২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত তেলিয়াপাড়া স্মৃতিসৌধ

-

আমার দাদার বাড়ি হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলায় অবস্থিত। এই কারণে আমার গর্বের শেষ নেই। গর্ব হবেই না কেন, এই মাধবপুর উপজেলার তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের ম্যানেজার বাংলোতে ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের মহাপরিকল্পনার প্রথম গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেই গোপন বৈঠক থেকেই মুক্তিযুদ্ধের সামরিক সর্বাধিনায়ক আতাউল গনি ওসমানীর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের শপথবাক্য পাঠ করা হয় এবং তিনি নিজের পিস্তল থেকে ফাঁকা গুলি করে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধের ঘোষণা করেন। এ ছাড়াও ৪ এপ্রিল থেকে ওই বাংলোটি প্রথমে মুক্তিবাহিনীর সদর দফতর এবং পরবর্তী সময়ে ৩ ও ৪ নম্বর সেক্টরের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এবং পাক হানাদার বাহিনীর সাথে বেশ কিছু রক্তক্ষয়ী সম্মুখ যুদ্ধের সাক্ষীও তেলিয়াপাড়া ও এর আশেপাশের এলাকা। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে প্রকৃতির নয়নাভিরাম পরিবেশে তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের পাশেই স্থাপন করা হয় ‘তেলিয়াপাড়া স্মৃতিসৌধ’। বর্তমানে এই স্থানটি হবিগঞ্জ জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন স্পট। কিছু দিন আগেই আমার কজন বন্ধুর সাথে সেখান থেকে ঘুরে এলাম।
আমরা এক দুপুরে হবিগঞ্জ জেলা শহর থেকে তিনটি বাইকে চড়ে ছয় বন্ধু রওনা দেই। শায়েস্তাগঞ্জ পার হয়ে সুতাং বাজার যেতেই চোখে পড়ে সিলেটের বিভাগের দীর্ঘতম রঘুনন্দন পাহাড়। পাহাড়ের পাশ দিয়ে পিচঢালা রাস্তা ধরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে আমরা এগিয়ে যেতে থাকি। যেতে যেতে চোখে পড়ে হবিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক, শাহজিবাজার বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, হজরত ফতেহ গাজী রা.-এর মাজার, হবিগঞ্জ গ্যাস ফিল্ড ও রাবার বাগান। তারপর আরেকটু এগিয়ে সায়হাম গ্রুপের ফ্যাক্টরিগুলো পার হয়ে হাইওয়ে রাস্তার পাশে নোয়াপাড়ার বিখ্যাত ‘আল আমিন’ হোটেলে বসে চা-নাশতা করে আবার রওনা দেই। সেখান থেকে জগদীশপুর পার হয়ে তেলিয়াপাড়ার দিকে এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ে বিশাল এশিয়ার বৃহত্তম সুরমা চা-বাগান। কাঁচা চা-পাতার মন মাতানো গন্ধে মনটা যেন ভরে গেল। নারী শ্রমিকদের চা-পাতা সংগ্রহ করা দেখতে দেখতে তেলিয়াপাড়ায় অবস্থিত বিজিবির বিশাল তোরণ পার হয়ে একটু এগিয়েই পৌঁছে গেলাম তেলিয়াপাড়া স্মৃতিসৌধে। ১৯৭৫ সালে এ স্মৃতিসৌধটি উদ্বোধন করেন মুক্তিযুদ্ধের ৩ নম্বর সেক্টর কমান্ডার, তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ বীর উত্তম পিএসসি। বুলেট আকৃতির সৌধটি দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না, কতটা ‘বুলেট-পণ’ ছিল মুক্তিযুদ্ধের সেই শপথ অনুষ্ঠান। স্মৃতিসৌধের সামনে দাঁড়িয়ে চলল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসচর্চা।
স্মৃতিসৌধের মূল প্রবেশপথের দুই পাশে ফলকে লেখা কবি শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতার পঙ্ক্তিমালা। দক্ষিণ দিকে লাগানো ফলক জানাল, এ স্থানটি শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে নির্মিত। সেখানে স্মৃতিফলকে ৩৩ জনের নামের তালিকায় রয়েছে রাজনৈতিক নেতা, সাবেক সেনা ও সরকারি কর্মকর্তা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নাম। স্মৃতিসৌধের পাশেই রয়েছে একটি প্রাকৃতিক লেক। বর্ষাকালে এখানে লাল শাপলা ফোটে। তখন লেকটি দেখতে খুব সুন্দর লাগে। স্মৃতিসৌধ থেকে একটু সামনে এগিয়ে গেলেই সেই ঐতিহাসিক বাংলোটি চোখে পড়ে। যে বাংলোর সামনে বসে ৪ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধের মহাপরিকল্পনার গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেই ঐতিহাসিক বৈঠকের ভাস্কর্য নির্মাণ করে রাখা আছে মুজিবনগর স্মৃতিসৌধে। যদিও সেটি এখানেই স্থাপনের কথা ছিল। ঐতিহাসিক ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন কর্নেল (অব:) এম এ জি ওসমানী এমএনএ, লে. কর্নেল (অব:) এম এ রব এমএনএ, লে. কর্নেল সালাউদ্দীন মোহাম্মদ রেজা, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর কে এম সফিউল্লাহ, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর কাজী নুরুজ্জামান, মেজর নুরুল ইসলাম, মেজর শাফায়াত জামিল, মেজর মঈনুল হোসেন চৌধুরী এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিদ্রোহী মহুকুমা প্রশাসক কাজী রকিব উদ্দিন। ভারত সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে বিএসএফের পূর্বাঞ্চলীয় মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার ভি সি পাণ্ডে এবং আগরতলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ওমেস সায়গল উপস্থিত ছিলেন। আমাদের গর্বের, বহু ত্যাগের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সাক্ষী বাংলোটি এখনো মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের অধীনে আসেনি। এখনো সেটি তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের ম্যানাজারের বাংলো হিসেবেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তবে প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ করে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় বাংলোটি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে রূপান্তর করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। সারা বছরই অগণিত মানুষ এখানে আসে পিকনিক আয়োজনের জন্য। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত ও চা-বাগানের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মেলবন্ধনে তেলিয়াপাড়া তাই সব মিলিয়ে অনন্য এক পর্যটন স্পট।
যেভাবে যাবেন : ঢাকা থেকে সিলেট বা হবিগঞ্জগামী বাসে করে মাধবপুর উপজেলার জগদীশপুর মোড়ে নামতে হবে। সেখান থেকে অটোরিকশা বা সিএনজি করে ঢাকা-সিলেট পুরাতন মহাসড়ক ধরে সরাসরি তেলিয়াপাড়া স্মৃতিসৌধে যাওয়া যায়। আর সিলেটগামী ট্রেনে গেলে নোয়াপাড়া রেলস্টেশনে নেমে একটি অটোরিকশা বা সিএনজি নিয়ে সরাসরি তেলিয়াপাড়া স্মৃতিসৌধে যাওয়া যাবে। খরচ পড়বে সর্বোচ্চ ১০০ থেকে ২০০ টাকা।

ছবি : ডা: আল আমিন সুমন (ড্রোন ক্যামেরা) ও
সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুহান


আরো সংবাদ



premium cement