পরিযায়ী পাখির সাথে এক বিকেল...
- সুমন্ত গুপ্ত
- ২৪ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০
প্রকৃতিতে শীতের আমেজ শুরু হলে ভোরের শিশিরবিন্দু জমে থাকে পাখির ঠোঁটের ডগায়। দূরদিগন্ত থেকে উড়ে আসে অনেক পরিযায়ী পাখি। হেমন্তের পাকা ধানের সুবাস শেষ হলেই উত্তরের হিমেল বাতাসে ভর করে ওরা ভিড় জমায় আমাদের দেশে। এসব পরিযায়ী পাখি হাজার হাজার মাইল দূরের পথ উড়ে আমাদের দেশে আসে তীব্র শীত ও খাদ্যাভাব থেকে বাঁচার জন্য। আসে দূর সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া, তিব্বত, হিমালয়ের পাদদেশ, চীনসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে। আসতে শুরু করে নভেম্বর মাসে এবং এপ্রিল পর্যন্ত থাকে। এই অল্প দিনেই এরা হয়ে যায় আমাদের বন্ধু। দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে ওই পাখিরা। সেই পাখির খোঁজে আমরা বের হয়েছিলাম এক পড়ন্ত দুপুর বেলায়। সব সময়ের সঙ্গী আমার মা আর আমার পাইলট নুরুল ইসলাম ভাই। গন্তব্য স্থানটা আমরা চিনি না, তবে একবার শুনেছিলাম পারাইরচক। যাই হোক, সূর্য দেবের নাম নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম আমরা। বারে শনিবার গত বেশ কিছু দিন হয় মাকে নিয়ে বাইরে ঘুরতে যাওয়া হয় না। আর ডিসেম্বর মাস শুরু অনেক কাজের চাপ সহ্য করতে হবে, তার আগে রিফ্রেশ হয়ে নেয়া দরকার। তাই আমরা বেরিয়ে পড়লাম শহরের যানজট তার মাঝে স্কুল ছুটি হয়েছে, তাই শহর থেকে বের হতে কিছুটা বেগ পেতে হলো আমাদের। যাই হোক, গাড়িতে বাজছে নচিকেতার জীবনধর্মী । আমরা শহর থেকে বের হলাম, সিলেটের দক্ষিণ সুরমার দিকে ধাবিত হলাম। হাতের ডান পাশে বয়ে গেছে রেল লাইন। কিছু দূর যাওয়ার পর দেখা মিলল কু ঝিক ঝিক ছন্দে ট্রেন তার দুরন্ত গতিতে ছুটে যাচ্ছে। আমি আবার গাড়ি থেকেই ছবি তোলার চেষ্টা করলাম। কিছুক্ষণ পর নুরুল ভাই বলেন দাদা, পারাইরচক তো এসে গেলাম, পাখি কই। আমি ডান-বাম তাকাতে লাগলাম, পাখির তো দেখাই নেই। আমি মনে মনে ভাবলাম, আগে একবার অতিথি পাখি দেখতে গিয়ে তিন দিন ঘুরতে হয়েছে জায়গা খুঁজে বের করতে, আজো কি সেই রকম হতে চলল কি না। মা বললেন, চল অন্য কোথাও যাই। এখানে পাখি আসে না হয়তো। আমি আবার সহজেই হার মানার পাত্র নই। তাই বললাম, আরেকটু সামনে যাই, না পেলে ফিরে যাবো। কিছু দূর যাওয়ার পর হঠাৎ চোখে পড়ল কয়েকটা সাদা বক উড়ে যাচ্ছে দেখে আমার মন আনন্দে নেচে উঠল। এই তো পেয়েছি ঝিলের জলে ঝাঁকে ঝাঁকে পরিযায়ী পাখি বসে আছে। আরেকটু সামনে যেতেই দেখা মিলল পরিযায়ী পাখিরা আপন মনে বসে আছে। নেই কোনো কোলাহল, নেই কোনো পাখিশিকারির দল। বলে রাখা ভালো, জীবজগতের মধ্যে পাখিরাই সর্বাধিক পরিযায়ী। শীতের এসব পাখিকে অতিথি পাখি বলেন অনেকে। পাখি অতিথি নয়, পাখি কোনো দেশের নয়। তবে পাখিদের দেশভিত্তিক একটা তালিকা থাকতে পারে। অতিথি পাখি বলে কোনো শব্দ পৃথিবীর কোথাও ব্যবহৃত হয় না। কোনো পাখি একদিন মাত্র কোনো দেশে থাকলে সে পাখিটা সেই দেশের পাখি হয়ে যায়। যে পাখি সারা বছর এ দেশে বাস করে, তাকে আমরা বলি আবাসিক পাখি (জবংরফবহঃ ইরৎফ)। যে পাখি বছরের পুরোটা সময় এ দেশে না থেকে নিয়মিত বিদেশ ভ্রমণ করে, তাদের পরিযায়ী পাখি (গরমৎধঃড়ৎু ইরৎফ) বলা হয়। আমাদের দেশে ৬৫০ প্রজাতির পাখির একাংশ গ্রীষ্মে আহার, বাসস্থান ও প্রজননের জন্য হিমালয়ের তুষারঢাকা অঞ্চল হয়ে সুদূর বেরিয়া ও তুন্দ্রা অঞ্চলে চলে যায়। এসব পাখির কোনোটা তিন মাস, কোনোটা ছয় মাস ওই অঞ্চলে থাকে। তার পর আবার দেশে ফেরে। ১০ থেকে ১৫ প্রজাতির যেসব পাখি শীতের সময় দেশে থাকে না, তারা হলো সুমচা ও কোকিল প্রজাতির পাখি। যাই হোক, আমরা চাইলাম আরো কাছে যেতে, কিন্তু ঝিলে কিছুই নেই; অনেক দূরে দেখলাম একটা ডিঙ্গি নৌকা। নুরুল ভাই তার ভাঙা নৌকা নিয়েই ডাকা শুরু করলেন। শেষ পর্যন্ত আমাদের ডাকে সাড়া দিয়ে মাঝি আসতে শুরু করলেন। বলে রাখা ভালো, এখানে মানুষের আনাাে নেই বললেই চলে রাস্তার ধারে, তাই খুব সাবধানে ঝিলের পাশে নামতে হবে। ডিঙ্গি নৌকা কাছে আসার পর আমি আর নুরুল ভাই রাস্তার থেকে ঝিলের দিকে নামলাম। খুব সাবধানে পা বাড়ালাম, কারণ এঁটেল মাটি। নৌকা আসার পর নৌকাতে উঠতে গিয়ে দেখি নৌকা দিয়ে জল উঠছে। আমি একবার ভেবেছিলাম, নৌকাতে উঠব না। কিন্তু আরো সামনে থেকে পরিযায়ী পাখি দেখার লোভ সামলাতে পারছিলাম না। তাই সূর্য দেবের নাম নিয়ে নৌকায় উঠেই গেলাম। ঝিলের জলে আমরা ভাসছি, আমি ক্যামেরা তাক করে একের পর এক ছবি তুলে যাচ্ছি। অসাধারণ সে দৃশ্য চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। ঝিলের জলে পাখিদের ছুটে বেড়ানোর দৃশ্য যে কারোর মন ভরিয়ে দেবে। খুব স্বল্প সময়ে কাছের দূরত্বে দেখার মতো লোভনীয় স্থান, এটি এখনো লোকচক্ষুর অন্তরালে রয়ে গেছে। যারা সিলেট ঘুরতে আসেন খুব স্বল্প সময় নিয়ে, তারা সহজেই ঘুরে আসতে পারেন পারাইরচকে। অস্তগামী সূর্যের আগমনের সাথে সাথেই আমাদের বিদায়ের পালা চলে এলো। আমরা পাখির মতো ফিরে চললাম আমাদের নীড়ে।
পথের ঠিকানা :
ঢাকার যেকোনো স্থান থেকে আপনাকে প্রথমে যেতে হবে যাত্রাবাড়ী বা কমলাপুর। এখান থেকে বাসে অথবা ট্রেনে করে সিলেট। সিলেটের রেলস্টেশন বা বাস টার্মিনাল থেকে দক্ষিণ সুরমা পারাইরচক বললেই যে কেউ চিনিয়ে দেবে। অথবা গাড়ি ভাড়া করে পৌঁছে যেতে পারেন পারাইরচকে। ভাড়া পড়বে ৩০০ টাকা থেকে এক হাজার ২০০ টাকা। গাড়ির জন্য গন্তব্যÑ ০১৮৮১০১১৭৭৪, ০১৭৩৫০২৪২০৫