২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ঘুরে আসুন আড়াইহাজার

-


তারিখটি ছিল ১৫ ডিসেম্বর রাত। পরদিন ১৬ ডিসেম্বর। বাংলাদেশীদের জন্য অন্যতম আনন্দময় বিজয় দিবস। যার কারণে শহরের টার্মিনালগুলোতে উপচেপড়া ভিড়। কেউ নিজ গ্রামে কেউবা আমাদের মতো ভ্রমণে বের হয়েছেন। ‘দে ছুট ভ্রমণ সংঘ’র বন্ধুরাও সবাই গুলিস্তান বাস কাউন্টারে জমাট বেঁধেছি। কিন্তু একি হায়! বাস আসে আর দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীরা, হুলস্থুল করে ওঠার পরপরই ছেড়ে যায়। ভাগ্যিস ভ্রমণবন্ধু বেশি থাকায়, কোনো মতে একটি বাসে উঠে পড়ি। আমরা যাচ্ছি দে ছুট ফটো কন্টেস্ট বিজয়ীদের সম্মানে ঘোষণা দেয়া জোলাভাতি আয়োজন ও গ্রামবাংলা ঘুরতে।
জোলাভাতি শব্দটাই আজ প্রায় বিলুপ্ত। প্রাণ-প্রকৃতি ও নিত্যনতুন জায়গায় ভ্রমণ নিয়ে গবেষণার সংগঠন দে ছুট ভ্রমণ সঙ্ঘ, এখন থেকে একদা বাংলার সংস্কৃতির সাথে জড়িয়ে থাকা বিলুপ্ত শব্দের কৃষ্টিগুলোও নবরূপে তুলে ধরার জন্য সচেষ্ট রয়েছে। সেই প্রয়াস থেকেই আড়াইহাজারের মেঘনার চরে ছুটছি। হবে দুই দিনব্যাপী জম্পেশ আড্ডা, সরিষা ক্ষেতে ঘোরাঘুরি আর জোলাভাতি। একসময় মহাধুমধামে এবাড়ি ওবাড়ি মিলে জোলাভাতি আয়োজন করা হতো।
দিন দিন মানুষ যন্ত্রে রূপান্তরিত হয়ে যাওয়ার ফলে সেসব আনন্দময় উৎসবে ছেদ পড়েছে। ছেদ পড়া থেকেই হোক না শুরু আবার। বহু দিন পর এই ভ্রমণটা যেন মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। পুরো বাসের অর্ধেকের চেয়েও বেশি যাত্রী দে ছুট। ওদিক অপেক্ষায় থাকা শাহীনূর আড়াইহাজারী ভাই যখন জানতে পারলেন, বাস ছেড়েছে ৯টায়। তখন তিনি ধরেই নিলেন, ১২টার পর ছাড়া পৌঁছব না আড়াইহাজার। বাস চলছে, খোশগল্পে সবাই। ঘড়ির কাঁটা ১০টা না বাজতেই শুনি গাড়ি প্রায় আড়াইহাজার। ফোন পেয়ে হুড়মুড় করে, কলেজ গেটে ছুটে এলেন শাহীনুর ভাই। তার জন্য গাড়ি কিঞ্চিৎ অপেক্ষা।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, পথে কোথাও যানজটে পড়িনি। ভাবতেই বেশ লাগল ভালো। স্বস্তির রেশ না কাটতেই বিশনন্দী ফেরিঘাট পৌঁছে গেল গাড়ি। একে একে সবাই উঠলাম ট্রলারে। জোছনার আলোয় ট্রলার চলে শিপপুর ক্যানেলের চর শিবপুর। জায়গাটা বি.বাড়িয়া জেলার বাঞ্ছারামপুর উপজেলা। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই চরে হাজির। স্থানীয় বাসিন্দা ব্যাংকার শাহরিয়ার ও আক্তার ভাই আগে থেকেই আমাদের সঙ্গ দেয়ার জন্য চরে ছিলেন। তাদের বদান্যতায় লোকবল দিয়ে রাতের রান্না চলছিল। ভাজা মাছের ঘ্রাণ পেতে পেতে, দ্রুত যে যার মতো তাঁবু টানিয়ে নিলাম। এরপর রাতের জম্পেশ খানাপিনা শেষে আতশবাজি ফুটিয়ে জোলাভাতির উদ্বোধন করা হলো। শুরু হলো ক্যাম্পফায়ার, বার-বি-কিউ। অনেক রাত অবধি আড্ডা চলল। শেষ রাতে জোছনার আলোয় তাঁবুবাস। নীরব নিঃস্তব্ধ পুরো চর। আমাদের আশপাশ কোনো গ্রাম নেই। হুক্কাহুয়া শিয়ালের হাঁকডাক। পৌষের হিমেল হাওয়া তাঁবুর ফাঁকফোকর দিয়ে ঢুকে, শরীরে ঝাঁকুনি দিয়ে যায়। সদ্য কিঞ্চিৎ ক্ষয়িষ্ণু চাদটা যেন মাথার ওপর বিশাল ল্যাম্পপোস্ট। একটা সময় ইচ্ছের বিরুদ্ধেই ঘুমিয়ে যাই। ঘণ্টা দুয়েক পর তাঁবু থেকে মাথা বের করতেই, এক অন্যরকম সকাল আবিষ্কার করি। দু’চোখ যতদূর যায় শুধু ফসলের ক্ষেত। সেই সাথে সরিষা ফুলের ম ম ঘ্রাণ। তাঁবু থেকে সবাই বের হই। প্রথমেই ৪৮তম বিজয় দিবস উপলক্ষে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ও তাদের পরিবার পরিজন এবং যারা অংশ নিয়েছিলেন তাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়। এরপর ক্ষেতের আল ধরে ফসলের মাঠ ঘুরে বেড়াই। ঝাঁকে ঝাঁকে সাদা বক উড়ে বেড়ায়। এখনো এখানে লাঙ্গল দিয়ে চাষাবাদ হয়। সরিষার পাশাপাশি প্রচুর বাদাম ফলে এই মাটিতে। হাঁটতে হাঁটতে দেখা হয় মেঘনার বুকে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয়। এলাকাজুড়ে নয়নাভিরাম আলোকরশ্মি খেলা করে। সে এক অপার্থিব সৌন্দর্য।
চর ঘুরে হাঁসের গোশত ও ডালেচালে মিলিয়ে লাকড়ির চুলায় জোলাভাতির রান্না শুরু। এই ফাঁকে ছবি প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের পুরস্কার বিতরণী ও দড়ি টানাটানি খেলা চলল। ধোঁয়া তোলা খিচুরি রেডি। সাথে হাঁসের গোশত ভুনা। আহ্ সেই স্বাদ। খেয়েদেয়ে চেটেপুটে ছুটলাম ট্রলারে চেপে চউদ্দার চরে। মেঘনার পানিতে ভেসে চলে ট্রলার। দেখা হয় জেলেদের জীবন জীবিকা। কনকনে শীতেও হার না মানা যাপিত জীবনের যুদ্ধে লিপ্ত থাকা মানুষগুলো, শহুরে হতাশাগ্রস্তদের প্রেরণা জোগায়। দেখতে দেখতে ট্রলার ঠেকে চউদ্দার চরে। জায়গাটা আড়াইহাজার উপজেলার খাগকান্দা ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত। চার পাশে পানি, মাঝে বিশাল এক চর। উত্তাল মেঘনার জলরাশি আছড়ে পড়ে। আরেক পাশে সারি সারি মাছ ধরার ফাঁদ। নিশ্চিন্ত মনে চিল পাখি মেঘনার পানিতে শরীর ভেজায়। বিশুদ্ধ বাতাসে হেঁটে বেড়াই চউদ্দার চর। কেউবা অনাবাদি ভূমিতে, ফুটবল আর দৌড় খেলায় মেতে ওঠে। সব শেষে টলটলে পানিতে ইচ্ছেমতো ডুবাডুবি। পায়ের নিচের বালু, ক্ষণিকের জন্য সমুদ্রসৈকতের আনন্দ দেয়। সব মিলিয়ে ধারেকাছে এক ঢিলে অনেক রকমের ভ্রমণান্দের উৎস হবে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার।

যাবেন কিভাবে
গুলিস্তান মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের টোলঘরের পাশ থেকে এ/সি বিআরটিসি বাস সার্ভিস রয়েছে আড়াইহাজার বিশনন্দী ফেরিঘাট পর্যন্ত। ভাড়া জনপ্রতি ১০ টাকা। এ ছাড়া নিয়মিত বিভিন্ন পরিবহনের বাসও চলাচল করে। ফেরিঘাট থেকে ট্রলার চর শিবপুর ও চউদ্দার চর, যাওয়া-আসা সারা দিনের জন্য রিজার্ভ নেবে পঁচিশ শত -তিন হাজার টাকা মাত্র।

খাওয়া-দাওয়া
নিজেরা রান্না করে খেতে পারেন। নতুবা খাগকান্দা ঘাটে সেরে নিতে পারেন।

ভ্রমণ তথ্য
মানুষ বেশি হলে ক্যাম্পিং করা যেতে পারে। অন্যথায় দিনে দিনে ঘুরে আসাটাই ভালো। স্থানীয় নিশ্ন শ্রেণী, এখনো পুরোপুরিভাবে বাইরে থেকে ঘুরতে আসা ভ্রমণপিপাসুদের সহজভাবে নিতে শেখেনি। সুতরাং যতটা সম্ভব তাদের এড়িয়ে চলুন। রাতে ক্যাম্পিং, ক্যামফায়ার করতে চাইলে বিউটিফুল আড়াইহাজার ফেসবুক গ্রুপের সাথে যোগাযোগ করে নিতে পারেন।

 


আরো সংবাদ



premium cement