২০ নভেম্বর ২০২৪, ৫ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

সন্দেহ সংশয় ও মানবজীবন

-


যিনি আপনাকে সন্দেহ করছেন তাকে এড়িয়ে চলুন আর নিজে সব সময় আনন্দের মধ্যে থাকতে চেষ্টা করুন। জীবনের সুখ-শান্তি অনুভব করার চেষ্টা করুন। আনন্দে থাকলে শারীরিক ও মানষিকভাবে সুস্থ থাকা যায় তাই অন্যের সন্দেহকে পাত্তা না দিয়ে নিজের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে তুলুন আর আনন্দিত থাকুন

সন্দেহ বা doubt শব্দটি আকারে ছোট হলেও এই শব্দের ক্ষমতা অনেক। বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের অন্তর্বর্তী যে নেতিবাচক চিন্তা ও অনুভূতি আমাদের যন্ত্রণা বা কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায় তার নাম সন্দেহ।
সন্দেহ যখন মাত্রাতিরিক্ত হয়ে ওঠে তখন সেটি রোগে পরিণত হয়। এই রোগের সুন্দর একটি নাম আছে। শেক্সপিয়ারের বিখ্যাত চরিত্র ওথেলো নিজের প্রমিকাকে প্রচণ্ডভাবে সন্দেহ করত। সেখান থেকেই এই রোগের নামকরণ করা হয়েছে- ওথেলো সিনড্রোম। ওথেলো সিনড্রোম বা সন্দেহ বাতিক রোগ এমন, রোগ যেটি দাম্পত্য সম্পর্কে ভয়াবহ পরিণতি এনে দেয়। বিষময় হয়ে ওঠে জীবন। এ ক্ষেত্রে সন্দেহ করা অভ্যাসে রূপ নেয় এবং সন্দেহটি ঘনীভূত বিশ্বাসে পরিণত হয় যদিও এর পেছনে যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ থাকে না। এক্ষেত্রে কল্পিত সন্দেহ নিছক হলেও সেটিকে বাস্তবে পরিণত করতে রোগী সবসময় সচেষ্ট থাকে।
একটি জরিপে দেখা গেছে, ওথেলো সিনড্রোম রোগে পুরুষরা মহিলাদের তুলনায় বেশি ভুগে থাকে। মহিলা ও পুরুষের আক্রান্ত হওয়ার আনুপাতিক হার ১ : ৩। গবেষণায় দেখা গেছে, ওথেলো সিনড্রোমের রোগীদের এই রোগের পাশাপাশি অন্য রোগ যেমন- প্যারানয়েড, সিজোফ্রেনিয়া, নিউরোসিস, পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার, অ্যালকোহলিজমসহ অন্যান্য মানসিক রোগও থাকতে পারে।

সন্দেহ বাতিক রোগের কারণে ভয়াবহ সহিংসতার ঘটনাও ঘটে যেতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, ক্রমাগত তীব্র সন্দেহের জ্বালা সইতে না পেরে অনেক নিরপরাধ পার্টনার আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। বতর্মান সময়ে সন্দেহ মহামারী আকার ধারণ করেছে। সন্দেহ মূলত দু’টি কারণে হয়। যথা-
১. প্রচণ্ড ভালোবাসলে : কেউ যদি কাউকে প্রচণ্ড ভালোবাসে তবে তার মনের মধ্যে তাকে সব সময় হারানোর ভয় কাজ করে। এই হারানোর ভয় থেকেই সৃষ্টি হয় সন্দেহ। অনেক সময় পিতা-মাতা সন্তানকে প্রচণ্ড ভালোবাসেন আর এই প্রচণ্ড ভালোবাসা থেকেই তারা সন্তানদের সব সময় সন্দেহ করতে থাকেন। পারস্পরিক সন্দেহ আর ভুল বোঝাবুঝির কারণে নষ্ট হয়ে যায় তাদের সুন্দর পারিবারিক সম্পর্ক।
২. অন্যের রিলেশনের ঘটে যাওয়া ঘটনা দেখে দেখে মনে সন্দেহের সৃষ্টি হতে পারে : আশপাশের চেনাজানা কারো পরকীয়া বা অন্য কোনো নতুন সম্পর্ক গড়ে উঠতে দেখলে মনের মধ্যে সন্দেহের দানা বাঁধতে শুরু করে। সহকর্মীদের পরকীয়ায় জড়াতে দেখে নিজের ঘরের স্ত্রীকেও সন্দেহ করতে শুরু করেন অনেকে। অনেক সময় পিতা-মাতাও অন্যের বখে যাওয়া সন্তানকে দেখে নিজের সন্তানের প্রতি সন্দেহের তীর ছুড়তে শুরু করেন।

ওথেলো সিনড্রোম বা সন্দেহপ্রবণ রোগীর লক্ষণ : ওথেলো সিনড্রোম রোগীর ভেতরে কিছু আচরণ প্রকাশ পায়। যেমন-
১. ওথেলো সিনড্রোম ব্যক্তি একা থাকতে পছন্দ করে। সবার ভেতরে থেকেও তারা যেন একাকিত্বে থাকে। নিজের একটি ভিন্ন জগৎ তৈরি করে রাখে। যে জগতে তিনি একাই রাজা একাই প্রজা। টিভির রুমেও তিনি যেন অন্য কিছু ভাবতে থাকেন। অন্য মনস্ক হয়ে কিছু ভাবতে থাকেন।
২. ওথেলো সিনড্রোম ব্যক্তির মধ্যে কিছু ভ্রান্ত বিশ্বাস সৃষ্টি হয়। এমন কিছু অবাস্তব চিন্তা করেন বা বলেন যার বাস্তব কোনো ভিত্তি নেই। নিজ থেকে কাল্পনিক দৃশ্য দেখতে পান এবং কাল্পনিক ক থাবার্তা শুনতে পান। আর সঙ্গীকে দোষারোপ করতে থাকেন। দিন দিন তার এই সন্দেহ প্রবণতা বাড়তে থাকে।
৩. অনেক সময় সন্দেহপ্রবণ ব্যক্তি আক্রমণাত্মকও হয়ে ওঠেন। তিনি যাকে নিয়ে সন্দেহ করেন তার প্রতি সবসময় একটি শত্রুভাবাপন্ন মনোভাব প্রদর্শন করেন। একটা পর্যায়ে তিনি রেগে গিয়ে গায়ে হাত তুলতেও লজ্জা পান না।

৪. সন্দেহপ্রবণ ব্যক্তির ভেতরে এক ধরনের অস্থিরতার লক্ষণ দেখা যায়। ছটফট ছটফট করতে থাকেন। অফিসের কাজে মন বসে না। ঘরে থাকলেও কেমন যেন উদাস থাকেন। আবার কেউ কেউ এর উল্টো আচার-আচরণও প্রকাশ করতে থাকেন। একদম স্থির পর্যায়ে অবস্থান করেন। সারাক্ষণ আনমনে কি যেন ভাবতে থাকেন।
৫. সন্দেহপ্রবণ ব্যক্তি সঙ্গীকে অবিশ্বাস করে। মূলত তারা সবাইকে অবিশ্বাস করে। আর অবিশ্বাসের মাত্রা এত বেড়ে যায় যে, স্বাভাবিক জীবন নষ্ট হয়ে যায়। স্বাভাবিক আচার-আচরণ বদলে যায়। কথাবার্তায় সবসময় সন্দেহ প্রকাশ করে। ফলে পরিবেশ পরিস্থিতি হয়ে ওঠে অসহনীয়।
৬. সন্দেহপ্রবণ ব্যক্তির চিন্তাভাবনায় একটি অস্বাভাবিকতা প্রকাশ পায়। সারাক্ষণ মনগড়া অবাস্তব চিন্তা করার ফলে এরা সুষ্ঠু সুন্দর চিন্তা করার শক্তি হারিয়ে ফেলেন।
৭. অনেক সময় সন্দেহপ্রবণ ব্যক্তি আবার স্বাভাবিক কাজকর্মও সুষ্ঠুভাবে করতে পারেন না। সন্দেহপ্রবণ স্বামী অফিসের কাজকর্ম বাদ দিয়ে হুটহাট বাড়ি ফিরে আসেন। বাসায় এসে স্ত্রীকে চোখে চোখে রাখেন। এতে তার কর্মদক্ষতা কমতে থাকে, সুনাম নষ্ট হতে থাকে। ফলে তিনি আরো খিটখিটে স্বভাবের হয়ে যান। ব্যক্তি বিশেষে সন্দেহপ্রবণতার লক্ষণেও ভিন্নতা থাকে।

ওথেলো সিনড্রোমের ক্ষতিকর প্রভাব
মনে যখন সন্দেহের বিষ বাসা বাঁধে তখন সেই মানুষ আর সুস্থ থাকতে পারেন না। সন্দেহপ্রবণতার কারণে নানা রকম ক্ষতিকর প্রভাব দেখা দেয়। যেমন-
১. ক্যান্সার আর সন্দেহের মধ্যে একটি মিল রয়েছে। ক্যান্সার একটি শরীরকে দিনে দিনে নষ্ট করে ফেলে আর সন্দেহ একজন মানুষের ভালোবাসা ও মনকে গভীরভাবে নষ্ট করে দেয়। শেষ করে দেয় জীবনের সুখ-শান্তি।
২. সন্দেহ বিশ্বাস নষ্ট করে দেয়। বিশ্বাসের অর্থ হচ্ছে নিজেকে বিশ্বাস করতে শেখা, নিজের কাজকর্মের প্রতি যেমন ভরসা রাখা তেমনটি অন্যের কাজকর্মের প্রতিও আস্থা রাখতে শেখা। সন্দেহ মনে এলে মন অবিশ্বাসী হয়ে ওঠে।
৩. সন্দেহ দীর্ঘদিনের সম্পর্ক শেষ করে দেয়। একটি সম্পর্ক গভীরভাবে গড়ে উঠতে অনেক সময় লাগে কিন্তু সেই সম্পর্ক যখন পারস্পরিক সন্দেহ আর ভুল বোঝাবুঝির কারণে নষ্ট হয়ে যায় সেটি থেকে দুঃখের ব্যাপার আর কিছুই হতে পারে না।
৪. সন্দেহ মানুষকে পিছিয়ে দেয়। যে মানুষের জীবনে সন্দেহ এসে যায় সেই মানুষ আর এগিয়ে যেতে পারে না। সে আর কাজে সফল হতে পারে না।
৫. সন্দেহপ্রবণতা বৃদ্ধির কারণে পারিবারিক সুখ-শান্তি নষ্ট হয়। পরিবারে সবসময় একটি গুমোট পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়ে থাকে। একে অন্যের প্রতি বিরক্তি, রাগ, ক্ষোভ প্রকাশ করে থাকে। একে অন্যের প্রতি সবসময় নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করে থাকে।

৬. সন্দেহপ্রবণতা মানুষকে সামাজিকভাবে খাটো করে দেয়। মনের মধ্যে সন্দেহের বিষ ঢুকলে রোগীরা নিজের সন্দেহের কথাগুলো অন্যের কাছে বলে, এতে সামাজিকভাবে নিজেদের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয় এবং পরিবারের গোপন কিছু তথ্য বাইরে রটে যায়। ফলে পরিবারটি সামাজিকভাবে নেতিবাচক আচরণ পেতে শুরু করে।
৭. সন্দেহপ্রবণতা বা ওথেলো সিনড্রোম পরিবারের সব সদস্যদের মুখের হাসি,মনের শান্তি কেড়ে নেয়। যদি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এই রোগ দেখা দেয় তো পরিবারের শিশুরা মারাত্মকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এ ধরনের সন্দেহপ্রবণতার ক্ষতিকর প্রভাব গিয়ে পড়ে শিশুদের ব্যক্তিত্বের ওপরে। ফলে পরিবারের শিশুরা নেতিবাচক ব্যক্তিত্ব নিয়ে বড় হয়ে ওঠে এবং পরে এই সব শিশুরাও নানা রকম মানসিক জটিলতার ভেতরে থাকে।
৮. ওথেলো সিনড্রোমের মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব হচ্ছে, অনেক সময় রোগীরা যখন অন্যের কাছে গিয়ে পরামর্শ চায় তখন যিনি শুনছেন তিনি তার কথা (মানে রোগীর কথা) বিশ্বাস করে ভুল পরামর্শ দিয়ে থাকেন। আর রোগীও সেই ভুল পরামর্শ গ্রহণ করে তার স্ত্রীর সাথে নেতিবাচক আচরণ করে থাকে। অনেক সময় এ ধরনের ভুল পরামর্শই ভেঙে দেয় রোগীর সাজানো গোছানো সুখের সংসার।

ওথেলো সিনড্রোম দূর করার উপায় :
সন্দেহ থাকলে যেকোনো সম্পর্কই মুহূর্তে ভেঙে যেতে পারে। তাই সন্দেহপ্রবণতাকে টের পাওয়ার সাথে সাথেই তা দূর করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
প্রথমত. খোলামেলা আলোচনা করা। মনের সন্দেহ কি সন্দেহ নাকি তা সন্দেহবাতিক তা বোঝার চেষ্টা করা। প্রয়োজনে মনোচিকিৎসকের সাহায্য নিতে হবে। স্বামী বা স্ত্রীর প্রতি সন্দেহের বিষয়টি নির্ভরযোগ্য কারো সাথে খুলে আলোচনা করা যেতে পারে। এতে মন হাল্কা হবে। এ ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে, যাকে তাকে নিজের পারিবারিক সমস্যা বলা ঠিক নয় এবং নিজেকেও হাসির পাত্র করা উচিত হবে না।
দ্বিতীয়ত. পুনরায় মূল্যায়ন করা। সবসময় নেতিবাচক পরিস্থিতির ইতিবাচক দিকগুলো চিন্তা করা। এটি নেতিবাচক ধ্যান ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করবে। মনের যত্ন নিতে হবে, সুন্দর চিন্তা করার জন্য নিজেকে সময় দিতে হবে। মাঝে মধ্যে গান শোনা, ছবি আঁকা, প্রাকৃতিক পরিবেশে ঘুরতে বের হওয়া যেতে পারে। এতে মন নেতিবাচক চিন্তা থেকে দূরে থাকবে এবং মন ফুরফুরে হবে।
তৃতীয়ত. নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে। অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা, তাই নিজেকে যথাসম্ভব ব্যস্ত রাখা দরকার। যারা অলস থাকে তারা ভালোবাসার মানুষটিকে নিয়ে ভেবে ভেবে অস্থির হয়, এমন অবস্থায় মনে সন্দেহের মেঘ জমতে পারে। তাই কোনো সৃষ্টিশীল কাজে ব্যস্ত ব্যস্ত থাকা অথবা ধর্ম-কর্মে বেশি মনোযোগী হওয়া যেতে পারে।

চতুর্থত. খারাপ দিকগুলো লিখে রাখলে বিষয়গুলো মনে থাকবে। অবসর সময়ে সেগুলো নিয়ে চিন্তা করে সমাধানের ব্যবস্থা করা উচিত।
পঞ্চমত. বিশ্বাস রাখতে হবে। বিশ্বাসের ওপরেই নির্ভর করে সম্পর্কের স্থায়িত্ব। ভালোবাসার মানুষটিকে মন থেকে বিশ্বাস করলে এবং একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে আর এ সব সন্দেহ মনে বাসা বাঁধতে পারবে না।
ষষ্ঠত. কারণ খোঁজার চেষ্টা করা। কেন দু’জনের মধ্যে এত ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে সে কারণ খোঁজার চেষ্টা করতে হবে। অনেক সময় একে অপরের প্রতি বিরক্তি, রাগ, অভিমান, ইত্যাদি কারণেও সন্দেহের সৃষ্টি হয়। এ সবের কারণে যদি মনের ভেতরে সন্দেহের সৃষ্টি হয় তাহলে নিজেকে বুঝে সেগুলো দূর করার চেষ্টা করতে হবে।
সপ্তমত. নিজেকে মানসিকভাবে শক্তিশালী করতে হবে। আমরা মানসিকভাবে দৃঢ় কিনা তা নির্ভর করে প্রধানত আমাদের চিন্তাধারা, অভিজ্ঞতা, আবেগ, আচরণ বা ব্যবহার, বিশ্বকে অনুভব করার শক্তির ওপরে।
Amy Morin তার বই 13 things Mentally Strong People Don't Do-তে কিছু উপায় তুলে ধরেছেন যেগুলো আমাদের মানসিকভাবে শক্তিশালী করে তুলতে সাহায্য করে। সেগুলো হলো-

১. We should not waste time feeling sorry for our selves : পূর্বের কোনো কাজের জন্য সে যত বড়ই ভুল হোক তার জন্য অনুতাপ করে কখনোই সময় নষ্ট করা উচিত নয়। মানসিকভাবে শক্তিশালী ব্যক্তিরা কখনোই মনকে দুঃখের ভার বোঝাই করে জীবন আরো দুঃখময় করে তোলে না। তারা অতীতে যা হয়েছে তা গ্রহণ করতে শেখে এবং সেগুলো স্মার্টলি ইগনোর করে সামনের দিকে এগিয়ে চলতে শেখে। তারা কখনোই বলে না যে, আমার জীবনের সমস্যাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সমস্যা, বা যদি ভাগ্য ভালো হতো তাহলে এমনটি হতো না, ঠিক জীবনে উন্নতি করতে পারতাম বা দিনে দিনে দেখছি সমস্যা বেড়েই চলেছে অথবা আমার দুঃখ-কষ্ট কেউ বুঝল না বা আমার ভাগ্যটাই খারাপ- এ সব বলে আফসোস করে সময় নষ্ট করা যাবে না। এসব হাপিত্যেস বা অনুতাপ করে জীবন অতিবাহিত করতে চাইলে জীবন আরো দুঃখময় ও দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। তাই নিজের প্রতি করুণা করবেন না। অনুতাপ করে সময় নষ্ট করবেন না। মানসিকভাবে শক্তিশালী হতে হলে প্রথমেই অনুতাপ করে সময় নষ্ট করা বন্ধ করতে হবে। মানসিকভাবে শক্তিশালী ব্যক্তিরা সময়কে স্মার্টলি কাজে লাগিয়ে জীবনে সফলতার উন্নত শিখরে ঠিক পৌঁছে যায়। আজ থেকেই নিজেকে বদলে ফেলতে হবে।

২. We should accept change : মানসিকভাবে শক্তিশালী ব্যক্তিরা সবসময় পরিবর্তনকে সানন্দে গ্রহণ করতে পারে। আমাদের এই ক্ষণস্থায়ী জীবনে একমাত্র চিরস্থায়ী সত্য হলো, এই পরিবর্তন। যে জীবনের পরিবর্তনের সাথে পরিবর্তিত হতে পারে না সে আসলে জীবনের প্রবাহ থেকে ছিটকে পড়ে। যেমন- আজকের এই কম্পিউটার যুগে যে সব সফটওয়্যার ব্যবহার করি তারা প্রত্যেকে সময়ের সাথে নিজেদের আপডেট ও আপগ্রেড করে পরিবর্তন করে থাকে বলেই কম্পিটিশনের মার্কেটে টিকে আছে। তাই সময়ের সাথে সাথেই নিজেদের আপডেট ও আপগ্রেড করে নিতে হবে। পরিবর্তনকে স্বীকার করার ক্ষমতা একমাত্র মানসিকভাবে শক্তিশালী মানুষেরই থাকে।

৩. We should not focus on things that we cannot control : মানসিকভাবে শক্তিশালী মানুষেরা কখনোই সেই সব বিষয়ের ওপর ফোকাস করে না যা তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। বেশির ভাগ দুর্বল মানসিক ব্যক্তিরাই হৃদয়ের গভীরে বিশ্বাস করে যে তাদের জীবন অদৃষ্ট, ভাগ্য, নিয়তি, সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। আর মানসিকভাবে শক্তিশালী ব্যক্তিরা বিশ্বাস করে যে, the man is the maker of his won dzstany তাই এই দৃঢ় প্রত্যয়ের ব্যক্তিরা সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বা পরিবর্তনের চেষ্টা না করে নিজের মনের গতি ও পরিস্থিতি বদলে নেয়। তাই মানসিকভাবে শক্তিশালী হতে চাইলে কোনো পরিস্থিতি বদলের চেষ্টা না করে নিজেকে বদলে নিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ না করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।

৪. We should not try to please everyone : আমাদের কখনোই সবার মন জুগিয়ে চলার জন্য কাজ করা উচিত নয়। যে ব্যক্তি সবাইকে খুশি করতে চায় সে আসলে কাউকেই খুশি করতে পারে না। তাই মানসিকভাবে শক্তিশালী ব্যক্তিরা মানুষের প্রিয়জন হতে চায় না; বরং তারা নিজের ভালোবাসার দিকে লক্ষ্য স্থির করে অবিচল থেকে এগিয়ে যায়। কোথায় কাকে ‘না’ বা ‘হ্যাঁ’ বলতে হবে তা ভালো করে শেখা দরকার আজ থেকেই। মানসিকভাবে শক্তিশালী ব্যক্তিরা সব সময় স্পষ্টভাষী হয়ে, তারা নিজের স্বপ্নের দিকে এগিয়ে যায়। কারো মন জোগাতে চায় না।
৫. They do not fear taking calculated risks : হিসাব-নিকাশ কষে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যারা ঝুঁকি নিতে ভয় পায় না বা পিছু পা হয় না, তারা ঝুঁকি নেয় সাহসীভাবে, নতুন নতুন কাজে হাত দেয় সফল হওয়ার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে থাকে। তাই আজ থেকেই নতুন নতুন ঝুঁকি নিতে শিখুন।

৬. They do not live in the past: মানসিকভাবে শক্তিশালী ব্যক্তিরা অতীত নিয়ে পড়ে থাকে না বা অতীত নিয়ে চিন্তা করে বর্তমানকে ধ্বংস করে না। তারা বর্তমানকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করে এবং বর্তমান পরিস্থিতির সাথে সবসময় নিজেকে মানিয়ে নেয়।
৭. They don’t make the same mistakes repeatedly : মানসিকভাবে শক্তিশালী ব্যক্তিরা একই ভুল বার বার করে না। জীবনের একটি ভুল থেকে তারা শিক্ষা নেয় এবং নিজেকে সংশোধন করে সামনে এগিয়ে যায়। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে তারা শিক্ষা নিয়ে সফল হন।
৮. They don’t feel jealous about other people’s success : মানসিকভাবে শক্তিশালী ব্যক্তিরা কখনোই অন্যের সাফল্যে হিংসা বা ঈর্ষা করেন না; বরং তারা অন্যের সম্পর্কে সবসময় ভালো কিছু বলে। তারা অন্যের সাফল্য থেকে নিজেকে উন্নত করার পথ খুঁজে নেয়। সফল ব্যক্তির কাছ থেকে উপদেশ গ্রহণ করে। কখনোই তারা সফল ব্যক্তির বদনাম করে না; বরং ভালো কথা প্রচার করে থাকে। তাই নিজেকে মানসিকভাবে শক্তিশালী করার জন্য অন্যকে হিংসা করা বন্ধ করতে হবে। অন্যের গুণ দেখে সেই গুণের প্রশংসা করতে শিখুন।

৯. They don’t give up after the first failure : মানসিকভাবে শক্তিশালী ব্যক্তিরা প্রথমবার ব্যর্থ হলেও হাল ছেড়ে দেয় না। বারবার চেষ্টা করতে থাকে। তারা অধ্যবসায়ে বিশ্বাসী হয়। পৃথিবীর অনেক বড় বড় বিজ্ঞানী বারবার চেষ্টা করে তবেই সফল হয়েছেন। কবির ভাষায়- একবার না পারিলে দেখো শতবার। Never give up attitude তাদের সফলতার শীর্ষে পৌঁছে দেয়।
১০. They don’t feel boring when they are alone : মানসিকভাবে শক্তিশালী ব্যক্তিরা নিজের সাথে সময় কাটাতে বোর ফিল করে না। নিজের সাথে সময় কাটাতে পছন্দ করে। একাকিত্ব তাদের ভালো লাগে। একাকী তারা চিন্তার বিকাশ ঘটায়। নতুন নতুন আইডিয়া বের করে এই একাকী চিন্তা করার কারণে এবং তারা কখনোই কোনো কাজের ফলাফল তাড়াতাড়ি আশা করে না। তারা সময়ের জন্য অপেক্ষা করে থাকে।
আজকের দিনে এই সন্দেহপ্রবণতা বা ওথেলো সিনড্রোম মহামারীতে রূপ নিয়েছে। ঘরে ঘরে বেড়ে চলেছে এই সমস্যা। তাই এখনই আমাদেরকে সচেতন হতে হবে। ওথেলো সিনড্রোম দূর করার জন্য খুব বেশি প্রয়োজন পারিবারিক সম্পর্কের সুষ্ঠু বিকাশ।

কেউ সন্দেহ করলে কি করা উচিত?
যেখানে সন্দেহ থাকে সেখানে ভালোবাসা থাকতে পারে না। একজন সন্দেহপ্রবণ ব্যক্তি কখনো মন থেকে ভালোবাসতে পারে না। সঙ্গী যদি সন্দেহপ্রবণ হয় তো জীবন হয়ে ওঠে যন্ত্রণাময়। সঙ্গী অথবা অন্য কেউ যদি সন্দেহ করে তবে কি করা উচিত সে বিষয়ে কিছু পরামর্শ-
১. কেউ যদি আমাদের নিয়ে সন্দেহ করে তাহলে আমরা অনেক সময় রেগে যাই। যে দোষে দোষী নই অথচ কেউ যদি সেই দোষে আমাদের দোষী করে বা সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায় বা কোনো প্রকার নেতিবাচক আচরণ করে তাহলে আমরা সেটি বুঝি এবং রেগে গিয়ে নেতিবাচক আচরণ প্রকাশ করে থাকি। এটি উচিত নয়।
২. কেউ যদি আপনাকে সন্দেহ করে তাহলে কি আপনি সেটি হয়ে গেলেন? কখনোই নয়। কেউ যদি আপনাকে চোর ভেবে সন্দেহ করে তাহলে কি আপনি চোর হয়ে যাবেন? অবশ্যই নয়। যার যা খুশি ভাবুক ওরা, আপনি আপনার পথে সঠিকভাবে চলুন।
৩. যারা আপনাকে সন্দেহের চোখে দেখছে বা সন্দেহ করে অন্যের কাছে আপনার নামে বদনাম বলে বেড়াচ্ছে তাহলে সেই মানুষগুলো থেকে সাবধানে থাকুন। একটি ইতিবাচক দূরত্ব বজায় রেখে চলুন। এ ধরনের মানুষের কথায় মন খারাপ করবেন না। রাগ করবেন না। তার কথায় কান না দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলুন, তাকে পাত্তা না দিয়ে মনকে শক্ত করুন।
৪. বারবার সন্দেহ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে হলে নিজের মতো এক মনে কাজ করে যেতে হবে। মনকে শক্ত করে রুখে দাঁড়াতে হবে। কিছু কিছু সময় শক্ত হতে হয়, সর্তক থাকতে হয়।

৫. কেউ আপনাকে সন্দেহ করলে চুপ করে থাকুন। সময়ের উপর ছেড়ে দিন। বাস্তবে কেউ যখন আপনাকে সন্দেহ করছে তখন সে হয়তো কল্পনা করে সন্দেহ করছে অথবা কেউ তাকে আপনার নামে মিথ্যা অভিযোগ ঢুকিয়ে দিয়েছে সে ক্ষেত্রে আপনার করণীয় হবে বাস্তবে চুপ করে থাকা। এসব পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে চুপ করে থাকলে সময়ের কারণে এই সব অমূলক সন্দেহ এমনি এমনি দূর হয়ে যাবে।
৬. কেউ আপনাকে সন্দেহ করলে সেদিকে না তাকিয়ে বরং নিজেকে ডেভেলপ করে নিন। কারো নেতিবাচক কথায় মন না দিয়ে নিজের কাজের প্রতি মনোযোগ বাড়িয়ে দিন এবং নিজেকে ডেভেলপ করে নেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
৭. যিনি আপনাকে সন্দেহ করছেন তাকে এড়িয়ে চলুন আর নিজে সবসময় আনন্দের মধ্যে থাকতে চেষ্টা করুন। জীবনের সুখ-শান্তি অনুভব করার চেষ্টা করুন। আনন্দে থাকলে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকা যায় তাই অন্যের সন্দেহকে পাত্তা না দিয়ে নিজের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে তুলুন আর আনন্দিত থাকুন। জীবনের জন্য মানসিক শান্তি খুবই জরুরি। অন্যের সন্দেহের জন্য নিজের মানসিক শান্তি নষ্ট করাটা বোকামি।
পরিবারে যদি ওথেলো সিনড্রোমের মতো বিষ ঝামেলা বা সমস্যার সৃষ্টি করে তাহলে সবাই মিলে সুস্থ সুন্দর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এ বিষ শুরুতেই বিনষ্ট করতে হবে। বাঁচিয়ে রাখতে হবে ভালোবাসাপূর্ণ পরিবার। গড়ে তুলতে হবে সুন্দর শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক, চমৎকার পৃথিবী।
লেখক : কবি, গবেষক ও প্রবন্ধকার

 

 

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement