২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

দ্য লস্ট সিটি খ্যাত পানামনগরীতে একদিন

-


নারায়ণগঞ্জের ঐতিহাসিক কিছু স্থানের মধ্যে পানামনগর ইতঃপূর্বে দুইবার গিয়েছিলাম। আমার আমেরিকান (বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত) স্ত্রী ফেসবুকে তার এক বন্ধুর ওয়ালে পানামনগরীর কিছু ছবি দেখে সেখানে যাওয়ার বায়না ধরে। তাই এক ছুটির দিনে ঢাকা থেকে মাইক্রোবাসে চেপে পরিবারের ক’জন মিলে তৃতীয়বারের মতো গেলাম ‘দ্য লস্ট সিটি’ হিসেবে খ্যাত ‘পানামনগরী’ বা ‘পানাম সিটি’। আমরা সেখানে পৌঁছে মাথাপিছু মাত্র ১৫ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে প্রবেশ করি প্রাচীন এই নগরীতে। প্রবেশমুখেই রয়েছে একটি বড় ফলক। যেখানে সংক্ষিপ্ত আকারে পানামনগরীর ইতিহাস লেখা রয়েছে। পানামনগরের নির্মিত ভবনগুলো ছোট লাল ইট দিয়ে তৈরি। দীর্ঘ একটি সড়কের উভয় পাশে দৃষ্টিনন্দন ভবন। উভয় পাশে ৫২টি পুরনো বাড়ি এই ক্ষুদ্র নগরীর মূল আকর্ষণ। চারদিকে যেন সুনসান নীরবতা। যদিও অনেক পর্যটক এসেছে এই ছুটির দিনে। এই নগরীতে প্রবেশের পর যেন অনুভব হয় অন্যরকম এক অনুভূতি। মনে হয় যেন এক মৃত নগরীতে প্রবেশ করেছি। আমার স্ত্রী পানামনগরীর ৪০০ বছরের পুরনো অপরূপ কারুকার্যমণ্ডিত সুরম্য অট্টালিকাগুলো দেখে মুগ্ধ হয়ে বলে উঠে ‘ওয়াও... ওয়ান্ডারফুল’।
পৃথিবীর ১০০টি ধ্বংসপ্রায় ঐতিহাসিক শহরের মধ্যে একটি হচ্ছে পানামনগর। ওয়ার্ল্ড মনুমেন্ট ফান্ড ২০০৬ সালে পানামনগরকে বিশ্বের ধ্বংসপ্রায় ১০০টি ঐতিহাসিক স্থাপনার তালিকায় প্রকাশ করে। ঈসা খাঁর আমলের বাংলার রাজধানী ছিল পানামনগর। বড় নগর, খাস নগর, পানামনগর-প্রাচীন সোনারগাঁয়ের এই তিন নগরের মধ্যে পানাম ছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয়। এখানে কয়েক শতাব্দী পুরনো অনেক ভবন রয়েছে, যা বাংলার বারো ভূঁঁইয়ার ইতিহাসের সাথে সম্পর্কিত। রাজধানী ঢাকা থেকে ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে নারায়ণগঞ্জের খুব কাছে সোনারগাঁয়ে অবস্থিত এই নগর। সোনারগাঁয়ে ২০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে এই নগর গড়ে ওঠে। ঐতিহাসিকভাবে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি শহর। জানা যায়, ১৪০০ শতাব্দীতে এখানে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। যেখানে পৃথিবীর নামী-দামি শিক্ষকরা পড়াতে আসতেন।
পানামনগরের নির্মাণশৈলী অপূর্ব এবং এর নগর পরিকল্পনা দুর্ভেদ্য ও সুরক্ষিত। এটি মূলত বঙ্গ অঞ্চলের তাঁতব্যবসায়ীদের মূল কেন্দ্রবিন্দু ও আবাসস্থল ছিল। এ স্থান থেকে ব্যবসায়ীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে তাঁতব্যবসা পরিচালনা করতেন। বাংলার মসলিনসহ অন্যান্য তাঁতশিল্পের প্রচার-প্রসার ও ব্যবসায়ের তীর্থস্থান এ পানামনগর। পানামনগরে মূলত ব্যবসায়ী ও জমিদাররা বসবাস করতেন। এর পাশাপাশি রাজাদের আমির ওমরাহদের জন্য পানামনগরে ও তার আশপাশের গ্রামগুলোতে গড়ে উঠেছিল নিপুণ কারুকাজখচিত পাকা ইমারতরাজি। পানাম ও তার আশপাশকে ঘিরে পঞ্চদশ শতক থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত এক সমৃদ্ধ জনজীবন ছিল। এখানে সরু রাস্তার দুই ধারে গড়ে উঠেছিল অট্টালিকা, সরাইখানা, মসজিদ, মন্দির, মঠ, ঠাকুরঘর, গোসলখানা, কূপ, নাচঘর, খাজাঞ্চিখানা, টাকশাল, দরবার কক্ষ, গুপ্তপথ, প্রশস্ত দেয়াল, প্রমোদালয় ইত্যাদি। আমরা পানামনগরের চারপাশে ঘুরে প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো প্রতিটি স্থাপনা আমরা খুটিয়ে খুটিয়ে দেখলাম। বেশির ভাগ ভবন ঝুঁঁকিপূর্ণ হওয়ার কারণে ভবনের ভেতরে প্রবেশের অনুমতি নেই। তাই আমি কিছুটা নিরস মুখেই ছিলাম। বিধাতা সহায় থাকলে যা হয়, এখানে ঘুরতে আসা ক’জন বিদেশী পর্যটকের সাথে আমার স্ত্রীর দেখা হতেই তাদের সাথে তার গল্প করা শুরু হয়ে যায়। ওদের মধ্যে একজন ছিল আমেরিকান, সে একটা এনজিও সংস্থায় কাজ করে। যা হোক, তাদের সাথে আমরা পানামনগর প্রবেশের ডানদিকের একটা বিল্ডিংয়ে ভেতরে প্রবেশ করি। ওটা নাকি শুধু ভিআইপি ও বিদেশী পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত। ওই বিল্ডিংয়ের উঁচু উঁচু সিঁড়ি পার হয়ে দোতলায় উঠে একটা বিশাল হলরুমে পৌঁছালাম। চারদিকের দেয়ালে রঙিন কারুকার্য। পিলার তো বটেই, সিলিংয়েও। জানতে পারি, এককালে এখানে নাচের আসর বসত এককালে। পুরনো শতাব্দীর সেই কথা মনে করে শিহরিত হচ্ছিলাম, নূপুরের আওয়াজ শুনছিলাম নিজের অজান্তেই।

যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে বাসে চেপে শুরুতে যেতে হবে সোনারগাঁয়ের মোগড়াপাড়া বাসস্ট্যান্ড। বাস ভাড়া সার্ভিস ভেদে ২৫-৪৫ টাকা হতে পারে। মোগড়াপাড়া থেকে ১০-২০ টাকা ভাড়ায় রিকশা-অটোরিকশা যোগে পানামনগরে যাওয়া যায়। এ ছাড়া কেউ যদি প্রাইভেটকার, বাস, মিনিবাস, বেবিট্যাক্সি, মোটরসাইকেলে যেতে চান, সেটিও করা যাবে। চাইলে সোনারগাঁও লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর ঘুরে পাঁচ মিনিট হেঁটেও পানামে পৌঁছা সম্ভব। ঢাকা থেকে পানামনগরের দূরত্ব খুব বেশি না হওয়ায় দিনে দিনেই ঘুরে আসা সম্ভব।


আরো সংবাদ



premium cement