তমালদের কাক
- জহির টিয়া
- ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
অভাব-অনটনের সংসারে হঠাৎ করেই মারা গেলেন তমালের বাবা। বাবাকে হারিয়ে আরো টানাপড়েন শুরু হয়ে গেল। নুন আনতে পান্তা ফুরানো অবস্থা। তিন ভাইবোনের মধ্যে তমাল বড়। বয়স ১০ ছুঁইছুঁই। ওদের বাড়ির আশপাশে যেটুকু পতিত জায়গা ছিল; তাতে শাক-সবজির চাষ শুরু করলেন তার মা রোকেয়া। মা রোকেয়া ও তমাল নিড়ানী দেয়। পানি দেয়। আশপাশ হতে গোবর সংগ্রহ করে গাছের গোড়ায় দেয়।
এর মধ্যে হঠাৎ করে এক দোকানে তমালকে রাখার জন্য প্রস্তাব এলো। চা, সিঙ্গাড়া, পুরির দোকান। তমালের মা প্রথমে না করলেও পরে রাজি হলেন। তমাল কাক ডাকা ভোর হতে শুরু করে রাত ৯-১০টা পর্যন্ত কাজ করে। মাঝখানে শুধু দুপুরের খাবার খেতে বাড়ি আসে। প্রতিদিন দুপুরের খাবারে কোনো না কোনো প্রকারের শাক থাকত। যা আশপাশে হতে সংগ্রহ করতেন মা রোকেয়া। মাঝে মধ্যে বেগুন, আলু বা অন্য সবজি থাকলেও তা ছিল অতি নগণ্য। বাবা মারা যাওয়ার পর, কোনোদিন তমালেরা মাছ-গোশত গন্ধ শুঁকে দেখতে পারেনি। তাই প্রতিদিন একই খাবার খেয়ে খেয়ে একঘেয়েমি চলে আসত।
একদিন দুপুরে গিয়ে তমাল দেখল, ছোট ভাই রোহান কান্নাকাটি করছে। সে তমালের বছর তিনেকের ছোট। রোহান মাছ দিয়ে ভাত খেতে চায়। তাই কান্না করছে। হয়তো পাশের বাড়ির কাউকে খেতে দেখেছে। তার কান্নার সময় একটি কাক তমালদের বারান্দার চালের ওপর উড়ে এসে বসল। কাকটি বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকল। এরপর কা কা করে যেন কিছু বলতে চাইল। তমালের মা ঘর হতে বাইরে এলেন। কাকটি মায়ের দিকে অপলক দৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। কাকের দিকে একমুঠো ভাত ছিটিয়ে দিলেন। কাকটি নিচে নেমে ভাতগুলো ঠিকরে ঠিকরে খেয়ে নিলো। কাকটি আবার উড়ে গিয়ে বারান্দার চালে বসল। তমালের মা বলতে লাগলেন, তোর ছোট ভাই মাছ দিয়ে ভাত খেতে চায়। কিন্তু মাছ কোথায় পাবো! এই বলেই মা রোকেয়া একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
মা রোকেয়ার কথা শেষ হতেই কাকটি উড়ে চলে গেল। তমাল মাকে কোনো উত্তর দিলো না। কারণ, না আছে তমালের কাছে টাকা। না আছে কাছাকাছি নদী-নালা। দোকানে কাজ নেয়া এখনো মাস জুটেনি। তাই মালিকের কাছে টাকাও চাইতে পারে না। তাছাড়া তমালের মালিকের সাথে কোনো চুক্তি নেই। যা করার তার মা-ই করবেন। তমাল খাওয়া শেষ করে ছোট বোন রুপাকে একটু আদর করে বেরিয়ে পড়ল।
রাত ১০টায় বাড়ি এলো তমাল। তার মা রোকেয়া তখনো জেগে আছেন। তমাল না আসা পর্যন্ত জেগে থাকেন। তমালকে ভাত বেড়ে দেন। ভাতের থালায় শাকের পাশাপাশি কয়েকটি পুঁটি, খোলসে ও ছোট মাছের ঝোল দিলেন মা। কতদিন পরে আঁইশের গন্ধ! তমাল মাকে জিজ্ঞেস করতেই বললেন, আগে খেয়ে নে। পরে বলছি।
খাওয়া শেষে তমাল ঘুমিয়ে পড়ল। মায়ের কাছে আর জানা হলো না। মা-ও মাছের ব্যাপারে আর কিছুই বললেন না। যেহেতু তমাল রোজ কাক ডাকা ভোরে দোকানে যায়। রাতে বাড়ি ফিরে। সারা দিনের ক্লান্তিতে বাড়ি এসে খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ে।
কয়েক দিন পরের ঘটনা। দুপুরের খাবারে ভাত ও গোশত! সাথে তো শাক ছিলই। এবার তমাল খুবই অবাক হলো। খেতে খেতে মাকে জিজ্ঞেস করল, মা, গোশত কোথায় পেলে? মালিক কি টাকা দিয়েছে?
না রে বাপ। মালিক টাকা দেয়নি।
তাহলে গোশত কোথায় পেলে? তাও গরুর গোশত!
খাওয়া শেষ করো। খেতে খেতে কথা বলতে হয় না।
মায়ের কথায় চুপচাপ খাওয়া শেষ করল তমাল। এরপর মাকে ঝাপটে ধরে জানতে চাইল, সেদিন যে মাছ দিয়ে ভাত খেয়েছিলাম আর আজকে গোশত দিয়ে ভাত খাইলাম। তা কোথায় পেলে?
তমালের মা মৃদু হেসে বললেন, তোর কাক ভাই এনে দিয়েছে।
মায়ের কথার আগামাথা কিছুই বুঝল না তমাল। এবার রীতিমতো বিস্ময় চোখেমুখে ঝরে পড়ল। চোখজোড়া বড়সড় করে জানতে চাইল, বলছ কী মা! কাক নামে কী আমার কোনো ভাই আছে? তাছাড়া মানুষের নাম কি কাক হয়?
হয়, হয়। দ্যাখ বাপ, তোর অনেক মানুষ ভাই আছে। কিন্তু কেউ পাশে এসে তোদের খোঁজখবর নেয়? নেয় না। কিন্তু নিয়মিত তোর কাক ভাই আমাদের কাছে আসে। সেই কাক ভাই তোদের জন্য মাছ ও গোশতের ব্যবস্থা করেছে। বলতে বলতে মা রোকেয়ার চোখজোড়া ছলছল করে উঠল।
এ তুমি কী কথা শোনালে মা!
হ্যাঁরে বাপধন। যা সত্যি তাই তোরে বলছি।
কেমনে কী বলো তো?
তুই তখন অনেক ছোট। বছর দুয়েকের মতো। তখন তোর নানার বাড়ি হতে তোকে কোলে করে বাড়ি ফিরছিলাম। পথের মাঝে এক গাছের নিচে একটি পাখির বাচ্চা চিঁ চিঁ শব্দে কাঁদছিল। আশপাশে কোনো পাখি দেখতে না পেয়ে বাচ্চাটি বাড়ি নিয়ে আসি। তাকে ভাত পানি খাইতে দিলাম। নিজে নিজে খেতে পারত না। তাই আমি নিজে তার দুই ঠোঁট ফাঁক করে খাইয়ে দিতাম। কয়েক দিন যেতেই বাচ্চাটির লোম বের হতে লাগল। তখন বুঝতে পারলাম এটি কাকের বাচ্চা। সেই হতে আজ-অবধি কাকটি আমাকে ছেড়ে যায়নি। দিনে দু’-একবার আসে দেখা করতে। তাকে কিছু না কিছু খেতে দিই। আমি কিছু বললে সে আমার কথা বুঝতে পারে। সেদিন রোহান কাঁদছিল। তখন কাকটির সামনে রোহানের কান্নার কথা বলতেই সে মাছ এনে দিয়েছিল। আর আজকে আবার গোশত এনে দিলো।
মা রোকেয়া একটানা বলে গেলেন। আর তমাল অবাক হয়ে শুনল। কিন্তু মা, কাকটি মাছ ও গোশত কীভাবে আনল?
কাক নাকি তার বন্ধু বকের কাছে হতে মাছ নিয়ে এসেছিল। বক মাছ ধরে দিত। আর কাক পলিথিনে ভরে নিয়ে রাখত।
আর গোশত?
সেটি নাকি সে নিজেই বাজারের বিভিন্ন কসাইখানা হতে একটু আধটু করে সংগ্রহ করেছে। তাকে আমি মানা করেছি। তবুও সে বলে মাঝে মধ্যে এভাবেই তোদের মাছ-গোশত খাওয়াবে।
এদিকে দোকানে যাওয়ার সময় হয়ে যাওয়ায়, তমাল মায়ের সাথে আর কথা বাড়াল না। মায়ের দিকে তাকিয়ে তমাল শুধু বলল, তাহলে মা তুমি কাক পোষো!
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা