১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১ পৌষ ১৪৩০, ১৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

বিজয় দিবস : প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি ও প্রত্যাশা

-


বাংলাদেশের বিজয় দিবস আমাদের জাতীয় জীবনে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বিজয় মানে অপ্রতিরোধ্য শত্রুকে পরাস্ত করে নীলাকাশে মুক্তির নিশান উড়ানো। বিজয় মানে জগদ্দল পাথরের মতো বুকের ওপর চেপে বসা জীবন বিনাশী ভয়কে ছুড়ে ফেলা। আমরা লাখ লাখ শহীদের রক্ত পিচ্ছিল পথ মাড়িয়ে বিজয় ছিনিয়ে এনেছি। কত কষ্টকর ছিল সে স্বাধীনতা যুদ্ধের কঠিন মুহূর্তগুলো-
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. এমাজউদ্দীন আহমদ পাক হানাদার বাহিনীর ২৫ মার্চ ১৯৭১ মধ্যরাতে অপারেশন সার্চলাইট নামে বাংলাদেশের মানুষের ওপর যে নিষ্ঠুর বর্বরতা চালিয়েছিল তার একটি প্রবন্ধে এভাবে তা তুলে ধরেছিলেন :
Peaceful night was turnd into a time of wailing, Crying and burning- the military action was display of stark cruelity, more merciless than the massacer of Bukhara and Bagdad by Changis khan & Halaku khan and Zalian Wala Bagh by Dyre of British.
‘নির্জন শান্ত গভীর রাতে ঘুমে নিমগ্ন নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে (পাক হানাদার বাহিনী); কান্না-ভয় আতঙ্ক ও আর্তনাদে ভরে উঠেছিল নিস্তব্ধ রজনী, যার বীভৎসতা বোখারা ও বাগদাদ ধ্বংসকারী চেঙ্গিস খান, হালাকু খান আর জালিয়ান ওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডে দায়ী ব্রিটিশ জেনারেল ডায়ারের হত্যাকাণ্ডের মতোই।’

গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে একতরফা যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়ার পরিণামে বাংলার সর্বসাধারণ পাক হানাদার শত্রু বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধে, মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
আমাদের এই স্বাধীনতা অর্জন ছিল এক দীর্ঘ সময় ও সমরের ফসল। এ ফসল ঘরে তুলতে আমাদের পূর্বপুরুষদের সংগ্রাম করতে হয়েছে হাজার বছর ধরে। এই হাজার বছরে আমরা শাসন, শোষণ ও নিপীড়নের শিকার হয়েছি যাদের হাতে, তারা সবাই ছিল ভিনদেশী বেনিয়া, আগ্রাসনকারী। আমরা কখনো নিজেদেরকে নিজেদের শাসক দ্বারা শাসিত হইনি। নিজেদের দুঃখ-দুর্দশার কথা তুলে ধরতে পারিনি। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন দেশ। একটি স্বাধীন পতাকা। একটি স্বাধীন ভূখণ্ড। বাংলাদেশ নামাঙ্কিত নতুন পরিচিতি, নতুন পাসপোর্ট। আর আমরা পেয়েছি বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর শক্তি। এখন আমরা নিজেরাই নিজেদের দেশকে পরিচালনা করি।

১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে যে, স্বাধীন বাংলাদেশের লক্ষ্য In order to ensure for the peoples of Bangladesh equality, human dignity and social justice- সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট স্বাধীনতার দুটো অর্থ করেছিলেন।
প্রথমত; ক্ষুধা থেকে মুক্তি বা স্বাধীনতা।
দ্বিতীয়ত; ভীতি থেকে মুক্তি।

ক্ষুধা থেকে মুক্তির অর্থ মৌলিক মানবিক প্রয়োজনের স্বীকৃতি। গোটা পৃথিবী আজ মানুষের সেই- অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিা ও চিকিৎসার স্বাধীনতা মোটামুটি নিশ্চিত করেছে। স্বাধীনতার প্রায় ৫৩ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর আমাদের জনগণ কি সেই মৌলিক স্বাধীনতা ভোগ করছে? আপাত দৃষ্টিতে দারিদ্র্য ও নিরন্ন মানুষের সংখ্যা কম দেখা গেলেও প্রকৃত প্রস্তাবে আজও মানুষ ুধার জন্য প্রাণপাত করছে। এরকম অসংখ্য খবর সংবাদপত্রে প্রতিদিন প্রকাশিত হচ্ছে। একটি দেশের জাতীয় নিরাপত্তার বড় দিক হলো সব নাগরিকের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এখানে খাদ্যের সুষম বণ্টন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। খাদ্য যদি স্বাধীনতার একটি পূর্বশর্ত হয় তাহলে এখন সহজে বলা যায়, বাংলাদেশের মানুষ কতটা খাদ্য নিরাপত্তা তথা খাদ্যের স্বাধীনতা ভোগ করছে। বিজয়ী বাংলাদেশ মানুষের জীবন ধারণের জন্য অপরিহার্য শর্তগুলো কি পূরণ করতে পেরেছে?

স্বাধীনতার দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে- ভীতিমুক্ত পরিবেশ। ভীতিমুক্ত পরিবেশ হতে হলে ভূখণ্ডটি স্বাধীন হতে হবে। বাংলাদেশ প্রায় ২০০ বছর ব্রিটিশদের দখলে ছিল। ১৯৪৭ সালে এই উপমহাদেশ ব্রিটিশদের দখলমুক্ত হয়। আরো ২৩ বছর পাকিস্তানের দখলে থাকে। এই উভয় দখলদারের আমলে বাংলাদেশ ভীতিমুক্ত ছিল না। রাজনৈতিক নিপীড়ন, নির্যাতন, জেল-জুলুম অব্যাহত ছিল। স্বাধীনতার অর্থ যদি হয়- ভীতিমুক্ত পরিবেশ, তা হলে আমরা কি সেই ভীতিমুক্ত পরিবেশে এখনো বসবাস করছি?
লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার সুফল থেকে বঞ্চিত হয় এ দেশের জনগণ। ৯ মাস যুদ্ধ করে লাখো প্রাণের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন করল সর্বসাধারণ- এককভাবে ফল ভোগ করল মুক্তিযোদ্ধা নামধারী, সুবিধাবাদী, কালোবাজারি, অর্থ পাচারকারী, আওয়ামী লীগ ও তার চেলা-চামুণ্ডারা। ’৭৪ সালে কৃত্রিম খাদ্য সঙ্কট সৃষ্টি করে দুর্ভিক্ষের মাধ্যমে হত্যা করে লাখ লাখ মানুষ। রাজনৈতিক হত্যা ছিল ততোধিক। সিরাজ শিকদারকে ক্রসফায়ারের মাধ্যমে হত্যা করে এদেশে গুম ও হত্যার রাজনীতির সূচনা করেন স্বয়ং মুজিব। কী আশ্চর্য! এই গণতান্ত্রিক নেতা পরমতকে একেবারেই সহ্য করতে পারতেন না, যেমন পরবর্তীতে তার কন্যা হিংসুটে হাসিনা...।

১৯৭১ সালের পর একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে অস্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছিল। কিন্তু যা অস্বাভাবিক ছিল তা ছিল ক্রমসঙ্কুুচিত স্বাধীনতা। এক পর্যায়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার শপথ নেয়া সরকার বাকশাল কায়েম করে গণতন্ত্র হত্যা করে। সংবাদপত্রের কণ্ঠ রোধ করে। বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা এই যে, পরে সামরিক সরকার গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেয়। শেখ মুজিবুর রহমান যে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বাতিল করেছিলেন সামরিক নেতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তা ফিরিয়ে দেন। ব্যক্তির অন্তর্নিহিত গণতান্ত্রিক মানসিকতা অথবা বাংলাদেশের মানুষের চির প্রবহমান গণতন্ত্রের প্রত্যাশা এর কারণ হতে পারে। সে যাই হোক সামরিক বাহিনীর আর একটি বিপথগামী অংশ জনপ্রিয় প্রেসিডেন্টকে হত্যা করে। মতা লোভী সামরিক ও কর্মকর্তা রাজনীতিকদের ষড়যন্ত্রে আরও একবার সামরিক শাসন জারি করা হয়। গণতন্ত্রের জন্য মানুষের প্রত্যাশা আরো একবার ব্যাহত হয়।

১৯৯০ সালের গণ-আন্দোলনে এরশাদ শাহীর পতনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত তিনটি নির্বাচনে গণতন্ত্রের প্রত্যাশা আবার পূর্ণতা পায়। কিন্তু তাও ছিল ক্ষণস্থায়ী। ষড়যন্ত্রের কলকাঠিতে জুডিশিয়াল কিলিংয়ের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন ব্যবস্থা বাতিল করে দিয়ে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ব্যতীত ভোটারবিহীন নির্বাচন, পূর্বরাতের নির্বাচন ও ডামি নির্বাচনের মাধ্যমে পরপর তিনটি নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ সরকার। প্রকাশ্য দিবালোকে এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে পুরো জাতির সাথে চরম প্রতারণা করে ফ্যাসিস্ট সরকার। আজকের যে তরুণ-প্রজন্ম তারা একবারও ভোট দিতে পারেনি।
বাকশাল শব্দটি ব্যবহার না করলেও- ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয় ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্রের ধোঁকাবাজি কায়দায়। বিচার বিভাগ, প্রতিরক্ষা বিভাগ, প্রশাসন বিভাগ, আর্থিক বিভাগ ও স্থানীয় সরকার সবকিছুকে দলীয়করণ করে জনগণের ওপর স্টিম রোলার চালাতে থাকে নির্দ্বিধায় এবং পুরো জাতিসহ বিশ্বের কাছে এটা প্রতিভাত হয় যে, বাংলাদেশে চলেছে পরিবার তন্ত্রের শাসন। স্বজন প্রীতির নিকৃষ্ট উদাহরণ : শেখ পরিবারের অপশাসন।

বিজয়ের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি আমাদের কতটা পূর্ণ হয়েছে আর কতটা পূর্ণ হয়নি। এক্ষেত্রে প্রথমে আমরা রুজভেল্ট কথিত স্বাধীনতার দুটো মানদণ্ড- ক্ষুধা ও ভীতি দ্বারা বিগত ৫৩ বছর পর্যালোচনা করেছি। আমদের গরিব সাধারণ জনগণ এখনো তাদের বেঁচে থাকার পাঁচটি মৌলিক সুবিধা পায়নি। সব সম্পদ পুঞ্জীভূত হয়েছে রাষ্ট্রীয় প্রশ্রয় ও পৃষ্ঠপোষকতায় কতিপয় রাজনীতিক, ব্যবসায়ী এই গরিব দেশে কায়েম করে Oligarch (অলিগার্ক) বা মুষ্টিমেয় ধনিক শ্রেণীর লুটেরা শাসন। অপর দিকে যদি ভীতিমুক্ত শর্ত দ্বারা আমাদের বিগত শাসন কালগুলোকে বিশ্লেষণ করি তাহলে অবশ্যই চরম হতাশ হতে হয়েছে পুরো জাতিকে। এই হতাশা ও ফ্যাসিবাদের জগদ্দল পাথর সরাতে এগিয়ে আসে একদল জানবাজ বুদ্ধিদীপ্ত কৌশলী ছাত্র- Generation-Z বা জেন-জি। তারা বৈষম্যবিরোধী কোটাপ্রথার সংস্কার সাধন ও স্বাধীকার আদায়ের সুকঠিন সংগ্রামে রাজপথে বজ্রশপথে নেমে পড়ে। নিষ্ঠুর স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা ও তার পেটুয়া বাহিনী- মন্ত্রিপরিষদ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, হেলমেট বাহিনী ও পুলিশ লীগ আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রী ও নিরস্ত্র মানুষের বুকে সরাসরি বন্দুকের গুলি ছোড়ে। হত্যা করে সহস্রাধিক ছাত্র-জনতা। এতে আহত হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার, পঙ্গু হয়েছে প্রায় ৬০০ জন। শহীদদের মধ্যে ৮০ জন মাদরাসার ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষক; তন্মধ্যে ২৩ জন হাফেজ।
অবশেষে রক্তস্রোত মাড়িয়ে স্বৈরাচারের পতনের একদফা দাবীতে লক্ষ লক্ষ ছাত্র-জনতা গণভবনের দিকে বাঁধ ভাঙা জোয়ারের মতো ছুটে চলে। দিগবেদিক শূন্য রক্তখেকো হাসিনা জনতার রুদ্ররোষ থেকে প্রাণ বাঁচাতে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। দীর্ঘ ১৬ বছরের নিষ্ঠুর শাসনের অবসান হয়। অবসান হয় গুম-খুনের। অবসান হয় চরম মিথ্যাচারের। অবসান হয় দেশের সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দেয়ার আত্মঘাতী ষড়যন্ত্র। অবসান হয় দেশকে খুবলে খাওয়া আওয়ামী লুটেরাদের Aristocracy বা অভিজাততন্ত্রের।

৩৬ জুলাই (৫ আগসট) ২০২৪ আমরা পুনরায় বিজয় লাভ করি। বিপ্লবী ছাত্র-জনতা এই গণ-অভ্যুত্থানের বিজয়কে দেখছেন বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা হিসেবে। বহু রক্তের বিনিময়ে প্রাপ্ত এই স্বাধীনতা। এটি আমাদের অনেক অনেক বড় অর্জন। কবির ভাষায় :
ফুল ফোটাতেও যুদ্ধ লাগে কুঁড়ির মুখে পানি
স্বাধীনতার শব্দ দিয়ে সাজাই বাগানখানি।
গোলাপ কেন রক্তবরণ গোলাপ কেন লাল
বাংলাদেশের নিশান জুড়ে হাসছে মহাকাল
যুদ্ধ ছাড়া কেউ কি পারে ফোটাতে লাল ফুল
ফুলের হাসি আড়াল করে বোনের কালো চুল।
বিজয় দিবস বিজয় দিবস আজ বিজয়ের মাস
শহীদ প্রাণের রক্তে ভিজে সবুজ হলো ঘাস।
[বিজয়ের মাস : আল মাহমুদ]

আজ ৫৩ তম বিজয় দিবসে এসে যদি নৈর্বেক্তিক দৃষ্টিতে তাকাই তাহলে অবশ্যই স্বীকার করতে হয় যে, রাষ্ট্রের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, অবকাঠামো, গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রবাসী আয়, নারী শিক্ষা ও নারীর কর্মসংস্থান আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলসহ বিবিধ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উন্নতি হয়েছে। পক্ষান্তরে সুদূর গ্রাম পর্যন্ত সমহারে সম্পদের বণ্টন হয়নি। পল্লী পর্যন্ত পৌঁছেনি, সব সরকারি পরিষেবা। উচ্চ শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি। সমাজে নারীরা সবচেয়ে বেশি লাঞ্ছিত, বঞ্চিত ও অপমানিত। নগ্নতা, বেহায়াপনা ও অপসংস্কৃতি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশকে ভেতর থেকে কুড়ে কুড়ে খেয়ে ফেলছে। বয়ঃজ্যেষ্ঠদের প্রতি সম্মান এবং ছোটদের প্রতি স্নেহ-ভালোবাসা এখন এ দেশে যেন ফেরারি। ভারতীয় আধিপাত্যবাদী আগ্রাসনে আমাদের স্বাধীনতা বিপর্যস্ত। আমাদের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করে সীমান্ত হত্যা বিনা বাধায় অব্যাহত রেখেছে বিএসএফ। সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলছে ফেলানীর লাশ; বুক ঝাঝরা হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে নিহত কিশোরী স্বর্ণা দাস।

একটু পেছনে ফিরে তাকালে আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই, স্বাধীনতা পূর্ব বাংলাদেশে এবং স্বাধীনতার পরবর্তী বাংলাদেশের প্রথম এক দশকে ইসলামের বিকাশ ঘটেনি। পাকিস্তান রাষ্ট্রটি ইসলামের নামে প্রতিষ্ঠিত হলেও এর প্রতিষ্ঠাতা মুসলিম লীগ শাসকরা ও সামরিক শাসকরা এবং ব্রিটিশ আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত আইসিএসরা; পরবর্তীতে পিসিএস’র নিয়োগপ্রাপ্ত আমলারা সবাই ছিল সেক্যুলার। রাষ্ট্রের সব নিয়মকানুন চলেছে ব্রিটিশ আইনে। পাকিস্তান নামে ইসলামী প্রজাতন্ত্র হলেও বাংলা ভাষায় ইসলামের বিকাশ ঘটেনি। তখন ইসলামি বই বলতেই আমরা বুঝতাম মোকছুদুল মোমেনীন, নামাজ শিক্ষার চটি বই, বেহেশতি জেওর প্রভৃতি কিতাব। আল্লাহ্র অসীম রহমতে ১/২ দশক পর শত বাধার মুখেও বাংলাদেশের ভেতর থেকে একদল জিন্দাদিল কলম সৈনিক জেগে ওঠে। তারা লেখনীর সাহায্যে শত শত ইসলামী সাহিত্য রচনায় আত্মনিয়োগ করেন। শত শত প্রকাশনা সংস্থা গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, আধুনিক প্রকাশনী, শতাব্দী, প্রফেসর, প্রীতি প্রকাশন, এডর্ন, ঝিঙেফুল, বার্ড পাবলিকেশন, মদিনা পাবলিকেশান্স, বায়তুশ শরফ প্রকাশন প্রভৃতি থেকে বের হয়েছে অনেক পত্র-পত্রিকা ও বইপত্র। ২০০৯ সালের পূর্ববর্তী সময়ের ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রকাশনাগুলো বাংলাদেশকে নতুন পথ প্রদর্শন করে। বিশেষতঃ সাধারণ শিক্ষিতদের ইসলামী জ্ঞানে সমৃদ্ধ করেছে এই সমস্ত বই। এক দল বিদ্যোৎসাহী দেশের আইন মেনে সুদূর গ্রাম পর্যন্ত গড়ে তোলে হাজার হাজার মাদরাসা। ইসলামিক এডুকেশন সোসাইটির তত্ত্বাবধানে প্রতিষ্ঠিত হয় শত সহ¯্র ইসলামী কিন্ডারগার্টেন, স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং প্রি-ক্যাডেট মাদরাসা। ইসলামী সমাজ কল্যাণ পরিষদ ও বিভিন্ন ট্রাস্টের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা লাভ করে মানসম্পন্ন অনেক বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশ ইসলামিক ইকোনমিক রিচার্স ব্যুরোর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয় দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম ইসলামী ব্যাংক। তাদের সফলতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বেশ কয়েকটি ইসলামী ব্যাংক। সরকারি-বেসরকারি অনেক কনভেনশনাল ব্যাংক গ্রাহক টানার উদ্দেশ্যে বাধ্য হয়েছে ইসলামী ব্যাংকিং উইন্ডো খুলতে। মরহুম আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী সাহেবের মতো অসংখ্য আলেম-ওলামা মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে ইসলামের প্রচার ও প্রসারের মাধ্যমে ভেতর থেকে বাংলাদেশকে বদলে দিয়েছেন। যে কাজটি করার কথা ছিল এই মুসলিম দেশের সরকারের। কিন্তু তাদের চরম ব্যর্থতা এবং হাজার বাধা সত্ত্বেও ইসলামী আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের জুলুম-ফাঁসি উপেক্ষা করে রক্তঝরা আত্মত্যাগের ফলে তা সম্ভব হয়েছে। এটি তখনই পূর্ণতা পাবে যখন বাংলাদেশে একটি ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে এবং কায়েম হবে আল কুরআনের রাজ।

বহু আত্মত্যাগের ফলে শহীদদের রক্তে রঞ্জিত রাজপথ মাড়িয়ে যে অন্তর্র্বতী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তার মাধ্যমে প্রয়োজন রাষ্ট্র সংস্কার কর্মসূচি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা। সংবিধান সংশোধন, বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগ থেকে পৃথকীকরণ, সৎ, যোগ্য ও আমানতদার বিচারক ও প্রশাসক নিয়োগ করা। বিদ্যমান নির্বাচন ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে ঢেলে সাজানো এবং নির্বাচন কমিশনকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা। পুলিশ ও প্রতিরক্ষা বাহিনীকে দলীয়করণের বিপক্ষে শক্তিশালী আইন প্রণয়ন এবং শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রথম শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত ইসলামী শিক্ষা তথা কুরআন অধ্যয়ন, মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা:), খোলাফায়ে রাশেদীন এবং জগদ্বিখ্যাত মুসলিম শাসক, শহীদ, গাজী ও পীর-আউলিয়াদের জীবনী পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা। অবশ্য অবশ্যই মাদ্রাসা শিক্ষার পরিবর্তন আনতে হবে। কয়েকটি কিতাব ছাড়া বর্তমানে সবশ্রেণীতে স্কুল ও কলেজের এনসিটিবির সেকুলার বই অন্তর্ভুক্ত। ফলে মাদরাসা থেকে প্রকৃত আলেম সৃষ্টি হচ্ছে না। যারা হচ্ছেন তারা ব্যক্তি প্রচেষ্টা ও পরিবারের অব্যাহত সাপোর্টের ফলেই হচ্ছেন। সুতরাং সময়ের দাবি হলো মাদ্রাসার জন্য পৃথক শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়ন ও প্রতিষ্ঠা।
অতএব, আমরা যদি কাক্সিক্ষত বিজয় ও স্বাধীনতা ধরে রাখতে চাই তবে অতীতের ভুল শিক্ষাকে পদানত করে দেশের সকল পর্যায়ের অব্যবস্থা ও বৈষম্যকে সংস্কারের মাধ্যমে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে হবে। ভারতীয় আগ্রাসন ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে শুধু সোচ্চার নয়, সব কূটনীতিক কৌশল অবলম্বন করতে হবে। আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্নে মুসলিম উম্মাহ্র সাথে দৃঢ়-সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বন্ধন সুদৃঢ় করতে হবে। তবেই আমাদের বিজয়, আমাদের স্বাধীনতা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ রাষ্ট্র গঠিত হবে।


আরো সংবাদ



premium cement