১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

এক বিভীষিকাময় রাত

-


এক গভীর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ৩৩ নম্বর কক্ষে আমার ওপরে চালানো হয়েছিল ইলেক্ট্রিক শক, তরকারি কাটা বঁটির উল্টো পিঠের জখম করা বাড়ি, ছুরির আঘাত, বুকে বেদম ঘুষি ও লাথি, টানা ৭ ঘণ্টার অমানুষিক নির্যাতন। আমার নখগুলো টেনে তোলার চেষ্টা, চুল ছিঁড়ে ফেলা, চোখে মুখে এবং সমস্ত শরীরে স্ট্যাম্পের বাড়ি আমার কলিজা পর্যন্ত গিয়ে আঘাত হানছিল। ফ্লোরে ফেলে আমার সমস্ত শরীরের ওপরে উঠে করেছিল নৃত্য। আর নৃত্যের বাহার বাড়ানোর জন্য কম্পিউটারে ছাড়া হলো ইন্ডিয়ান জংলি গান। বারবার একটু পানি চেয়েছিলাম, দেয়নি। ভেবেছিলাম এই রাতই আমার জীবনের শেষ রাত। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল কলিজার টুকরা মাকে একটিবার মা বলে ডেকে জড়িয়ে ধরে মরতে পারতাম। আমার বাবাকে বলতে পারতাম বাবা, কোথায় দিয়েছ তোমার ছেলেকে পড়াশোনা করতে? আমার লাশ কি তুমি বইতে পারবা? আমার সমস্ত শরীর রক্তাক্ত! আমি সেন্সলেস। ভেতরের অনেক কিছুই আমি জানি না। আমার অপরাধ! আমার মুখে দাড়ি কেন? কেন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি। তাদের ভাষায় শিবির করিস নিশ্চয়ই! এই সন্দেহ। কি পশুত্ব! মধ্যযুগীয় কায়দায় চালানো হলো আমার ওপরে নির্দয় নির্যাতন। সর্বশেষে মৃতপ্রায় ভেবে ৩৩ নম্বর রুম থেকে নিয়ে পশ্চিম ব্লকের নীচতলার একটি রুমে আমাকে রাখা হলো। আসলে এই নির্মমতা লিখে বা বলে কখনো বোঝানো সম্ভব না। হয়তো অনুভবে আনতে পারবেন পাঠক। আপাতত এখানেই থামছি।

বেশ মনে আছে। ডিসেম্বর মাসের তীব্র শীতে চাদর জড়িয়ে যেতাম। যেতাম চার কিলোমিটার পথ বেয়ে। আমার প্রাইভেট শিক্ষক ছিলেন তাজপুর গ্রামের আব্দুল জলিল। তখন ভাইয়া, মনিরামপুর ডিগ্রি কলেজে বিএসসি পড়েন। গণিতে তিনি ছিলেন দুর্দান্ত পারদর্শী। গল্পটা বড় করছি কারণ এবার শুরু হলো এক নতুন বৈষম্য। মাদরাসার ছাত্র আবার আসছে প্রাইভেট পড়তে। স্কুলের বন্ধুদের সাথেই ম্যাথ শিখতাম।
এদিকে মাদরাসা সিলেবাসে ইংরেজি গ্রামার পড়ানো হতো না। স্কুলে ছিল ইংরেজি প্রথম আর দ্বিতীয় পত্র। মাদরাসায় শুধুই প্রথম পত্র। মানে মাদরাসার শিক্ষার্থীরা যেন কোনোভাবেই সামনে না আসতে পারে সে আয়োজন রাষ্ট্র থেকেই করা হয়। নাটক, সিনেমাগুলোতে পরিকল্পিতভাবে দেখানো হয় দাড়ি, টুপি এবং পাঞ্জাবি, এরা জঙ্গি। এরা যুদ্ধাপরাধী, মানবতাবিরোধী। বিষয়টি এ দেশের মানুষের মনস্তাত্ত্বিক জগতে ঢুকিয়ে দেয়ার সব আয়োজন নিশ্চিত। নবম শ্রেণীতে থাকতে পড়লাম এ দেশের ইতিহাস বিনির্মাণে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ভূমিকা। আমিতো রীতিমত সেই নবম শ্রেণী থেকেই ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তির মানসিক প্রস্তুতি শুরু করে দিলাম। সিলেবাসের বাইরে গিয়ে শুরু হলো অধ্যবসায়।

উচ্চ মাধ্যমিকের রেজাল্ট বের হওয়ার পূর্বেই শুরু হলো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রস্তুতি। ভর্তি হলাম ঢাকার মৌচাকে ফোকাস বিশ^বিদ্যালয় ভর্তি কোচিংয়ে। মৌচাক শাখায় আবার নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বেশি।
অবশেষে ঢাবিতে চান্স হলে কোচিংয়ের এক শিক্ষক ভাইয়ার পরামর্শে বিষয় পছন্দ করলাম গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা। যেখানে নিজের পরিচয় দেয়ার সময় কোনোদিন বলতে পারিনি আমি এসএসসি না দাখিল পড়েছি। ঢাবিতে ভর্তি হই ২০০৯-১০ সেশনে।
পরের দিন বিভাগে ওরিয়েন্টেশন। আমি যথারীতি উপস্থিত হলাম ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামে। বিভাগের রীতি অনুযায়ী ওরিয়েন্টেশন প্রোগাম আয়োজন করে বিভাগের ইমিডিয়েট সিনিয়র ব্যাচ। ওরিয়েন্টেশনের নামে চলল বহিঃসংস্কৃতির মহা এক আয়োজন। গান, নৃত্য, র‌্যাগিং, আড্ডা, সিনিয়রদের কুরুচিপূর্ণ ভাষা ব্যবহার। এ কোথায় আসলাম? পরিচয় দিতে গিয়ে যখনই বললাম মাদরাসা, সবাই বলে উঠলো, কি হুজুর শিবিরের সাথী না সঙ্গী? না জঙ্গি দলে আছো? আমি বাকরুদ্ধ। অসহায়ত্বের এই আয়োজন শেষ করেই মালিবাগ ফিরে যাবো। কলা ভবনের পেছনের গেট দিয়ে বের হতেই খেলাম ধাওয়া। বিশাল মিছিল। ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া। ইটের আঘাতে প্রথম দিনেই জখম। বিভাগের সিনিয়রদের সামনে পড়লাম। এই শালা শিবির করে নিশ্চয়ই। মারামারির মধ্যে গেলি কেন? আমার শরীরে রক্তপাত হচ্ছে সেদিকে নজর না দিয়ে আমাকে উল্টো মানসিক নির্যাতন। ক্যাম্পাসে পুলিশ। আঘাতপ্রাপ্ত সবাইকেই অ্যারেস্ট করছে। আমি ভয়ে ঠাণ্ডা হয়ে গেলাম। আমি সব কষ্ট লুকাবার চেষ্টা করেও শরীর কাঁপছে ব্যাপক। বিকেল হলো পরিবেশ ঠাণ্ডা হতে।
মেসে ফিরে বাবাকে বললাম- বাবা, আমার মনে হয় এখানে পড়াশোনা হবে না। আমি বিদেশে পড়াশোনা করার খোঁজখবর নিচ্ছি। খুব কষ্টে আজকের কথাগুলো লুকালাম।

হলে ওঠার জন্য আমার এলাকার এক সিনিয়র আব্দুর রাজ্জাক (শহীদ সার্জেন্ট জহরুল হক হলে তিনি থাকতেন) তার পরামর্শ নিলাম। তিনি শিখিয়ে দিলেন কিভাবে হলে উঠতে হবে। ভাইয়ার শেখানো নিয়মে রাত ১০টায় গেলাম আমার হলের গেস্টরুমে। সাধারণত রাত ১০টা থেকে শুরু হয় গেস্টরুম। গেস্টরুম সম্পর্কে কিছু না লিখলে পাঠক আবার অন্ধকারে রয়ে যাবেন। বিশ^বিদ্যালয়ের প্রত্যেকটি হলেই থাকে একটি বিশেষ রুম, যেখানে সাধারণত শিক্ষার্র্থীদের অভিভাবক বা কোনো পরিচিত লোকের সাথে বসে কথা বলা যায়। আমরা যারা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তারা গেস্টরুমের সংজ্ঞাটা ভিন্নভাবে জানি। সাধারণত যে দল দেশের ক্ষমতায় থাকে সে দলের ছাত্র সংগঠনের মাধ্যমে জুনিয়র শিক্ষার্থীদের ম্যানার শেখানোর নামে গেস্টরুমে চলে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। আমার সময় ছাত্রলীগের আমি যেটি করতে দেখেছি, প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা রাত ৯টায় গিয়ে হাজির হলাম হলে ওঠার জন্য ছাত্রলীগের নিকট নিজেকে সম্পূর্ণ ছাত্রলীগের আদর্শে ক্যাম্পাসে থাকব এই বাসনা প্রকাশ করতে। দেখলাম প্রথম এবং দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের সবাই গেস্টরুমের সামনে দাঁড়ানো। লম্বা লাইন আনুমানিক ১৫০-২০০ শিক্ষার্থী সবাই একেক করে গেস্টরুমে ঢুকছে আর নিজের পরিচয় দিয়ে হলের মাঠে এসে দাঁড়াচ্ছে। আমিও দাঁড়ালাম সে লাইনে। যখন আমার পালা চলে এলো আমার বুক দুরু করে কেঁপে উঠলো ছাত্রলীগের নেতাদের ভয়ঙ্কর চেহারা দেখে। হাতে সিগারেটের আগুন জ্বলছে। চোখগুলো শকুনের মতো। পায়ের ওপরে পা ওঠানো। আর মুখে আছে বিশ্রী ভাষার গালি। তাদের এই ভয়ঙ্কর আয়োজনের সামনে দিয়ে সবাইকে নতশিরে নিজের নাম ও পরিচয় নামক এই অগ্নিপরীক্ষায় নিজেকে ছাত্রলীগের সৈনিক বানাতে হবে।

এতো কিছুর পরেও নিজেকে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলাম। হলের কোনো রুমে জায়গা হলো না। উঠলাম বারান্দায়। আর আমাদের হলে ছাত্রলীগের তৈরি নিয়ম প্রথম বষের্র কোনো শিক্ষার্থী মানেই বারান্দা দিয়েই হল লাইফ শুরু। এরপর অগ্নিপরীক্ষায় যারা জিতবে এবং নেতাদের নিকট নিজেকে পূর্ণাঙ্গভাবে সঁপে দিবে সে-ই কেবল দ্বিতীয় বর্ষে গিয়ে সিট পাবে। যেন সিটটা ছাত্রলীগের বাবার সম্পত্তি। আমাদের কোনো অধিকারই নেই হলে থাকার। বহু দয়া করে তারা আমাদের এই সিটটা বরাদ্দ দিচ্ছে। বারান্দায় শুরু করলাম রাত্রি যাপন। জানুয়ারি মাস। তীব্র শীত। কম্বল গায়ে দিয়েও যেন শীত মানে না। ব্যাস শুরু হয়ে গেল তীব্র ঠাণ্ডা আর জ্বর। এই জ্বর নিয়েও যেতে হবে মধুতে মিছিলে। ভয়ে বলতেও পারছি না ভাই আমি জ্বরে আক্রান্ত। কারণ, আমার ওপরে আবার বিশেষ নজর। এক সপ্তাহ চলে যায় আমার জ্বর কমলেও ঠাণ্ডা যায় না। শুরু হয়ে গেল কাশির সাথে রক্ত বের হওয়া। অতিরিক্ত কাশির ফলে ফুসফুসে ইনফেকশন হয়ে গেল।

৬ ফেব্রুয়ারি ২০১১! শুরুতেই বলেছি কী হয়েছিল সেদিন রাতে আমার সাথে। সারাদিন ক্যাম্পাসের ক্লাস করেছি। বাইরে কিছু কাজ ছিল শেষ করেই সন্ধ্যায় হলে ফিরেছি। আমি রুমে প্রবেশে করতেই ইসরাফিল (আমার রুমমেট, এখন সে পুলিশ কর্মকর্তা) আমাকে বলল এই বারী, তোমাকে নাহিদ ভাই আর দিদার ভাই ৩৩ নম্বর রুমে দেখা করতে বলেছে। এ কথা শোনার সাথে সাথেই আমার বুক কাঁপা শুরু হয়ে গেল। দিদার আর নাহিদ দু’জনই ছাত্রলীগের হল শাখার নেতা। দিদার আমাদের হলের অন্তত ৫০ জন শিক্ষার্থীকে নিজ হাতে পঙ্গু করেছে। আমার জুুনিয়র জাকিরকে স্ট্যাম্প দিয়ে পিটিয়ে পা ভেঙে দিয়েছে। ভাঙা স্ট্যাম্পের বাড়িতে পায়ের হাঁটুর নীচ দিয়ে ঢুকে অপর পাশে বের হয়ে গেছে। দিদারের বাড়ি কুমিল্লার দেবিদ্বারে। দেখতে সন্ত্রাসীদের চেয়েও ভয়ঙ্কর। আমার ব্যাচমেট এমন কোনো শিক্ষার্থী নেই যে তার হাতের মার কিংবা গালি খায়নি। আর সেটা একবার দুবারের জন্য না বহুবার। শুধু দিদারের নির্যাতনের ইতিহাস টানলেই গল্পের বহু ভিন্ন ভিন্ন প্লট তৈরি হবে। নাহিদের বাড়ি গোপালগঞ্জে। সেও ছাত্রলীগের সশস্ত্র ক্যাডারদের একজন। আর এদের ক্ষমতার কেদ্্রবিন্দু হলো ছাত্রলীগের সেক্রেটারি আনোয়ার হোসেন। তার বাড়ি গোপালগঞ্জ। দিনে রাতে শিক্ষার্থীদের গায়ে হাত তুলতে তার বুক কাঁপে না। সর্বদা এডিকটেড থাকতো। হল ছাত্রলীগের প্রত্যেককে নিয়ে একেকটি নির্যাতনের ইতিহাস তৈরি সম্ভব।

কি করবো এখন? কিছুই মাথায় আসছে না, হলে ছাদে উঠে পালাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না। তাহলে আবার বাইরে গিয়ে থাকবা কোথায়? আমারতো কোনো অপরাধ নেই। রাত তখন ৯টা বাজে। আত্মবিশ^াস নিয়ে ৩৩ নম্বর রুমে গেলাম। দরজার কড়া নাড়তেই দিদার গালি দিয়ে বলল এই শালা আয় ভেতরে আয়। ঘাড় ধরে ঢোকানো হলো আমাকে। প্রবেশ করতেই দেখি আইন বিভাগের সিনিয়র হাফেজ তারেক ভাই। আর ইসলামি স্টাডিজের শাহিদ ভাই। তাদের দু’জনকে নির্যাতন চালানো হচ্ছে। আর জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। আমাকে দিদার বলল, এই ... (অকথ্য গালি) বয়। চেয়ারে বসতে বললো। আমি ভয়ে ভয়ে বসছি না। আবার গালি। এবার বসলাম। এরপর শুরু হল জিজ্ঞাসাবাদ। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই শুরু দিদার আমার মুখের ওপরে সজোরে থাপ্পড়। বয় এই ...(গালি)...এদেরকে কি করেছি খেয়াল করেছিস? তোকেও করব। তুই যদি বাঁচতে চাস বল এই হলে আর কে কে শিবির করে। আমি বললাম আমি কাউকে চিনি না। এবার লাথি মেরে আমাকে চেয়ার থেকে ফেলে দিলো। আমি পড়ে তীব্র ব্যথা পেলাম। আমার মোবাইল নিয়ে নিলো। মোবাইলের নাম্বার একে একে ঘেঁটে বের করছে। মোবাইলে তেমন কিছু না পেলেও আমার একটি রুটিন খুঁজে পেল। যেখানে কুরআন তেলাওয়াত ও কিছু আয়াত-হাদিস মুখস্থ করার পরিকল্পনা ছিল। এবার আর কোনো কথা ছাড়াই শুরু করল স্ট্যাম্প দিয়ে মার। বল, শালা তুই না শিবির করিস না, তো মিথ্যা বললি কেন? এই কারেন্ট লাইন নিয়ে আয়। হাফিজ নামে ছাত্রলীগের আরেক নেতা ধরলো এবার। রুমে পানি গরম করার হিটার ছিল। কারেন্ট লাইন আমার গায়ে ধরতেই গোটা শরীর ঝিম হয়ে গেল। আমি পড়ে গেলাম।

এবার বলল এই শালার কিছুই হয়নি। সব অভিনয়। এদিকে আমার ডান হাতে ইলেকট্রিক শক লেগে অবস হয়ে গেছে। আবারো শক প্রস্তুত করছে; সত্য কথা বল। এই শিবির করে আর কে কে? আমি কী বলব? কিছুই বুঝতেছি না। চুপ করে থাকলে নির্যাতন আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। এবার ছিল তরকারি কাটা বঁটি আর ছুরি। রাসেল আর সুমন দু’জন দুই দিক থেকে ধরল। আমি চিল্লায়ে উঠলাম। হাফিজ বলল ওরে শালা এ বড় লিডার অল্পতে কিছুই হবে না। আর চিল্লায়ে অন্যদের ডাকার চেষ্টা করছে। এই গান ছাড়। কম্পিউটারে ছাড়া হলো হিন্দি গান। এবার বলল চিল্লা শালা। আর লাভ হবে না। এবার শুরু হলো নির্যাতনের নতুন মাত্রা। আমাকে লাথি মেরে ফ্লোরে ফেলে দিয়ে গানের তালে তালে নৃত্য করল। আমি এবার সেন্সলেস হয়ে গেলাম। শুধু পানি চাইলাম। আর বললাম ভাই আমার মাকে একবার দেখতে চাই। আমি মনে হয় আর বাঁচব না। আমার ফোনটা দিন। আমার মায়ের সাথে একটু কথা বলতে চাই। মারতে মারতে আমার এই বর্ণনা লেখার সময় আমি সেই স্মৃতি মনে করছি আর শুধুই ভাবছি এই পশুত্ব কিভাবে ঢুকল তাদের মাধ্যে। আমি পড়ে রইলাম। এবার ধরে আনলো আমার এক সিনিয়র বাংলা বিভাগের আকাশ ভাইকে। ভাইকে আনার পরই আমাকে জিজ্ঞেস করল, এই বল আকাশ শিবিরের কী? আমি বললাম ভাই আমি জানি না। এবার সিগারেটের আগুন ধরল আমার গায়ে। পোড়ানো শুরু করল। আর অকথ্য ভাষায় গালি। আবার সেন্সলেস হয়ে গেলাম।

রাত আনুমানিক ২টা। আমাকে আর আকাশ ভাইকে নেয়া হলো হলের পশ্চিম ব্লকে হল সেক্রেটারি আনোয়ার হোসেন আনুর রুমে। এবার শেষ বিদায়ের প্রস্তুতির মতো নিজেকে দেখে নিচ্ছি। চতুর্দিকে তাকাচ্ছি আরশে আজীমের নিকট মনে মনে দোয়া পড়ছি হে মালিক এই নরপশুরা হয়তো আমাকে মেরে ফেলবে। আমাকে মাফ করে দিও। আমি শুধুই বলছি হে রব্বে কারিম, আমার বাবাকে আমার লাশ বহনের সাহস দিও। চোখে পানি। এরা খুবই চুপিসারে নিয়ে গেল আনুর রুমে। তাদের ভাষায় একটা প্রাইমারি স্বীকারোক্তি পেয়ে গেছে শালারা শিবির করে। আনু আসলে মূল আয়োজনটা করবে। মহান মালিকের রহমত বর্ষণ হলো। ভোর চারটা বেজে গেল। আনু রুমে এখনো ফেরেনি। রুম বাইরে থেকেও আটকানো, আমরা ভেতরে, চাবি দিদারের কাছে। ভোর ৪টার দিকে হঠাৎ দরজায় আঘাত। এবার ভাবলাম, মালিক আমাদের রক্ষা কর। দরজা ভেঙেই ভেতরে প্রবেশ করল পুলিশ। আমি দোয়া পড়া শুরু করলাম এবং বোঝার চেষ্টা করলাম। আমাদের দু’জনকে হলের গেস্টরুমে নেয়া হলো। কিছুক্ষণের মধ্যে বিশ^বিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. সাইফুল ইসলাম খান আসলেন। এসে কোনো কথা ছাড়াই আবার জিজ্ঞাসাবাদ শুরু। আমি ভেবেছিলাম যারা নির্যাতন করেছে তাদের বিষয়ে খোঁজ নেবে। কিন্তু নাহ। উল্টো সব অন্যায় যেন আমাদের। আমাদের কী অন্যায় ? আমাদের শিবিরের সাথে সম্পর্ক আছে। কিছুটা অবাক হলাম। পুলিশ ভ্যানে তোলা হলো। নিয়ে যাওয়া হলো প্রক্টর অফিসে। সমস্ত শরীর রক্তে ভেজা আর তীব্র ব্যথা। এরপরও ফজরের আজান দেয়ার সময় নামাজে দাঁড়িয়ে গেলাম। সে সময় প্রক্টরের ভাষা এমন যে, ওসি সাহেব খেয়াল করেছেন? এরা কত বড় জঙ্গি? দ্যাখেন এই কষ্টের মধ্যেও নামাজে দাঁড়ায়। কত বড় প্রশিক্ষিত এরা। এমন সব মন্তব্য শুরু হলো। পরের দিন শুনেছিলাম আমার বন্ধু হলের বড় ভাই হাসান্জ্জুামান ভাইকে জানিয়েছিল। ভাই আমাদের জীবিত ফেরত আনার জন্য প্রক্টরকে ফোন করেছিল। নতুবা আনু এলে হয়তো ভিন্ন কিছু হতো।

 

 

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement