গণতন্ত্রায়ন ও উন্নত জাতি গঠনে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের প্রয়োজনীয়তা
- ড. এম আবদুল আজিজ
- ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দীর্ঘ ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান এবং নতুন সরকারের মতাগ্রহণ কেবল একটি নতুন শাসনের সূচনা নয়, বরং সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে। সুদীর্ঘ পনেরো বছরের দুঃশাসন ও অসংখ্য মানুষের আত্মত্যাগের ফসল হিসেবে এই গণ-অভ্যুত্থান। তাই, অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আসা অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের কাছে মানুষের চাওয়া-পাওয়াও অনেক। তবে, সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের অসীম প্রত্যাশার বিপরীতে নানাবিধ প্রতিবন্ধকতা সরকারকে চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছে। যার মধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো নির্বাচন ও সাংবিধানিক মৌলিক বিভিন্ন বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য।
দীর্ঘদিন দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধ, আদর্শিক দ্বন্দ্ব, মতপার্থক্য এবং মতার প্রতিযোগিতা দ্বন্দ্ব জাতিকে বিভক্ত করে রেখেছে। পাশাপাশি সদ্য পতিত ফ্যাসিবাদী শক্তির বিভিন্ন গোষ্ঠী আবার সক্রিয় হয়ে উঠছে। যে কারণে সম্পূর্ণ ভঙ্গুর এবং অপরাধপ্রবণ একটি ব্যবস্থাকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানোর জন্য নতুন সরকারের প্রয়োজন যথেষ্ট সময় ও সবার পূর্ণ সহযোগিতা। আশা জাগানিয়া হলো- পতিত আওয়ামী লীগ ও তাদের মিত্ররা ছাড়া দেশের সব রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও বিভিন্ন ধর্মীয় নেতাদের সাথে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাম্প্রতিক বৈঠক।
দেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন একদিনে ধ্বংস হয়নি, তেমনি এর পুনর্গঠনও একদিনে সম্ভব নয়। দেশের বিচারব্যবস্থা, প্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন, নির্বাচন কমিশন, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই বিগত সরকারের সময় দলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। পাশাপাশি, লুটপাট, রাষ্ট্রীয় সম্পদ পাচার এবং তছরুপের কারণে দেশের অর্থনীতি অনেকটা খাদের কিনারে এসে পৌঁছেছিল। এই প্রোপটে, নতুন সরকারকে যেমন আপাত পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হচ্ছে, সাথে সাথে দীর্ঘমেয়াদিভাবে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো যথাযথ পুনর্গঠনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করতেও কাজ করতে হচ্ছে।
একটি কার্যকর, গণতান্ত্রিক ও জনগণের চেতনার প্রতিফলনে সংবিধান প্রণয়নের ল্েয জাতীয় ঐকমত্য তৈরি করা খুবই জরুরি। বর্তমানে সরকার বিভিন্ন সংস্কার কমিশন গঠনের পাশাপাশি সংবিধান সংস্কারের জন্যও একটি কমিশন গঠন করেছে। এই কমিশনের সংবিধান সংস্কারের প্রক্রিয়ায় সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মতামত ও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে একটি ‘সংস্কার ফ্রেমওয়ার্ক’ তৈরি করা যেতে পারে। এই সংস্কার ফ্রেমওয়ার্ক ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের চেতনা ধারণ করে এবং অবশ্যই গণভোটের মাধ্যমে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে চূড়ান্ত করতে হবে।
গণভোটের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কার নাকি পুনর্লিখন তার উত্তর যেমন পাওয়া যাবে, তেমনি সংবিধানের বিভিন্ন মৌলিক বিষয়েও সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব হবে। বর্তমান সংবিধানের বিতর্কিত ও অগণতান্ত্রিক সংশোধনীগুলো পুনর্বিবেচনা বা পর্যালোচনা করতে হবে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী তা রহিত বা সংশোধন করতে হবে। যেমন, ৭০ অনুচ্ছেদের মতো গণতন্ত্রবিরোধী ধারাগুলো সংশোধনের মাধ্যমে সংসদ সদস্যদের স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করা যেতে পারে। একই সাথে সংবিধানের মূলনীতিতে গণতন্ত্র, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সমতার মতো বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দিতে হবে।
ধর্মনিরপেতার নামে ধর্মহীনতার পরিবর্তে সব ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মধ্যে সমান মর্যাদা প্রতিষ্ঠার বিষয় স্থান দিতে হবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত রাখা উচিত। সংবিধানে প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মতার ভারসাম্য আনা যেতে পারে; যাতে রাষ্ট্র, সরকার ও রাজনৈতিক দল পৃথক থাকে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল করার মাধ্যমে সুষ্ঠু ও নিরপে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করা এবং মতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তর নিশ্চিত করার পদপে নিতে হবে।
একটি গণমুখী ও শক্তিশালী সংবিধান প্রণয়নের ল্েয প্রয়োজনে বর্তমান সংবিধানের পরিবর্তে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন অথবা বিদ্যমান সংবিধানের অগণতান্ত্রিক ধারাগুলোর সংশোধন করা যেতে পারে। গণভোটে পাস হওয়া নতুন সংবিধানের অধীনে রাষ্ট্র সংস্কার করে জনগণের হাতে মতা ফিরিয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব হতে পারে।
একটি কার্যকর, শক্তিশালী ও স্বাধীন নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ এখন জরুরি। অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে মতার শান্তিপূর্ণ বদল নিশ্চিত করতে হলে নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে পেশিশক্তি, কালো টাকার প্রভাব এবং গণমাধ্যমের অপব্যবহার রোধ করার পদপে নিতে হবে। নির্বাচন কমিশনের জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক ও জনবল সংস্থানের পাশাপাশি একটি পৃথক ক্যাডার গঠন এবং জনপ্রশাসন থেকে প্রেষণে নিয়োগের পরিবর্তন একটি কার্যকর পদপে হতে পারে।
বর্তমান আসনভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির পরিবর্তে সংখ্যানুপাতিক ভোট পদ্ধতি চালুর মাধ্যমে নির্বাচনে সমান প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা যেতে পারে। এতে করে একদলীয় স্বৈরশাসনের সম্ভাবনা যেমন দূর হবে, তেমনি বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথও সুগম হবে। ‘পার্টি লিস্ট’ পদ্ধতিতে ভোটাররা সরাসরি তাদের পছন্দের প্রার্থীকে বেছে নিতে পারবেন, যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো ইশতেহার প্রকাশ করে ভোটারদের নিকট তাদের ল ও পরিকল্পনা তুলে ধরতে পারবে। এতে ভোটাররা দলীয় ইশতেহারের ভিত্তিতে তাদের পছন্দের দলের প্রতি সমর্থন জানাতে পারবেন।
সংসদীয় কাঠামোকে আরো কার্যকর করতে দ্বিকবিশিষ্ট সংসদ প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। নিম্নকে জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা থাকবেন এবং উচ্চকে দেশের বিশিষ্টজন ও বিশেষজ্ঞরা গণতন্ত্র ও সংবিধানের রক হিসেবে ভূমিকা পালন করবেন। এ ধরনের কাঠামো আইনগত প্রয়োগের যথাযথ কার্যকারিতা ও জাতীয় আদর্শের সাথে সাংঘর্ষিক সিদ্ধান্ত প্রতিহত করতে সম হবে।
নির্বাচনে আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচন কমিশন ও রাজস্ব বোর্ডে আর্থিক বিবরণী জমা দেয়া বাধ্যতামূলক করা উচিত। প্রার্থীদের শিাগত যোগ্যতা ও আয়কর রিটার্নের বিষয়ে স্বচ্ছতা আনতে বাধ্যতামূলক বিধান চালু করা যেতে পারে। রাজনৈতিক প্রার্থীদের ব্যবসায়িক স্বার্থ থাকলে নির্বাচনে অংশগ্রহণের পূর্বে সংশ্লিষ্ট ব্যবসা হস্তান্তরের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা যেতে পারে। আর্থিক ও রাজনৈতিক মতার একত্রীকরণ দুর্নীতির জন্ম দেয়, যা প্রতিহত করা গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনারের নিয়োগপ্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতার পরিবর্তে সিলেক্ট কমিটি ও সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী আইনি কাঠামোর আওতায় আনা উচিত। এতে নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক চাপমুক্ত থাকবে এবং জাতীয় স্বার্থে দায়িত্ব পালনে সম হবে। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে নির্বাচন কমিশনের কার্যকরী ভূমিকা নিশ্চিত করার ল্েয সুষ্ঠু, নিরপে ও স্বচ্ছ নির্বাচনী ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া গুরুত্বপূর্ণ।
এহেন সীমাহীন সংস্কার ও কার্যক্রমের প্রেক্ষিতে দেশে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মাঝে দ্বন্দ্ব, সঙ্ঘাত ও বৈরিতা সামনে চলে আসছে, যার ফলে কিছুটা অস্থিতিশীলতাও সৃষ্টি হচ্ছে। এরকম পরিস্থিতিতে সরকারের উদ্যোগে রাজনৈতিক দলগুলো এবং নাগরিক সমাজের সাথে ধারাবাহিক সংলাপ ও সংস্কারপ্রক্রিয়ায় সবার অংশগ্রহণ ও মতামতের প্রতিফলন নিশ্চিত করা আবশ্যক।
এ ছাড়া রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সাংবিধানিক এবং নির্বাচনী বিষয়ে কিছু মতৈক্য পরিলতি হচ্ছে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অবয় বাংলাদেশের বর্তমান সঙ্কটকে আরো গভীর করে তুলেছে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থা হারানোর এই অবনতি কেবল জনগণের মধ্যেই নয়, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বিরোধও আরো দৃঢ় করছে। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সহিংসতা, হিংসা ও জালিয়াতির ঘটনা প্রতিনিয়ত গণতান্ত্রিক আদর্শের প্রতি জনগণের আস্থা কমিয়ে দিয়েছে। বিরোধী দলগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সঙ্কীর্ণতা জাতীয় ঐক্যের পরিবর্তে ভাঙনের সৃষ্টি করেছে। ফলে জনগণের মধ্যে ক্রমাগত সরকারি ব্যবস্থার ওপর অনাস্থা তৈরি হয়েছে এবং একই সাথে বিরোধী দলগুলোর সমর্থকদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ ও বিক্ষোভ বাড়ছে।
এই অচলাবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন একটি গ্রহণযোগ্য এবং সুষ্ঠু নির্বাচনী ব্যবস্থার পথ তৈরি করা, যা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিশ্বাসের সেতু হিসেবে কাজ করবে। তবে এটি সহজে সম্ভব নয়, কারণ এই বৈরী অবস্থার মধ্যে একটি বিশ্বাসযোগ্য এবং কার্যকর নির্বাচনী কাঠামো গড়ে তোলা জটিল কাজ। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ, দ্বন্দ্ব ও দীর্ঘদিনের বিরোধে বিদ্যমান বিশ্বাসের অভাবের কারণে এটি কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে সরকারের নতুন উদ্যোগে একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা এবং সহযোগিতার মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সূচনা করা সম্ভব। দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য সংলাপ ও সহযোগিতার ভিত্তিতে সঠিক নীতির আলোকে আলোচনা শুরু করা জরুরি। রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগের মাধ্যমে জনগণের অধিকার, স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে সুফল বয়ে আনতে পারে, যা সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষকে একত্রিত করবে।
নাগরিক সমাজের সমর্থনে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জাতীয় সঙ্কট মোকাবেলায় একটি ক্রমাগত পরিবর্তনের প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে, যা গণতন্ত্র ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য অপরিহার্য। রাজনৈতিক দলগুলোকে মতার খেলায় না গিয়ে জনগণের সেবায় মনোনিবেশ করতে হবে। গণতন্ত্র, নাগরিক অধিকার, মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা এবং জনগণের স্বার্থে সংগঠন করা দেশকে উন্নতির দিকে নিতে সাহায্য করবে।
সাধারণ জনগণের কাছে রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে জনগণের দাবি ও অধিকার প্রতিষ্ঠার ল্েয কাজ করার ব্যাপারে একটি সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। সরকারের সাধারণ জনগণের জন্য সহযোগিতা, সুশাসন ও গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিতকরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এভাবে রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি ও চাহিদা বোঝার মাধ্যমে কার্যকরভাবে জাতীয় স্বার্থ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে পারে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা