ভৌতিক আলখাল্লা
- আহমদ মতিউর রহমান
- ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
কেবল সন্ধ্যা নেমেছে। বনশ্রীর তিতাস রোডের ৩৬/এ নম্বর বাড়িটির সামনে বেশ গাছগাছালি। দিনের বেলাতেই ছায়া ঢাকা থাকায় আলোআঁধারি ভাব থাকে। বিকেলটা গেছে ছোট হয়ে। সাড়ে ৫টাতেই সন্ধ্যা নেমে আসে। ফলে এখন আরো আঁধার এসে ভিড় করছে। সাকলাইন এই ভবনের ছয় তলায় থাকে। ক্লাস এইটের ভালো ছাত্র। সে খুব ব্যস্ত। আজ রাতে বন্ধুদের সাথে খোলা ছাদে হবে ভূত উৎসব। তার প্রস্তুতি দেখতে বের হয়েছে সাকলাইন। ওর নামটা বেশ বড়। বন্ধুরা যে যার মতো করে ডাকে। অত বড় নাম ডাকা নাকি যায় না। নামের ব্যাপারে ওর কী করার আছে? নাম রেখেছে বাবা মা। না না নাম রেখেছে ওর এক কাকা, শরিফ কাকা। তো নিজের নাম তিন অক্ষরের হলেও তার ভাস্তের নাম কেন লম্বা রাখলেন এ প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। আসলে প্রশ্ন করলে তো উত্তর থাকবে? কাকাকে জিজ্ঞেস করা হয়নি আজ পর্যন্ত। বাসায় মাস্টার্স পড়া এই কাকার খুব গুরুত্ব। তিনি নাম রেখে দিয়েছেন, অতএব বাবা মা সে নাম নিয়েই সন্তু‘ষ্ট।
হন্তদন্ত হয়ে গেট দিয়ে ঢোকে মনা। সাকলাইনের এক বন্ধু।
: কী রে কী খবর সাকু? মনা তাকে ডাকে এই নামে। আরো কয়েকজন ডাকে। আর বাসায় ওর নাম খোকা। বাবা মা সবাই ডাকে খোকা। তবে বন্ধুরা খোকা ডাকে না।
: বিলকুল সব ঠিক আছে। জবাব দেয় সাকলাইন।
: মোজাম্মেল ভাই কোথায়? বাসার দারোয়ানের নাম মোজাম্মেল। তার কথা জানতে চায় মনা।
: তিনি আছেন, মনে হয় ছাদে।
: ও আচ্ছা। চলি রে। সব ঠিক থাকলেই ভালো। বলে বিদায় নেয় মনা।
আসলে আজ রাতে ছাদে ওরা কয়েক বন্ধু মিলে হ্যালোইন উৎসব করবে। এই রাতে নাকি ভূতেরা নেমে আসে চরাচরে। আর সব কিছু গ্রাস করে। ওদের গ্রুপের ভূতবিষয়ক বিশেষজ্ঞ মাইকেল বলছিল হ্যালোইনের আসল কাহিনি। সে যা বলেছিল তার নিগলিত অর্থ হচ্ছে, অলহ্যালোইন অল হ্যালোজ ইভ, বা অল সেইন্টস ইভ হিসেবে পরিচিত দিনটি। মানে রাতটি। একটি বার্ষিক ছুটির দিন যা প্রতি বছর বিভিন্ন দেশে পালিত হয় ৩১ অক্টোবর তারিখে। এই দিনটি নিবেদন করা হয় মৃত, সাধু (হ্যালোজ), শহীদ এবং সব বিশ্বস্ত বিদেহী বিশ্বাসীদের স্মরণ করে। হ্যালোইন উৎসবের প্রাক্কালে যেই মূল ধারণা বা থিম অনুসরণ কর হয় তা হলো ‘হাস্যরস ও উপহাসের সাহায্যে মৃত্যুর ক্ষমতার মুখোমুখি হওয়া।’ অনেক পণ্ডিতদের মতে, ‘হ্যালোইন’ বা ‘অল্ হ্যালোজ্ ইভ্’ হলো খ্রিষ্টধর্মের একটি বার্ষিক উৎসব যা প্রাথমিকভাবে কেলটিক ফসল কাটার উৎসব দ্বারা প্রভাবিত। হ্যালোইন উৎসবে কর্মকাণ্ডের মধ্যে আছে ‘ট্রিক-অর-ট্রিট’, ‘বনফায়ার’ বা অগ্ন্যুৎসব, আজব পোশাকের পার্টি, ভৌতিক স্থান ভ্রমণ, ভয়ের চলচ্চিত্র দেখা ইত্যাদি। আইরিশ ও স্কটিশ অভিবাসীরা ১৯ শ’ শতকে এই ঐতিহ্য উত্তর আমেরিকাতে নিয়ে আসে। পরে বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলিও হ্যালোইন উদ্যাপন করা শুরু করে। বর্তমানে পশ্চিমা বিশ্বের অনেকগুলো দেশে হ্যালোইন পালিত হয়, যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, আয়ারল্যান্ড, পুয়ের্তো রিকো ও যুক্তরাজ্য। এ ছাড়া এশিয়ার জাপানে এবং অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডেও হ্যালোইন পালিত হয়। হ্যালোইন মূলত পশ্চিমা বিশ্বের একটি জনপ্রিয় উৎসব, যা ৩১ অক্টোবর পালিত হয়। বিশ্বাস করা হতো এই রাতে মৃতদের আত্মারা পৃথিবীতে ফিরে আসে। পরে খ্রিষ্টধর্মের প্রভাবে এটি `All Hallows' Eve’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে এবং ধীরে ধীরে মজাদার এবং ভৌতিক উৎসবে পরিণত হয়। তার মানে যে হ্যালোর সাথে সবাই পরিচিত এর বানান সে রকম নয়।
শুনে ওদের বুদ্ধিমান বন্ধু হিসেবে পরিচিত ধীমান বলেছিল, অত শত বুঝে কাজ নাইরে। আমার এটা পালন করবো ভূত উৎসব নামে। তথাস্তু বলে বাকি বন্ধুরা মানে সাকিব, আবরার, নিখিল এক মত হয়েছিল। সেই মতে কিছু টাকা চাঁদা তোলা হয়েছে। খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করবেন মোজাম্মেল ভাই। কাজ শেষে তাকে কিছু টাকা গুঁজে দিলেই কেল্লা ফতে।
ভূত দেখা আর ভূতের গল্প নিয়ে তাদের এই গ্রুপটার আগ্রহের অভাব নেই। আদতে এদের অনেকেই ভূত দেখেনি। শুধু গল্প শুনেছে। আর ভয় পেয়েছে। গভীর রাতে যখন ভূতের গল্পের বই ‘গভীর রাতের আতঙ্ক’ পড়ে তখন গা ছমছম করে ওঠে। পড়ার বইয়ের ফাঁকে ফাঁকে মা-বাবাকে না জানিয়ে ওরা পড়ে এসব বই। একজনের বই এভাবে সবার বাড়ি বাড়ি ঘোরে। সাত ভূত আট পেতœউ, গল্পগুলো ভূতের, গাছতলার ভূত, ভূত সংগ্রহ কত নামের বই।
সাকলাইন খুব আশা করে আছে আজ রাতে ভূত দেখবে। হ্যালোইন উৎসবের রাতে ভূত নেমে আসবে ওদের বাবাস ছাদে সেটাই আশা করে ও। কখনো ভূত দেখেনি বলে দেখার খুব শখ।
সন্ধ্যার কিছু পরে ধীমান নিয়ে আসে খাবারের প্যাকেট। হালকা কিছু খাবার। সে তাদের রেস্তোরাঁ থেকে এক বেয়ারাকে বলে নিয়ে এসেছে। আসল খাবার রান্না করবে মোজাম্মেল। খিচুড়ি উইথ পোড়া গোশত। সব কিছু গুছিয়ে দিয়ে গেছে আবরার। এসে বাকিটা দেখবে সে।
ওদের এসব বিষয় কারো সাথে শেয়ার করেনি। বড়রা বিষয়টা জানেই না। তারা জানে নববর্ষের মতো একটা বারবিকিউ পার্টি হবে ছাদে। ছেলেগুলো এমনিতে লেখাপড়ায় ভালো। তাই পরিবার এসব কাজে বাধা দেয় না। ওরা বড় ক্লাসের ছাত্র। একটু-আধটু এসব কাজ তো করবেই। ফাও হিসেবে ভবনের প্রতিটি মা পান খাবারের ভাগ। রাত সাড়ে ১১টা বাজতে একে এক হাজির সবাই। সিঁড়ির গোড়ায় মোজাম্মেল ভাই স্বাগত জানায় সবাইকে। আর ইশারায় দেখিয়ে দেয় ছাদ আর লিফট। মানে যার যার মতো উঠে যাও।
ছাদের এক কোণে জড়ো হয়েছে ওরা আটজন। এসব কাজে বেজোড় হলে নাকি ভালো। আরেকজন হলে ভালো হতো। কিন্তু বিজন আসেনি। মোজাম্মেল ভাইকে নিয়ে অবশ্য নয়জন ওরা। মোজাম্মেল ওদের গোনায় আসবে কি না এ নিয়ে তর্ক দুই পক্ষের। যাই হোক অপেক্ষার পালা শেষ হলো বোধহয়।
চিয়ার্স বলে আনন্দ করতে করতে খাওয়া-দাওয়া পর্ব শুরু হয়ে গেল। পোড়া গোশত বানাতে গিয়ে চুলায় আগুন ধরে গেল হঠাৎ করে। তারপর দ্রুম করে শব্দে বাস্ট হলো চুলো। মোজাম্মেলের জামাকাপড় গেল লেপ্টে। চোট তেমন লাগেনি। এই যা রক্ষ্মা। সেই আধ পোড়া গোশত আর পরোটা খেয়ে খাবার পর্ব শেষ। ড্রিংকস সার্ভ করছিল সাকলাইন। সেই জানান দিলো ছাদের এক পাশ থেকে কয়েকটি মুরগি ছানা বেরিয়ে এসে ঘোড়াঘুড়ি করতে শুরু করেছে। হিস হিস! চুপ চুপ। সবাই হতবাক। ছাদে মুরগির বাচ্চা আসবে কোত্থেকে? ফিস ফিস শুরু হলো।
: এগুলো কী ভৌতিক রে? বলল একজন।
: চুপ করে দেখে যা। আরেক জনের গলা। কে কথা বলছে অন্ধকারে ঠাহর করা মুশকিল।
আরেক কোনা থেকে কালো মতো কি যেন দেখে জ্ঞান হারালো একজন। ভূত কি না না নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। ছাদের এক পাশে কলাগাছ আছে। তার বড় বড় পাতা অন্ধকারে প্রেতের আলখাল্লার মতো মনে হওয়া স্বাভাবিক। পাশের বিল্ডিং থেকে আসা এক চিলতে আলোয় দেখা গেল ভূতের ভয়ে নিখিল জ্ঞান হারিয়েছে। অথচ এই দলে নিখিল সবচেয়ে সাহসী বলে জানত সবাই। তাকে সুশ্রƒষা করতে একে এক ছাদ থেকে নেমে গেল সবাই। পড়ে রইল রহস্যজনক মুরগির ছানা আর ভৌতিক আলখাল্লা।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা