুষ্ঠানিক প্রবেশের স্মারক হিসেবে নির্মাণ করা হয়। ব্রিটিশ কর্তৃক আকবর গেটের পুনরায় নামকরণ করা হয় ‘অমর সিং’ গেট। এ গেটটি দিল্লি গেটের মতোই। এ দু’টো গেটই লাল পাথরে নির্মিত। ‘বেঙ্গল মহল’ও তৈরি একই পাথরে, যা বর্তমানে ‘আকবরি মহল’ ও ‘জাহাঙ্গীর মহলে’ বিভক্ত।
আকবরের মৃত্যুতে ১৬০৫ খ্রিষ্টাব্দে তার ছেলে জাহাঙ্গীরের সম্রাট হিসেবে রাজ্যাভিষেক হয় এই আগ্রা ফোর্টে। পরবর্তীতে সম্রাট শাহজাহান ১৬২৮ খ্রিষ্টাব্দে আগ্রা ফোর্টে তার রাজমুকুট পরিধান করেন। আগ্রা ফোর্টে সাদা মার্বেলে নির্মিত যতো প্রাসাদ আছে সবই তার গড়া। তিনি এ ফোর্টে মোতি মসজিদ, নাগিনা মসজিদ ও মিনা মসজিদ নামে সাদা মার্বেল পাথরে তিনটি মসজিদ নির্মাণ করেন। ১৬৫৮ খ্রিষ্টাব্দে সামুগড়ের যুদ্ধের পর সম্রাট শাহজাহানের তৃতীয় পুত্র আওরঙ্গজেব আগ্রা ফোর্ট ঘেরাও করেন এবং নদী থেকে এ ফোর্টের পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেন। শাহজাহান কূপের পানি পান করতে না পারায় পুত্রের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। আওরঙ্গজেব তার পিতা শাহজাহানকে কারাদণ্ড প্রদান করেন। এ দণ্ড ভোগ করতে হয় তাকে আগ্রা ফোর্টেই। ১৬৫৮ থেকে ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত এখানেই আট বছর কারাবাস করেন শাহজাহান। মৃত্যুর পর তার লাশ এখান থেকে নৌকাযোগে নিয়ে প্রিয়তমা স্ত্রী মমতাজের পাশে তাজমহলে সমাহিত করা হয়।
গাইড জানালেন- আগ্রা ফোর্ট থেকে তাজমহল যাওয়ার স্কাই পথ তৈরি হবে। ইতোমধ্যেই পরিকল্পনার ব্লুপ্রিন্ট তৈরির কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে সমতল থেকে ২৫ ফুট উচ্চতায় স্কাইওয়াক বা সেতুটি তৈরি হবে। সেতুটিকে পরিবেশবান্ধব করে তোলার জন্য বিশেষ ধরনের পাথর ব্যবহার করা হবে। রাস্তার দুইপাশে থাকবে গাছ সিঁড়ি এবং চলন্ত সিঁড়ির মাধ্যমে সেতুর ওপর উঠে দুই কিলোমিটার হাঁটলেই আগ্রার এক দর্শনীয় স্থান আগ্রা ফোর্ট থেকে বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্য তাজমহলে পৌঁছে যাওয়া যাবে।


আরো সংবাদ



premium cement
প্রধান উপদেষ্টা আজ আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষণ দেবেন পাকিস্তানের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ভারতে লঞ্চে ধাক্কা নৌবাহিনীর স্পিড বোটের! মৃত ১৩ পণ্যশুল্ক নিয়ে মোদিকে হুঁশিয়ারি ট্রাম্পের বিশ্বকাপে মদের নিষেধাজ্ঞা শিথিল করবে না সৌদি আরব র‍্যাঙ্কিংয়ে শেখ মেহেদী-হাসান মাহমুদের বড় লাফ রাখাইন রাজ্যে সংঘর্ষে আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন শিক্ষার্থীরা আরবি ভাষা শিখলে উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবে বিসিএসের আবেদনে চিকিৎসকদের বয়স ৩৪ করা হোক : ড্যাব জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ শিক্ষার্থী গুপ্তহত্যায় ছাত্রশিবিরের উদ্বেগ যোগ্যতা অনুযায়ী পদোন্নতি দাবি শিশু বিশেষজ্ঞদের

সকল