০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১, empty
`

ভাবাদর্শের পুনর্গঠন ও রাষ্ট্র সংস্কার

-


পাঁচ আগস্টের আগে কে জানতো যে শেখ হাসিনা পালাবে! এমনকি শেখ হাসিনা হয়তো নিজেও জানতো না যে তাকে সেদিন এভাবে পালাতে হবে। কিন্তু পালাতে হলো; কেন হলো? এ জন্য যে, রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে সে বুঝতে পারতো না যে তার অপরাধটা কী! তিনি মাঝে মধ্যেই বিভিন্ন বক্তৃতায় সে কথা গর্ব করে বলতেনও; ‘তার অপরাধ কি তিনি বোঝেন না।’
একটা মানুষ চিন্তায় কতটা দৈন্য হলে হাজার অপরাধ করেও বুঝতে পারে না; তার অপরাধ কী? যে ব্যক্তি ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য বুঝতে পারে না তার দ্বারা ন্যায়ের চেয়ে অন্যায় হওয়ার সম্ভাবনা থাকে সবচেয়ে বেশি। শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে সেটাই হয়েছে; আর তা হয়েছে তার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে। বিশের দশকে ঢাকা থেকে প্রকাশিত শিখা পত্রিকার স্লোগান ছিল-‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।’

শিখা পত্রিকার এই স্লোগানের তাৎপর্য হয়তো শেখ হাসিনা কোনো দিনই উপলব্ধি করবার চেষ্টা করেনি। তাহলে কি শেখ হাসিনা জ্ঞানী ছিল না! মোটেই নয়। তার জ্ঞানও ছিল না বুদ্ধিও ছিল না। তাকে যারা বুদ্ধি পরামর্শ দিয়েছে তারা কেউ-ই শেখ হাসিনার মঙ্গল চায়নি। তারা সবাই ছিল ধান্দাবাজ। শেখ হাসিনা নিজেও ছিলেন ধান্দাবাজ। সে কারণে ধান্দাবাজদের পরামর্শ তার এত পছন্দনীয় ছিল। ধান্দাবাজদের প্রতি ছিলেন তিনি কৃতজ্ঞও। শেখ হাসিনার পরামর্শক ধান্দাবাজদের অন্যতম ছিল দিল্লি। দিল্লিই শেখ হাসিনাকে ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠার সম্পূর্ণ রসদ জুগিয়েছিল। শেখ হাসিনাকে ফ্যাসিস্ট করার পেছনে দিল্লির স্বার্থ ছিল বহুবিদ; তার মধ্যে ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক।
দিল্লি এখনো সে স্বার্থ চরিতার্থ করার ফন্দি অব্যাহত রাখতে চাইবে। সে সুযোগও আছে। কারণ দিল্লির আশীর্বাদে এ দেশের অধিকাংশ রাজনীতিক বাংলাদেশ শাসনের স্বপ্ন দেখে। এই কারণে বাংলাদেশের মানুষ সতর্ক না হলে হাসিনা ব্যতীতও এই অভ্যুত্থান ফলপ্রসূ না-ও হতে পারে।

২.
হাসিনা ও আওয়ামী লীগের রাজনীতি ছিল মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক। বাংলাদেশের রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের অধ্যায়টা গুরুত্বপূর্ণ টার্নিংপয়েন্ট। এ জন্য দেশকে ঘিরে রাজনীতির সব নির্যাস এ অধ্যায়ে কেন্দ্রীভূত। সেই রাজনীতিটা শুরু হয়েছিল পলাশী যুদ্ধের পর থেকে। ব্রিটিশরা ঢাকা, মুর্শিদাবাদ কোনোটাতেই তাদের রাজধানী না রেখে কলকাতাতে (১৭৭২-১৯১১) রাজধানী প্রতিষ্ঠা করল। সেখান থেকে এ দেশের রাজনীতি ও সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রিত হতে থাকল। ব্রিটিশ এসেছিল ভারতবর্ষ থেকে মুনাফা লুণ্ঠন করতে। মুনাফা লুণ্ঠনকে নিরঙ্কুশ করতে গিয়ে তারা হয়ে উঠেছিল মুসলমানদের শত্রু। সে জন্য মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার প্রশ্নে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের জন্ম (১৯০৬) হয়েছিল। মুসলিম লীগের প্রতিরোধে ব্রিটিশ ভারতবর্ষ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু ততদিনে তারা ভারতবর্ষকে গড়ে তুলেছিল মুসলমানদের স্বার্থবিরোধী করে। ব্রিটিশদের এই কৌশল আয়ত্তে রাখতে পেরেছিল কংগ্রেস (১৮৮৫) নেতৃবৃন্দ। ব্রিটিশদের ফর্মুলার ডিভাইডেড রুল প্রয়োগ করে তারা পূর্বপাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে আলাদা করতে পেরেছিল। এটি সম্ভব হয়েছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে। আওয়ামী লীগ পরিপূর্ণভাবে দিল্লির এজেন্ডা বাস্তবায়নের রাজনীতি করে এসেছে। আওয়ামী রাজনীতির এই জায়গাটা জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্র-জনতা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিল আবরার হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে। আবরার হত্যাকাণ্ড ছাত্রদের সামনে আওয়ামী লীগ রাজনীতির খোলসকে খুব সহজে উন্মোচন করতে পেরেছিল। ফলে আগস্ট বিপ্লবের কাঠামো শক্ত হতে ও বিপ্লব সংঘটিত হতে খুব একটা দেরি হয়নি।

এই বিপ্লবে প্রত্যাশা যেমন সঞ্চারিত হয়েছে তেমন শঙ্কাও রয়েছে সন্দেহাতীত। শঙ্কার জায়গাটা হলো কোন আদর্শকে সাথে নিয়ে বাংলাদেশ সামনে এগিয়ে যাবে; এই জায়গাটা বিপ্লবে নেতৃত্বদানকারী ছাত্র-জনতা এখনো পরিষ্কার করতে পারেনি। তারা এ দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশ্যে বলেছে- বিপ্লবকে ধারণ করার মতো সহনশীল জোগ্যতা অর্জন করে আসতে হবে।
এই বক্তব্যে বোঝা যাচ্ছে, রাজনীতি করা দলগুলোর মতাদর্শগত সংস্কার প্রয়োজন কিন্তু কোন মতাদর্শের ভিত্তিতে সংস্কার হতে হবে তা স্পষ্ট নয়। আওয়ামী লীগের রাজনীতির চেতনা ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদে। বিএনপির ছিল বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। জামায়াত রাজনীতি করে মুসলিম জাতীয়তাবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে। এখন বাংলাদেশ কোন মতার্শকে আমলে নিয়ে চলবে সেটা দ্রুত উত্থাপিত হওয়া জরুরি। প্রধান উপদেষ্টার সহকারী মাহফুজ আলম বলেছেন- সংবিধানের একই সাথে চার মূলনীতির সংস্কার হওয়া দরকার। কিন্তু এই চার মূলনীতির পরিবর্তে কী হতে পারে সেটা তিনি খোলাসা করেননি। এটি খোলাসা হতে পারলে রাজনৈতিক দলগুলোও দ্রুত তাদের প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে পারতো।

৩.
মানুষ নিয়ন্ত্রিত হয় চিন্তার দ্বারা। আর চিন্তা তৈরি হয় শিক্ষা ও সংস্কৃতির দ্বারা। চিন্তার পরিবর্তন মানেই রাষ্ট্রের পরিবর্তন। কাজেই আগস্ট চেতনায় রাষ্ট্রীয় দফতরগুলোর ভাবাদর্শগত সংস্কার হতে হবে। তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন যারা এই দফতরগুলো পরিচালনা করবে তাদের মন, চিন্তা ও মূল্যবোধের পুনর্গঠন। রাষ্ট্রীয় দফতরের টপ লেভেলে যারা দায়িত্ব পালন করবে তারা রাজনৈতিক দলের সদস্য এবং আমলা। তাদের চিন্তার পুনর্গঠন হতে হবে আশাব্যঞ্জক। আর এর স্টেকহোল্ডার রাজনৈতিক দলের সদস্যসহ সাধারণ মানুষ। কিন্তু রাজনৈতিক দলের সদস্যদের মন-মেজাজ বিপ্লবের চেতনায় পুনর্গঠিত হতে না পারলে দাফতরিক পরিকাঠামোর পরিবর্তন খুব একটা কাজে আসবে না। রাজনৈতিক দলগুলো যে সদস্য রিক্রুট করে সেখানে আনতে হবে পরিবর্তন। সুনাগরিকতার মূল্যবোধে বিশ্বাসী লোকদের দলের সদস্য নির্বাচন করা যেতে পারে। দলের সদস্য হওয়ার শিক্ষাগত যোগ্যতাও নির্ধারিত থাকতে পারে। আর সুনাগরিক তৈরি করার কাজটি করবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সে জন্য শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতে হবে বেশি। আমরা যদি বিশ্বাস করি শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। তাহলে শিক্ষা কমিশন জরুরি। কিন্তু কী কারণে এখনো শিক্ষা কমিশন গঠিত হলো না তা বুঝা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় নানান ধরনের বিশৃঙ্খলা বিরাজমান। নিয়োগবাণিজ্য, পরিচালনা পর্ষদের স্বেচ্ছাচারিতা, শিক্ষক-কর্মচারীদের অবমূল্যায়ন, সরকারি-বেসরকারি বৈষম্যসহ হীনউদ্দেশ্যপ্রণোদিত কারিকুলাম যোগ্য নাগরিক তৈরিতে গড্ডালিকা প্রবাহ সৃষ্টি করেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দোহাই দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বিকৃত ইতিহাস গেলানোর মাধ্যমে মানবতার মৌলিক জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। ফলে শিক্ষিত মানুষগুলোই হয়ে উঠেছে জাতির সর্বনাশের কিন্দ্রবিন্দু। এ ধরনের নাগরিক তৈরিতে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা (দেশবিমুখ, সমাজবিমুখ স্বার্থান্বেষী শিক্ষিত জনগোষ্ঠী তৈরিতে) সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে। দিল্লি এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থাই সবসময় রাখতে চেয়েছে বাংলাদেশে। আমরা খেয়াল করেছি বাংলাদেশে একটি ভঙ্গুর শিক্ষাব্যবস্থা বহাল রাখতে দিল্লিপন্থী একটি সক্রিয় শক্তিশালী চক্র কাজ করে যাচ্ছে। এই চক্রকে উচ্ছেদ করতে শিক্ষাকমিশন আবশ্যক। এই কমিশন করতে না পারলে জাতি ভুল জীবনদর্শনে পড়ে হাবুডুবু খাবে এবং জনগণের প্রত্যাশা মাফিক কল্যাণ রাষ্ট্র পেতে আরো বিলম্ব হতে পারে।

৪.
সুযোগ যখন এসেছে রাষ্ট্র সংস্কারের তখন এটাকে কাজে লাগাতে হবে নির্দয়ভাবে। ‘নিজে বাঁচলে বাপের নাম’ এই পুরাতন চিন্তা ও ধ্যান-ধারণা থেকে বের হয়ে নিজেদের পুনর্গঠন হওয়া দরকার নতুনভাবে। নতুনের এই পথ চলায় ঢাকা কেন্দ্রিক রাষ্ট্রের ধারণা থেকে বের হয়ে গ্রাম-গঞ্জের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করতে হবে। গ্রামীণ জনপদের উৎপাদনমুখী কৃষি এবং কৃষকের মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করার মতো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা রাষ্ট্রকে করতে হবে দায়িত্বের সাথে। কৃষক এবং কৃষকের সন্তান নাগরিক সুযোগ সুবিধা থেকে আর যেন বঞ্চিত হতে না পারে তার বন্দোবস্ত থাকতে হবে সংস্কারের তালিকাতে। গ্রামীণ অবকাঠামোর উন্নয়ন এবং কৃষিপণ্যের বাজারজাত; প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষককে বিনাসুদে ঋণ ও ক্ষতি পুষিয়ে ওঠার মতো এককালীন অর্থ সহযোগিতার ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় সংস্কারের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কৃষি ও কৃষক অবহেলিত এই বক্তব্য যেন আর শুনতে না হয় তার জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মপরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন থাকা জরুরি। বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত্তি কৃষি। কৃষি উৎপাদনের সাথে নিবিড়ভাবে ঘনিষ্ঠ প্রান্তিক কৃষক এখন চরম মানবেতর জীবনযাপন করছে। প্রান্তিক এসব কৃষকের জন্য চিকিৎসাসেবা ফ্রি করার ব্যবস্থা থাকা বাঞ্ছনীয়। কৃষকের এসব স্বপ্ন বাস্তবায়নের অঙ্গীকার নিয়ে নতুন বাংলাদেশ জেগে উঠবে এবং কৃষক হাসলে বাংলাদেশও হাসবে; এই চিন্তা সবার মাথায় সবসময় রেখে সামনের পথ পাড়ি দিতে পারলেই অভ্যুত্থান সফল হতে পারে।

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement