ঝলমলে চুলের সাতকাহন
- কাজী তানজিলা মেহনাজ
- ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০
ইদানীং চুল পড়ে যাওয়া খুবই কমন একটি সমস্যা। এ ছাড়া আছে চুল বড় না হওয়া, চুল পাতলা হয়ে যাওয়া ইত্যাদি সমস্যাও। কখনো কি মনে এই প্রশ্ন জাগে যে, এমন কি কোনো তেল বা শ্যাম্পু আছে যা ব্যবহার করলে এই সমস্যাগুলোর হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে? উত্তর যদি ‘হ্যাঁ’ হয় তাহলে আপনাকে জানিয়ে রাখছি যেÑ সুন্দর, ঝলমলে, ঘন ও বাড়ন্ত চুল শুধু শ্যাম্পু বা তেলের একার কৃতিত্ব নয়। বরং আপনি কি খাচ্ছেন, সেই খাবার থেকে চুল প্রয়োজনীয় পুষ্টি পাচ্ছে কি না সেটিও অনেক বড় ব্যাপার। চাইলেই কিন্তু বিশেষ কিছু খাবার আপনার খাদ্যতালিকায় যোগ করে চুলের প্রয়োজনীয় পুষ্টি জুগিয়ে চুলকে করে তুলতে পারেন ভেতর থেকে স্বাস্থ্যবান, ঘন, ঝলমলে ও বাড়ন্ত। সাথে চুলপড়াও উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে আনতে পারেন কয়েক সপ্তাহের মধ্যে।
চুলের ফলিকল বা গ্রন্থিকোষ বিপাককার্যে খুবই সক্রিয় এবং এই কোষগুলো খুবই দ্রুত নতুন কোষ দ্বারা পরিবর্তিত হতে থাকে। প্রয়োজনের তুলনায় কম ক্যালোরি গ্রহণ বা প্রতিদিনের খাবারে পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রোটিন, মিনারেল, ফ্যাটি এসিড এবং ভিটামিন না থাকলে চুলের বৃদ্ধি ও গঠন ক্ষতিগ্রস্ত হয় যা চুল রুক্ষ হয়ে যাওয়া, ভেঙে যাওয়া ও চুল ঝরে যাওয়ার কারণ হয়। খাবারের যেসব উপাদান চুলের ঘনত্ব, বৃদ্ধি ও স্বাস্থ্য নিশ্চিত করে তা হলোÑ
ষ প্রোটিন বা আমিষ
ষ আয়রন বা লৌহজাতীয় খাবার
ষ ভিটামিন এ সি ডি ও ই
ষ বি ভিটামিনগুলো
ষ ওমেগা ৩ এবং ৬ ফ্যাটি এসিড
ষ জিঙ্ক
ষ সেলেনিয়াম
ষ ম্যাগনেসিয়াম
ষ আঁশজাতীয় খাবার
যেহেতু চুলের স্বাস্থ্যরক্ষায় এসব উপাদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তাই খাবার প্লেটে কী কী খাবার তুলে নিচ্ছেন সে দিকে কড়া নজর রাখুন। ওপরের উপাদানগুলো আপনার প্রতিদিনের খাবারে যেন থাকে তা নিশ্চিত করুন। ডারমাটোলজিস্টদের মতে, নিচের এই খাবারগুলো চুলের বৃদ্ধি ও চুলের স্বাস্থ্যের জন্য সেরা।
বাদাম, বিভিন্ন বীজ ও নারকেল
বাদামে আছে স্বাস্থ্যকর ফ্যাট যা শুধু হার্ট এবং মাসলের জন্যই নয়, চুলের জন্যও খুবই উপকারী। বাদামে থাকা ওমেগা ৩ এবং ওমেগা ৬ ফ্যাটি এসিড চুলপড়া কমায় এবং চুলের বৃদ্ধিতে কার্যকরী ভূমিকা রাখে, চুলকে ঘন করে। বাদাম ও বিভিন্ন বীজে আছে প্রচুর পরিমাণ ম্যাগনেসিয়াম, বি ভিটামিন, জিঙ্ক ও ভিটামিন ই। মাত্র ২৮ গ্রাম সূর্যমুখী বীজ মানুষের প্রতিদিনের ভিটামিন ই চাহিদার ৫০ শতাংশ পূরণ করতে সক্ষম, তা ছাড়া এতে আছে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন বি। কাঠবাদাম, আখরোট এবং নারকেল বা নারকেল তেল প্রতিদিনের খাবার তালিকায় রাখলে তা ত্বক ও চুলের ওপর একটি সুরক্ষা প্রলেপ হিসেবে কাজ করে। এ ছাড়া এই খাবারগুলো চুলকে ভেতর থেকে ময়েশ্চারাইজ করে ঝলমলে করে তোলে। তিসির বীজ প্রতিদিন অল্প অল্প করে খেলে চুলের জন্য খুবই উপকার। সবচেয়ে ভালো ফল পাওয়ার জন্য নানা ধরনের বাদাম বীজের মিশ্রণ রাখতে হবে প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায়।
বিভিন্ন ধরনের ডাল, শিম, মটরশুঁটি ইত্যাদি
এই খাবারগুলো উদ্ভিদজাত আমিষে ও খাদ্যআঁশে ভরপুর যা চুলের বৃদ্ধির জন্য দরকারি উপাদান। এতে আছে জিঙ্ক যা চুলের ক্ষতি পূরণ করে এবং চুলকে বাড়তে সাহায্য করে। এ ছাড়া এই খাবারগুলোতে আছে নানা ধরনের প্রয়োজনীয় উপাদান যেমনÑ আয়রন, বায়োটিন, ফলেট ইত্যাদি যা চুলের স্বাস্থ্যরক্ষা ও বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।
ওটমিল ও অন্যান্য হোল গ্রেইন খাবার
ওটস একটি আয়রন, জিঙ্ক, ফাইবার, ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিড এবং পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিড সমৃদ্ধ খাবার। এই উপাদানগুলো চুল ঘন করতে সাহায্য করে, চুলকে স্বাস্থ্যবান করে তোলে ও চুল বাড়তে সাহায্য করে। এ ছাড়া হোল গ্রেইন খাবারে আরো আছে বায়োটিন ও বি ভিটামিন যা কোষের বিস্তারে সাহায্য করে। তা ছাড়া এই খাবারগুলো এমিনো এসিড উৎপাদনে ভূমিকা রাখে যা চুল বাড়তে সাহায্য করে।
ডিম
একটি বাড়ি তৈরিতে যেমন ইট ব্যবহার হয়, তেমনি চুল গঠনে প্রোটিন ইট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। চুলের কেরোটিন ভালো রাখতে, এমনকি কেরোটিন গঠনে প্রোটিন সবচেয়ে বেশি জরুরি। অন্য দিকে ডিম হলো প্রোটিনের সেরা উৎসগুলোর একটি। একটি ডিমে থাকে ৬-৭ গ্রাম প্রোটিন বা আমিষ। সুতরাং রোজকার খাবারের তালিকায় ডিম অবশ্যই রাখতে হবে। এতে করে চুল থাকবে ঘন ও স্বাস্থ্যবান, বাড়বেও দ্রুত।
পালং ও অন্যান্য গাঢ় সবুজ শাক
চুলের কোষের জন্য আয়রন একটি দরকারি মিনারেল। দেহে আয়রনের ঘাটতি হলে অক্সিজেন ও খাবারের পুষ্টি চুলের গোড়া ও ফলিকল পর্যন্ত ঠিকমতো পৌঁছাতে পারে না। ফলে চুলের বৃদ্ধি থেমে যায় ও চুলের গোঁড়া দুর্বল হয়ে চুল পড়ার পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। পালং ও অন্যান্য গাঢ় সবুজ শাকে আছে প্রচুর আয়রন। তা ছাড়া আছে ফলেট, ভিটামিন এ ও ভিটামিন সি। এসব উপাদানই চুলের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
তেলযুক্ত মাছ
তেলযুক্ত বিভিন্ন মাছ ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিডের একটি চমৎকার উৎস। এসব মাছে আরো আছে প্রোটিন, ভিটামিন ডি এবং ওমেগা ৬ যা দেহ ও মাথার ত্বকে পুষ্টি জোগায় এবং চুলের ফলিকলের চারপাশের ফ্যাটের আস্তরণকে ভারী করে। ফলস্বরূপ চুল মজবুত এবং ঝলমলে হয় ও দ্রুত বাড়ে। গবেষণায় দেখা গেছে নারীরা প্রতিদিন ওমেগা ৩ ও ওমেগা ৬ গ্রহণ করেন, তাদের চুলের ঘনত্ব এবং দৈর্ঘ্য খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং চুল পড়া বন্ধ হয়।
লেবুজাতীয় ফল
কমলালেবু, মাল্টা, লেবু, জাম্বুরা ইত্যাদি ফল ভিটামিন সি’তে ভরপুর। ভিটামিন সি দেহে প্রয়োজনীয় পুষ্টি যেমন আয়রন শোষণে ভূমিকা রাখে, আর আয়রন ও অন্যান্য উপাদান চুলের সুস্বাস্থ্য রক্ষায় ভূমিকা রাখে। তা ছাড়া ভিটামিন সি দেহে কোলাজেন তৈরি করে যা চুল বাড়তে সাহায্য করে এবং চুলের আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত মজবুত রাখে ফলে চুল ভেঙে পড়ে না।
এসব খাবার প্রতিদিন খেয়েও যদি আপনার চুলের স্বাস্থ্যের উন্নতি না হয় বা চুলপড়ার সমস্যা না কমে, তাহলে একজন ডাক্তারের পরামর্শ নিন। চুল পড়া বা চুলের অস্বাভাবিক পরিবর্তন কোনো রোগ যেমনÑ লিভারের সমস্যা, থাইরয়েড ইত্যাদির লক্ষণ হতে পারে। কোনো ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট সেবন করার আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। কারণ না জেনে ওষুধ খেলে তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এর বাইরেও চুল পড়ার আরো নানা কারণ থাকতে পারে। যেমনÑ সন্তান জন্মদান, আপনজনের মৃত্যু, নতুন চাকরি বা যেকোনো মানসিক চাপ থেকেও চুল পড়তে পারে। তা ছাড়া মনে রাখতে হবে, চুল সবচেয়ে বেশি বাড়ে ১৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। ৪০ বছর বয়সের পর মানুষের চুলের বৃদ্ধির হার স্বাভাবিকভাবেই কমে যায়।
চুলের জন্য ক্ষতিকর কয়েকটি খাবার
এই খাবারগুলো চুল বড় হতে বা নতুন চুল গজাতে সাহায্য তো করেই না, বরং উল্টোটি করে। এই খাবারে এমন কিছু উপাদান আছে যা চুলের বৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে, চুলের ফলিকলের ক্ষতিসাধন করে। সুন্দর ও ঘন চুল চাইলে এই খাবারগুলো থেকে ১০০ হাত দূরে থাকুন।
চিনি
চুল পড়ার অন্যতম কারণ হলো চিনি। কিভাবে? খুব সহজ! সুন্দর চুলের জন্য প্রোটিন একটি অপরিহার্য উপাদান। শরীর যখন খাবার থেকে প্রোটিন শোষণ করে নেয়, চিনি সেই কাজকে বাধাগ্রস্ত করে। তাই চিনি খাওয়া বাদ দিন, সাথে চিনি আছে এমন সব খাবারকে নিজের খাদ্যতালিকা থেকে বিদায় করুন।
সাদা শস্য
সাদা রুটি, পাস্তা, চাল ইত্যাদি চুলকে পাতলা ও চিকন করে ফেলে। তাই ময়দা, সাদা চাল ইত্যাদি দিয়ে তৈরি খাবার যেমনÑ কেক, পেস্ট্রি থেকে দূরে থাকুন। সাদা চালের পরিবর্তে লাল চাল, সাদা আটা বা ময়দার পরিবর্তে লাল আটা খাওয়ার অভ্যাস গড়ুন।
এলকোহল
সুন্দর ও স্বাস্থ্যবান চুলের জন্য এবং চুলের বৃদ্ধির জন্য জিঙ্ক খুবই দরকারি একটি খনিজ উপাদান। এলকোহল সেবনের ফলে দেহে জিঙ্কের পরিমাণ কমে যায়। তা ছাড়া এটি দেহে পানিশূন্যতাও ঘটায়, যার ফলে চুল ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। তাই চুল সুন্দর রাখতে এলকোহল ছাড়তে হবে।
প্রসেসড খাবার
প্রসেসড বা প্যাকেটজাত খাবারে পুষ্টির পরিমাণ খুবই কম থাকে। এ ছাড়া এতে এমন সব উপকরণ ব্যবহার করা হয় যা শরীর ও চুলের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এসব খাবার খেলে পেট ভরে কিন্তু শরীর ও চুল পুষ্টি পায় না। কারণ এসব খাবার দেহের উপকারী ব্যাক্টেরিয়াকে খাবার থেকে দরকারি পুষ্টি শোষণে সাহায্য করে না। তাই এসব রেডিমেড খাবার যত কম খাবেন ততই আপনার শরীর ও চুলের জন্য ভালো।