১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

তারুণ্যে ভরা শীত

-


শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন নিঝুম রাত্রি। পৌষের কনকনে হিমেল হাওয়ায় জড়োসড়ো প্রকৃতির সব প্রাণীগুলো। পৃথিবীর প্রায় সব মানুষগুলো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। পাখিরাও নীড়ে ফিরে আসছে সন্ধ্যার আগেই প্রিয় ছানাগুলোর কাছে। হিমায়িত রাতের অন্ধকারাচ্ছন্ন শহর, নগর, আর গ্রামের ব্যস্ত মানুষগুলো উষ্ণতায় সন্ধি স্থাপন করে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে শীতের চাদর মুড়িয়ে।
আলোময় ব্যস্ত শহরের ল্যাম্পপোস্টের বাতিগুলোও জ্বলছে অনবরত সারা রাতভর। প্রকৃতি সেজেছে অপূর্ব সাজে। ঝরা পাতার নৃত্যে গালিচা সেজেছে সবুজের বুক জুড়ে। ঝিরিঝিরি শিশিরের ছোঁয়া পেতে ফুটে আছে পথের ধারে ঘাসফুল। মনোরম পরিবেশে শিথিলতা এনে দেয় মনে সকালের আবহাওয়ায়। গাঁয়ের মেঠো পথে হেঁটে চলে কত পথিক, হলুদ সর্ষের মৃদুমন্দ ঘ্রাণে মাতোয়ারা তার মন প্রাণ।

শীতের সকালে ঘন কুয়াশায় স্নান করে চুপসে আছে প্রকৃতির সবুজ পল্লব। দূর্বাঘাসে ঝিলিক ছড়াচ্ছে সোনালি মিষ্টি রৌদ্দুর। পৌষ পার্বণে কাক ডাকা ভোরে শহর আর গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষেরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে ছুটছে কাজের সন্ধানে। শৈত্যপ্রবাহের আবছা আলোয় ঢেকে আছে নগরীর প্রতিটি প্রান্ত। শীত আসলেই আমাদের দেশে শুরু হয় পিঠাপুলির বিশাল আয়োজন।
ষোলোআনা বাঙালির মহোৎসব শুরু পিঠাপুলির ধুমধাম আয়োজনে। নতুন ধানের গন্ধে ভরে ওঠে কৃষকের ঘর। শুরু হয় আনন্দে মুখরোচক উৎসব। নতুন চাউলের পিঠা তৈরিতে ব্যস্ত গ্রামের সব বাড়ি। শহরের জীবনেও তার দেখা মিলে। রাস্তার ধারে বসে পিঠা তৈরির ব্যাপক ধুম পড়ে যায় বিক্রির জন্য। যা আগে ছিল না, এখন শহরের বুকেও গ্রামের মতো পিঠাপুলির এই আয়োজন দেখা যায়। পাওয়া যায় মুখরোচক সব ধরনের পিঠা।
শীতের পিঠার সাথে খেঁজুর গুড় আর খেঁজুরের রসের দারুণ সম্পর্ক রয়েছে। চমৎকার মিষ্টান্নতায় ভরপুর সুমিষ্ট রস। বাড়িতে নানান রকম পিঠা তৈরি করেন মায়েরা তার অতি আদরের সন্তানদের আর প্রিয় মানুষগুলোর জন্য। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু মজার মজার পিঠা হলো, ভাঁপা পিঠা, চিতই, পাটি সাপটা, দুধপুলি, মালপোয়া, দুধ চিতই ইত্যাদি হরেক রকমের পিঠা।

মায়েদের কখনো ক্লান্ত হতে দেখিনি প্রিয় মানুষদের জন্য পিঠা তৈরি করতে। আমার মাও খুব ভালো পিঠা তৈরি করেন আমাদের জন্য। সকালে উনুনের এক পাশে বসে মায়ের হাতের পিঠা খাওয়ার মজাই আলাদা। মা যেন পরম যত্নে ভালোবেসে পিঠা তৈরি করেন সেই ছোট বেলা থেকে দেখে আসছি। মায়ের ভালোবাসা জীবনের সর্বত্র জড়িয়ে আছে সে শৈশব থেকে কৈশোরে, এভাবেই থাকবে আমৃত্যু অব্দি।
শীতের সবুজ শাকসবজিগুলো যেন মহান আল্লাহর দেয়া বড় নেয়ামতে ভরা। সর্ষেফুলের গন্ধে মুখরিত গ্রামাঞ্চলের চারদিক। বাতাসে সুবাসিত ঘ্রাণে প্রাণ কেড়ে নেয়। এই মনোমুগ্ধকর পরিবেশ যা কেবল আমাদের দেশেই দেখা যায়। কনকনে এমন শীতের মৌসুমে প্রকৃতির সতেজতায় চমৎকার লাগে চারপাশের পরিবেশ।
অতিথি পাখিরা দল বেঁধে আসে দূর দিগন্ত থেকে আমাদের খাল, বিল, জলাশয়, হাওর, বাঁওড়ে, নদীর চারপাশটা মুখরিত করে তুলে। হিমেল হাওয়ায় দোলা জাগায় মনে। কবিত্বের অনুভূতি বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ। কবি সাহিত্যিকরা হাতের জাদুতে সৃষ্টি করে তোলেন নতুন নতুন শৈল্পিক বুনন। তাদের কলমের আঁছড়ে সৃষ্টি হয় কত কবিতা, গল্প। লেখার ভাষ্যে আর অধিক শব্দতরঙ্গে গড়ে উঠে অনন্য, সুন্দর শ্রুতিমধুর বাক্যবিন্যাসের নিপুণ সব সাহিত্যের।
গ্রামের রূপ অনেকটা পাল্টে যায় শীতের মনোমুগ্ধকর পরিবেশে। যেন প্রকৃতির এক স্নিগ্ধ ছোঁয়া আর অপরূপ সৌন্দর্যে মনটা ভরে উঠে। চারিদিকে শুধু সবুজের সমারোহ। শীতের সময় গ্রামে গাছিয়ালদের খেজুরের রস সংগ্রহ করা, কাঁধে করে রসের হাঁড়ি নিয়ে বাড়ি ফেরা, বাড়ি বাড়ি টাটকা শাকসবজি নিয়ে সবজি ওয়ালাদের আসা, খেত খামারে কৃষকদের নিজের হাতে কাজ করা এসব দৃশ্যগুলো কেবল গ্রামে থাকা মানুষগুলোই উপভোগ করতে পারেন।

শহরে এই দৃশ্যগুলো দেখা যায় না। ছোটবেলা থেকেই আমি গ্রামের আলো বাতাস, মা, মাটি ও প্রকৃতির সংস্পর্শে বেড়ে উঠেছি। নদীর পাড় ঘোরা, পুকুরে গোসল করা, প্রকৃতির মাঝে ঘুরাফেরা, স্নিগ্ধ সতেজ আর নির্মল বাতাসে খুঁজে পেয়েছি এক অপরূপ সৌন্দর্যের ছোঁয়া। শীতের পরেই আসে বসন্ত ঋতু। বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। এখানে প্রতিটি ঋতুতে অপূর্ব সুন্দর করে সেজে উঠে প্রকৃতি। বসন্ত ঋতুতে ফুটে ওঠে নানান রকম ফুল।
শীতের শেষে পাতা ঝরার অসম্ভব সুন্দর এক দৃশ্য দেখা যায়। ঝরাপাতার গালিচায় হেঁটে যাওয়া ভীষণ ভালো লাগে। শীতের আমেজে আর ফুরফুরে বাতাসে নেচে উঠে ঘাসফড়িং আর রঙ-বেরঙের প্রজাপতির দল। বাংলাদেশের মতো এমন চমৎকার দৃশ্য আর কোথাও দেখা যায় না। আমি চিরকাল হারাতে চাই এই প্রকৃতির বুকে ভালোবেসে। আবিষ্কার করতে চাই বাংলার রূপ-বৈচিত্র্য। মা, মাটি আর মানুষের প্রেমে ডুবে থাকতে চাই আমৃত্যু।
বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে এক টুকরো সবুজ বাগিচা। এখানে ফুলে ফুলে দোল খেলে ভ্রমর। নদীর বুকে উড়ে বেড়ায় সাদা বক আর নাম না জানা কতরকম পাখি। ঋতুচক্রে ঘুরে আসে বৈচিত্র্যময় আয়োজন। ষড়ঋতুর এই খেলায় বাংলার রূপে মুগ্ধ হয়েছি আমি বারংবার। মুগ্ধতা ছেয়ে যায় আমার কবিত্বময় মনে। এমন দেশের মাটিতে জন্মেছি বলে ভীষণ আনন্দ হয়। ভালোবাসি এই বাংলা মায়ের চিরসবুজ রূপ।

 


আরো সংবাদ



premium cement