বিজয় দিবসের আনন্দ বেদনা
- ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী
- ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
১৯৭১ সালে আমরা যে স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম তা আজ হয়ে পড়েছে অর্থহীন। এর থেকে পরিত্রাণের জন্য সাধিত হয়েছে জুলাই বিপ্লব। জুলাই এর গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের প্রিয় স্বাধীনতার লক্ষ্য অর্জনে সচেষ্ট হব। গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু হবে। প্রতিষ্ঠিত হবে নির্যাতন, নিপিড়ন এবং শোষণ, বঞ্চনাহীন এক নতুন বাংলাদেশ
১৬ ডিসেম্বর, মহান বিজয় দিবস। ১৯৭১ এর এই দিনে পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে আমরা চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করি। অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। বিজয় দিবসে স্মরণ করি মুক্তিযুদ্ধে নিহত লাখো শহীদকে যাদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা। আজকের দিনে তাদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি- বলতে চাই তোমাদের আত্মদান, তোমাদের রক্ত বৃথা যায়নি- বৃথা যেতে দেবো না।
বাংলাদেশের চূড়ান্ত বিজয়ের প্রাক্কালে ১৪ ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা ও তাদের দোসরেরা এই জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। বাংলাদেশের চূড়ান্ত বিজয়ের প্রাক্কালে পাক বাহিনী এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে চেয়েছিল। তাই তারা সকল স্তরের বুদ্ধিজীবীদের নৃশংসভাবে হত্যার পরিকল্পনা গ্রহণ করে এবং সারা দেশের শিক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী ও বিজ্ঞানীসহ অনেক বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে। আজকের দিনে সকল শহীদ বুদ্ধিজীবীকে আমি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি এবং তাদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। ১৪ ডিসেম্বরের নিধনযজ্ঞে যেমন ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ি, তেমনি আবার ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ি। তাই ডিসেম্বর মাস এক দিকে যেমন আনন্দের অন্য দিকে তেমনি বেদনার।
১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত। ক্রমান্বয়ে এই দাবি ব্যাপকতা লাভ করে। ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এই সংগ্রামকে তীব্রতর করে এবং সে বছর ২১ ফেব্রুয়ারিতে সরকারের জারিকৃত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ভাষার দাবিতে মিছিল বের করে। মিছিলে গুলিবর্ষণ করা হয়। বরকত, সালাম, জব্বারসহ অনেকেই শহীদ হন। এই ভাষা আন্দোলনের মধ্যেই আমি মনে করি বাঙালি জাতীয়তাবাদের তথা বাংলা ভাষাভিত্তিক একটি জাতীয় রাষ্ট্রের বীজ বপন করা হয়।
ভাষা আন্দোলনের সূত্র ধরেই পরবর্তীকালে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্টের জয়লাভ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ যে মুসলিম লীগ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল সেই মুসলিম লীগ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র ছয়-সাত বছরের মধ্যে পরাজয় বরণ করে। এই ঘটনার মধ্য দিয়েই এই অঞ্চলের মানুষের মনোভাব বোঝা যায়। অর্থাৎ এই অঞ্চলের মানুষ মুসলিম লীগকে পাকিস্তানি শাসক এবং শোষক শ্রেণীর এবং উর্দু ভাষার স্বার্থরাকারী হিসেবে চিহ্নিত করে। তাই তারা এর বিরোধী শক্তি যুক্তফ্রন্টকে সমর্থন দান করে। ফলে ৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিপুল বিজয় এবং মতাসীন মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয় ঘটে। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নটিও এখানে গুরুত্ব লাভ করে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন এবং তৎপরবর্তী চুয়ান্নর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের জনগণের মধ্যে একটি জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারার সূত্রপাত ঘটে।
পাকিস্তানি শাসকচক্র তখন থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে বিমাতা সুলভ ব্যবহার শুরু করে। কেন্দ্রে কোয়ালিশন শাসক দলগুলোর চক্রান্তের কারণে পাকিস্তানে গণতন্ত্রের ভিত একেবারেই নড়বড়ে হয়ে ওঠে। ঘন ঘন সরকার বদল এবং এর উত্থান পতন ও স্বার্থান্বেষী দলগুলোর হানাহানির সুযোগ নিয়ে ১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আইয়ুব খান সারা দেশে সামরিক শাসন জারি করেন। এর কিছু দিন পর প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জাকে অপসারিত করে তিনি নিজেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতির পদ দখল করেন। এভাবে পাকিস্তানে গণতন্ত্রের কবর রচিত হয় এবং এক-নায়কতান্ত্রিক শাসন জারি হয়।
এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে আইয়ুব শাহী পাকিস্তানের মতায় অধিষ্ঠিত হয়। এরা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি বাইশ ধনিক পরিবারের স্বার্থরাকারী, প্রতিনিধি। পাকিস্তানের প্রায় সমস্ত সম্পদ এই বাইশ পরিবারের হাতেই কুগিত ছিল। এরা সকলেই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি। আর এই ধনিক এবং মুৎসুদ্দী শ্রেণীর প্রতিনিধি ছিলেন আইয়ুব শাসকগোষ্ঠী। আইয়ুব শাসনামলে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করা হয়। অনেক মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয়া হয়। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করা হয়। রাজনৈতিক দমন-পীড়ন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। মৌলিক গণতন্ত্র নামক এক অগণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া চালু করা হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে এ ধরনের গণতন্ত্রের কোনো নজির মিলে না। মৌলিক গণতন্ত্রের মাধ্যমে সম্পূর্ণ একদলীয় শাসন আইয়ুবশাহী অব্যাহত রাখে।
১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক আকাশে এক প্রচণ্ড ঝড়মেঘের সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে শেখ মুজিবুর রহমানের রেসকোর্স ময়দানে ৭ মার্চের ভাষণের পর রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তাল হয়ে উঠে। পূর্ব পাকিস্তানে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের ছাদে উড়ানো হয় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। সেই পতাকা ঠিক আজকের পতাকার পূর্ণাঙ্গ ছবি না হলেও এই পতাকারই প্রথম সংস্করণ। ডাকসুর তদানীন্তন ভিপি আ স ম আব্দুর রব কলাভবনের ছাদে এই পতাকা উত্তোলন করেন। জাতীয় দ্বন্দ্ব প্রধান দ্বন্দ্বে রূপান্তরিত হয় এবং জাতীয় মুক্তির প্রশ্নে সকল দেশপ্রেমিক শক্তি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ৭ মার্চের পর থেকে প্রতিদিনই অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, কল-কারখানা সর্বত্রই বিক্ষোভ শুরু হয়। সভা-সমিতি ও মিছিলে ঢাকা শহর মুখর হয়ে ওঠে। দেশের সর্বত্র বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
২৭ মার্চ ও ও তার পরবর্তী দিবসগুলোতে ঢাকায় ২৫ মার্চের রাতের হত্যাযজ্ঞের খবর সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ছড়িয়ে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের বিভাগীয় এবং তৎকালীন জগন্নাথ হলের প্রাধ্য ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেবের হত্যার খবর। নিহতের মধ্যে আরো ছিলেন পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো: মনিরুজ্জামান, ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুর, ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, পদার্থবিদ্যা বিভাগের তরুণ শিক খান খাদেম, শিা গবেষণা ইনস্টিটিউটের তরুণ শিক ফয়জুল মহীসহ আরো অনেক শিক ও ছাত্র। প্রাণ হারিয়েছিলেন রাজারবাগ পুলিশ বাহিনী ও পূর্ব পাকিস্তানে রাইফেলসের অনেক সদস্য। এর মধ্যে আরো প্রচারিত হয় মেজর জিয়া ও তার নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর একটি অংশ, চট্টগ্রামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী থেকে বিদ্রোহ করে বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিরা বাহিনীর বাঙালি সদস্যদের পাকিস্তান প ত্যাগ এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের খবর দেশের মানুষকে আরো অনুপ্রাণীত করে তোলে।
নয় মাস যুদ্ধের পর, পাকিস্থান বাহিনীর এই নিধনযজ্ঞ চূড়ান্ত রূপ নেয় ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে। বিশেষ করে ১৪ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকা শহরের অসংখ্য শিক, বুদ্ধিজীবীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আনোয়ার পাশা, গিয়াসউদ্দিন আহমেদসহ আরো অনেক শিক এবং ড. ফজলে রাব্বী, শহীদুল্লাহ কায়সারসহ অনেক বুদ্ধিজীবী এবং সিরাজউদ্দিন, নিজামউদ্দিন আহম্মেদসহ আরো অনেক সাংবাদিক। অর্থাৎ পাক বাহিনীর পরিকল্পনা ছিল যাওয়ার আগে তারা এ দেশকে ধ্বংস করে যাবে এবং তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী তাই তারা সম্পন্ন করেছিল। ১৬ ডিসেম্বর পাক বাহিনীর আত্ম সমর্পণের মাধ্যমে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র।
কিন্তু আজ স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে লক্ষে এবং উদ্দেশ্যে- এ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়েছিল তা আজো পূরণ হয়নি। পাকিস্তান রাষ্ট্রের নিপীড়ন, নির্যাতন, শোষণ এবং বঞ্চনা যেন নবরূপে দেখা দিয়েছে। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পাওয়ার ল্েয বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটানো হয়েছিল।
কিন্তু সেই গণতন্ত্র আজ বাংলাদেশে সোনার হরিণ। যদিও ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের মোট তিনটি নিরপে এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সূত্রপাত হয়েছিল, পরে সে ধারা অব্যাহত থাকেনি। হীন রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। এভাবে মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করা হয়। সম্প্রতি এখানে বিকশিত হয়েছে দেশপ্রেম বিবর্জিত এক লুটেরা বর্জুয়া শ্রেণী, বর্তমান শাসক গোষ্ঠী তাদেরই প্রতিনিধি। এদের মূল কাজ হল ছলে বলে কৌশলে মতায় টিকে থাকা এবং দেশের সম্পদ লুণ্ঠন করে বিদেশে পাচার করা। এই লুণ্ঠন প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে এবং মতা চিরস্থায়ী করতে গিয়ে এই শাসক শ্রেণী মানুষের সকল গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিয়েছে এবং কায়েম করেছে এক নিষ্ঠুর ও নিকৃষ্ট স্বৈরশাসন। অতএব ১৯৭১ সালে আমরা যে স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম তা আজ হয়ে পড়েছে অর্থহীন। এর থেকে পরিত্রাণের জন্য সাধিত হয়েছে জুলাই বিপ্লব। জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের প্রিয় স্বাধীনতার লক্ষ্য অর্জনে সচেষ্ট হবো। গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু হবে। প্রতিষ্ঠিত হবে নির্যাতন, নিপিড়ন এবং শোষণ, বঞ্চনাহীন এক নতুন বাংলাদেশ।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা