১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১ পৌষ ১৪৩০, ১৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

বিজয় ’২৪

-


বিজয় দিনের গল্প শোনার ইচ্ছে যদি হয়
পাখির পাখায় ছড়িয়ে রাখো তোমার পরিচয়।
মেঘকে বলো দেখতে এসে বাংলাদেশের বন
পাতার সাথে ফুলের কেমন হচ্ছে আলাপন!
আমার বিজয় তোমার বিজয় সবার বিজয় হোক
তোমার ঘ্রাণে মুগ্ধ হবে সারা বিশ্বলোক
জাগতে হবে নতুন করে গড়তে হবে দেশ
জাগলে তুমি জাগবে দেখো তোমার বাংলাদেশ।
- কবি জাকির আবু জাফর

কবির কণ্ঠে মিলিয়ে বলি- বিজয়ের গল্প শোনার আকাক্সা আমাদের সবার। প্রকৃতির নিসর্গতা আমাদের মনে করিয়ে দেয় বেঁচে থাকা কতটা আনন্দের। আমরা চাই সুস্থ মন ও শরীর নিয়ে স্বাধীনভাবে বাঁচতে। চাই একটি স্বনির্ভর জাতি হয়ে ওঠতে। চাই স্বাধীন দেশের মানুষ হয়ে স্বাধীনভাবে অধিকার আদায়ে সরব হতে। স্বাধীনতাবিহীন কেউ কি পেরেছে সুখী হতে? শত বছরের ইতিহাস ঐতিহ্যে বাংলাদেশের গণমানুষ একটি অধ্যায় রচনা করেছে। বীরত্বপূর্ণ ও গৌরবময় সেই অধ্যায় রচনা করতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে শত মানুষের রক্ত ঝড়িয়ে মানুষ পেয়েছে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার সুযোগ। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তাক্ত মুুক্তিযুদ্ধের পর বিজয়টি এসেছে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর।

মানুষ কিছু শব্দ আপন করে নিতে চায়। শব্দের মাধুর্যতা স্পর্শ করে হৃদয়কে। শব্দটি যখন জড়িয়ে ধরে সম্মান তখন সেটিই মর্যাদার। আত্মতৃপ্তির। ঐতিহাসিক এই বিজয় বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যে এক অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়। একটি শসস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে বিজয়। এটি কোনো সাধারণ বিজয় নয়। এই বিজয়ের ঘোষণা দেন মেজর জিয়াউর রহমান। সময়টি ছিল ২৬ মার্চ ১৯৭১। চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একটি নতুন পৃথিবী দেখার সুযোগ পায়। সেই থেকে ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। অতীতে অঞ্চলভিত্তিক খণ্ডযুদ্ধজয়ের নানা ঘটনা থাকলেও ভাষাভিত্তিক বাঙালির পরিচয়ে এবং বাঙালি জাতীয়তার ভিত্তিতে এমন শৌর্য-বীর্যময় বিজয় লাভ বাঙালির জাতীয় জীবনে আগে কখনো ঘটেনি। সেই থেকে প্রতি বছর ডিসেম্বর এলেই বিজয় দিবস আসে আমাদের কাছে। ১৬ ডিসেম্বরকে আমরা বিজয় দিবস বলি। ছোট থেকে বড় সর্বস্তরের মানুষ মেতে উঠি বিজয়ের আনন্দে।

একটি জীবনকে ঘিরে মানুষের স্বপ্ন থাকে হাজারো। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে দিন-রাত্রির পরিবর্তন। সময়ের স্রোতে গড়িয়ে যায় জীবন গাড়ি। শত না পাওয়ার মধ্যেও মানুষ আনন্দ খোঁজে। চায় স্বাধীনভাবে বাঁচতে। তেমনি বিজয় শব্দটি মানুষের জীবনের পথকে উজ্জ্বীবিত করে। আত্মবিশ্বাসী হয়ে চলার পথকে সহজ করে তোলে। নিজস্বতায় মানুষ বিজয় শব্দের মধ্যে সাফল্যের ঘ্রাণ পায়। বিজয় আমাদের চিনিয়েছে কেমন করে পাখির মতো উড়তে হয়। স্বাধীন হয়ে স্বাধীনভাবে চলতে হয়। কেমন করে মুক্তমনের মানুষ হয়ে আকাশ ছুঁতে হয়। এই আনন্দ অন্যরকম আনন্দ। স্বাধীনতার সময়টি অনেক দীর্ঘ। ৫৪টি বছর পার হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন রয়েই গেছে- স্বাধীনতার এত বছর পরও কি আমরা সত্যিকারের স্বাধীন হতে পেরেছি? সাফল্যময় জীবনের তরে কতটুকু এগিয়েছি? যে আশা-আকাক্সা বুকে নিয়ে শত হাজার মানুষের বুকের তাজা রক্ত ঝরেছে সেই রক্তের ঋণ কতটুকু পেরেছি শোধ করতে? বা একটি সুষ্ঠু সুন্দর দেশ গঠন করতে। চারিদিকে অবাঞ্ছিতের হাহাকারের চিত্র! শাসক শ্রেণীর ওপর আস্থাহীনতা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। উত্তর দেয়ার মতো কেউ নেই যেন। এমন দেশ দেখব বলেই কি বুকের তাজা রক্তে পথ ভিজিয়েছিলাম? যেকোনো কাজ তখনই সাফল্য অর্জন করতে পারে যখন কাজটি সবার হয়। নির্দিষ্ট একজন বা কয়েকজনের নয়। দেশ গড়ার কাজ আমার বা আপনার একক কোনো কাজ নয়। কাজটি সবার। এ উপলব্ধি আমাদের মধ্যে সেভাবে নেই বলেই স্বাধীনতার এত বছর পরও আমরা তার সুফল পুরোপুরি পাইনি। জাতীয় জীবনের প্রতিটি ধাপেই দেখা যায় সঙ্ঘাত। এক ধরনের অস্থিরতা ঘিরে আছে আমাদের। শান্তির ছোঁয়া নেই এতটুকু। দিনকে দিন পরিস্থিতি যেন আরো বৈরী রূপ ধারণ করছে। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতা যেন ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছে।
কবি যেমনটি বলেছেন- জাগতে হবে নতুন করে গড়তে হবে দেশ/জাগলে তুমি জাগবে দেখো তোমার বাংলাদেশ।

বিজয় ২৪। ৩৬ জুলাই। সময়টা দ্রোহের। একঝাঁক বিদ্রোহী তরুণের শাণিত পদপে। মুক্তপ্রাণ তরুণ। টগবগে রক্তের উন্মাদনা। অধিকার চাই। বেকারত্বের কষাঘাতে জর্জরিত তরুণসমাজ জেগে উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধের যে ত্যাগ তা আজ ভূলুণ্ঠিত। স্বাধীন দেশে নেই মত প্রকাশের স্বাধীনতা। নামমাত্র স্বাধীন দেশে পরাধীনতার শেকলে আবদ্ধ জাতি আজ আওয়াজ তুলেছে। সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে নিয়োগেরেে ত্র মেধার তুলনায় ৫৬ শতাংশ কোটার পরিমাণ তরুণসমাজের মধ্যে এক চরম অসন্তোষের জন্ম দিয়েছে। কোটার জন্য মেধাবীরা যোগ্যতার সার রাখতে পিছিয়ে। স্বাধীন দেশে কেন এই বৈষম্য? কেন যৌক্তিক অধিকার চাইতে গেলে শুনতে হবে রাজাকার? এ প্রশ্ন আজ পুরো জাতির। এ জন্যই কি এ দেশ স্বাধীন হয়েছিল? এই অসন্তোষের প্রোপট থেকেই আন্দোলনের সূত্রপাত।
শেখ হাসিনা সরকার ভেবেই নিয়েছিল আন্দোলন করে কবে কে কী করতে পেরেছে। যেখানে পুরো দেশ তার নিয়ন্ত্রণে। চরম আত্মবিশ্বাসী মন তাকে নরম করেনি কিছুমাত্র। রাজনীতিতে কৌশল হিসেবে বিরোধী দলকে দমন করতে যে গালি এত বছর ব্যবহার করে আসছে শেখ হাসিনা সরকার আজ সেই বাক্য ব্যবহৃত হলো কোমলমতি ছাত্রদের উদ্দেশে। সংবাদ সম্মেলন করে শেখ হাসিনা বলেছেন, সরকারি চাকরি মুক্তিযুদ্ধের সন্তানরা পাবে না তো পাবে রাজাকারের নাতিপুতিরা? তরুণসমাজকেেি পয়ে তুলতে এমন একটি বাক্যই যথেষ্ট। মুহূর্তেই ফুঁসে উঠে ছাত্রসমাজ। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে পুরো দেশের তরুণদের মধ্যে। সন্তানরা যখন মাঠে তখন বাবা-মায়েরা কেমন করে ঘরে বসে থাকে। ফলে আন্দোলন হয়ে ওঠে শিশু থেকে বৃদ্ধ- সবার। জালিম ফ্যাসিবাদী হাসিনা তরুণদের যৌক্তিক চাওয়াকে তুচ্ছজ্ঞান করে জাতির সাথে করেছে উপহাস। মতার দম্ভে স্বৈরশাসক হাসিনা শত হাজার তরুণ শিশু বৃদ্ধকে রক্তের বন্যায় ভাসিয়েও ছিল নির্বিকার। সে শুধু তার মতা টিকিয়ে রাখার কৌশলে ছিল ব্যস্ত। তার গঠিত সর্বোচ্চ আইনের অপব্যবহার করে তিনি মানুষকে করেছে পদদলিত। মতার লিপ্সায় অন্ধ হাসিনা ভুলে গেছে মতার দৌড় যত দীর্ঘই হোক না কেন, তার একদিন বিনাশ হবেই।

মাত্র একটি কোটা আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসকে পাল্টে দিয়েছে। অধিকারের লড়াইয়ে যুক্ত হয় অগণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের ােভ। সমাজের প্রতিটিেে ত্র যে দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে, আইনের প্রতি মানুষ আস্থা হারিয়েছে, মতার অপব্যবহার সেসব চিত্রই ফুটে উঠেছে কঠিন বাস্তবতায়। মাতাসীনদের মতার চেয়ে গণমতা যে অধিক শক্তিশালী এটিই তরুণরা বারুদের মতো জ্বলে ওঠে বুঝিয়ে দিয়েছে। কোটা থেকে এক দফায় জ্বলে ওঠে বাংলাদেশের তরুণসমাজের পাশপাশি সুশীল সমাজও। দেশকে দ্বিতীয়বার স্বাধীন করার দৃঢ় প্রত্যয়ে মাঠে নামে হাজার হাজার মানুষ। একটাই ভাবনা- বাঁচলে গাজী মরলে শহীদ। বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণদের সাথে একাত্ম হয়ে মাঠে নেমে আসে হাজারো স্কুল কলেজ মাদরাসার ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে সাধারণ খেটেখাওয়া মানুষ। নারী অভিভাবকরাও তাদের শিশুসন্তানকে সাথে নিয়ে যুক্ত হয়েছিলেন অধিকার আদায়ের সংগ্রামে। হাজার হাজার ছাত্র-জনতা মুখরিত রাজপথে- স্লোগানে স্লোগানে অধিকারের লড়াইয়ে বুক পেতে দেয় বন্দুকের সামনে। কী সাহসী উচ্চারণ ‘পেছনে পুলিশ সামনে স্বাধীনতা’। এ জাতিকে থামায় সাধ্য কার! এ দৃশ্য বাংলাদেশ আগে কখনো প্রত্য করেনি। দেশকে বাঁচাতে হাজারো মানুষের রক্তে বদলে যায় বাংলাদেশ। ফ্যাসিবাদী শাসক শেখ হাসিনা কোনো উপায় না পেয়ে নিজেকে বাঁচাতে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
বাংলাদেশের মানুষ জুলাই ২৪ আন্দোলনকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নাম দিয়েছে দ্বিতীয় স্বাধীনতা। প্রাপ্তির এই ঢেঁকুর তুলতে তরুণদের তাজা রক্তে রাজপথ ভেসে গেছে। তবুও থামাতে পারেনি তাদের। তারা আজো একইভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে জীবন দিতে প্রস্তুত। প্রতিটি যৌক্তিক দাবির পরিপ্েেরিত স্বীকৃতি আদায়ে তারা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

বর্তমান সময়টিও কোনোভাবেই সহজ নয়। চারিদেকে ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল। সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে যে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে এ দেশের তরুণসমাজ, তাকে কোনোভাবেই বিফল হতে দেয়া যাবে না। সবাইকে নিঃশর্তভাবে দেশ বাঁচাতে এগিয়ে আসতে হবে। ১৯৭১ সালের ৯ মাস যুদ্ধের যে ইতিহাস এ সময়ের তরুণদের কাছে তা ছিল অনুপ্রেরণা। সেই প্রেরণাকে ধারণ করেই তারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে বুক পেতে গুলি ধারণ করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। শহীদ আবু সাঈদের প্রসারিত দুই হাত, অসীম সাহসী সেই বুকের পাটা! অন্যায়ের বিরুদ্ধে চিৎকার করে বলছে, ‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর।’ নির্মম নিষ্ঠুরতম সেই দৃশ্যের সাক্ষী গোটা বিশ্ব। অবাক নয়নে চেয়ে দেখেছে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে মানুষ হয়ে মানুষ হত্যার ঔদ্ধত্য অহমিকা। আরেক শিশু বাবার সাথে নিজের বাসার ছাদে খেলায় ব্যস্ত। সে কেমন করে জানবে মতার লিপ্সায় আকাশ হতে গুলি এসে তাকে শেষ করে দেবে। মুগ্ধর সেই কণ্ঠ ‘পানি লাগবে? পানি’। এমন হাজারো ঘটনার সাী আজকের এই বাংলাদেশ। মনে রাখতে হবে, এ দেশ তোমার আমার আমাদের। ভালোবাসার মূল্যটি আমরা সবাই জানি। তাই আমাদের দেশকে ভালোবাসতে হবে হৃদয় থেকে। মনের গভীর থেকে অনুভব করতে হবে। বিজয়ের একটিই অর্থ তাকে সার্থক করে তোলা। উপযোগী করে দেশকে উন্নতির শিখরে উপনীত করা। তবেই বিজয় ভাষা পাবে বিজয়ের। অর্থপূর্ণ হবে বিজয় শব্দটি। কবির কণ্ঠে মিলিয়ে বলি- ‘আমার বিজয় তোমার বিজয় সবার বিজয় হোক
তোমার ঘ্রাণে মুগ্ধ হবে সারা বিশ্বলোক।

 

 

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement