মৈনট ঘাট : ঢাকার পাশে আরেক কক্সবাজার
- সীমান্ত আকরাম
- ২১ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০
কনক্রিটের শহরে যান্ত্রিক জীবনে একটু শান্তির পরশ পেতে আমাদের চাহিদার মধ্যে ক্রমেই যুক্ত হচ্ছে ভ্রমণ। ভ্রমণ মানুষকে সমৃদ্ধ করে। খুলে দেয় মনের জানালা, উন্মোচিত করে স্বপ্নের দরজা। নতুনত্বের নান্দনিক দৃষ্টি বিনির্মাণ ও সুস্থ মানসিকতা গঠনে ভ্রমণের তুলনা নেই। তাই উন্নত বিশ্বের মানুষগুলো ভ্রমণকে দৈনন্দিন চাহিদার একটি অনুষঙ্গ মনে করে। সে জন্য ভ্রমণ তাদের সংস্কৃতিরই একটি অংশ।
ঢাকা থেকে মাত্র ৪৫ কিলোমিটার দূরে নবাবগঞ্জের দোহারে পদ্মায় অবস্থিত মৈনট ঘাট। বক্ষ্যমান সময়ে জায়গাটা মিনি কক্সবাজার নামে খ্যাত। ভ্রমণ পিয়াসীদের কাছেও এটি এখন মিনি কক্সবাজার নামে বেশ পরিচিত। পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র-সৈকত কক্সবাজারের মতোই মৈনট ঘাটের বালু-মাটির বিশালান্তর প্রথম দেখায় যে কারো মনে হতে পারে এটি কক্সবাজারের বিশাল সমুদ্র-সৈকতের একটি অংশ। সেখান থেকে যতদূর চোখ যায় দেখবেন পদ্মার অপরূপ জলরাশির সৌন্দর্য, কিছুক্ষণের জন্য হলেও মনে হবে আপনি সমুদ্র-সৈকতে আছেন, এ কারণে জায়গাটা মিনি কক্সবাজার নামে খ্যাত।
রাজধানীর কাছাকাছি নতুন এ পর্যটন স্থানটি এরই মধ্যে ভ্রমণপিয়াসীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বিশ্বের দীর্ঘতম বালুকাময় সমুদ্র-সৈকত কক্সবাজারে হাঁটতে হাঁটতে যাদের সমুদ্রের গর্জন শোনা হয়ে উঠেনি কিংবা ব্যস্ত জীবনের ভিড়ে যাদের আকাশের মতোই অসীম প্রশস্ত ও দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশিতে পা ভিজিয়ে ক্রান্তি দূর করার ফুরসত হয়ে ওঠে না, তারা ঢাকা থেকে নাতিদীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে মৈনট ঘাটে চলে যেতে পারেন। সাগরের তীব্র গর্জনের অগণিত আওয়াজ না পাওয়া গেলেও ফুলে ফেঁপে ওঠা পদ্মার ছলাৎ ছলাৎ ঢেউয়ে হারিয়ে যেতে পারেন আপনি। বর্ষাকালই সে আবহ উপলব্ধির উত্তম সময়। তবে শীতের পড়ন্ত রোদেলা বিকেলে মৈনট ঘাট ভিন্ন এক মহিমায় হাজির হবে। ঘাট পাড়ের বালুচরে হেঁটে সে স্বাদ আস্বাদন করবার চেষ্টা ফলপ্রসূ হবে। পড়ন্ত বিকেলে পদ্মার বুকে হৈমন্তিক মৃদু হিম হাওয়াকে সঙ্গী করে সে রূপ দেখতে দেখতে পদ্মাকে আলিঙ্গন করে নিতে হবে আপনাকে। নদীর বুকে ঘুরতে ঘুরতে পশ্চিম আকশে হেলে পড়া সূর্যের মিঠে রোদ নদীর ঢেউয়ে আলতো পরশ বুলিয়ে কমলা রঙের যে চিকিমিকি আবহ তৈরি করবে, তা-ই দেখা যাবে মনের কুঠুরিতে আনন্দের ভিন্ন ঢেউ বইয়ে দিচ্ছে। অববাহিকা ধরে যেতে যেতে মনে হবে শেষ বিকেলের মিহি ঢেউ নদীতে বইছে না, বইছে যেন আপন অন্তরজুড়ে। ঢেউয়ের লুকোচুরির এই মায়াবী রূপও অবলোকন করা যাবে এই সুযোগে। মানবজীবন যেমন উত্থান-পতনে ভরপুর; ঢেউও বুঝি জীবনের মতো কোথাও উথিত, কোথাও নীরব-মসৃণ, আবার কোথাও ঘূর্ণিতে প্যাঁচানো।
স্থানীয় জেলেদের কাছে জানা যায়, নদীর পাশের এই নিচু জমিটি ২০১৫ সালে বন্যায় তলিয়ে যায়। উত্তর পাশে বালু পড়লেও দক্ষিণের অংশে পুরু হয়ে পলি পড়ে। পানি নেমে যাওয়ার ফলে পলি মাটি জমে থাকা জায়গাটি অনেকটা সমুদ্র-সৈকতের মতো দেখায়। বালু না থাকায় চলাফেরাও বেশ সুবিধাজনক। নদী পারাপারের সময় অনেকে এখানে এসে ছবি তোলেন। ফেসবুকে সেই ছবি দিতে থাকেন। সেই ছবি দেখে এখানে বেড়াতে আসতে থাকে লোকজন। লোকসমাগম গত বছর থেকে বেশি হচ্ছে। গত বছর ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহাসহ সরকারি ছুটির দিনগুলোতে এখানে হাজার হাজার মানুষের সমাগম হয়েছিল। মৈনট ঘাটের বয়স কত, তা কেউ সঠিক বলতে পারেনি। তবে মিনি কক্সবাজার হিসেবে তার এই নয়া পরিচিতি বছর তিন হলো, মূলত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে।
প্রায় দেড় কিলোমিটার লম্বা হবে চরটি। অনেকে হাঁটাহাঁটি করছেন, কেউবা হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেখছেন পদ্মা। সাহস করে নেমেও পড়ছেন কেউ কেউ। সাঁতার না জানলে পানিতে নামা উচিত না। জানা যায়, গত প্রায় দেড় বছরে এখানে নদীতে নেমে নয়জন প্রাণ হারিয়েছেন। এখন লোকসমাগম বাড়ায় স্থানীয় প্রশাসন নিরাপত্তার বিয়ষটি নজরদারিতে রাখছেন।
দর্শনার্থীরা চাইলে ঘণ্টা হিসেবে বা দলবেঁধে স্পিডবোটে পদ্মায় ঘুরতে পারেন। আধা ঘণ্টার জন্য রিজার্ভ স্পিডবোটের ভাড়া দুই হাজার আর দলবেঁধে ১০-১২ জন মিলে গেলে জনপ্রতি ১২০ থেকে ১৫০ টাকা গুনতে হয়। ট্রলারেও ঘুরতে পারেন ঘণ্টা হিসেবে রিজার্ভ করে। ঘাট থেকে চড়ে যাওয়া-আসাসহ ২০-৩০ জন এক ট্রলারে ঘোরা যায়। ঘণ্টায় ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা করে নেয়। আবার সুযোগ বুঝে ঘণ্টায় এক হাজার টাকাও নেয়। প্রতিটি লেনদেনের আগেই দামদর ঠিক করে নেয়া উচিত।
মৈনট ঘাটের মাঝিরা জানান, এখান থেকে স্বল্পসময়ে স্পিডবোট করে ফরিদপুর, মাওয়া ও আশপাশের এলাকায় যাওয়া যায়। এ ছাড়া ঘাটের এক পাশে পদ্মার তাজা ইলিশ, বাঘাইড়, চিতল ইত্যাদি মাছ বিক্রি করেন। ঢাকা ও আশপাশের এলাকা থেকে আসা অনেকেই পদ্মার তাজা ইলিশ কিনে নিয়ে যান।
পদ্মায় স্নান করেও আসতে পারেন, সে ক্ষেত্রে দূরে কোথাও না গিয়ে আশপাশের ঘাট থেকেই গোসল করা ভালো। ঘাটের আশপাশেই রয়েছে ছোট ছোট চা কফির দোকান। স্নান শেষে এক কাপ কফি হাতে নিয়ে উপভোগ করতে পারেন পদ্মার বিস্তৃতি অপরূপ জলরাশির সৌন্দর্য। সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যটি দেখতে পাবেন সূর্যাস্তের সময়, তখন যেন পুরো পদ্মা এক অপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা করে, সূর্যের রক্তিম বর্ণে পুরো পদ্মার বিশাল জলরাশি লালাভ আভা ধারণ করে যা আপনাকে মুগ্ধ করবেই!
কিভাবে যাবেন :
ঢাকা থেকে যাওয়ার সবচেয়ে সহজ রাস্তা হচ্ছে গুলিস্তান গোলাপ শাহর মাজারের সামনে থেকে সরাসরি মৈনট ঘাটের উদ্দেশ্যে যমুনা ডিলাক্স, দ্রুত পরিবহন, এন মল্লিকসহ অনেক বাস পাওয়া যায়, ভাড়া ৯০ টাকা করে, সময় লাগবে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা, মৈনট ঘাট থেকেও একইভাবে ঢাকা আসতে পারবেন, মৈনট ঘাট থেকে ঢাকার উদ্দেশ্য সর্বশেষ বাস ছাড়ে সন্ধ্যা ৬টার দিকে। যাওয়ার পথে ইচ্ছে হলে নেমে যেতে পারেন নবাবগঞ্জের কালকোপা নামক স্থানে, সেখানে ঘুরে ঘুরে দেখতে পাবেন জজবাড়ি, উকিল বাড়ি, আনসার ক্যাম্প ও আশপাশের দর্শনীয় স্থান, কালকোপা থেকে আবার বাস বা অটোতে করে যেতে পারবেন মৈনট ঘাটে, ভাড়া নেবে বাসে ১০ টাকা আর অটোতে ৪০ টাকা করে।
কোথায় খাবেন :
খাওয়ার জন্য সবচেয়ে মনোরম হোটেল হচ্ছে পদ্মা বিলাস, একেবারে ঠিক ঘাটের সাথেই হোটেলটি অবস্থিত, বিশাল পদ্মার পাড় ঘেঁষে হোটেলের বাইরে ছাউনি দিয়ে চেয়ার বসানো আছে। পদ্মার ঢেউ, জেলেদের নৌকা আর বাতাস উপভোগ করতে করতে অর্ডার করতে পারেন পদ্মার তাজা ইলিশ। এ ছাড়াও পাবেন গলদা চিংড়ি, বিভিন্ন মাছ, মুরগিসহ আরো নানা জাতের খাবার। খাবারের মূল্যেও অনেক সাশ্রয়ী দামে। এ ক্ষেত্রে আপনাকে যেকোনো একটা প্যাকেজ গ্রহণ করতে হবে, প্যাকেজে থাকবে ভাত বিভিন্ন ভর্তা, ডাল ও সাথে পছন্দসই যেকোনো একটি আইটেম, মূল্য ১৫০ টাকা করে।
যারা শুধু ইলিশ ভাজি খেতে চান তারাও খেতে পারেন, শুকনো মরিচ আর পেঁয়াজ ভাজির সাথে আপনাকে সাথে সাথেই ইলিশ ভেজে এনে দেয়া হবে, দাম মাত্র ১০০ টাকা। লোকসমাগম বাড়ায়, বেড়েছে হোটেলের সংখ্যাও। এ ছাড়া রয়েছে অনেক চায়ের দোকানসহ বিভিন্ন ফাস্টফুড। বিকেলে নদীর চরে বসে ফুচকা চটপটিওয়ালাদের আসর। সব মিলিয়ে বেশ জমজমাট পরিবেশ।