স্বাধীনতা ও মুক্তির বিজয়
- ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ
- ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ‘প্রস্তাবনায়’ উল্লেখ রয়েছে- ‘আমরা, বাংলাদেশের জনগণ, ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি; ...যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে;... আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে; ... আমরা যাহাতে স্বাধীন সত্তায় সমৃদ্ধি লাভ করিতে পারি এবং মানবজাতির প্রগতিশীল আশা-আকাক্সার সহিত সঙ্গতি রক্ষা করিয়া আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে পূর্ণ ভূমিকা পালন করিতে পারি, সেই জন্য বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তিস্বরূপ এই সংবিধানের প্রাধান্য অুণ্ন রাখা এবং ইহার রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তাবিধান আমাদের পবিত্র কর্তব্য।’ সুতরাং বাংলাদেশের জনগণ, যারা সবাই মিলে দেশ ‘স্বাধীন’ করেছে, সেই আমজনতা ‘গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হওয়ার’ পরিবেশ পরিস্থিতিতে যখনই কোনো ব্যত্যয় ঘটে, বা বাধা অসে তখনই স্বাভাবিকভাবে তাদের মাথায়, মনে ও মুখে যে প্রতিরোধের প্রবেধ-প্রত্যয় ও মুক্তির আকাক্সা জেগে ওঠে তা প্রবলভাবে আন্দোলনে রূপ নেয় এবং শেষ পর্যন্ত একটি বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে তাদেরে নিয়ে যায়। ১৯৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধেও বিজয়ে যে রাজনৈতিক ‘স্বাধীনতা’ অর্জিত হয়েছিল ২০২৪ সালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শত-সহ¯্র আত্মত্যাগের মাধমে স্বাধীনতার স্বপ্ন সাধ বৈষম্য বঞ্চনা থেকে ‘মুক্তি’র বিজয় সুচিত হয়েছে।
আদি পিতা হজরত আদম ইবলিশ শয়তানের প্ররোচনায় নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করেছিলেন। প্রভু নিরঞ্জনের নির্দেশ উপদেশ উপেক্ষা করে সম্পাদিত সেই ভুলের খেসারত হিসেবে স্বর্গ থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল প্রথম মানব-মানবীকে। অনেকেরই ধারণা, এমনতরো অসতর্ক না হলে, সিদ্ধান্ত নিতে ভুল না করলে, এমন নির্দেশ অমান্যের ঘটনা না ঘটলে আজ সবাই স্বর্গে স্থায়ীভাবে বিনা দলাদলিতে বিনা সঙ্কট সন্ত্রাসে সংশয়ে বাস করা যেত। যাই হোক, আদি মানবের করা প্রথম নির্দেশ অমান্যের ঘটনা থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত সারা বিশ্বে যত অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, অন্তর্ঘাত, অপশাসন, আইনের বরখেলাপ, চোরাগোপ্তা হামলা, ডাকাতি, পুকুর ও সাগর চুরি, প্রবঞ্চনা-প্রতারণা, ডলার (কৃত্রিম) সঙ্কট, দুর্নীতি, দুঃশাসন, স্বৈরাচার- সব কিছুর সালতামামি ও শুমার করলে তার সারমর্ম দাঁড়ায়- স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রামের অর্থবহ বিজয় অনায়াসলব্ধ নয়।
চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে- অতি সনাতন কথা। আর ভারতে ব্রিটিশ সরকার সবাইকে শিখিয়ে গেছে, ‘চোর তো চুরি করবেই গৃহস্থকে সজাগ থাকতে হবে’, সর্বত্র সর্প হয়ে দংশন করে ওঁঝা হয়ে ঝাড়ার’ ফন্দিফিকির চলছেই। সেই চাণক্যের আমল থেকে বলা হচ্ছে ‘ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করা সহজ’। এমনতরো নীতিকথা খনার বচনে ঠাঁই পাওয়ার পরিবেশ পরিস্থিতি তৈরি হতেই থাকে। মানুষের নীতি-নৈতিকতার অভিজ্ঞতার ঝুড়ি বড় হয়, চুল পাকে যে প্রকারে ও গতিতে, চোর ডাকাত আর দুষ্কর্মী দুর্নীতিবাজের হাত পাকে তার চাইতে বেশি মাত্রায় ও গতিতে, শয়তানি বা দুষ্টু বুদ্ধির বিনিয়োগ বেশ প্রখর, লক্ষ্যভেদি ও সুতীক্ষ্ণ, পক্ষান্তরে তাকে মোকাবেলা করা ওরফে মাড়িয়ে বা এড়িয়ে চলার প্রয়াস প্রচেষ্টা সে তুলনায় তত জোরালো হতে সময় লাগে। পরস্পরের দোষারোপে অধিকাংশ সময় পার হয় এবং অল্প কিছুক্ষণের ‘ঠেকে শেখার’ উপাদান শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়- একটু অন্য কায়দায় কিছু একটা আবার ঘটলে তখন সবাই আবার যুক্তির বাড়ি দৌড়ায়, যৌক্তিকতা খোঁজার কাজে লেগে যায় এবং এক সময় আবার কান্ত হয়ে পড়ে। বর্তমানেরটা বটেই অতীতেরটা মোকাবেলার অগ্রগতি অনুসরণের জন্য উদ্যম আর মেলে না। এই টানাপড়েনে ঘুঘুর বারবার ধান খেয়ে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়।
আসলে বারবার দৃষ্টি অন্যত্র সরানোর ফলে চোখ এমন ট্যারা হয়ে যায় যে কোথায় দৃষ্টিক্ষেপ হচ্ছে তা বোঝার বিষয়টিও গোলমেলে হয়ে যায়। তখন বড়জোর এটি করলে ভালো হতো ওটি করলে ভালো হতো টাইপের চর্বিত চর্বণ উচ্চারণেই সব কিছু মিলিয়ে ও থিঁতিয়ে যায়। আসল বাদ দিয়ে নকলের দিকে চলে যায় চোখ, চোখে ধোকা দিয়ে ব্যস্ত রাখা হয় অন্যত্র ফলে নকলের, অনিয়মের, অশিক্ষার, কুশিক্ষার বাড়ে সুযোগ। তারা বেশ বলশালী হয়।
বাংলাদেশের আমজনতা এমন একসময় ও পরিবেশে বাস করে সেখানে অতি সতর্কতার নামে সময় ব্যয় হয় যত্রতত্র এবং আসল দুরবস্থা থেকে দৃষ্টি চলে যায় অনেক দূরে, বহু দূরে। সেখানে সকালে সবাই সুকান্তের মতো ‘শিশুর নিরাপদ বাসযোগ্য বিশ্ব রচনায় মনোনিবেশের মন্ত্রজঁপে, তাদের সময় কাটে ‘সব জঞ্জাল সরানোর’ প্রত্যয় ও প্রগলভতায়। কিন্তু কিছুই না করে বা করতে না পেরে বিকেলে রবীন্দ্রনাথে আশ্রয় নিয়ে সবাই বলে- ‘আমার হাতে তো ছিল না পৃথিবীর ভার।’ অন্যের ওপর সব দায়-দায়িত্ব চাপানোর চৌকস চতুর লোকের সংখ্যা বাড়ছে সমাজে। আসলে দশখান অব্যবস্থাপনার মধ্যে সবাইকে ব্যস্ত রেখে ঠেকে শেখার দাওয়াই দিয়ে ইচ্ছায়-অনচ্ছিায় আড়ালে কারো কারো আসল কাজ উদ্ধারের পথ করা হয় নিরাপদ নিরোপদ্রুপ। সফলতা সবখানে-উপেক্ষার আড়ালে, উপলব্ধির খতিয়ান ও পর্চায় কাটাকাটির ঘটনা তাই বারবার ঘটে। ঠেকে শেখা শেষ হয় না।
বাংলাদেশের আমজনতাকে একসময় উন্নতি-উন্নয়নের চমক দেখিয়ে, তাদের আর্থ-সামাজিক স্বার্থ- সৌভাগ্যের ক্রমবিপর্যয় ঘটানোর অপপ্রয়াস অপচেষ্টার ধরন দেখে বিলেতি সেই প্রবাদের কথা মনে পড়ে যায়- ‘বোকারা রাধে বাড়ে চালাকেরা তা খেয়ে ফতুর করে দেয়’।
বাঙালির ঐতিহাসিক ‘মুক্তির সংগ্রাম’-এর প্রকৃত অর্জন বা বিজয় বিবেচনার জন্য বিগত পাঁচ দশকে অর্থনৈতিক উন্নয়নে স্বয়ম্ভরতা অর্জনের প্রত্যয় ও প্রতীতির স্বরূপ পর্যালোচনার অবশ্যই অবকাশ রয়েছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রশ্নে দল-মত গোত্র-গুষ্ঠী নির্বিশেষে গোটা দেশবাসীকে ভাববন্ধনে আবদ্ধকরণে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস যেমন জরুরি, তেমনি জাতীয় উন্নয়ন প্রয়াস প্রচেষ্টাতেও সমন্বিত উদ্যোগের আবশ্যকতাও একইভাবে অনস্বীকার্য। নাগরিক অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা ও উপলব্ধির জাগৃতিতে অনিবার্য হয়ে ওঠে যে নিষ্ঠা ও আকাক্সা তা অর্জনের জন্য সাধনার প্রয়োজন, প্রয়োজন সব পক্ষের ত্যাগ স্বীকারের । দায়-দায়িত্ব পালন ছাড়া স্বাধীনতার সুফল ভোগের দাবিদার হওয়া বাতুলতা মাত্র। পারস্পরিক দোষারোপের দ্বারা নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার প্রবণ তায় প্রকৃত অর্জন অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। বিভ্রান্তির বেড়াজালে দেশগত সমৃদ্ধির স্বপ্ন আত্মপ্রবঞ্চনার পর্যায়ে চলে যেতে পারে। নিজেরাই নিজেদেও শত্রু সেজে দূরের ও কাছের শত্রুদের কাছে ভূরাজনীতির দাবার ঘুঁটিতে পরিণত হওয়ার অশুভ পরিণতি পরিলক্ষিত হয়েছে কয়েকটি দেশে অতি সাম্প্রতিককালে।
একজন কর্মচারী কিংবা রাজনৈতিক কর্মীর পারিতোষিক বা আয়-উপার্জন তার সম্পাদিত কাজ কিংবা ‘রাগ অনুরাগ বর্জিত’ দেশসেবার পরিমাণ বা পারদর্শিতা অনুযায়ী না হয়ে কিংবা কাজের সফলতা-ব্যর্থতার দায়দায়িত্ব বিবেচনায় না এনে যদি দিতে হয় অর্থাৎ কাজ না করেও সে যদি আয় উপার্জন করতে পারে, তাহলে দতা অর্জনের প্রত্যাশা আর দায়িত্ববোধের বিকাশভাবনা মাঠে মারা যাবেই। এ ধরনের ব্যর্থতার বজরা ভারী হতে থাকলেই যেকোনো উৎপাদন ব্যবস্থা কিংবা উন্নয়ন প্রয়াস ভর্তুকির পরাশ্রয়ে যেতে বাধ্য। দারিদ্র্যপীড়িত জনবহুল কোনো দেশে পাবলিক সেক্টর বেকার ও অকর্মণ্যদের জন্য যদি অভয়ারণ্য কিংবা কল্যাণ রাষ্ট্রের প্রতিভু হিসেবে কাজ করে তাহলে সেখানে অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। যদি বিপুল জনগোষ্ঠীকে মানবসম্পদ ও সরকারি শক্তিতে পরিণত করা না যায় উপযুক্ত কর্মমতা অর্জন ও প্রয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি করে, তাহলে উন্নয়ন কর্মসূচিতে বড় বড় বিনিয়োগও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে। সরকারি চাকরিকে সোনার হরিণ বানানোর কারণে সে চাকরি পাওয়া এবং রাখার জন্য অস্বাভাবিক দেনদরবার চলাই স্বাভাবিক। দায়-দায়িত্বহীন চাকরি পাওয়ার সুযোগের অপেক্ষায় থাকার ফলে নিজ উদ্যোগে স্বনির্ভর হওয়ার আগ্রহতেও অনীহা চলে আসে। মানবসম্পদ অপচয়ের এর চেয়ে বড় নজির আর হতে পারে না। দরিদ্রতম পরিবেশে যেখানে শ্রেণী নির্বিশেষে সবার কঠোর পরিশ্রম, কৃচ্ছ্রতা সাধন ও আত্মত্যাগ আবশ্যক সেখানে সহজে ও বিনা কেশে কিভাবে অর্থ উপার্জন সম্ভব সে দিকেই ঝোঁক বেশি হওয়াটা সুস্থতার লক্ষণ নয়। নানান ভুল ভালে ভরা, বিকৃত ইতিহাস পাঠে বাধ্য করতে, মুক্তবুদ্ধি চিন্তা-চেতনাকে প্রজন্মানান্তরে সীমাবদ্ধকরণে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ জাতির মেরুদণ্ড বলে খ্যাত শিক্ষা ব্যবস্থাকে পঙ্গুত্ব বরণে সহায়তা করা যা কিনা দূরের ও কাছের স্বাধীনতার শত্রুদের দীর্ঘমেয়াদি সর্বনাশ সাধনের নীলনকশারই বাস্তবায়ন। এটি বোঝার ক্ষমতাটাও হরণ হতে দিলে সমূহ সর্বনাশ। ট্রেড ইউনিয়ন নির্বাচনে প্রার্থীর পরিচয়ে যে অঢেল অর্থব্যয় চলে তা যেন এমন এক বিনিয়োগ যা অবৈধভাবে অধিক উসুলের সুযোগ আছে বলেই। শোষক আর পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় বঞ্চিত নিপীড়িত শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থ উদ্ধারে নিবেদিত চিত্ত হওয়ার বদলে ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্ব নিজেরাই যখন উৎপাদনবিমুখ আর শ্রমিক স্বার্থ উদ্ধারের পরিবর্তে আত্মস্বার্থ উদ্ধারে ব্যতিব্যস্ত হয়ে শোষণের প্রতিভু বনে যায় তখন দেখা যায় যাদের তারা প্রতিনিধিত্ব করছে তাদেরই তারা প্রথম ও প্রধান প্রতিপক্ষ। প্রচণ্ড স্ববিরোধী এই পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে উৎপাদন, উন্নয়ন তথা জনকল্যাণ সবই বালখিল্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
যেকোনো অজুহাতে অপচয়-অপব্যয় তহবিল তছরূপ আত্মসাৎ যেকোনো সবল অর্থনৈতিক উন্নয়ন ধারাকেও করে দ্বিধান্বিত। বাধাগ্রস্ত। এসব রোধে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়ার বিকল্প নেই। প্রত্যেক নাগরিকেরই তার দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ হওয়ার মধ্যেই সুখী ও সমৃদ্ধশালী সমাজ এবং অর্থনীতি পুনর্গঠনের সুযোগ নিহিত। আগেই বলা হয়েছে, মানুষই তার পরিবেশের নিয়ন্তা। তাকে সজ্ঞান সচেতনতায় সিদ্ধান্ত নিতে হবে সাধ্যমতো দায়িত্ব পালনের। সংসার, সমাজ ও দেশের উন্নয়নে তার নিজের অংশগ্রহণকে অর্থবহ করতে ঐকান্তিক নিষ্ঠার দরকার। সংসারে নানান বাদ প্রতিবাদে মানুষ বেড়ে ওঠে, তার দায়-দায়িত্ব তদানুযায়ী নির্ধারিত হয় এবং তা যথাযথভাবে পালনে সংসারের গতির চাকা সচল থাকে নির্র্দিষ্ট নিয়মে।
বিদ্যমান ব্যবস্থাপনার সংস্কার ও কিংবা উন্নয়নকামী যেকোনো নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাস্তবায়নযোগ্যতার এবং বাস্তবায়নের দৃঢ়চিত্ততার বিষয় বিবেচনা অগ্রগণ্য না হলে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে আন্তরিক প্রয়াস নিশ্চিত হয় না। জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনার জন্য দূরদৃষ্টি রূপকল্প প্রণয়নকারীর, প্রগাঢ় প্রতিশ্রুতি ও দৃঢ়প্রত্যয় প্রয়োজন। সমস্যা গোচরে এলে ব্যবস্থা নিতে নিতে সব সামর্থ্য ও সীমিত সম্পদ নিঃশেষ হতে দিলে প্রকৃত উন্নয়নের জন্য পুঁজি ও প্রত্যয়ে ঘাটতি তো হবেই। সমস্যারা পরস্পরের মিত্র, একটির সাথে একটির যেন নাড়ির যোগাযোগ। আইনশৃঙ্খলার সাথে ব্যক্তি নিরাপত্তার, ব্যক্তি নিরাপত্তার সাথে সামাজিক নিরাপত্তার, সামাজিক নিরাপত্তার সাথে আয় উপার্জনের সব কার্যক্রমের কার্যকরণগত সম্পর্ক রয়েছে। দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে চাই আয় উপার্জনের সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশ। শিক্ষা কর্মদক্ষতাকে , স্বাস্থ্যসেবা কর্মক্ষমতাকে, কর্মদক্ষতা ও কমক্ষমতা উৎপাদন ও ব্যবসায়-বাণিজ্যে প্রসার ঘটবে, এটিই প্রত্যাশা। সর্বত্র সেই পরিবেশের সহায়তা একান্ত অপরিহার্য যেখানে সীমিত সম্পদের ও সুযোগের সর্বোত্তম ব্যবহার সম্ভব। একটিকে উপেক্ষা মানে যুগপৎভাবে অন্যান্য অনেক সমস্যাকে ছাড় দেয়া। সমস্যার উৎসে গিয়ে সমস্যার সমাধানে ব্রতী হতে হবে। এ কাজ কারো একার নয়, এ কাজ সবার। সমস্যার মোকাবেলায় প্রয়োজন সমাধানের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সমস্যা পরিপোষণের জন্য নয়। যেকোনো সংস্কারমূলক পদক্ষেপ বাস্তবায়নের জন্য জনমত সৃষ্টিতে, আস্থা আনয়নে ও একাগ্রতা পোষণে গঠনমূলক উদ্যোগ গ্রহণ অপরিহার্য। সংস্কার বাস্তবায়ন কোনোমতেই সহজসাধ্য নয় বলেই সর্বত্র দৃঢ়চিত্ততা আবশ্যক। এখানে দ্বিধান্বিত হওয়া দ্বিমত পোষণ কিংবা প্রথাসিদ্ধবাদী বশংবদ বেনিয়া মুৎসুদ্ধি মানসিকতার সাথে আপস করার সুযোগ থাকতে নেই। অতীতে এই ভূখণ্ডে যতগুলো রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্কার কর্মসূচি কিংবা ধ্যানধারণা ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তাদের কমবেশি ব্যর্থতার পেছনে বিরুদ্ধবাদীদের বিরুদ্ধে দৃঢ়চিত্ত অবস্থান গ্রহণে অপারগতাই মুখ্য কারণ ছিল।
বিশ্বে আমরা যেসব পণ্য রফতানি করছি সেগুলোর সুনাম ধরে রাখার চেষ্টা করতে হবে। আমাদের শিল্পনীতি যেগুলো নেয়া হয়েছিল সেগুলো বেশ ভালো ছিল কিন্তু আমরা সেগুলো আক্ষরিক অর্থে বাস্তবায়নের পরিবেশ তৈরি হয়নি। আমরা শিল্পনীতিতে অনেকগুলো সুযোগ-সুবিধার কথা বলেছি, শর্তের কথা বলেছি কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়ন করতে সময় নিচ্ছি অথচ ইতোবছরে অনেক সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। আমরা বিদেশীদের জন্য অনেক সুযোগ-সুবিধার কথা বলেছি কিন্তু সেগুলো তারা পায়নি। আবার অনেকে আমাদের ঘোষিত সুযোগ-সুবিধা অপব্যবহারের কৌশল অবলম্বন করেছে। আমরা দেশের রাজস্ব আহরণে সফলতা অর্জন করলেও এই জায়গায় আরো অনেক কাজ করার আছে। কারণ আমরা কর ও জিডিপি রেশিওকে এখনো উন্নত করতে পারিনি। আমাদের রাজস্ব আহরণের সিস্টেমের ভেতরে এখনো অনেকগুলো গলদ রয়ে গেছে। প্রচুর খাতকে আমরা কর ফাঁকি দেয়ার সুযোগ করে দিয়েছি, অনেক খাতকে উপেক্ষা করেছি। কালো টাকা সাদা করার ব্যাপারে এমন সুযোগ-সুবিধা দিয়েছি যার ফলে দুর্নীতি ও অসৎ উপার্জনকে আরো উৎসাহিত হতে পেরেছে। অন্য দিকে নিয়মিত করদাতারা ও সৎপথে উপার্জনকারীরা নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।
আগে খুব সহজ শর্তে বাংলাদেশ বিদেশী ঋণ পেতো। যার ফলে আমরা খুব সহজে ঋণ পরিশোধ করতে পারতাম। কঠিন শর্তে বিদেশী ঋণ নেয়ার ফলে তার যে লায়াবিলিটি তৈরি হচ্ছে তা শোধ করার জন্য অর্থনীতিকে যদি স্বয়ম্ভর করতে না পারি তাহলে ডেথ ট্র্যাপে পড়ার সম্ভাবনা স্পষ্ট হচ্ছে। আমরা অবশ্যই প্রত্যাশা করি, এই আশঙ্কা যেন সত্যি না নয়। খুব কঠিন শর্তে ঋণ নিয়ে কোনো অবকাঠামো তৈরি করলে সেটি যত তাড়াতাড়ি তৈরি করে তত তাড়াতাড়ি সেখান থেকে যে উপযোগিতা আসবে সেটি দিয়ে ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। কঠিন শর্তে ঋণ নিয়ে দ্রুত কাজ শেষ করতে না পারলে সফলতা পাওয়া যাবে না। আমাদের মাথাপিছু দেশী এবং বিদেশী ঋণ ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। সুদের পরিমাণও এত বেড়ে যাচ্ছে যে, পুরো বাজেটের প্রায় ২০-২২ শতাংশ শুধু সুদ পরিশোধ করতে খরচ হয়। ভবিষ্যতে আমাদের বাজেটের বেশির ভাগ খেয়ে ফেলবে এই ঋণের দায় শোধ করতে। তাহলে উন্নয়ন হবে কখন ও কিভাবে? তখন প্রকৃত উন্নয়ন করতে পারব যদি আমরা ঋণ নিয়ে যে অবকাঠামো তৈরি করেছি সেগুলো যদি সত্যি সত্যি সময়মতো পাই তাহলে অর্থনীতিতে যে গতিশীলতা আসবে সেটির দ্বারা আমরা কাভারআপ করতে পারব। মানুষ ঋণ নেয় ভবিষ্যতে সক্ষমতা অর্জন করার জন্য। এমন ঋণ নেয় যেটি ভবিষ্যতে শোধ করতে পারবে কিন্তু সেটি যদি পরিশোধ করতে না পারে তাহলে ডেট ট্র্যাপে পড়ে। অনেক উন্নয়নশীল দেশ, আফ্রিকার বহু দেশে এবং আমাদের অনেক প্রতিবেশী দেশ এ ধরনের বিপদে পড়েছে। অতএব, মুক্তির বিজয়ের এ মুহূর্তে এ আশঙ্কার বিষয়টি সবাইকে অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা