২০ নভেম্বর ২০২৪, ৫ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

শিল্পসাহিত্যের সংস্কার জরুরি

-


বিশে্বর বিভিন্ন দেশে যখন রাষ্ট্রবিপ্লব, যুদ্ধ, স্বাধীনতা আন্দোলন অথবা ব্যাপক সামাজিক রাজনৈতিক পরিবর্তন এসেছে তখন সমান্তরালভাবে অথবা আগে পরে কাছাকাছি সময়ে সাহিত্যে, শিল্পে তার প্রতিফলন দেখা গেছে। ইউরোপীয় রেনেসাঁ, ফরাসি বিপ্লব, রুশ বিপ্লব ও সোভিয়েত গঠন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সব ক্ষেত্রেই নতুন ভাবধারা, সাহিত্যের গতিপথে বাঁক বদল, নতুন সাহিত্য আন্দোলন, আঙ্গিকের পরিবর্তন দেখা গেছে। এসব পরিবর্তনে সব সৃষ্টিই যে কালোত্তীর্ণ হয়েছে তা নয়। তবে এর মধ্য থেকেই বেরিয়ে এসেছে কালোত্তীর্ণ সৃষ্টি।
বাংলাদেশের ইতিহাসেও বাঁক বদলের সাথে সাহিত্যের ধারায় পরিবর্তন এসেছে। সৃষ্টি হয়েছে নতুন রীতি, নতুন ধারা। সেই চর্যাপদ থেকেই দেখা গেছে সামাজিক পরিবর্তন সামাজিক অবস্থা, ব্রাত্যজনের বহমান জীবন ফুটে উঠেছে। চর্যাপদের কবি বলেছেন ‘টালত মোর ঘর নাহি পড়বেসী। হাড়িত ভাত নাহি নিতি আবেশী। বাংলার দারিদ্র্যক্লিষ্ট সাধারণ মানুষের জীবনের চিত্র কি সার্থকভাবেই না তুলে ধরেছেন প্রাচীন কবি।
তেমনি সেন আমলের স্থবিরতা ভেঙে সুলতানি আমলে বাংলার সমাজ জীবনের ব্যাপক রদবদল ধরা পড়ে সাহিত্যে। পুঁথি সাহিত্য, মৈমনসিংহ গীতিকা বাংলাদেশের সমাজজীবনের পরিবর্তনকে রূপায়িত করে। মোগল, নবাবী আমল, ইংরেজ আমল, ১৯৪৭ এর দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ সব কিছুই সাহিত্যে নতুন গতি এনেছে।

২০২৪ এর জুলাই বিপ্লব আমাদের স্বৈরাচার মুক্ত বাংলাদেশ দিয়েছে। এখন দরকার স্বৈরাচারী আমলের চিন্তাভাবনা, পশ্চাৎপদ মানসিকতা, অন্যদেশের মুখাপেক্ষী মনোভাব, ক্ষমতার তোষণ, পদপদবী পুরস্কারের লোভে সাহিত্যের নামে আবর্জনা সৃষ্টি এবং শিল্প-সাহিত্য অঙ্গনের লুটতরাজ, দুর্নীতি থেকে বেরিয়ে এসে নতুন ধারা, নতুন মানসিকতার, নতুন আলোয় উদ্ভাসিত সাহিত্য সৃষ্টি।
বাংলাদেশে সাহিত্যের নামে যে কত রকম অনাচার ও ক্ষমতা তোষণ, দুর্নীতি হয়েছে তা বাংলা একাডেমির দিকে তাকালেই বোঝা যায়। গত ১৫ বছরে রাজনৈতিক দলদাসদের নিকৃষ্ট রচনাকে পুরস্কৃত করা হয়েছে। বাংলা একাডেমি থেকে পদ্মা সেতু বিষয়ে, শেখ হাসিনার জন্মদিন বিষয়ে, শেখ হাসিনাকে নিবেদন করে ছড়া, কবিতার নামে আবর্জনা প্রকাশ করা হয়েছে। বাংলা একাডেমিতে চাকরি করে, রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচার করে, দলীয় গুণ্ডার মতো আচরণ করে, ক্ষমতাসীনদের পদলেহন করে অনেকেই বাগিয়ে নিয়েছেন সাহিত্যের পুরস্কার।
জাতীয় কবিতা পরিষদ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের নামে ক্ষমতার পদলেহন এবং ব্যক্তিগত সুবিধা হাসিলের খেলা চলেছে নগ্নভাবে। শুধু তাই নয়, ভিন্ন দেশের দালাল, চাটুকার ও পঞ্চম বাহিনীতে পরিণত হয়েছেন বাংলাদেশের শিল্প সাহিত্য জগতের কথিত রথী মহারথীরা।
বাংলাদেশের সাহিত্যক্ষেত্রের এসব নষ্টাচার ও ভ্রষ্টাচারের বিশদ বর্ণনা দেয়া এ ক্ষেত্রে অনাবশ্যক। কারণ শিল্প সাহিত্য জগতের অধিকাংশ ব্যক্তিই জানেন কি কী ধরনের অনাচার, লুটতরাজ, সুবিধা গ্রহণ ও দুর্নীতি বিগত বছরগুলোতে সঙ্ঘটিত হয়েছে।

এখন প্রয়োজন এসব আবর্জনা পরিষ্কার করে নতুনভাবে শিল্প সাহিত্য অঙ্গনকে গড়ে তোলা।
জুলাই বিপ্লব যে ছাত্র-জনতার চরম আত্মত্যাগের ফসল সেই চেতনাকে রক্ষা করার জন্য দরকার সাংস্কৃতিক বিপ্লব ও শিল্পসংস্কার।
গণবিপ্লবের পর প্রতিবিপ্লবের একটা আশঙ্কা থেকেই যায়। কারণ দীর্ঘ সময় স্বৈরাচারের শাসনে দেশ থাকলে সেখানে স্বৈরাচারের মদদপুষ্ট ও সুবিধাভোগী একদল দালাল চক্রের সৃষ্টি হয়। জুলাই বিপ্লবে যখন স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার নির্দেশে ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি বর্ষণ হচ্ছিল, যখন এ দেশের তরুণ শিশু-কিশোররা একের পর এক শহীদ হচ্ছিল, মুগ্ধ, শান্ত, আবু সাঈদের মতো তরুণদের রক্তে যখন বাংলার মাটি রঞ্জিত হচ্ছিল তখনও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট এবং দালাল সুবিধাভোগী লেখক কবি, শিল্পীরা স্বৈরচারের সমর্থনে ষড়যন্ত্রে অংশ নেয়। স্বৈরাচারকে মদদ জোগায়। তখনও ফেসবুকে দালালরা একের পর স্ট্যাটাস দিয়ে গেছে। একের পর এক ষড়যন্ত্র করেছে। তারা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। গুজব ছড়িয়েছে। মিডিয়ায় লম্বা চওড়া কথা বলেছে, স্বৈরাচারের সব অনাচারের সমর্থন দিয়েছে। এমনকি গণহত্যায় উসকানি দিয়েছে। তারা ইসলাম ফোবিয়া ছড়ানোর চেষ্টা করেছে। শেখ হাসিনা না থাকলে দেশ রসাতলে যাবে এমন অপপ্রচার চালিয়েছে। তারা দেশে বিদেশে এই আন্দোলনকে খর্ব করা চেষ্টা করেছে। এমনকি এই আন্দোলনকারীরা জয়ী হলে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা বিপদে পড়বে এমন অপপ্রচার চালিয়েছে।

শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পরও তাদের আস্ফালন বন্ধ হয়নি। এখনো তারা দারুণভাবে সক্রিয়। তারা বিভিন্নভাবে জুলাই আন্দোলনকে খাটো করার প্রচেষ্টা চালিয়েছে। তাদের বহুল ব্যবহৃত কথা হলো, তারা নাকি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তি। তারা দেশের জনসাধারণের এই আন্দোলনকে ‘মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে’ দাঁড় করানোর জন্য সব নোংরা খেলা খেলেছে। আওয়ামি স্বৈরাচারের বিরোধিতা মানেই নাকি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা। যেন আওয়ামী লীগই মুক্তিযুদ্ধের সোল এজেন্ট।
তাদের মুখে ‘মুক্তিযুদ্ধ গেল’ ‘একাত্তরের চেতনা’ ভূলুণ্ঠিত হলো, সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত হলো এমন সব বাঁধাবুলি শোনা গেছে। এখনো যাচ্ছে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ কোনো বিশেষ দলের বা কোনো বিশেষ ব্যক্তির রাজনৈতিক এজেন্ডা ছিল না। এটি ছিল গণমানুষের লড়াই। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় আওয়ামী লীগের একদল দালাল ও সুবিধাবাদী মানুষ যখন কলকাতায় গিয়ে হাওয়া খাচ্ছিল সে সময় দেশের ভেতরে থাকা সাধারণ মানুষই কিন্তু যুদ্ধটাকে চালিয়ে নিয়ে গেছে। মুক্তিযোদ্ধারাও সবাই কিন্তু আওয়ামী লীগের কর্মী ছিল না। বরং মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকাংশই ছিল সাধারণ কৃষক, ছাত্র, জনতা। শহীদও হয়েছে সাধারণ মানুষই বেশি।
অথচ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আওয়ামী লীগের কিছু ব্যবসায়ী ও ধান্ধাবাজ লোকই সুবিধা গ্রহণ করেছে। নেপোয় দই খেয়ে গেছে। আর সাধারণ মানুষ যুদ্ধের ক্ষতচিহ্ন বুকে নিয়ে সংগ্রাম করেছে।

২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবের পর মানুষের সামনে আসছে আওয়ামী লীগের রাঘব বোয়ালদের একের পর এক দুর্নীতির ঘটনা।
কিন্তু স্বৈরাচারের দোসররা এখনো গুজব ছড়াতে এবং জল ঘোলা করতে ব্যস্ত। এসব প্রতিহত করার জন্য দরকার সাংস্কৃতিক বিপ্লব, সাংস্কৃতিক পরিশোধন।
জুলাই বিপ্লবের চেতনা হলো বৈষম্যহীন, দুর্নীতিমুক্ত, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়ার চেতনা। জুলাই বিপ্লবের চেতনা হলো আধুনিক, উন্নত বাংলাদেশ গড়ার চেতনা। সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার চেতনা। গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখার চেতনা। স্বৈরাচারকে প্রতিহত করার চেতনা। গত ১৫ বছরে জাতিকে বিভক্ত করার যে অপকৌশল অবলম্বন করা হয়েছে তা থেকে মুক্ত হয়ে ইনক্লুসিভ জাতি গঠনের চেতনা । এই চেতনাকে ধারণ করে এখন সাংস্কৃতিক বিপ্লব শুরু করতে হবে। আমরা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। আমরা সবাই এ দেশের মানুষ। বাঙালি, পাহাড়ি, মুসলমান হিন্দু, বৌদ্ধ খ্রিষ্টান সবাই মিলেই আমরা বাংলাদেশের নাগরিক বাংলাদেশী। আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে, নিজস্ব শিল্প ও জীবনাচার রয়েছে। বাংলাদেশের এই নিজস্ব সংস্কৃতিকে ধারণ করে আমাদের শিল্প সাহিত্যকে এগিয়ে যেতে হবে।

বিদেশী অপসংস্কৃতির আগ্রাসন থেকে আমাদের নিজস্ব শিল্প সাহিত্যকে রক্ষা করে তাকে সমুন্নত করতে হবে। নিজের পরিচয়ে বিশে^ মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে।
আমরা অন্য কোনো দেশের বাহবা পাওয়ার জন্য তাদের অনুকরণ করে পরজীবী হয়ে বাঁচতে চাই না। আমরা অন্য কোনো দেশের ও সংস্কৃতির ধ্বজাধারীও হতে চাই না। বাংলার নিজস্ব শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির সম্পদ রয়েছে। এই শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির কথা আমাদের নিজস্ব ইতিহাস ঐতিহ্যের কথা আমাদের সম্পদের কথা, শক্তির কথা আমাদের সাহিত্যে প্রতিফলিত করাই সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রধান কাজ।
পাশাপাশি আমাদের শিল্প সাহিত্যের প্রতিষ্ঠানগুলোকে দালালমুক্ত, চাটুকারমুক্ত করা প্রয়োজন। বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি ও শিশু একাডেমিকে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা প্রয়োজন। এতে মন্ত্রণালয়ের ছোট বড় আমলাদের সামনে জি হুজুর করার নষ্ট ধারা থেকে আমরা মুক্তি পাব। এসব প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ফান্ড দরকার, পরিচালনা পরিষদ দরকার। তাহলে বছরে বছরে দলীয় মুখপত্রের ভূমিকা পালন আর চাটুকারিতার আবর্জনা মার্কা বই প্রকাশের ঘৃণ্য ধারা থেকে আমরা মুক্ত হতে পারব।
দরকার আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য, সংস্কৃতি বিষয়ে গভীর গবেষণা চালিয়ে যাওয়া। আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে তুলে ধরা। দরকার দাস মানসিকতার অবসান।
নতুনভাবে বাংলাদেশকে দুর্নীতিমুক্তভাবে গড়ে তুলতে হবে। আর সেজন্যই চাই আমাদের একান্ত নিজস্ব জাতীয় সংস্কৃতির চর্চা।

 

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement
আদানির বিদ্যুৎ নিয়ে অনুসন্ধান কমিটির নির্দেশ হাইকোর্টের ভারতকে অবশ্যই ফিরিয়ে দিতে হবে হাসিনাকে নির্বাচন বিলম্বিত করার শঙ্কা বাড়ছে বিএনপিতে নর্থ মেসিডোনিয়ায় ২০ হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থানের সুযোগ খুঁড়িয়ে চললেও কোনো ব্যাংক বন্ধ হবে না : অর্থ উপদেষ্টা মানবসম্পদ উন্নয়নে কাঠামোগত সংস্কার ও জাতীয় উদ্যোগ জরুরি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত ছাড়া সংস্কার কাজে লাগবে না : তারেক অতি প্রয়োজনীয় সংস্কার করে দ্রুত নির্বাচন দেয়া হবে : আইন উপদেষ্টা বাতিল কারিকুলামে ৮২৮ কোটি টাকার নিষ্ফল প্রশিক্ষণ প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ রোহিঙ্গাবিষয়ক প্রতিনিধি হলেন খলিলুর রহমান সশস্ত্রবাহিনী দিবস কাল

সকল