১৪ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

কোন পথে বাংলাদেশের অর্থনীতি?

রাজনীতি ঠিক না হলে আর্থিক খাতের সংস্কারগুলো টেকসই হবে না
-


বিগত সরকারের দেয়া তথ্য, বক্তব্য ও পরিসংখ্যানে বক্তব্যে দেশের অর্থনীতির সঠিক চিত্র দেখা যায়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে বিগত সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর গঠিত অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার দেশের অর্থনীতির প্রকৃত চিত্র জানতে একটি শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করেছে। এর মাধ্যমে বর্তমান সরকার উপলব্ধি করবে, কী ধরনের উত্তরাধিকারের অর্থনীতিতে তাদের কাজ করতে হবে। সেই ভিত্তিভূমি নিরূপণ করাই কমিটির কাজ। নব্বই দিনের মধ্যে এটি সরকারকে জমা দেয়ার কথা বলা হয়েছে প্রজ্ঞাপনে। শ্বেতপত্রে দেশের বিদ্যমান অর্থনীতির সামগ্রিক চিত্র থাকার পাশাপাশি অর্থনৈতিক বিষয়ে সরকারের কৌশলগত পদক্ষেপ, জাতিসঙ্ঘের টেকসই অভীষ্ট (এসডিজি) বাস্তবায়ন ও বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে করণীয় বিষয়ের প্রতিফলন থাকবে। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি ৯০ দিনের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করবে। শ্বেতপত্রের ধারণাটি এসেছে যুক্তরাজ্যের সংসদীয় ব্যবস্থা থেকে। সরকারের দ্বারা প্রকাশিত কোনো নীতিগত নথি যেখানে সংসদীয় প্রস্তাবনা থাকে, সেগুলোই শ্বেতপত্র, যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের ওয়েবসাইটে এভাবেই শ্বেতপত্রের বর্ণনা দেয়া আছে। এর ফলে অধিকতর আলাপ-আলোচনার সুযোগ তৈরি হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর ব্রিটেনে পার্লামেন্ট রিপোর্টের প্রচ্ছদ থাকত নীল রঙের। যদি রিপোর্টের বিষয়বস্তু সরকারের জন্য কম গুরুত্বপূর্ণ হতো নীল প্রচ্ছদ বাদ দিয়ে সাদা প্রচ্ছদেই সেগুলো প্রকাশ করা হতো। সেই রিপোর্টগুলোকে বলা হতো হোয়াইট পেপারস। এ প্রথা কোনো প্রস্তাবিত নীতি বা জনস্বার্থ সম্পর্কিত সমস্যার সাথে যুক্ত নয়; বরং কোনো রাজনৈতিক দলের সরকার পরিচালনার পরবর্তী সময়ে অন্য কোনো রাজনৈতিক দল কর্তৃক শাসক দলের কুকীর্তির দলিল হিসেবে শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হয়। যদিও এবারেরটি দুর্নীতি ধরার কমিটি নয়। দুর্নীতি কেন হয়েছে এবং মাত্রাটা কী, সেটি বলবে এই কমিটি। কিন্তু কে দুর্নীতি করেছে, কেন করেছে সেটা বলা তদের দায়িত্ব নয়, এর জন্য সরকারের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান আছে। বাংলাদেশে শ্বেতপত্র প্রকাশের ঘটনা এবারই প্রথম নয়।

সাত বছরে দ্বিগুণ হয়েছে বাংলাদেশের ঋণ। জানা যায়, ২০২৩ সালের শেষ প্রান্তিকে বাংলাদেশের সার্বিক ঋণ ১০০.৬৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়। এর মধ্যে ৮০ ভাগই সরকারের ঋণ। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তাদের সময়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক দায় নিয়ে কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়েছে , শেখ হাসিনার সরকার ঋণ রেখে গেছে ১৮ লাখ কোটি টাকা। বিগত বছরগুলোতে মূল্যস্ফীতি, অর্থ পাচার, ব্যাংক ও আর্থিক খাতের অবস্থাসহ বিভিন্ন প্রকল্পের দুর্নীতি সংবাদের শিরোনাম হয়েছে। অন্তর্র্বর্তী সরকার উত্তরাধিকারসূত্রে কেমন অর্থনৈতিক অবস্থা পেল সেটি বুঝতে অর্থনীতির একটা ‘হেলথ চেকআপ’। শ্বেতপত্র প্রণয়ন বর্তমানে অর্থনীতি কোন অবস্থায় আছে, উত্তরাধিকারসূত্রে কী পাওয়া গেছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কিভাবে চলছে সেগুলোকে চিত্রায়িত করার কাজটাই করবে। এটি স্বাস্থ্য পরীক্ষার মতো। এ ছাড়া ‘মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষাও করা হবে। পলিসি বা নীতিগত দিকটা কীভাবে চলছে, সেই পর্যালোচনাও থাকবে শ্বেতপত্রে। তারা ব্যাংক ও আর্থিক খাতের পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন করবেন না। তারল্য সঙ্কট, নামে-বেনামের ঋণ, সঞ্চিতি ঘাটতি এসব বিষয়ে পর্যালোচনা করা হবে। আর যেন টাকা পাচার না হয়, টাকা পাচার করলে শাস্তি পেতে হবে, এমন কথা বলা থাকবে শ্বেতপত্রে। গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে আকৃতি ও প্রভাব বিবেচনায় বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্পও রয়েছে। কোনো কোনো মেগা প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে, কোনোটির কাজ চলমান। আওয়ামী লীগ সরকার তাদের অর্জন হিসেবে এসব মেগা প্রকল্পের কথা বেশ জোরেশোরেই প্রচার করে আসছিল। তবে পদ্মা সেতুসহ মেগা প্রকল্পগুলোতে ব্যাপক দুর্নীতি অভিযোগ করে আসছে সরকার বিরোধীরা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি নিয়ে আলোচনার স্বার্থে প্রকল্প নিয়ে কাজ করবে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি। সময় স্বল্পতার কারণে সব প্রকল্প বিশ্লেষণ করবে না। তবে তারা মেগা প্রজেক্ট নিয়ে আলোচনা করবে। মেগা প্রজেক্ট নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে যদি কোনো একটি বিশেষ প্রজেক্টের ওপর মনোযোগ দিতে হয় তারা সেটা করবেন।

এবার কি তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতির ‘সত্যিকার চিত্রটি’ দেখা যাবে? এবারের শ্বেতপত্রটি দুর্নীতি ধরার জন্য নয় বলা হয়েছে। দুর্নীতি কেন হয়েছে এবং মাত্রাটা কী, সেটি বলবে এই কমিটি। কিন্তু কে দুর্নীতি করেছে, কেন করেছে সেটি বলা তাদের দায়িত্ব নয়, এর জন্য সরকারের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান আছে। বাংলাদেশে শ্বেতপত্র প্রকাশের ঘটনা এবারই প্রথম নয়। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তাদের সময়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক দায় নিয়ে কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার সরকার ঋণ রেখে গেছে ১৮ লাখ কোটি টাকা। বিগত বছরগুলোতে মূল্যস্ফীতি, অর্থ পাচার, ব্যাংক ও আর্থিক খাতের অবস্থাসহ বিভিন্ন প্রকল্পের দুর্নীতি সংবাদের শিরোনাম হয়েছে। অন্তর্র্বর্তী সরকার উত্তরাধিকার সূত্রে কেমন অর্থনৈতিক অবস্থা পেল সেটি বুঝতে অর্থনীতির একটা হেলথ চেকআপ। শ্বেতপত্র প্রণয়ন বর্তমানে অর্থনীতি কোন অবস্থায় আছে, উত্তরাধিকারসূত্রে কী পাওয়া গেছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কিভাবে চলছে সেগুলোকে চিত্রায়িত করার কাজটাই করবে। এটি স্বাস্থ্য পরীক্ষার মতো। এ ছাড়া মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষাও করা হবে। পলিসি বা নীতিগত দিকটা কিভাবে চলছে, সেই পর্যালোচনাও থাকবে শ্বেতপত্রে। তারা ব্যাংক ও আর্থিক খাতের পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন করবেন না। তারল্য সঙ্কট, নামে-বেনামের ঋণ, সঞ্চিতি ঘাটতি এসব বিষয়ে পর্যালোচনা করা হবে। আর যেন টাকা পাচার না হয়, টাকা পাচার করলে শাস্তি পেতে হবে, এমন কথা বলা থাকবে শ্বেতপত্রে। গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে আকৃতি ও প্রভাব বিবেচনায় বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্পও রয়েছে। কোনো কোনো মেগা প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে, কোনোটির কাজ চলমান। আওয়ামী লীগ সরকার তাদের অর্জন হিসেবে এসব মেগা প্রকল্পের কথা বেশ জোরেশোরেই প্রচার করে আসছিল।

তবে, পদ্মা সেতুসহ মেগা প্রকল্পগুলোতে ব্যাপক দুর্নীতি অভিযোগ করে আসছে সরকার বিরোধীরা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি নিয়ে আলোচনার স্বার্থে প্রকল্প নিয়ে কাজ করবে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি। সময় স্বল্পতার কারণে সব প্রকল্প বিশ্লেষণ করবে না। তবে তারা মেগা প্রজেক্ট নিয়ে আলোচনা করবে। মেগা প্রজেক্ট নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে যদি কোনো একটি বিশেষ প্রজেক্টের ওপর মনোযোগ দিতে হয় তারা সেটা করবেন। কয়েক মাস আগে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম দশ মাসের রফতানি আয়ের হিসেবে বড় ধরনের অসামাঞ্জস্য ধরা পড়ে। রফতানির বার্ষিক হিসেবে প্রকৃত পরিমাণের চেয়ে ১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বেশি দেখানোর ঘটনা বিভিন্ন মহলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। সরকারি সংস্থাগুলো পরিসংখ্যান নিয়ে অর্থনীতিবিদদের বিভিন্ন সময় সংশয় প্রকাশ করতেও দেখা গেছে। ফলে তাদের দেয়া তথ্য-উপাত্তের ওপর ভর করে পাওয়া চিত্র কতটা সঠিক হবে তা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়; যা তথ্য পাওয়া গেছে, অর্থাৎ বিবিএস (পরিসংখ্যান ব্যুরো), ইপিবি এবং অন্য সংস্থাগুলোর কাছে যা আছে তার ভিত্তিতে অর্থনীতির একটা বস্তুনিষ্ঠ চিত্রায়ন এখানে আশা করা যেতে পারে। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটিতে অর্থনীতিবিদ ছাড়াও জ্বালানি, অভিবাসন, উন্নয়ন ও সুশাসনের মতো বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞ রয়েছেন।

নীতি বিশ্লেষক বা বিষয় বিশেষজ্ঞ হিসেবে কমিটির সদস্যরা তাদের মতামত দেবেন। আগামী দুই মাসের মধ্যেই কার্যক্রম গুছিয়ে আনা হবে। খাতওয়ারি যেমন জ্বালানি, প্রাতিষ্ঠানিক, ব্যাংক, রাজস্ব খাত, অর্থপাচার, বৈষম্য ও দারিদ্র্যবিমোচনসহ বিভিন্ন বিষয় সদস্যদের মধ্যে ভাগ করা হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা নিয়ে শ্বেতপত্র তৈরির দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিটি জ্বালানি খাতসহ বিগত বছরগুলোতে হওয়া বৈদেশিক ঋণ চুক্তিগুলো খতিয়ে দেখা হবে। বিগত বছরগুলোতে বিদেশী ঋণসংক্রান্ত চুক্তিগুলো যদি পাওয়া যায় তাহলে তা খতিয়ে দেখে অবশ্যই তারা মূল্যায়ন করবেন তারা । কোন সদস্য কী বিষয়ে দায়িত্ব পালন করবেন, ঠিক করা হয়েছে। ইস্যুগুলো নিয়ে তারা ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে ও বিদেশেও যারা বিশেষজ্ঞ আছেন তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন। দেশের উন্নয়নে ১০ খাতে শ্বেতপত্র কমিটি কাজ করবে। শ্বেতপত্র কমিটি কোন কোন বিষয়ে মনোযোগ দেবে তা চিহ্নিত করা হয়েছে। সেগুলো হলো সাধারণ অর্থনীতি, সামষ্টিক অর্থনীতি, ব্যাংকিং খাত, মেগা প্রকল্প, কর আহরণ, পাচার হওয়া অর্থ, বৈষম্য, দারিদ্র্যবিমোচনসহ শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাত নিয়ে কাজ করবে শ্বেতপত্র কমিটি। তথ্যগুলো আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে তুলনা করে যাচাই করা হবে। ১২ সদস্যের শ্বেতপত্র কমিটি যাদের নিয়ে গঠিত হয়েছে, তাদের মধ্যে দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসহ বিগত সরকারের রেখে যাওয়া সামগ্রিক অর্থনীতির শ্বেতপত্র তৈরির কাজকর্ম শুরু করেছে। কমিটির কাজের পরিধি হবে নির্দেশনামূলক; বাধ্যতামূলক নয়।

সময়ে সময়ে পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে তথ্যের সঠিকতা যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে এবং সবার মতামত ও পছন্দ-অপছন্দকে গুরুত্ব দিয়ে গঠিত কমিটি কাজ করবে। দেশের বিদ্যমান অর্থনীতির সামগ্রিক চিত্র রাখার পাশাপাশি অর্থনৈতিক বিষয়ে সরকারের কৌশলগত পদক্ষেপ, জাতিসঙ্ঘের টেকসই অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়ন ও স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে করণীয় বিষয়ের প্রতিফলন তুলে ধরা হবে এই শ্বেতপত্রে। অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর একটা শ্বেতপত্র তৈরি করা দরকার। শ্বেতপত্র তৈরি করলে স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যাবে। এ মুহূর্তে অর্থনীতিতে যে জটিল পরিস্থিতি রয়েছে, তা জানার জন্য এবং পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য যা হবে একটি নির্দেশিকা। শ্বেতপত্রের অনেক সুবিধা আছে। নতুন সরকার কোন অবস্থায় অর্থনীতিকে পেল, তার জন্য একটি গ্রহণযোগ্য মূল্যায়ন তাদের যেমন দরকার, ইতিহাসের জন্যও দরকার। শ্বেতপত্র তৈরির ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করার পাশাপাশি মূল অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। আলোচনার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নীতি পর্যালোচনা ও দিকনির্দেশনার ক্ষেত্রে একটি গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের সৃষ্টি হবে। নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে যা এক ধরনের গণতান্ত্রিক ভিত্তি দেবে। কোনো কারণে সরকার যদি না করে তাহলে পেশাজীবী নাগরিক সম্প্রদায়ের এগিয়ে আসতে হবে। তাই শ্বেতপত্র তৈরি করা জরুরি।

শ্বেতপত্রের অনেক সুবিধা আছে। নতুন সরকার কোন অবস্থায় অর্থনীতিকে পেল, তার জন্য একটি গ্রহণযোগ্য মূল্যায়ন তাদের যেমন দরকার, ইতিহাসের জন্যও দরকার। শ্বেতপত্র তৈরির ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করার পাশাপাশি মূল অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। আলোচনার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নীতি পর্যালোচনা ও দিকনির্দেশনার ক্ষেত্রে একটি গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের সৃষ্টি হবে। নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে যা এক ধরনের গণতান্ত্রিক ভিত্তি দেবে। কোনো কারণে সরকার যদি না করে তাহলে পেশাজীবী নাগরিক সম্প্রদায়ের এগিয়ে আসতে হবে। তাই শ্বেতপত্র তৈরি করা জরুরি। শ্বেতপত্র তৈরি করতে হলে অবশ্যই সরকারকে একটি কাঠামো দিতে হবে। কাঠামোর সঙ্গে সরকারের আর্থিক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে যুক্ত করতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠান অবস্থানপত্র তৈরি করবে। যেমন- ইতোমধ্যে দায়দেনা পরিস্থিতি নিয়ে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের অবস্থানপত্র রয়েছে। একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও সংস্থার অবস্থানপত্র লাগবে। পাশাপাশি অংশীজনের মতামত নিতে হবে। এখানে বেসরকারি খাত, বিদেশী বিনিয়োগকারী ও উন্নয়ন সহযোগীদের আনতে হবে। ব্যক্তি খাতের বড় ও মাঝারিদের পাশাপাশি ছোট উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের মতামত নিতে হবে। শ্বেতপত্র তৈরিতে এক মাসের বেশি সময় নেয়া উচিত হবে না। অনেক কিছুই নির্ভর করবে সরকারের মেয়াদকালের ওপর।

মেয়াদকাল যাই হোক না কেন, স্বল্প সময়ের মধ্যে একটি ডাটা কমিশন করতে পারে। তথ্য-উপাত্তের ক্ষেত্রে যেসব ব্যত্যয় হয়েছে এবং ঘাটতি আছে বা যে ক্ষেত্রে নতুন প্রয়োজন দেখা দিয়েছে- সেই জায়গাটা পরিষ্কার করবে। তথ্যের উৎপাদক, ব্যবহারকারী ও মূল্যায়নকারী- এই তিন পক্ষকে এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। সরকারি তথ্য-উপাত্ত সুরক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তথ্য-উপাত্ত প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীনভাবে পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ করে দিতে হবে। পাশাপাশি সাংবিধানিক সুরক্ষা দিতে হবে। ব্যাংকিং এবং জ্বালানি- এ দু’টি খাত অর্থনীতির ফুসফুসের মতো কাজ করে। ব্যাংকিং কমিশন তৈরি করা দরকার। কিন্তু এর পরিধি কী হবে- তা সরকারের সময়কাল ও সামর্থ্যরে ওপর নির্ভর করবে। যে সময় পর্যন্ত সরকার থাকবে, তার মধ্যে ব্যাংকিং খাতের রোগ নির্ণয় করার সময় পাবে নাকি পথ্য দেয়া ও চিকিৎসা করার সময় পাবে এবং ফলাফল পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে পারবে- তা আমরা জানি না। কিন্তু একটি কমিশন হওয়া উচিত।

ব্যাংকিং খাতে তথ্য-উপাত্তের সঠিকতা যাচাই করা হবে এর প্রথম কাজ। খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ নির্ধারণ করা হবে বড় কাজ। প্রভিশন ঘাটতি ও মূলধন পর্যাপ্ততার মতো বিষয়গুলোকে স্বচ্ছতার সঙ্গে যাচাই করতে হবে। ব্যাংক কোম্পানি আইনে মালিকদের প্রতিনিধিত্ব এবং সময়কাল পর্যালোচনা করে বর্তমানের শিথিল অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য আমানতকারীদের স্বার্থ বিঘ্নিত না করে একটি বাস্তবসম্মত ‘এক্সিট পলিসি’ করতে হবে। ঋণ অবলোপনের নিয়ম পর্যালোচনা করতে হবে। ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ হতে হবে স্বচ্ছতা ও পেশাদারিত্বের ভিত্তিতে। যেসব শক্তিশালী শিল্পগোষ্ঠী বা রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে সুবিধাপ্রাপ্ত গোষ্ঠী ব্যাংকের মালিকানায় রয়েছে, তাদের মালিকানার প্রশ্নটি স্বচ্ছতার সঙ্গে সুরাহা করতে হবে। এটি খুবই জটিল রাজনৈতিক অর্থনীতির বিষয়। করপোরেট সুশাসনে বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে, যার সঙ্গে মালিকানা ও ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত। সরকারি ব্যাংক তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে দিতে হবে। অভিজ্ঞ, বিজ্ঞ ও পেশাদারদের সমন্বয়ে একটা ‘ব্লু রিবন’ কমিটি করা যেতে পারে, যারা ব্যাংকে পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী নিয়োগের সুপারিশ অনুমোদন দেবে। ব্যাংকের পাশাপাশি এ ধরনের কমিটি দুদক, নির্বাচন কমিশন ও মানবাধিকার কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে হতে পারে। এতে রাজনৈতিক অনুগ্রহে নিয়োগের চর্চা বন্ধ হবে। জ্বালানি খাতের জন্য একটা টাস্কফোর্স করতে হবে। ২৩ থেকে ২৪ হাজার মেগাওয়াটের সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ১২ থেকে ১৩ হাজার মেগাওয়াট কেন উৎপাদন করতে হচ্ছে এবং একই সঙ্গে আমদানি করতে হচ্ছে- টাস্কফোর্স তার ওপর প্রাথমিক একটা প্রতিবেদন দিতে পারে। রেন্টাল, কুইক রেন্টাল ও দায়মুক্তির বিষয়গুলোও সেখানে আসবে।

ব্যাংকিং খাত অর্থনীতির প্রাণ। দেশের আর্থিক খাত খুব একটা বড় নয়, পুঁজিবাজার দুর্বল, ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক খাতও শক্তিশালী নয়; সে কারণে অর্থের ৯০ শতাংশই ব্যাংক খাত থেকে আসে। স্বাধীনতার পর দেশের উদ্যোক্তা শ্রেণী তৈরি করেছে এই ব্যাংক খাত। কিন্তু এই খাত ধীরে ধীরে দুর্বল হয়েছে। অর্থনীতিতে নতুন সরকারের নানা চ্যালেঞ্জ আছে। এগুলোকে সরকার চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেছে । সরকার শক্ত হাতে এসব বিষয়ে পদক্ষেপ নিচ্ছে, অর্থনীতিতে স্বস্তি ফেরানোর বিষয়টি তার ওপর নির্ভর করছে। দেশের মানুষের নৈতিক মানের অবক্ষয় হয়েছে, মূল্যবোধও কমে গেছে। ব্যাংকিং খাতের লোকজনদের মধ্যে এটি প্রকট। খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, ব্যাংকিং খাতে চার ধরনের সমস্যা আছে। প্রথমত, প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা। সেটা হলো ব্যাংকিং খাতের যেসব নীতিমালা আছে, সেগুলো যথাযথভাবে পরিপালন করা হয় না। ক্যামেলস রেটিং অনুসারে ব্যাংকের স্বাস্থ্য পরিমাপের যেসব সূচক, যেমন মূলধন পর্যাপ্ততা, তারল্য, খেলাপি ঋণ, সম্পদ, ব্যবস্থাপনা, এসব ক্ষেত্রে নীতিমালা পরিপালিত হয় না। যদিও আলোচনা কেবল খেলাপি ঋণের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ২০০৮ সালে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা; ২০২৪ সালের জুন মাসে তা বেড়ে দাঁড়ায় দুই লাখ ১১ হাজার কোটি টাকায়। মূলধনের পর্যাপ্ততা আরেকটি বড় সমস্যা। আন্তর্জাতিক নীতিমালা বা ব্যাসেল অনুযায়ী যে পরিমাণ মূলধন থাকার কথা, তা কিন্তু সবাই মানতে পারে না। বিশেষ করে ১০-১২টি ব্যাংকের এই মূলধন অপর্যাপ্ততা আছে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা। আইনে যথেষ্ট স্বাধীনতা থাকলেও বাস্তবে তা অতটা পরিপালিত হয় না। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে সেই স্বাধীনতা প্রয়োগ করা বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে সম্ভব নয়। গভর্নর নীতিপরায়ণ হলে তার আয়ত্তের মধ্যে যতটুকু স্বাধীনতা প্রয়োগ করা সম্ভব, তিনি ততটুকু করতে পারেন। কিন্তু সেটা হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক আইনে বলা আছে, সরকারের কোনো কর্মকর্তা গভর্নর বা ডেপুটি গভর্নর হতে পারবেন না; কিন্তু পরপর দুজন গভর্নর আমলাতন্ত্র থেকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর জন্য যারা দায়ী, তাদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা হোক। সেই সঙ্গে পরবর্তী কোনো রাজনৈতিক সরকার যেন এর পুনরাবৃত্তি করতে না পারে, সে ব্যবস্থা নেয়া দরকার।

বাংলাদেশ ব্যাংক এখন টাস্কফোর্স করেছে, তারা এ লক্ষ্যে কাজ করবে বলে আশা করি। এ ছাড়া গত মে মাসে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করাসহ সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি দুই ধরনের হয়, এক ধরনের কোম্পানি দুর্বল ব্যাংকগুলোর সম্পদ অধিগ্রহণ করে এবং দুর্বল ব্যাংকগুলো বন্ধ হয়ে যায়। আরেকটি হলো দুর্বল ব্যাংকের সম্পদ কিনে পরবর্তীকালে ফেরত দেয়া হয়। তখন শঙ্কা থেকে যায়, আবারো সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। সে জন্য এই কাজে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের নেয়া যেতে পারে। আরেকটি বিষয় আইনগত। অর্থঋণ আদালতে অনেক মামলা পড়ে আছে। প্রয়োজনীয় বিচারক নেই বলে মামলার কার্যক্রম চলে না। আদালতের বাইরে যে এ সমস্যার সমাধান করা হবে, তার উদ্যোগও নেই। চতুর্থত, তথ্য প্রকাশ। ব্যাংকগুলো তথ্য প্রকাশ করে না; আগে এ বিষয়ে নজরদারিও করা হতো না। মামলা ও বিশেষ হিসেবে যে অর্থ আটকে আছে, সেগুলো বিবেচনায় নেয়া হলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ চার লাখ কোটি টাকা হতে পারে। যথাযথ তথ্য না থাকলে যথাযথ নীতি প্রণয়ন করা যাবে না। সামগ্রিকভাবে গড়পড়তা তথ্য পাওয়া যায়, কিন্তু ব্যাংকের সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। যেসব তথ্য দেওয়া বাধ্যতামূলক, ব্যাংকগুলো তা দেয় না। সেই সঙ্গে ঋণ শ্রেণীকরণ, পুনঃতফসিল, অবলোপন এসব নিয়মকানুন বারবার পরিবর্তন করা হয়েছে। সর্বশেষ ২০২২ সালে এসব নিয়মকানুন শিথিল করা হয়েছে। এতে কী ফল হয়েছে, তা আমরা জানি না; কিন্তু যা হয়েছে, তা হলো সমস্যার স্তূপ তৈরি হওয়া। এসব খাতে আমাদের সংস্কার দরকার। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক সেই ব্যবস্থা নেবে বলে আশা করি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর একসময় অর্থনীতিবিদ হিসেবে যেসব কথা বলেছেন, এখন সেগুলো বাস্তবায়নের চেষ্টা করছেন। দেশী বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে অনেক ধরনের উদার নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে, তাতেও বিশেষ কাজ হয়নি; বরং একধরনের দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে। আমরা দুর্বৃত্তায়নমুক্ত, সচল ও টেকসই ব্যাংকিং খাত দেখতে চাই। কিন্তু সমস্যা হলো, এই খাতে দীর্ঘদিন ধরে যে জঞ্জাল তৈরি হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংককে এখন তা দূর করতে হচ্ছে। স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি পদক্ষেপ দরকার। স্বল্প মেয়াদে বা তাৎক্ষণিকভাবে অনেকটা অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার মতো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। যথাযথভাবেই তা নেয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে দুর্বল ব্যাংকগুলোর পর্ষদ ভেঙে দেয়া হয়েছে। কিন্তু ব্যাংকিং খাতকে অর্থনীতির মূল নিয়ামক হিসেবে গড়ে তুলতে চাইলে টেকসই ব্যবস্থা নেয়ার বিকল্প নেই। সে জন্য কাঠামোগত দুর্বলতা আমলে নিতে হবে। অর্থনীতি খারাপ হয়ে পড়লে সরকারের পতন হয়। বাংলাদেশেও তাই হয়েছে। অর্থনৈতিক নিষ্পেষণ, দুর্নীতি ও ভোটাধিকার হরণের কারণে সরকারের পতন হয়েছে। রাজনৈতিক কারণে কিছু ভালো ব্যাংক দুর্বল হয়েছে। এক পরিবারের কাছে ৮-৯টি ব্যাংক তুলে দেয়া হয়েছে। ৪-৫টি পরিবার ব্যাংক থেকে ২ লাখ কোটি টাকা নিয়ে গেছে। বিস্ফোরণোন্মুখ এই অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বাংলাদেশ ব্যাংক চেষ্টা করে যাচ্ছে। টাকা ছাপানো বন্ধ, সঙ্গে বন্ধ রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রিও। এই নীতি স্থিতিশীল হলে মূল্যস্ফীতি কমতে বাধ্য। এতে সবাই স্বস্তিতে থাকবে। ব্যাংক খাত সংস্কারে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে রাজনীতি ঠিক না হলে ব্যাংক খাতের সংস্কারগুলো টেকসই হবে না। সুতরাং সংস্কার উদ্যোগ টেকসই করতে হলে রাজনীতিতেও সংস্কার আনতে হবে।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কাজ, এ জন্য কোনো টাকা ছাপানো হচ্ছে না। শুধু পোশাক শ্রমিকদের বেতন দিতে এক হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে দেয়া হয়েছে। রিজার্ভ থেকেও ডলার বিক্রি করা হচ্ছে না। খোলাবাজারে ডলারের দাম ব্যাংকের চেয়ে কমে গেছে। এভাবে চললে বিনিময় হার স্থিতিশীল হয়ে যাবে। এখন যেসব ব্যাংকের টাকার প্রয়োজন হচ্ছে, তা না ছাপিয়ে অন্য ব্যাংক থেকে জোগান দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে, যা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখবে। মানুষের ক্ষোভ ও কষ্ট কমাতে পারলে সেটা হবে বড় অর্জন। টাকা ছাপিয়ে সাময়িক স্বস্তি মিললেও সমস্যার সমাধান হবে না। মানুষের কষ্ট আরো বাড়বে। এজন্য টাকা না ছাপানো ও ডলার বিক্রি না করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে । মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগ যথাযথ। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জায়গা থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব উদ্যোগ নিচ্ছে, সেগুলো ঠিক আছে। তবে শিল্পের কথা ভাবা হয়নি। ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে ৯ শতাংশ সুদে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি করেছেন। এখন ব্যাংকঋণের সুদ সাড়ে ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ। সুদের হার আরও বাড়ানোর চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা কিভাবে ঋণের অর্থ পরিশোধ করবেন, সেটি ভাবা উচিত ছিল। রফতানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) আকার কমানো হয়েছে। সুদের হার বাড়ানো হয়েছে। ইডিএফ রফতানিকারকদের জন্য ভর্তুকি হিসেবে কাজ করছে। বিকল্প হিসেবে অফশোর ব্যাংকিং ব্যবস্থা থাকলে সবাই সেটি নিতে পারবে না। ফলে রফতানি কমতে পারে। ভবিষ্যতে অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং বিষয় হবে ঋণের সুদহার। ১৫ শতাংশ ব্যাংকসুদে শিল্পকারখানা করে সফল হওয়া কঠিন। সুদহার বাড়লে সেটা ব্যাংকারদের জন্য খুশির খবর। কারণ, তাতে সুদ আয় বাড়বে। কিন্তু এর ফলে খেলাপি ঋণও বেড়ে যাবে। সুদহারের সঙ্গে বিনিয়োগের সম্পর্ক নেই। স্বাধীনতার পর দেশের উদ্যোক্তা শ্রেণী তৈরি করেছে এই ব্যাংক খাত। কিন্তু এই খাত ধীরে ধীরে দুর্বল হয়েছে। সুদহারের কথা বলা হয়; এটা অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। কিন্তু সুদহারের সঙ্গে বিনিয়োগের সম্পর্ক তেমন একটা দেখা যায় না। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে অনেক ধরনের উদার নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে, তাতেও বিশেষ কাজ হয়নি; বরং একধরনের দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে। আমরা এখন দুর্বৃত্তায়নমুক্ত, সচল ও টেকসই ব্যাংকিং খাত দেখতে চাই। স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি পদক্ষেপ দরকার। এ জন্য সব লেনদেন বাজারভিত্তিক করা হচ্ছে। সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা না ফিরলে বিনিয়োগ হবে না। এ জন্য ছয় মাস সময় দিতে হবে। রফতানি উন্নয়ন তহবিলের আকার কমানো হবে না। খেলাপি ঋণ ব্যাংক খাতের আরেকটি সমস্যা। এ সমস্যার সমাধান কিভাবে হবে, তা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

বর্তমানে যে খেলাপি ঋণের কথা বলা হচ্ছে, সেটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়ে ঐকমত্যে আসতে হবে। পৃথিবীর এমন কোনো ব্যাংক নেই, যেখানে খেলাপি ঋণ নেই। ইচ্ছাকৃত খেলাপি খারাপ। যারা অনিচ্ছাকৃত খেলাপি, তাদের সহায়তা করতে হবে, আর যারা ইচ্ছাকৃত তাদের শাস্তি দেয়া, জেলে নিতে হবে। ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা ঠিক করতে হবে। খেলাপি ঋণ বেশি হয় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ঋণ থেকে। কারণ এ ধরনের বাণিজ্যের সব তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংক সংগ্রহ করে না। এর সূত্রপাত হয় ব্যাক টু ব্যাক ঋণপত্র থেকে। এই বাণিজ্যেই ৭০-৮০ শতাংশ জালিয়াতি ও অর্থ পাচার হয়। বাংলাদেশে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিক বেশি। ব্যাংকিং নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে আমাদের আশপাশের দেশ ও অঞ্চলের চর্চাগুলোকে আমরা বিবেচনায় নিতে পারি। অনেক সময় দেখা যায়, বিভিন্ন খাতের ভালো ও সফল উদ্যোক্তারা ব্যাংকের পরিচালনায় এসে আর ভালো কিছু করতে পারেন না। এর বড় কারণ রাজনৈতিক চাপ। এ ছাড়া বৈরী পরিবেশ ও নীতিও বড় কারণ। এমন একটি ব্যবস্থা করা দরকার, শুধু টাকা থাকলেই যে কেউ যাতে ব্যাংকের মালিকানায় চলে আসতে না পারে।
বিদায়ী সরকারের আমলে বাংলাদেশে অনেক ব্যবসায়ী, ব্যাংকার ও পর্ষদ সদস্য রাজনৈতিক হেনস্তার শিকার হয়েছেন। রাজনৈতিকভাবে কেউ কেউ এমন সুবিধা পেতেন যে সবাই সেই প্রতিযোগিতায় সক্ষম থাকতেন না। রাজনৈতিকভাবে সুবিধা পাওয়া একটি পরিবার ৮-৯টি ব্যাংকের মালিকানা পেয়েছে। সেটি কিভাবে সম্ভব? অথচ বলা হচ্ছে, ব্যাংকে একটি পরিবারের শেয়ার ১০ শতাংশের বেশি হতে পারব না। রাজনৈতিক কারণে কিছু ভালো ব্যাংক দুর্বল হয়েছে। কিছু ব্যাংকের উদ্দেশ্য ভালো ছিল, কিন্তু নানা কারণে দুর্বল হয়েছে। এ জন্য ব্যাংকের পূর্বাবস্থা যাচাই-বাছাই করে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। একটু সহায়তা দিলে কিছু ব্যাংক ঘুরে দাঁড়াবেই। তাই ব্যাংক খাত সংস্কারে সময়ক্ষেপণ করা উচিত হবে না।

ব্যাংক খাতের ক্ষতির প্রভাব পড়েছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে। ১৫ বছর আগে ব্যাংক খাত যে অবস্থায় ছিল, ১৫ বছর পর এসে সেই অবস্থায় নেই। ব্যাংক চলেছে মুদি দোকানের মতো। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এই পর্যন্ত ১১টি ব্যাংকের পর্ষদ পরিবর্তন করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন সাহসী সিদ্ধান্তগুলোয় আমরা আশ্বস্ত হয়েছি। অর্থনীতি খারাপ হয়ে পড়লে সরকারের পতন হয়। বাংলাদেশেও তা-ই হয়েছে। অর্থনৈতিক নিষ্পেষণ, দুর্নীতি ও ভোটাধিকার হরণের কারণে সরকার পতন হয়েছে। বিস্ফোরণোন্মুখ অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে চেষ্টা চলছে। আমরা ভাগ্যবান, বৈশ্বিক আর্থিক সঙ্কটে আমাদের সমস্যা হয়নি। ৪-৫টি পরিবার ব্যাংক থেকে দুই লাখ কোটি টাকা নিয়ে গেছে। এতে অর্থনীতিতে মন্দা নেমে আসতে পারত, সেটা হয়নি। ব্যাংক খাত রুগ্ণ হয়ে পড়েছে। আমাদের আরো কিছু দিন কষ্ট করতে হবে। মানুষের মনে এক ধরনের ভীতি আছে। অনেকেই জানতে চান, কোন ব্যাংকে টাকা রাখা নিরাপদ? নতুন সরকার আসার পর মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি হলেও অনিশ্চয়তার বোধ এখনো আছে। সে জন্য বিষয়টি পরিষ্কার করা দরকার। রুগ্ণ ব্যাংক টিকিয়ে রাখা হলে ভালো ব্যাংকেও তার প্রভাব পড়ে। এই খাত মানুষের আস্থার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। গত এক দশকে করপোরেট সুশাসনের কাঠামোয় অনেক ক্ষতি করা হয়েছে। এ সময়ে ব্যাংক কোম্পানি আইনে কয়েকবার পরিবর্তন করা হয়েছে। এ পরিবর্তন হয়েছে স্বজনতোষী ও ঋণখেলাপিদের সুবিধা দেয়ার জন্য। অন্তর্র্বর্তী সরকার এ ক্ষেত্রে কতটা কাজ করতে পারবে, তা দেখার বিষয়; তবে সংস্কার উদ্যোগ নেয়া জরুরি। আর্থিক খাতে সমস্যা কী, সেটা আমরা জানি। এ জন্য কমিশন না করেই কাজ শুরু করে দেয়া হয়েছে। এ জন্য তিনটি টাস্কফোর্স গঠন করা হবে, ইতিমধ্যে একটা গঠন করা হয়েছে। ১০-১১ ব্যাংকের পর্ষদ পরিবর্তন করে দেয়া হয়েছে। এসব ব্যাংককে নিবিড়ভাবে তদারকি করা হচ্ছে। স্বস্তির বিষয়, এত কিছুর পরও এসব ব্যাংকে ৮০০ কোটি টাকা আমানত বেড়েছে। মানুষ এখন এসব ব্যাংকে টাকা জমা করছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে এসব ব্যাংককে কিভাবে সহায়তা দেয়া যায়, তা দেখছে বাংলাদেশ ব্যাংক । এসব ব্যাংকের আমানতকারীরা ধৈর্যের পরিচয় দিচ্ছেন। এক বছর সময় দিলে এসব ব্যাংক ঘুরে দাঁড়াবে।

গ্রাহকরা অপ্রয়োজনে টাকা উত্তোলন করতে গেলে সমস্যা বাড়বে। দুর্বল ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা দেখে কত টাকার গ্যারান্টি সুবিধা পাবে, তা নির্ধারণ করা হচ্ছে। গ্যারান্টি দিলেও পুরো টাকা একবারে দেয়া হবে না। এই মডেলে কাজ না হলে অন্য উপায় ভাবতে হবে। শেয়ার বিক্রি করে দুর্বল ব্যাংকের টাকা আদায়ের চেষ্টা করা হবে। এ ছাড়া সরকার ও বিদেশী সংস্থা থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা মূলধন জোগানোর পরিকল্পনা আছে। তবে রাজনীতি সংস্কার না হলে অর্থনীতির সংস্কার টেকসই হবে না। দুর্বল ব্যাংককে তারল্য-সহায়তা প্রয়োজন। অবশ্যই দুর্বল ব্যাংককে সাহায্য করা দরকার। কিন্তু আমাদের ব্যাংককে যখন বিদেশী কোনো সংস্থা নিরীক্ষা করতে আসবে, তখন যদি দেখে কোনো তথ্য-উপাত্ত ছাড়াই দুর্বল ব্যাংককে ঋণ দেয়া হয়েছে; তাহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে। কোনো ব্যাংক অর্থ ফেরত দিতে না পারলে গ্যারান্টার হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে যাবে। এটি খুবই বিব্রতকর হবে বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য। ব্যাংক কোম্পানি আইনের খসড়া রাতের আঁধারে চূড়ান্ত করা হয়েছে। আইনটি আরো সংশোধন করে সমৃদ্ধ করা যায়। যদি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভালো হয় আর ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ভালো না হয়, তাহলে সুশাসন নিশ্চিত করা যাবে না। এই যে এতগুলো ব্যাংকে লুটপাট হয়ে গেল, সেখানে এমডিরা কী করেছেন? তাদের সততা কোথায় ছিল? বর্তমানে ব্যাংক খাত যে অবস্থায় আছে, তাতে কিছু ব্যাংকের জন্য লভ্যাংশ বিতরণ কয়েক বছরের জন্য বন্ধ করে দেয়া দরকার।

এ ছাড়া ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক খাতেও বড় ধরনের সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে। এই খাতের জন্য আলাদা কিছু নীতিও দরকার, যাতে প্রতিষ্ঠানগুলো ভালোভাবে টিকে থাকতে পারে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বন্ধ করে দেয়ার কথা হয়েছে। আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে থাকতে হবে। ফলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের মতো আরেকটি বিভাগ থাকলে স্বার্থের গুরুতর সঙ্ঘাত সৃষ্টি হয়। ব্যাংক খাত রুগ্ণ হয়ে পড়েছে। মানুষের মনে একধরনের ভীতি আছে। অনেকেই জানতে চান, কোন ব্যাংকে টাকা রাখা নিরাপদ? নতুন সরকার আসার পর মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি হলেও অনিশ্চয়তার বোধ এখনো আছে। সে জন্য বিষয়টি পরিষ্কার করা দরকার। এ ছাড়া কোনো ব্যাংককে ব্যর্থ হতে দেয়া যাবে না। এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে, সেরকম পরিকল্পনা নেই। যত রুগ্ণই হোক, কোনো ব্যাংককে মরতে দেয়া হবে না। সেটা হলে পরিষ্কার বার্তা দেয়া দরকার; তা না থাকলেও পরিষ্কার বলে দেয়া উচিত। সেই সঙ্গে শক্তিশালী ব্যাংক কোনগুলো, তা বলা উচিত। রুগণ্ ব্যাংক টিকিয়ে রাখা হলে ভালো ব্যাংকেও এর প্রভাব পড়ে। এ খাত মানুষের আস্থার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ১০০ থেকে এক হাজার টাকা ঋণ তৈরি হয়, অর্থাৎ পুরো বিষয়টি বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ভালো ব্যাংকও যেকোনো সময় ধসে যেতে পারে। সে জন্য সরকার, নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে পরিষ্কার বার্তা থাকা উচিত, কোন ব্যাংকগুলো কী অবস্থায় আছে। ব্যাংক তদারকিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও দক্ষতা দেখাতে হবে। আইনকানুন পরিপালনে কাউকে ছাড় দিয়ে টিকিয়ে রাখার প্রথা তুলে নিতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিবেচনায় সব ব্যাংকের পরিচালকদের এক কাতারে রাখতে হবে। যখন যা সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন, তা নিতে হবে। তাহলে এর সুফল পাবে দেশের অর্থনীতি। এখন কোন পথে বাংলাদেশের অর্থনীতি? এ প্রশ্ন উঠছে বারবার। অর্থনীতিকে সঠিক পথে আনতে নানা পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। তেমন প্রেক্ষাপটে বলা যায়, রাজনীতি ঠিক না হলে আর্থিক খাতের সংস্কারগুলো টেকসই হবে না।
লেখক : গবেষক, সাবেক ব্যাংকার ও কথাশিল্পী

 

 


আরো সংবাদ



premium cement