দৈত্যাকার বটবৃক্ষ
- মুহাম্মদ জাভেদ হাকিম
- ০৩ মার্চ ২০২০, ০০:০০
দেশের ঐতিহাসিক ভ্রমণ সংগঠন ‘দে-ছুট’-এর বন্ধুরা ঘুরতে গিয়েছিলাম ঢাকার পাশেই ধামরাই উপজেলার সাইট্টা গ্রামে। দিনটি ছিল শুক্রবার। যানজটের কারণে নবীনগর পর্যন্ত ঠেলেঠুলে গাড়ি চলে। এরপর একটানে ঢুলিভিটা হয়ে ধানতারা। মাঝে জুমা নামাজের বিরতি। ধানতারা থেকে বামে মোড় নিয়ে গাড়ি যখন ছোটে সাইট্টার পথে, তখন মনে হয় এ যেন এক প্রশান্তির পথ। বাংলার সেই চিরচেনা সুনসান নিরিবিলি গাঁয়ের পথ। সবুজ প্রান্তর-গাছের ছায়া, পাখির কলতান শুনতে শুনতে এগিয়ে যাই সাইট্টা। দূর থেকে গাড়ির জানালা দিয়ে যখন বটগাছ চোখে পড়ে তখন কিছুটা নিরাশ হয়ে পড়ি। কেউ একজন মন্তব্যই করে ফেলল, এ তো দেখছি গাবগাছের পাতার মতো। মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল। পিচঢালা পথ ছেড়ে গাড়ি ঢুকেছে মেঠোপথে। থামে গিয়ে একেবারে বটবৃক্ষের ছায়াতলে। আনন্দে মন নেচে ওঠে। ওয়াও! চোখ ঠেকে কপালে। অবাক বিস্ময়ে শুধু তাকিয়ে রই। এ কি আসলেই বটবৃক্ষ নাকি ভিন্ন কিছু। ডালপালা ছড়িয়ে এখন মহীরুহ। নানান জায়গায় ঘুরতে গিয়ে জীবনে অনেক বটগাছের ছায়ায় বসার সুযোগ এসেছে কিন্তু এরকম আর কোনো বটগাছ আমার চোখে পড়েনি। আশ্চর্য সুন্দর সাইট্টা বটগাছের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে নিজেকে বেশ সুখী মনে হলো। ভালো করে পরখ করতে থাকি। গাছের ওপর থেকে বটের ঝুরি মানে শাখামূল ঝুলে, মাটির সাথে মিশে গিয়ে এমন এক অদ্ভুদ রূপ ধারণ করেছে, যার বর্ণনা দিয়ে পাঠকদের বোঝানোর মতো সাধ্য নেই আমার। যা শুধু নিজের চোখে দেখে অনুভব করা যাবে। এরকম একটি বটগাছের সান্নিধ্যে সবাই বেশ আনন্দিত। ছবির ছৈয়ালরাও বেশ ব্যস্ত। ক্যামেরার শার্টারে শুধু ক্লিক ক্লিক শব্দ। উচ্ছ্বসিত না হয়ে উপায় আছে!
একটি বটগাছÑ একটি জীবন্ত ইতিহাস। সেই ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রইল, আজকের দে-ছুট ভ্রমণ সঙ্ঘের দামালরাও। গাছের আদ্যোপান্ত জানতে এবার স্থানীয়দের খোঁজে নামী। দু-একজনের সাথে ভাব জমাই। কিন্তু তথ্যসূত্র নির্ভরযোগ্য মনে হয় না। এ দিকে পেটেও টান পড়েছে। ইচ্ছা ছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ভাত-ভর্তা খাবো, কিন্তু সময়ের আবর্তনে তা বিবর্ণ হয়ে সাইট্টা বটগাছের তলায় এসে ঠেকেছে। সব দোষ যানজটের। শহর-মহাসড়কের জ্যাম বর্তমানে ভ্রমণপিপাসুদের জন্য মহাযন্ত্রণায় পরিণত হয়েছে। সময় মিলিয়ে এখন আর কিছুই করা যায় না। এ দিকে এই গ্রামের ধারে কাছে কোনো খাবার হোটেলও নেই। ভাগ্য ভালো গাড়িতে হাঁড়ি-পাতিল ছিল। করিৎকর্মা ফারুক বাইকে চড়ে স্থানীয় বাজার থেকে চাল-ডাল-ডিম কিনে আনে। গ্রাম্য চা দোকানি সন্তুষের সহযোগিতায় শুরু হয় রান্নার মহাযজ্ঞ। সে সুযোগে ঘুরে বেড়াই পুরো গ্রাম। ঘুরতে আর জানতে গিয়ে চোখে ধরা দেয় সাইট্টা গ্রামের নানান রূপ। জমির পর জমি লেবুবাগান। থোকায় থোকায় ধরে আছে নানা জাতের লেবু। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে হাঁটুপানির ছোট নদী। সেই নদীতেই জেলে ধরে মাছ। গাছের ডালে ডালে নানা রঙের পাখি। জনমানবের কোলাহল নেই। পাখিরা নিশ্চিন্ত মনে গেয়ে যায় গান। যেন সাইট্টা গ্রামটি ওদের জন্য অভায়শ্রম। ভর সন্ধ্যায় রান্না শেষ। মাগরিব নামাজ আদায় শেষে, খাবার জোটে ধোঁয়া তোলা খিচুড়ি আর ডিমভুনা। আহ্ কি মজার স্বাদ। খেতে খেতেই পরিচয় হয় জনি দাস নামক এক তরুণের সাথে। তার সাথে আলাপচারিতায় জানা গেল বেশ কিছু তথ্য। সাইট্টা গ্রামটি ধামরাই উপজেলার যাদবপুর ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত। ষাটটি পরিবার নিয়ে প্রথম এই গ্রামে বসতি শুরু। সেই থেকেই এই গ্রামের নাম ষাটটি থেকে সাইট্টা হয়েছে। গ্রামে মানুষের সংখ্যা প্রায় ৪০০। নিরানব্বই শতাংশই হিন্দু ধর্মাবলম্বী। শিক্ষার হার প্রায় ৯৫ শতাংশ। পেশায় অধিকাংশই সরকারি ও বেসরকারি চাকুরে। ধারণা করা যায় গ্রামবাসী মানসিকতায় বন্ধুবৎসল। বটগাছটি সম্পর্কে জানালেন, এটির বয়স আনুমানিক প্রায় ৫০০ বছর। যদিও সুনির্দিষ্ট করে কেউ জানাতে পারেননিই; তবুও অন্তত ৪০০ বছরের কম নয়। বটগাছটির পাশেই পাকুর গাছ। দু’টি গাছ সময়ের আবর্তনে একটির সাথে অন্যটির ডাল-পালা জড়িয়ে এখন বিরাট দৈত্যাকারের রূপ ধারণ করেছে। গাছটি প্রায় দুই একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত। বটগাছ ঘিরে ভুতুড়ে কিছু কল্পকাহিনী লোকমুখে চালু রয়েছে। ফলে এর ডালপালা-ঝুরি না কাটা বা ছাঁটা হওয়ায় এখন এক বিশাল দৈত্যাকার রূপ ধারণ করেছে। গাছটির পাশেই একটি নাট মন্দির রয়েছে। সেখানে নিয়মিত পূজা-অর্চনা চলে। নির্ভরযোগ্য তথ্য দিয়ে ভদ্রলোক বিদায় নিলেন। নীরব নিস্তব্দ গ্রাম্য পরিবেশে শুরু হলো দ্বিতীয় পর্ব বার-বি-কিউ। বটগাছের তলায় কয়লার আগুনে গোশত ঝলসানো, আহ্ সেইরকম একটা ফিলিংস। রাত ৯টায় সব আয়োজনের ইতি টেনে, শিয়ালপণ্ডিতদের হুক্কাহুয়া আওয়াজের সাথে তাল মিলিয়ে ঘরে ফেরার পথ ধরি।
যাবেন কিভাবে : ঢাকার যেকোনো প্রান্ত থেকে নিজ নিজ সুবিধা অনুযায়ী গাবতলী ও উত্তরার থার্ড ফেস এবং আবদুল্লাহপুর হয়ে ধামরাই উপজেলার ধানতারা বা কালামপুর বাজার হয়ে সাইট্টা গ্রামে যাওয়া যাবে।
পরিবহন : নিজস্ব বা রেন্ট-এ কার নিয়ে গেলে সুবিধা বেশি হবে। তবে গুলিস্তান থেকে ধামরাইয়ের বাসে ঢুলিভিটা বাসস্ট্যান্ড বা কালামপুর বাজার। সেখান থেকে অটো বা ভ্যানে চেপে সাইট্টা। বাসে গেলে কালামপুর হয়ে গেলে সময় বেশ কম লাগবে।
ঘোরার সময় : সকাল সকাল সাইট্টা গ্রামের পথে বের হওয়াটাই মোক্ষম সময়।