২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

মহিষখোলা গ্রাম

-

প্রত্যেক মানুষের ভেতরেই একটা শিল্পমন কাজ করে। মানুষ যদি ভেতরের শিল্পীত এ মনকে উপযুক্ত পরিচর্যা করে তবেই তা মোহ ও মাধুর্যের মাদকতায় অন্যকে আকৃষ্ট করে। সাহিত্য শিল্পেরই একটি জৌলুসপূর্ণ ধারা যা মানুষকে মোহিত করে অতি সহজে। শিল্প-সাহিত্যের এই অঙ্গনটি বরাবরই শক্তির আধার। একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বায়নের যুগে এ শক্তিতে যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা। একজন শিল্পীর হাতের ছোঁয়ায় গড়ে ওঠে নতুন কোনো কথামালার। স্থপতি রাজন দাশ সিলেটের জনপ্রিয় এক নাম। স্যারের বেশ কিছু স্থাপত্যকর্ম প্রশংসা অর্জন করেছে। অনেক দিন ধরে প্ল্যান করছি স্যারকে নিয়েই বের হবো তার স্থাপত্যকর্মগুলো দেখতে। কিন্তু স্যার সবসময় ব্যস্ত থাকায় ব্যাটেবলে মিলছিল না। অনেক দিন স্যারের পেছনে ঘ্যান ঘ্যান করতে করতে স্যার একদিন বিকেলে ফোন দিলেন। স্যারের সাথে বের হওয়ার জন্য দিনক্ষণ ঠিক করে ফেললাম। স্যারের কথামতো সকাল সকাল রওনা হতে হবে তাই এর প্রস্তুতি হিসেবে আগের দিন রাতে ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রাখলাম। পর্দার ফাঁক দিয়ে তির্যকভাবে আলো প্রবেশ করছে। আলোকিত করছে পুরো ঘর। এর মাঝেই ঘড়ি ডেকে উঠল, সময় হয়েছে এবার ঘুম থেকে ওঠার। ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছা করছিল না। শীতের সকালে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শোয়ার মজাই আলাদা। তাই আবার ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু কি হবে, মা আবার কানের সামনে ঘ্যান ঘ্যান শুরু করলেন। তাড়াতাড়ি ওঠ, তুই বুঝি ঘুরতে বের হবি, দেরি করে বের হলে তো কিছুই দেখতে পাড়বি না। না পারতে ঘুম থেকে উঠতেই হলো আমাকে। উঠে দেখি এর মধ্যে রাজন স্যার কয়েকবার ফোন দিয়েছেন। দ্রুত প্রস্তুতিপর্ব শেষ করে তৈরি হয়ে নিলাম। এ দিকে পাইলটও এসে উপস্থিত। বেরিয়ে পড়লাম আমরা। রাজন স্যারকে তার বাসা থেকে তুললাম। এক স্নিগ্ধ সকালে আমরা এগিয়ে চললাম। জিন্দাবাজার, চৌহাট্টা, আম্বরখানা পেরিয়ে এগিয়ে চলছি আমরা। মহাসড়কে সূর্যদেবের আভা পড়েছে তির্যকভাবে। আমরা যাচ্ছি সুনামগঞ্জ জেলার উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে ভারত-সীমান্ত লাগোয়া ধর্মপাশা উপজেলায় মহিষখোলা গ্রামে। সেখানে ঘুমিয়ে আছেন একাত্তরের বীর শহীদেরা। প্রকৃতির পালা বদলে বসন্তকাল আসি আসি তাই প্রকৃতির মাঝে চলেছে নতুন ঋতু বরণ করে নেয়ার পালা। আমরা চলছি নতুন গন্তব্যের পানে কিন্তু সেই সকালে বের হয়েছি তাই পেটে দানাপানি পরেনি। পাগলা বাজারে এসে আমরা নামলাম। ঢুকে পড়লাম দয়াল মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে। গরম গরম পরোটা আর ভাজি দেয়া হলো আমাদের। পেটে অনেক আগেই ভোগ লেগেছে তাই পরোটা আর ভাজি খেতে অমৃত লাগছিল। এক নিমেষে সাবার করে নিলাম অসাধারণ স্বাদ। পেটপূজা শেষ করে আমরা এগিয়ে চললাম গন্তব্য পানে। ঘড়ির কাঁটার সাথে তাল মিলিয়ে আমরা এসে পৌঁছালাম সুনামগঞ্জ শহরে। সেখান থেকে আমাদের যেতে হবে তাহিরপুর। প্রায় আড়াই ঘণ্টা যাত্রা শেষে পেটে চলছে রামরাবণের যুদ্ধ। শেষ পর্যন্তসুনামগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে অবস্থিত রোজ গার্ডেনে প্রবেশ করতেই ওয়েটার টেবিলের সামনে এসে হাজির কী লাগবে? আমি বললাম, পেটে দানাপানি দ্রুত দিতে হবে। তাই দ্রুত যা দিতে পারবে তাই দাও। আমাদের অবস্থা দেখে কয়েক মিনিটের ভেতরেই সাদা রুটি আর সবজি নিয়ে হাজির হলো ওয়েটার। আমরাও কালক্ষেপণ না করে শুরু করে দিলাম পেটপূজা। তৃপ্তিভরে পেটপূজা শেষ করে আমরা রওনা দিলাম তাহিরপুরের দিকে। গ্রামীণ পথে চলার মজাই আলাদা। দুই পাশে ধানক্ষেত, মাঝ দিয়ে আমরা এগিয়ে চলছি। কোথাও সূর্যদেবের দেখা পাচ্ছি কোথায় আবার সূর্যদেব মুখ কালো করে বসে আছেন। এভাবেই আমরা পথ পারি দিচ্ছি। সময়ের সাথে সাথে আমরা প্রায় দুই ঘণ্টার পথ পারি দিয়ে এসে পৌঁছালাম তাহিরপুর বাজারে। আমি রাজন স্যারকে বললাম, আর কত পথ পারি দিতে হবে আমাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে। স্যার বললেন, এবার আমাদের পারি দিতে হবে টাঙ্গুয়ার হাওর। সময় প্রায় দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা লাগবে। আমি মনে মনে খুশিই হলাম টাঙ্গুয়ার হাওরের রূপ অবলোকন করতে পারব; যদিও প্রায় চার ঘণ্টা ধরে যাত্রাপথে আছি। এর পরও নতুন গন্তব্যপথের যাওয়ার আনন্দে সব কিছু তুচ্ছ মনে হলো। রাজন স্যার বললেন, কিভাবে পাড়ি দেবে টাঙ্গুয়ার হাওর, ইঞ্জিন নৌকায় নাকি স্পিডবোটে। আমি ভাবলাম স্পিডবোটে গেলে তো টাঙ্গুয়ার রূপ ভালোভাবে দেখতে পারব না, তার চেয়ে ইঞ্জিন নৌকায় যাওয়া ভালো। যেই ভাবা সেই কাজ। আমরা চেপে বসলাম ইঞ্জিন নৌকায়। টাঙ্গুয়ার ঢেউের তালে তালে আমরা এগিয়ে চলছি। নদীকেন্দ্রিক মানুষের জীবনধারা আমাদের মোহিত করছে। আমি এই সুযোগে প্রাণভরে ছবি তুলতে লাগলাম। দেখতে দেখতে কিভাবে যে আড়াই ঘণ্টা পেরিয়ে গেল টেরই পেলাম না। আমরা এসে পৌঁছলাম ধর্মপাশা উপজেলার মধ্যনগর গ্রামে। সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন রাজন স্যারের সহচর সোহাগ আর মুনিম। আমরা চেপে বসলাম দুই চাকার বাহনে। এখান থেকে মহিষখোলা গ্রামের দূরত্ব ১০ মিনিটের রাস্তা। তবে গন্তব্যে পৌঁছার একমাত্র বাহন দুই চাকার যান্ত্রিক বাহন। স্বল্প সময়ের মধ্যে আমরা পৌঁছে গেলাম আমাদের সেই কাক্সিক্ষত গন্তব্যে মহিষখোলা গ্রামে। শান্ত নীরব পরিবেশ যেখানে ঘাসফড়িং মনের আনন্দে ঘুরে বেরায় একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। আমরা এগিয়ে চললাম মহিষখোলা নদীর পূর্বপাড় ঘেঁষে একখানা প্রায় নিশ্চিহ্ন টিনের ঘর যার অস্তিত্ব সরেজমিন প্রত্যক্ষ করেও কল্পনায় তার পূর্ণরূপ দেখা কল্পনাবিলাসীদের জন্যও হয়তো দুরূহ হবে এবং তার আশপাশখানা ৪২ বছর ধরে মনুষ্যস্পর্শহীন হওয়ায় প্রকৃতির লীলাক্ষেত্র অর্থাৎ জঙ্গলাকীর্ণ। সেই ঘরে ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধের ফাঁকে ফাঁকে বিশ্রাম নিতেন। পাক হানাদারদের মাঝে মাঝে ধরে নিয়ে বন্দী করেও রাখতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় এ অঞ্চলটি ছিল ১১ নং সেক্টরের ১ নম্বর সাব-সেক্টর। পশ্চিমে গা ঘেঁষে মহিষখোলা নদী, উত্তরে ২০০ গজের মধ্যেই ভারত সীমান্তে মেঘালয়ের পর্বতমালা, পূর্বে সংখ্যাতীত খাল-বিল আর সুবিশাল টাঙ্গুয়ার হাওর। এ হাওরের সঙ্গে রাগে-অনুরাগে জড়িয়ে আছে আরেকটি স্নিগ্ধ নদী যাদুকাটা। শ্রীচৈতন্যের জ্যেষ্ঠ পর্ষদ অদ্বৈতাচার্য এই নদী পাড়েরই সন্তান ছিলেন। যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে পাকবাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের এক ভয়াল সংঘর্ষ হয়। অনেক যোদ্ধা মারা যান। মহিষখোলা নদীর পাড়ঘেঁষা বাড়িটি ধ্বংস হয়ে যায় তখনই, শহীদ যোদ্ধাদের গণকবর রচিত হয় তারই এদিক-ওদিক। তারপর ৪২ বছর লতা-গুল্ম-বৃক্ষের চাদরে ঢাকা ছিল এই ইতিহাস। বলছিলেন আমাদের রাজন স্যার। স্যারের কথা চলছে আমরা ও ঘুরে দেখছি স্যার এর অনন্য স্থাপত্যকর্ম। এখানেই শায়িত আছেন একাত্তরের শহীদ হওয়া বীর প্রাণ। পূর্ব-পশ্চিম অক্ষ বরাবর সমান্তরাল দুটি সুউচ্চ দেয়াল ‘ন’ ফুট বেদীর ওপর এসে দাঁড়ায়, তার ওপর ছায়া হয়ে ছাদ এসে বসে। সিঁড়ি ভেঙে পূর্বদিকের প্রবেশবিন্দুতে চোখ রাখলে পশ্চিমের নদী আর তার গায়ে এসে পড়া আকাশ দেখা যায়। পূর্ব-পশ্চিম উন্মক্ত হওয়ায় দুই দেয়ালেরঘর রচিত হয়ে যায়। উত্তর-দক্ষিণের ২৭ ফুট উঁচু দেয়ালে ব্যাকরণ ভেঙে অনেক ছোট-বড় জানালা আড়াল খুলে আলোর উৎস হয়ে ওঠে। ঠিক চোখ মেলে তাকানোর মতো। ‘যারা এই দেশটাকে ভালোবেসে দিয়ে গেছে প্রাণ’, তারা তো বদ্ধঘরে থাকে না, যে ঘরে দোর-জানালায় অর্গল টানা, যে ঘরে আলোর ঝলক নেই, দোলা নেই, সে ঘরে স্বাধীনতা প্রবেশ করে না। সেই ঘর অন্ধকারের অধীন। তাই “সব ক’টা জানালা”ই খুলে আছে।
জানালা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপস্থাংশ, যার ব্যবহারিক ও মনোস্তাত্ত্বিক মূল্য অতুলনীয়। এটি আমাদের দর্শনেন্দ্রীয়ের মতো। চোখ দিয়ে যেমন আমাদের দেহ-ঘরে আলো প্রবেশ করে, আমাদের প্রথম অভিজ্ঞতা চোখ দিয়ে হয় (জ্ঞানচক্ষু), তেমনি দেয়ালকে মুক্তি দেয় জানালা। তবেই দেয়ালের চোখ ফুটে আলো-বাতাস প্রবেশ করে গৃহে প্রাণের সঞ্চার হয়। এজন্যই ‘খোলা জানালা’ আর ‘স্বাধীনতার চেতনা’ সমার্থক হয়ে উঠেছে। বেদির তিন দিক ঘিরে রয়েছে পানির আধার যা পশ্চিমে নদীর সাথে সংযুক্ত। প্রতি বর্ষাতেই মেঘালয়ের পাহাড়ি ঢল নামলে নদী উপচে বেদির তলায় কিছুক্ষণের জন্য হাঁটুপানি জমে যায়। এটা হাওর অঞ্চলের চেনা দৃশ্য। এভাবেই হাঁটুপানিতে দাঁড়িয়ে সব ক’টা জানালা খুলে আমাদের ডাকছে ওরা,
‘যারা এই দেশটাকে ভালোবেসে দিয়ে গেছে প্রাণ’।

যাবেন কিভাবে :

ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ যাওয়ার সরাসরি বাস রয়েছে। এনা, হানিফ, শ্যামলী, ইউনিকসহ অনেক বাস এই পথে চলে। তবে অবশ্যই অগ্রিম টিকিট কেটে রাখুন। তাহলে ঝামেলা পোহাতে হবে না। সুনামগঞ্জ শহরে এসে এমএ খান সেতু থেকে পাবেন মোটরবাইক অথবা গাড়ি নিয়ে চলে যান তাহিরপুর বাজার। সেখান থেকে নৌকা করে চলে যান মধ্যনগর গ্রামে। মধ্যনগর থেকে মহিষখোলা গ্রাম ১০ মিনিটের রাস্তা। দলবেঁধে ঘুরতে গেলেই বেশি আনন্দ করতে পারবেন।

 


আরো সংবাদ



premium cement

সকল