০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১, empty
`

মাতৃভূমি বাংলাদেশ : আশার কথা, কর্তব্যগাঁথা

-


সমালোচনা করা সহজ কিন্তু চ্যালেঞ্জিং সময়ে অর্থবহ কাজ করা বড় দুষ্কর। কর্মহীন সমালোচনা দুশমনির নামান্তর। তাই লাগামহীন সমালোচনার পথ পরিহার করে গঠনমূলক ও পরিমার্জিত সমালোচনা করা উচিত। গঠনমূলক সমালোচনার পাশাপাশি যার যা সামর্থ্য আছে তা নিয়ে দেশ গঠনে অন্তর্বর্তী সরকারকে এবং সরকারি অবকাঠামোর বাইরেও যেখানে সম্ভব সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসা দরকার

বাংলাদেশ আমার প্রিয় মাতৃভূমি। এখানেই জন্ম, এখানের আলো বাতাসেই বেড়ে ওঠা। জীবনের স্বর্ণালি তিন দশক এখানেই কাটিয়েছি। এ দেশের মাটি ও মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েই জীবন গড়েছি। পূর্ণ যৌবনে পদার্পণের পর জীবনের সে হাতেখড়ি নিয়েই বিশ্বের দেশে দেশে মানবতার কল্যাণে, সত্যের মশাল হাতে আপন কর্তব্য পালনে ব্রতী হওয়ার সাহস পেয়েছি। জন্ম, গঠন ও জীবনের মৌলিক হাতেখড়ি বাংলাদেশে হওয়ার কারণে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব নিয়েও জন্মভূমির প্রতি নাড়ির টান আর ভালোবাসা কখনো কমেনি। বাংলাদেশের সুখ আমাকে সুখ দেয় আর বাংলাদেশের দুঃখ আমাকে বেদনা দেয়। তাই বলি, বাংলাদেশ আমার ভালোবাসা।
১৯৯৬ সালে বার-এট-ল করার ব্রত নিয়েই মূলত ব্রিটেনে আসা। সিদ্ধান্ত ছিল বার-এট-ল শেষ করেই আমার ভালোবাসার কেন্দ্র বাংলাদেশে ফিরে যাব। মূলত হয়েছিলও তাই। কিন্তু ২০০৪ সালের এশিয়া ও আফ্রিকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ সুনামি আমার জীবনেও সুনামি নিয়ে আসে। একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সেবা সংস্থার ডাকে সুনামি বিপর্যস্ত দেশগুলোতে মাত্র ‘এক বছরের চুক্তিতে’ যোগ দেই। কিন্তু কাজের ব্যাপ্তি এবং মানবিক কারণে সে এক বছর আর শেষই হয়নি। বৈশ্বিক লেবেলে মানবতার কল্যাণে দায়িত্ব পালনে নিবেদিত হওয়ার কারণে দেশে ফিরে যাওয়া আজ অবধি আর হয়নি।

লন্ডন আমার বসতি শহর হলেও বিশ্বের পশ্চাৎপদ দেশগুলোর অবহেলিত জনপদ আর এ্যারোপ্লেনের সঙ্কীর্ণ সিট হয়ে উঠে আমার আবাসস্থল। তবুও আমার মনের মণিকোটা থেকে জন্মভূমির প্রতি টান আর ভালোবাসা কখনো কিঞ্চিত পরিমাণ কমেনি। ফলে দায়িত্বের কারণে ভারত, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার, কম্বোডিয়াসহ এশিয়ার যেকোনো দেশে সফরে গেলে স্বল্প সময়ের জন্য হলেও দেশে ঢুকে মা ও মাতৃভূমির ভালোবাসায় নিজেকে সিক্ত করতাম।
কিন্তু ২০০৮ সালে প্রহসনের নির্বচনের মাধ্যমে গণবিরোধী একটি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশে যাওয়া বাধাগ্রস্ত হতে থাকে, আর ২০১৩ সালের পর থেকে ভালোবাসার সে দেশটি একটি ঝুঁকিপূর্ণ দেশে পরিণত হয়ে যায়। মানুষের জীবন, সম্পদ, মান-মর্যাদা কোনো কিছুরই নিরাপত্তা নেই। বাক-স্বাধীনতার লেশমাত্র অবশিষ্ট ছিল না।

আমার এক আইনজীবী বন্ধু একবার এয়ারপোর্টে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে জীবন হারাতে বসেছিল। ব্রিটিশ নাগরিক না হলে হয়তো লাশ হয়েই ফিরে আসতে হতো। নিরাপত্তাহীনতার মাত্রা এতই ভয়াবহ রূপ ধারণ করে যে, মারাত্মকভাবে অসুস্থ মা সংজ্ঞা ফিরে পাওয়ার পর প্রথম যে কথাটি বলেন তা ছিল- ‘আমার অসুস্থতার খবর শুনে আমার ছেলে যেন দেশে না আসে। আমি আমার নাতিগুলোকে এতিম বানাতে চাই না।’
এ ভয়াবহ পরিস্থিতির কারণে ২০১৩ সালের পর থেকে বেশ কয়েক বছর দেশে যাওয়া হয়নি বললেই চলে। মাঝে মধ্যে ভাবতাম, আর বুঝি কখনোই মাতৃভূমির মুখ দেখব না। ২০২২ সালে আম্মা স্ট্রোক করার পর জীবনের ঝুঁকি নিয়েই দেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আলহামদুলিল্লাহ, যথেষ্ট প্রতিকূলতার মধ্যেও শুধু মাকে দেখার জন্য কয়েকবার দেশে যাই। সে সময় কড়া তাগিদ ছিল, ‘মাকে দেখতে এসেছেন, শুধু তাই করবেন।’ তবে এখানে একটি সত্য বলে রাখা আবশ্যক, সব প্রতিকূলতার মধ্যেও আমার এলাকার মানুষের ভালোবাসায় আমি কখনো ঘাটতি অনুভব করিনি।

যাই হোক, জুলুম চিরদিন চলে না। মজলুমের আর্তনাদ ও সংগ্রাম বৃথা যায় না। সেই চিরন্তন নিয়মে আলহামদুলিল্লাহ, ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক অভ্যুত্থান ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে (৫ আগস্ট ২০২৪) দেশ জালিমের রাহুমুক্ত হলো এবং নতুন স্বাধীনতা পেলো। মানুষ বহুদিন পর মুক্ত বাতাসে স্বাধীন দেশে ঘুরার সুযোগ লাভ করল। ৭ আগস্ট একটি পূর্বনির্ধারিত প্রোগ্রামে আমাকে প্রায় দেড় সপ্তাহের জন্য আমেরিকা যেতে হয়। সেখানে থাকতেই পরিবার ও আপনজনদের কাছ থেকে দেশে যাওয়ার তাগিদ ওঅনুরোধ আসতে থাকে। আমেরিকা সফরের দুই সপ্তাহ পরই আমার সপরিবারে সৌদি আরব সফরের schedule ছিল। ভাবলাম, এ সফরের সাথে মিলিয়ে আমি ক’দিনের জন্য বাংলাদেশে ঘুরে আসতে পারি। অবশেষে পরিবার ও সংগঠনের সম্মতি নিয়ে তাই করলাম, তবে কাউকে খবর না দিয়ে।
দেশে গিয়ে যা দেখলাম- ঢাকা এয়ারপোর্টে নেমেই একটু বিস্মিত হলাম। মনে হলো কোনো এক নতুন দেশে এলাম। সব কিছুই যেন বদলে গেছে। আগের মতো দম্ভপূর্ণ কোনো চেহারা নজরে পড়ল না। আগে নামলেই দেখা যেত- ‘অমুকের দেশে স্বাগতম’, যেন কারো বাপের ভিটায় পা দিয়েছি। এবার এসব দেখলাম না। মনে হলো- জনতার দেশে এসেছি। প্রথমে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছে, এত দ্রুত এত বড় পরিবর্তন সম্ভব। যতই আগাই ততই দেখি ইতিবাচক পরিবর্তনের নিশানা। কোনো টেনশন নেই, কোনো শঙ্কা নেই। সবাই দেখি বেশ relaxed. ভালই লাগল।

সবচেয়ে বেশি মনে দাগ কেটেছে কিছু দেয়াললিখন। বিশেষত, একটি স্লোগান- ‘পানি লাগবে?’ এ স্লোগানটি পড়ে মনের অজান্তে চোখে পানি এসে গেল। এ স্লোগানটি সাক্ষী দেয়, ১৭ জুলাই ২০২৪ থেকে ৫ আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত বাংলার মাটিতে কী কারবালা কাণ্ড ঘটে গিয়েছিল। আবু সাঈদ আর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধের মতো ঈমানের বলে বলিয়ান শহীদরা কিভাবে জীবন বাজি রেখে দেশ মাতৃকার মুক্তির জন্য অকাতরে সব কিছু বিলিয়ে দিয়েছে। মহান আল্লাহ মুগ্ধ, আবু সাঈদ এবং তাদের পথ ধরে যারা ইনসাফ ও মানবতার মুক্তির জন্য ঈমানের চেতনা নিয়ে জীবন দিয়েছে তাদের শাহাদতকে কবুল করুন এবং বাংলাদেশকে চিরদিন স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের রাহমুক্ত রাখুন, আমিন।

‘পানি লাগবে?’ বাংলার দেয়ালে দেয়ালে এ লিখন প্রমাণ করে, জুলাই ও আগস্ট বিপ্লব ছিল মানবতার মুক্তি আন্দোলনের বিজয়। মহান আল্লাহ এ বিজয়কে চিরস্থায়ী করুন, আমিন।
আশার কথা : দেশে মাত্র পাঁচ দিন ছিলাম। তবে পাঁচ দিনে মনে হয়েছে পাঁচ সপ্তাহের কাজ করে ফেলেছি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বেশ কয়েকজন উপদেষ্টার সাথে দেখা ও কথা বলার সুযোগ হলো। কোনো স্বার্থের জন্য নয়, প্রবাসীদের পক্ষ থেকে তাদেরকে জাতির এ ক্রান্তিকালে সাহস করে দায়িত্ব গ্রহণের জন্য ধন্যবাদ জানানোর জন্য এবং যেখানে সম্ভব সহযোগিতার আশ্বাস দেয়ার জন্য। কোনো আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ছাড়াই সবার সাথে দেখা হলো এবং খোলামেলা আলোচনা হলো।
সবক’জন উপদেষ্টাই দেখলাম সাদামাটা। আগের মন্ত্রী-মিনিস্টারদের মতো তাদের মধ্যে মন্ত্রিত্বের কোনো ঠাঁটবাট দেখলাম না। যথেষ্ট মানবিকতা, মমত্ববোধ, দায়িত্বশীলতা এবং দেশপ্রেম লক্ষ করলাম তাদের কাজ ও আচরণে। শুনলাম, সবাই নিজ নিজ বাসায় অবস্থান করছেন। মনে হলো- যেন আমি কোনো উন্নত ও সভ্য দেশের মন্ত্রী-মিনিস্টারদের সাথে মিটিং করছি।

এক সিনিয়র উপদেষ্টা জানালেন, গত দুই-তিন সপ্তাহের মধ্যে তিনি পাঁচটি বিদেশ সফরের দাওয়াত পেয়েছেন। উনি সবটাই reject করেছেন এ কারণে যে, দেশের স্বার্থে এখন বাইরে যাওয়া ঠিক হবে না। উনার জবাব শুনে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা অবাক বিস্ময়ে বললেন, এটি কেমন কথা স্যার। আগের মন্ত্রীরা তো বিদেশী দাওয়াত পেলে কখনো reject করতেন না; বরং বিশাল দলবল নিয়ে বিদেশে যেতেন। জাতিসঙ্ঘ সাধারণ অধিবেশনে আগের প্রধানমন্ত্রী প্লেন বোঝাই করে নিজ দলের দেড়-দুই শ’ লোক নিয়ে যেতেন। একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় চাকরির সুবাদে জাতিসঙ্ঘ সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে গিয়ে আমি স্বচক্ষে একবার জাতীয় কোষাগারের এ হরিলুট দেখেছি। কিন্তু এবার জানলাম বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা তার টিমে essential মাত্র ৯ জন লোক নিয়ে জাতিসঙ্ঘ সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিয়ে কৃচ্ছ্রতা সাধনের এক বিরল ইতিহাস রচনা করেছেন।

সব উপদেষ্টাই দেখলাম তাদের অফিসে কারো কাছ থেকে উপঢৌকন নেন না। দেশ গড়ার জন্য যেকোনো পরামর্শকে সাদরে গ্রহণ করছেন। আমার দায়িত্বের কারণে ইতঃপূর্বে বেশ কিছু উন্নত ও গণতান্ত্রিক দেশের মন্ত্রী ও আমলাদের সাথে মিটিং করতে হয়েছে। তাদের সাথে দেখা করতে বা মিটিং করতে গিয়ে, তাদের সহজ সরল ও সাদামাটা চালচলন দেখে বলতাম, আহারে আমাদের দেশটিতে যদি এ রকম গণমুখী মন্ত্রী-মিনিস্টার হতো, দেশটা কতই না উন্নত হতো। এবার উপদেষ্টাদের যে ক’জনের সাথে দেখা হলো সবার মধ্যেই সে অনাড়ম্বরতা এবং গণমুখী আচরণ দেখে মনে হলো যেন আমার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিতে চলছে, আলহামদুলিল্লাহ।
যেকোনো দেশে এরকম একটি বিপ্লব বা গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে বহু সময় লাগে। কোনো কোনো দেশ পাঁচ বা ১০ বছরেও ন্যূনতম শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। সে দিক থেকে বিপ্লবোত্তর যত দ্রুত বাংলাদেশে শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে তা সত্যিই প্রশংসার যোগ্য।
স্বৈরাচারী আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত ও স্বৈরশাসনের দোসর পুলিশ প্রশাসনের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অফিসারের অসহযোগিতা সত্ত্বেও এত দ্রুত শৃঙ্খলা আনা সম্ভব হয়েছে বিপ্লবী ছাত্র-জনতার অবিস্মরণীয় সহযোগিতা ও দেশাত্ববোধের কারণে। এতে প্রমাণ হয়, দেশপ্রেম ও আন্তরিকতা নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করলে আল্লাহর সাহায্য অনিবার্য হয় এবং দেশ গঠনে অনেক অসম্ভবকেও সম্ভব করা যায়। বিপ্লব এবং বিপ্লব-পরবর্তী সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা বাংলাদেশের ইতিহাসে দেশ গঠনে এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

আরেকটি বড় আশার দিক হচ্ছে ছাত্র-জনতার অটুট ঐক্য। পতিত স্বৈরাচারের অবৈধ সুবিধাভোগীরা অহর্নিশ চেষ্টা করছে নানা প্রতিবিপ্লবের মাধ্যমে ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করার জন্য। আলহামদুলিল্লাহ, ছাত্র-জনতার সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ বেশ কয়েকটি ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করেছে। আমার আশা, একটি কাক্সিক্ষত স্থিতিশীল ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ছাত্র-জনতা কোনো ষড়যন্ত্রে পা দেবে না এবং সিসা গলানো প্রাচীরের মতো ঐকবদ্ধভাবে সব ষড়যন্ত্রকে প্রতিরোধ করবে ইনশা আল্লাহ।
ড. ইউনূসের খ্যাতি, সততা ও আন্তর্জাতিকভাবে উঁচু অবস্থানের কারণে তিনি সরকারপ্রধান হওয়ায় এ সরকারের প্রতি দেশের মানুষের আস্থা ও প্রত্যাশা অতীতের যেকোনো সরকারের চেয়ে অনেক বেশি। জন-মানুষের, বিশেষত বিপ্লবী তরুণদের এ আস্থা ও আশা বাংলাদেশে একটি টেকসই গণতান্ত্রিক কাঠামো স্থাপনে সহায়তা করবে, ইনশাআল্লাহ।

বিগত গণ-অভ্যুত্থান চলাকালে সেনাবাহিনী ছাত্র-জনতার প্রতি গুলি ছুড়েনি, ফলে সেনাবাহিনীর গুলিতে কোনো আন্দোলনকারী প্রাণ হারায়নি। বিলম্বে হলেও তারা জনগণের পক্ষে অবস্থান নিয়ে স্বৈরাচারী সরকারের ভিতকে দুর্বল করেছে যার ফলে ৫ আগস্ট ২০২৪ ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ত্বরান্বিত হয়েছে।
আমাদের সমাজে একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ আছে, ‘শেষ ভালো যার সব ভালো তার’। আমার মনে হয় তাই ফ্যাসিস্ট সরকারের সহায়তায় সেনাবাহিনীর অতীত ভূমিকা যাই থাকুক না কেন, জনগণ শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনীকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছে। আমি লক্ষ করেছি, সেনাবাহিনী প্রধান এবং তার বাহিনীর প্রতি জনগণের আস্থা এবং শ্রদ্ধা আছে যে, সেনাবাহিনী দেশ ও জাতির স্বার্থে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সহায়তা করে বাংলাদেশে একটি টেকসই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিনির্মাণের মাধ্যমে জনগণের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বিপ্লবকে সফল করবে, ইনশাআল্লাহ। তবে কারো কারো এ আশঙ্কাও আছে যে, বহুমুখী টোপ আর লোভের শিকার হয়ে সেনাবাহিনীর কেউ কেউ বিপথগামী হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। যাই হোক, আমার দৃঢ় বিশ্বাস এবং প্রত্যাশা, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না এবং নীতির প্রশ্নে আপসহীন থাকবে।

সবচেয়ে বড় আশা এবং আনন্দের দিক হচ্ছে- ফ্যাসিবাদের পতন ও মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য দলমত নির্বিশেষে ছাত্র-জনতার ইস্পাতকঠিন ঐক্য। এ বিপ্লব বা গণ-অভ্যুত্থান পর্যালোচনায় দেখা যায়, পাঁচটি উপাদান এ ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনকে সফল করার ক্ষেত্রে মৌলিকভাবে কাজ করেছে : ১. অধিকার আদায়ের অপ্রতিরোধ্য ভিশন (Compelling vision); ২. লক্ষ্য অর্জনে আপসহীন অঙ্গীকার (Uncompromising Commitment); ৩. নিখুঁত দক্ষতা ও যোগ্যতা (Competence); ৪. নিখাদ দেশপ্রেম এবং ৫. আল্লাহর সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা। আর এ পাঁচটি উপাদানকে অপ্রতিরোধ্য শক্তি দিয়েছে দল-মত এবং ক্ষুদ্র ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে লক্ষ্য অর্জনে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও ইস্পাতকঠিন ঐক্যের প্রতিফলন ঘটানো, যা সর্বস্তরের জনতার মনে আন্দোলনের সফলতার ব্যাপারে আস্থা জুগিয়েছে এবং তাদেরকে রাজপথে নামতে উৎসাহ জুগিয়েছে।
গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী চ্যালেঞ্জিং দিনগুলোতেও ছাত্র-জনতার এ ঐক্য অটুট ছিল এবং এখনো আছে। তবে কিছুটা শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, এ ঐক্যে ফাটল ধরানোর জন্য পতিত স্বৈরাচারের দোসররা অহর্নিশ নানা ষড়যন্ত্রের জাল বুনে যাচ্ছে। সব ষড়যন্ত্রের মোকাবেলায় আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি নেতা ও সংগঠনকে সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে, যাতে ষড়যন্ত্রের কোনো ফাঁদে তারা কোনো অবস্থাতেই আটকে না যায়। পতিত স্বৈরাচারের কুশলী এবং দোসররা রং আর বোল পাল্টাতে ওস্তাদ। তাদের কাছে লুটে নেয়া অজস্র টাকা ও সম্পদের পাহাড় আছে। তারা যেন কোনো অবস্থাতেই টাকা দিয়ে অথবা রং বদলিয়ে ছাত্র-জনতার ঐক্যের মধ্যে ফাটল ধরাতে না পারে সে বিষয়ে অহর্নিশ সতর্ক থাকতে হবে। আমার বিশ্বাস, ছাত্র-জনতা এ ক্ষেত্রে আপসহীন থাকবে, ইনশাআল্লাহ।

কিছু চ্যালেঞ্জ : নতুন সরকারের সামনে যে সব চ্যালেঞ্জ লক্ষ করছি তার মধ্যে পাঁচটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ-
১. অবাস্তব আশা অথবা অতিরিক্ত প্রত্যাশা : একদিকে দীর্ঘ ১৫ বা ১৬ বছর মানুষ অবর্ণনীয় জুলুম, নির্যাতন ও বঞ্চনার শিকার। অপরদিকে, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দলীয়করণ ও পরিবারতন্ত্র কায়েমের মাধ্যমে সরকারের সব কাঠামো ধ্বংসপ্রায়। মানুষের প্রত্যাশা, এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেন সব কিছু খুব দ্রুত ঠিক করে নেয়। এখনো এ সরকারের বয়স চার মাস হয়নি, এর মধ্যেই হা-হুতাশ শুরু করেছে। কি করছে সরকার, এখনো প্রায় সব জায়গায় আগের মতো দুর্নীতি ও অনিয়ম চলছে। পরিবর্তন কই? উপদেষ্টাদের সাথে আলোচনা করে যা বুঝলাম, রাষ্ট্রের সব কাঠামোকে ফ্যাসিবাদী সরকার এমনভাবে বিপর্যস্ত করেছে যে, এ খানে ‘সর্বাঙ্গে ব্যথা ওষুধ দেবো কোথা’ এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অপর দিকে, প্রায় সবাই চায় দ্রুত (রাতারাতি) পরিবর্তন। এ অবস্থায় পর্বতসম সমস্যার বাস্তবভিত্তিক সমাধানে মনোনিবেশ ও জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ভারসাম্য বজায় রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দোয়া করি, মহান আল্লাহ যেন ধৈর্যের সাথে জনগণের প্রত্যাশা পূরণে উপদেষ্টাসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে কাজ করার তৌফিক দেন, আমিন। সবাইকে মনে রাখা দরকার, ধৈর্য এবং আন্তরিক চেষ্টাই সাফল্যের চাবিকাঠি।
২. আইনশৃঙ্খলা : আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক হয়নি। প্রায় ২০ শতাংশ পুলিশ সদস্য এখনো কাজে যোগ দেয়নি। যারা যোগ দিয়েছেন তাদের অনেকেই এখনো গাছাড়া দিয়ে আছেন। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন চলাকালে এবং ফ্যাসিস্ট সরকারের শাসনামলে পুলিশের নির্মম আচরণের কারণে পুলিশ প্রশাসনের প্রতি জনগণের আস্থা শূন্যের কোটায়। এ কারণে পুলিশ বাহিনীর নৈতিক সাহস নেই বললেই চলে। সঙ্গত কারণেই এর একটি বিরাট নেতিবাচক প্রভাব আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উপর পড়ছে। বিপ্লব-পরবর্তী ছাত্র-জনতা আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেশ কিছু দিন দায়িত্ব পালন করলেও তা কিন্তু আল্টিমেট সমাধান নয়।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্বলতার সুযোগে পতিত স্বৈরাচারের প্রেতাত্মারা পরিস্থিতি ঘোলাটে করার অহর্নিশ চেষ্টা চালাচ্ছে। তাই আইনশৃঙ্খলার নিয়ন্ত্রণ বর্তমান সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি অচিরেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। সম্প্রতি সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে মাঠে নামানোর কারণে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তবে এ ব্যবস্থা স্থায়ী নয়। তাই এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া আবশ্যক। এ ক্ষেত্রে সরকার উন্নত দেশের স্টাইলে কমিউনিটি পুলিশ ব্যবস্থার প্রচলন ও অপরাধী পুলিশ সদস্যদের পরিবর্তন এবং দ্রুত শূন্যস্থান পূরণের জন্য নিয়োগের ব্যবস্থা করতে পারে।
৩. স্বৈরাচারের ভূত : স্বৈরাচার বা ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন হলেও ‘স্বৈরাচারের ভূত’ কিন্তু এখনো সরকারি স্থাপনার বিভিন্ন পর্যায়ে বহাল তবিয়তেই আছে। তারা নানা কৌশলে সরকারের বিভিন্ন ইতিবাচক পদক্ষেপকে চ্যালেঞ্জ করছে অথবা ব্যর্থ করার চেষ্টা করছে। এ ভূতগুলোকে যতদিন সরানো যাবে না ততদিন এ বিপ্লবের সত্যিকার ফসল ঘরে ঢুকানো যাবে না। এ ক্ষেত্রে দ্রুত পদক্ষেপ একান্ত আবশ্যক।
৪. ষড়যন্ত্র : পতিত স্বৈরাচারের দেশী-বিদেশী এজেন্টরা এ বিপ্লবকে নস্যাৎ করার জন্য এবং বিপ্লবীদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টির জন্য হেন চেষ্টা নেই তারা করছে না। অর্থ, পদ-পদবি ও নানান সুযোগ-সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে তারা এ লক্ষ্য হাসিলের চেষ্টা করছে। সার্বক্ষণিক সচেনতা এবং জনতার জাগরণকে ধরে রাখাই হচ্ছে এ ষড়যন্ত্র মেকাবেলার অন্যতম উপায়।

৫. রাজনৈতিক : রাজনীতি ক্রমেই জটিল আকার ধারণ করছে। ক্ষমতার জন্যই যারা রাজনীতি করে তারা বেশিক্ষণ ক্ষমতার লাইনে অপেক্ষা করতে পারে না। যতই সময় যায় ততই তাদের অস্থিরতা বেড়ে যায়। এ অস্থিরতা ক্রমেই সমাজকে কলুষিত করতে থাকে। এ লক্ষণ ইতোমধ্যে দেখা দিতে শুরু করেছে। এ অস্থিরতার প্রশমন ঘটিয়ে বিপ্লবের লক্ষ্য হাসিলের জন্য প্রয়োজনীয় সময় ম্যানেজ করা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সফলভাবে এ চ্যালেঞ্জ মেকাবেলা করতে না পারলে বিপ্লব মুখথুবড়ে পড়তে পারে। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে dialogue বাড়ানো দরকার। তাদের সাথে আলাপ করে যত দ্রুত সম্ভব সংস্কার ও নির্বাচনের একটি কার্যকর রোডম্যাপ ঘোষণা করা দরকার, যাতে সবাই স্বস্তিতে থাকে এবং জাতিকেও স্বস্তিতে থাকতে দেয়।
দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে মহানুভবতা ও দায়িত্ববোধ নিয়ে দেশমাতৃকাকে গড়ার কাজে সবার ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা দরকার।
এ কথা পরিষ্কার যে, বিগত ফ্যসিবাদী সরকার দেশের অর্থনীতি, আইনশৃঙ্খলা, বিচার ব্যবস্থা, প্রশাসন, সমাজ কাঠামো- সব কিছুকেই বিপর্যস্ত করে গেছে। এ ভঙ্গুর রাষ্ট্রকাঠামোকে ঢেলে সাজানোর কাজটা অনেক বড় এবং চ্যালেঞ্জিং। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান-পরবর্তী এ কঠিন সময়ে যারা এ মহান দায়িত্ব নিয়েছেন তারা বড় ধরনের সাহসিকতা ও দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়েছেন। প্রচলিত সরকারের মতো তাদের বিশাল বহরের মন্ত্রিপরিষদ নেই। একেকজন দু’-তিনটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করছেন। চারপাশে সহযোগিতার হাতও খুব কম। স্বৈরাচারের প্রেতাত্মারা ওঁৎপেতে বসে আছে সুযোগের অপেক্ষায়। এমতাবস্থায় তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা না করলে দেশে স্থিতিশীলতা ও গতিশীলতা এনে কাক্সিক্ষত সংস্কার সূদুর পরাহত হবে।

মনে রাখা দরকার, সমালোচনা করা সহজ কিন্তু চ্যালেঞ্জিং সময়ে অর্থবহ কাজ করা বড় দুষ্কর। কর্মহীন সমালোচনা দুশমনির নামান্তর। তাই লাগামহীন সমালোচনার পথ পরিহার করে গঠনমূলক ও পরিমার্জিত সমালোচনা করা উচিত। গঠনমূলক সমালোচনার পাশাপাশি যার যা সামর্থ্য আছে তা নিয়ে দেশ গঠনে অন্তর্বর্তী সরকারকে এবং সরকারি অবকাঠামোর বাইরেও যেখানে সম্ভব সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসা দরকার।
আমরা যারা দেশের বাইরে বিভিন্ন দেশে নাগরিকত্ব নিয়ে অবস্থান করছি এবং গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছি, মাতৃভূমি হিসেবে বাংলাদেশের প্রতি আমাদের যে দায়িত্ব আছে তা পালন করা দরকার। প্রত্যেকে যার যার অবস্থান থেকে সামর্থ্য অনুসারে সর্বাত্মক সহযোগিতার জন্য নিজ দায়িত্বে এগিয়ে আসা সরকার। এ বিপ্লবকে কোনোভাবেই ব্যর্থ হতে দেয়া যাবে না।
লেখক : আজাদ এমসিএর কেন্দ্রীয় প্রেসিডেন্ট, খ্যাতিমান আইনজীবী ও মানবাধিকার ব্যক্তিত্ব।

 

 


আরো সংবাদ



premium cement