১৯ অক্টোবর ২০২৪, ৩ কার্তিক ১৪৩০, ১৫ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

মাউন্ট এভারেস্টের কথা

মাউন্ট এভারেস্টের কথা -


রিজওয়ান পুরান ঢাকার একটি নাম করা স্কলের দশম শ্রেণীর একজন সেরা ছাত্র। বিভিন্ন বিয়য়ে মোটামুটি খোঁজখবর রাখে সে। বিজ্ঞান বিষয়ে তার আগ্রহ সবচেয়ে বেশি। মাউন্ট এভারেস্টের একটি খবর তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। আর তা হলো এভারেস্ট এমনিতেই পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতচূড়া, সেটি নাকি আরো উঁচু হচ্ছে। মানে উচ্চতা বাড়ছে। সে গেল ছোট চাচু কিবরিয়ার কাছে। একটি ভার্সিটির অনার্সের ছাত্র। ফাইনাল ইয়ার। বিষয়টি তিনি ব্যাখ্যা করলেন। তিনি জানালেন, পাদদেশ দিয়ে বয়ে যাওয়া একটি নদীতে ভূমিক্ষয়ের কারণে বিশ্বের উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গটির উচ্চতা ১৫ থেকে ৫০ মিটার পর্যন্ত বেড়ে গেছে বলে নতুন একটি গবেষণাপত্রে জানা গেছে। ওই নদীতে ভূমিক্ষয় হয়ে যে পাথর ও মাটি সরে যাচ্ছে নদীবক্ষ থেকে, তারই চাপে মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে গবেষকরা জানাচ্ছেন।

সাধারণ তথ্য : এভারেস্ট পর্বত বা মাউন্ট এভারেস্ট নেপালে সগরমাথা এবং তিব্বতে চোমোলাংমা নামে পরিচিত। এটি বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ। এই শৃঙ্গটি হিমালয়ের মহালঙ্গুর হিমাল পর্বতমালায় অবস্থিত। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে এর উচ্চতা ৮,৮৪৮ মিটার (২৯,০২৯ ফুট) হলেও পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে এই শৃঙ্গের দূরত্ব সর্বাধিক নয়। চীন ও নেপালের আন্তর্জাতিক সীমান্ত এভারেস্ট পর্বতের শীর্ষবিন্দু দিয়ে গেছে। এভারেস্ট শৃঙ্গের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ হলো ৩০ ফুট ও ছয় ফুট। ১৮৫৬ সালে এভারেস্ট পর্বতের (যা তৎকালীন যুগে ১৫ নং পর্বতশৃঙ্গ নামে পরিচিত ছিল) উচ্চতা নির্ণয় করা হয় ৮,৮৪০ মি (২৯,০০২ ফটু)। ১৮৬৫ সালে ভারতের সার্ভেয়ার জেনারেল অ্যান্ড্রিউ স্কট ওয়াহর সুপারিশে রয়েল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটি তার পূর্বসূরি জর্জ এভারেস্টের নামে ১৫ নং পর্বতশৃঙ্গের নাম পরিবর্তন করে এভারেস্ট পর্বত রাখেন। ১৯৫৫ সালে একটি ভারতীয় জরিপে এই শৃঙ্গের উচ্চতা নির্ণয় করা হয় ৮,৮৪৮ মি (২৯,০২৯ ফুট), যা ১৯৭৫ সালে একটি চীনা জরিপ দ্বারা নিশ্চিত করা হয়।
এখন কি বলছেন বিজ্ঞানীরা? ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডনের বিজ্ঞানীরা বলছেন, এভারেস্ট থেকে প্রায় ৭৫ কিলোমিটার দূরে অরুণ নদী অববাহিকার ভূমিক্ষয়ের ফলেই প্রতি বছর মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা দুই মিলিমিটার পর্যন্ত বাড়ছে। ‘এটা অনেকটা পণ্যবাহী জাহাজ থেকে মালপত্র ফেলে দেয়ার মতো ব্যাপার’ জানাচ্ছিলেন ওই গবেষণাপত্রের সহলেখক অ্যাডাম স্মিথ। তার ব্যাখ্যা, ‘জাহাজ থেকে পণ্য ফেলে দেয়া হলে জাহাজটি কিছুটা ওপরে ভেসে থাকতে পারে, তাই ভূ-ত্বকের ক্ষরণ হলে পর্বতশৃঙ্গটিও কিছুটা ওপরে উঠে যাবে।’

পাদদেশ দিয়ে বয়ে যাওয়া অরুণ নদী অতিরিক্ত মাটি ও পাথর কেটে নিয়ে যাচ্ছে, সেই চাপেই ফুলে উঠছে পর্বতশৃঙ্গ
যেভাবে সর্বোচ্চ শৃঙ্গের উচ্চতা বাড়ছে : প্রায় চার থেকে পাঁচ কোটি বছর আগে ভারতীয় প্লেট ও ইউরেশিয়ান প্লেটের মধ্যে ধাক্কার অভিঘাতে হিমালয়ের জন্ম হয়েছিল। দু’টি প্লেটের ঘাত-অভিঘাতের কারণে এখনো হিমালয়ের উচ্চতা বেড়ে চলেছে। তবে ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডন বা ইউসিএলের বিজ্ঞানীরা বলছেন যে, দু’টি প্লেটের ঘাত-অভিঘাত ছাড়াও মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা বৃদ্ধির বাড়তি আরো একটি কারণ অরুণ নদীতে ঘটে যাওয়া ভূ-বৈজ্ঞানিক পরিবর্তনগুলো। হিমালয়ের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়ার পথে অরুণ নদী-নদীবক্ষ, অর্থাৎ ভূ-ত্বক থেকে পাথর ও মাটি কেটে নিয়ে যায়। এর ফলে ভূ-ত্বকের ঠিক নিচে ম্যান্টেল নামের যে স্তরটি রয়েছে তা উপরের দিকে ফুলে ওঠে। এই প্রক্রিয়াটিকে ভূ-বিজ্ঞানের তত্ত্বে আইসোস্ট্যাটিক রিবাউন্ড বলা হয়ে থাকে।

নেচার জিওসায়েন্স পত্রিকায় প্রকাশিত গবেষণাপত্রটিতে বলা হয়েছে, এই ভূ-বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ার ফলে এভারেস্ট ও সেটির কাছাকাছি অঞ্চলের অন্যান্য পর্বতশৃঙ্গগুলোকে ওপরের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এভারেস্ট ছাড়াও বিশ্বের চতুর্থ ও পঞ্চম সর্বোচ্চ শৃঙ্গ- যথাক্রমে লোৎসে এবং মাকালুর উচ্চতাও বেড়ে যাচ্ছে। গবেষণাপত্রটির আরেকজন সহলেখক ড. ম্যাথু ফক্স ব্যাখ্যা করছিলেন, ‘ভূমিক্ষয়ের ফলে যে হারে মাউন্ট এভারেস্ট ও কাছাকাছি অন্যান্য শৃঙ্গগুলোর উচ্চতা কমছে, তার থেকে বেশি হারে আইসোস্ট্যাটিক রিবাউন্ড শৃঙ্গগুলোকে ঠেলে ওপরের দিকে ঠেলে তুলে দিচ্ছে।...আমরা জিপিএস যন্ত্র ব্যবহার করে দেখেছি যে, ওই পর্বতশৃঙ্গগুলোর উচ্চতা বছরে প্রায় দুই মিলিমিটার করে বাড়ছে। এই উচ্চতা বৃদ্ধির কারণ আমাদের কাছে এখন আগের থেকে অনেক পরিষ্কার ।’ বলছিলেন ম্যাথু ফক্স।
ওই গবেষণার সাথে যুক্ত নন, এমন কয়েকজন ভূ-বিজ্ঞানী বলছেন, এই তত্ত্বটি বিশ্বাসযোগ্য ঠিকই, কিন্তু নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরো গবেষণার প্রয়োজন আছে। অরুণ নদী তিব্বত থেকে নেমে আসে নেপালে। আরো দু’টি নদীর সাথে মিলিত হয়ে ওই নদীটির নাম হয় কোশী। কোশী নদী নেপাল থেকে উত্তর ভারতে প্রবেশ করেছে, যা পরে আবার গঙ্গায় মিশেছে। খাড়া পর্বতমালার মধ্যে দিয়ে অরুণ নদী প্রচণ্ড স্রোতে নেমে আসে, তার ফলে নদীটির পলিমাটি কেটে নিয়ে আসার ক্ষমতাও খুব বেশি। নদীটির যাত্রাপথে তাই প্রচুর পরিমাণে পাথর আর মাটি বয়ে আনে।

অরুণ নদীর অববাহিকা
চায়না ইউনিভার্সিটি অব জিওসায়েন্সের গবেষক ড. শু হান ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডনের প্রকাশিত গবেষণাপত্রটির মূল লেখক। ইউসিএলে একটি স্কলারশিপে এসে গবেষণাপত্রটির কাজ করেছিলেন তিনি। তার কথায়, ‘মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা বৃদ্ধি আরো বেশি করে আমাদের দেখিয়ে দেয় যে ভূ-ত্বক আসলে কতটা গতিশীল একটা ভূ-বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া।’
ইউসিএলের গবেষণাপত্রটি জানাচ্ছে, তিব্বত থেকে বয়ে আসা আরো একটি নদী খাতের সাথে যে সময়ে মিশেছে অরুণ নদী, তখন থেকেই বিপুল মাটি আর পাথর কেটে নিত নদীবক্ষ থেকে। তার পরিমাণ এবং গতি সম্ভবত আরো বেড়েছে। ইউনিভার্সিটি অব এডিনবরার স্কুল অব জিওসায়েন্সেসের অধ্যাপক হিউ সিনক্লেয়ার ইউসিএলের ওই গবেষণার বিষয়ে বলছেন, যে ইউসিএলের গবেষকরা মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা বৃদ্ধির যে অন্তর্নিহিত কারণ খুঁজে বের করেছেন, তা যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত।
তবে তিনি এটিও বলছেন, নদীবক্ষের মাটি আর পাথর কেটে নেয়ার সঠিক পরিমাণ ও সময়কাল এবং তার ফলে আশপাশের শৃঙ্গগুলোর উচ্চতা বৃদ্ধির মধ্যে অনেক অনিশ্চয়তা এখনো আছে। তার কথায়, ‘প্রথমত, একটি নদীপথ আরেকটি নদী খাতে মিশে যাওয়ার ফলে বিরাট অববাহিকাজুড়ে একটি নদীবক্ষের মাটি ও পাথর কেটে আনার পরিমাণ হিসাব করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।’ এই অনিশ্চয়তার কথা মানছেন গবেষণাপত্রটির লেখকরাও।

 


আরো সংবাদ



premium cement