৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

পরিবর্তন

পরিবর্তন -


শফিক তার মাকে বলল, ‘আম্মু তোমার কাছে একশ’ টাকার নোট আছে?’
মা বলল, ‘কেন? এই কথা জিজ্ঞেস করছিস কেন? একশ’ টাকার নোট দিয়ে তুই কী করবি?’
‘আমার দরকার। থাকলে দাও। আমি তার বদলে তোমাকে পাঁচটা বিশ টাকার নোট দেই।’
মা বললো, ‘ঠিক আছে।তোর বিশ টাকার নোটগুলো নিয়ে আয়।’
শফিক পাঁচটা বিশ টাকার নোট এনে তার মায়ের হাতে দিয়ে বলল, ‘এই নাও টাকা। এখন আমাকে একশ’ টাকার নোট দাও।’
শফিকের মা তাকে একশ’ টাকা দিয়ে বিশ টাকাগুলি হাতে নিয়ে বললো, ‘এই টাকা তুই কোথায় পেয়েছিস?’
‘তুমি যে প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার সময় আমাকে বিশ টাকা করে দাও।এগুলো সেই টাকা। তোমার টাকা তুমিই চিনো না?’
‘হ্যাঁ চিনি, বুঝতে পেরেছি এগুলো আমার দেয়া টাকা। কিন্তু অবাক হচ্ছি, এই টাকা তোর হাতে কেন? তুই টাকা পেলে সাথে সাথেই খরচ করে ফেলিস। হাতে তো রাখিস না।’

‘আগে খরচ করতাম। কিন্তু এখন আর করি না। গত পাঁচ দিন যাবৎ আমি আর টাকা খরচ করি না। সব টাকা জমাই।’
‘টাকা জমাস! জমিয়ে কী করবি?’
‘আছে। আমার কাজ আছে।’
‘কী কাজ? আমাকে বলা যাবে কি?’
‘যাবে। তোমাকে বলা যাবে। কিন্তু শুনে তুমি রাগ করতে পারবে না।
‘না না। রাগ করবে না। রাগের বিষয় না হলে রাগ করব কেন? বল টাকা জমিয়ে কী করবি তুই?’
‘আমাদের স্কুলের পিছনে চৌধুরীদের বাঁশ ঝাড়ের নিচে একটা ভাঙা ঘরে একটা বুড়ি থাকে। তুমি তাকে দেখেছ আম্মু?’
‘হ্যাঁ, দেখেছি তো। আমার সাথে ওই বুড়ির আলাপ পরিচয়ও আছে। বুড়ি ভিক্ষা করে। বুড়ির ছেলে ফজল আগে স্কুলের সামনে আচার বেচত। এখন কী করে জানি না।’

শফিক বলে, ‘সেই ফজলের মা গতবার শীতে খুব কষ্ট করেছে। আমি দেখেছি। খড়ের ওপর একটা কাঁথা বিছিয়ে আর একটা কাঁথা গায়ে দিয়ে সে ঘুমাত। গত শীতেই তার জন্য একটা ব্যবস্থা করা উচিত ছিল। কিন্তু তখন আমার বুদ্ধিতে এটা ধরেনি। এবার আগে ভাগেই ওই বুড়ির কথা আমার মাথায় এসেছে। এবার আমি তাকে আর কষ্ট করতে দিবো না। এবার একটা লেপ আর একটা তোশক কিনে দিবো। এজন্যই টাকা জমাচ্ছি।’
শফিকের মা বলল, ‘বাহ! ফাইন কথা।খুব ভালো হবে।’

‘আব্বু যেন নিষেধ না করে। আমি কিন্তু বুড়িকে এবার লেপ তোশক দিবোই।’
‘না না, নিষেধ করবে না। ভালো কাজ করতে নিষেধ করবে কেন?’
রাতে ঘুমানোর আগে শফিকের মা শফিকের আব্বুকে ঘটনাটা বলল।
শফিকের আব্বু বললেন, ‘ঠিক আছে দিতে চায় দিক। আমি নিষেধ করব না, তুমিও উৎসাহ দিও।’
‘একটা লেপ আর একটা তোমক কিনতে হয়তো দেড় দুই হাজার টাকা লেগে যাবে। বেশিও লাগতে পারে। বিশ টাকা করে দৈনিক জমিয়ে এত টাকা হবে কি?’
শফিকের বাবা বললেন, ‘হবে। এখনো শীত আসতে কিছু দিন বাকি আছে। নিশ্চয়ই এর মধ্যেই হয়ে যাবে। কিছু কম পড়লে আমি দিবো।’
‘এক কাজ করলে কেমন হয়?’

‘কী কাজ?’
‘ওই বুড়িকে একটা লেপ আর একটা তোশক না হয় আমরাই কিনে দেই। ছেলেটার এটা নিয়ে চিন্তা করার কী দরকার?’
‘না। তা করা যাবে না। ছেলেটার চিন্তা ছেলেটাই করুক।’
‘সেই তো ঘুরেফিরে আমাদের টাকাই যাবে। এক কথাই তো হলো।’
‘না। এক কথা না। এখানে আরো বিষয় আছে।’

‘কী বিষয়?’
শফিকের বাবা বুঝিয়ে বললেন, ‘বাইরের ঝালমুড়ি, চাটনি, আচারসহ যে কোনো খোলা জিনিস খাওয়া শিশুদের জন্য খুবই ক্ষতিকর। স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। ডাক্তার সব সময় এই কথা বলে। কিন্তু আমরা শিশুদেরকে এসব খাওয়া থেকে ফিরাতে পারি না। যেভাবেই হোক শিশুরা বাপ-মায়ের কাছ থেকে দশ-বিশ টাকা নিবেই এবং স্কুলে গিয়ে সময় সুযোগ মতো শিক্ষকদের চোখ ফাঁকি দিয়ে এই সব ক্ষতিকর খাবার খাবেই।’
‘কাজেই কোনো শিশু যদি কোনো গরিব মানুষের কল্যাণের জন্য কোনো প্রকল্প হাতে নেয় এবং স্কুল গেইটের আজেবাজে জিনিস খাওয়া বাদ দিয়ে সেই টাকা জমাতে থাকে তাতে দুইটা লাভ।’
ইফতির মা বলল,‘দুইটা লাভ কী কী?’

‘সেগুলো হলো-
এক, বাইরের নোংরা জিনিস খাওয়া থেকে সে দূরে থাকল। যার ফলে তার স্বাস্থ্যটা নিরাপদ থাকলো।
‘আর দুই, তার মনে একটা সুন্দর পরিবর্তন এলো, মানব কল্যাণমূলক কাজের জন্য তার মন-মস্তিষ্ক ছোটবেলা থেকেই তৈরি হতে শুরু করল।’
‘বাহ! তাই তো, আমি তো এমন করে ভাবিনি।’
‘এখন থেকে ভাবো। ভাবতে শিখো।’
শফিক প্রতিদিন তার জমানো টাকাগুলি গণনা করে। হাতে পাঁচটা বিশ টাকা জমলেই সে তার মাকে সেগুলো দিয়ে একটা একশ’ টাকার নোট নেয়। তারপর যখন পাঁচটা একশ’ টাকার নোট জমে তখন সেগুলোকে দিয়ে পাঁচশ’ টাকার নোট নেয়। এরকম করতে করতে এখন তার হাতে এক হাজার সাতশত টাকা জমা হয়ে গেছে।

দেখতে দেখতে চার মাস চলে গেল।
কার্তিক মাস শেষ হয়ে অগ্রহায়ণ শুরু হলো। একটু একটু করে শীত পড়া শুরু করলো।
একদিন শফিকের বাবা শফিককে কাছে ডেকে বলল, ‘বাবাজি শীত তো এসে পড়েছে, এখন ফজলের মায়ের কাজটা তো করে ফেলা দরকার।’
শফিক বলল, ‘কবে করা যায় আব্বু?’
‘চলো আজকেই দোকানে যাই। তোমার টাকাগুলো বের করো।’
তারপর সেদিনই শফিককে সাথে নিয়ে শফিকের আব্বু বেডিং হাউজে চলে গেলেন। সেখান থেকে আড়াই হাজার টাকা দিয়ে একটা লেপ একটা তোশক আর একটা মশারি কিনে নিজে ফজলের মায়ের বাঁশতলার ভাঙা বাড়িতে গিয়ে পৌঁছে দিয়ে এলেন।

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement