শরীরচর্চায় হেলাফেলা!
- হাসান জয়
- ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০
কখনো কি নিজের দুই হাত দিয়ে পেটের থলথলে মেদভুঁড়িটি ধরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছেন? স্বপ্ন দেখেছেন কি মেদভুঁড়িহীন একটি পেট, ছিপছিপে হাত-পা, সুঠাম ও শক্তিশালী একটি শরীরের? সত্যি করে বলুন, সেই স্বপ্ন পূরণের পথে কোনো দৃঢ় পদক্ষেপ কি আদৌ নিয়েছেন কখনো? নিয়ে থাকলেও ধরে রাখতে পেরেছেন কি সেই প্রচেষ্টা?
সবাই-ই চায় নিজেকে সুন্দর রাখতে, বাড়তি মেদ ঝড়িয়ে সুন্দর শারীরিক গঠন পেতে। প্রশংসা পেতে কার না ভালো লাগে? কিন্তু বেশির ভাগ মানুষই সারা জীবন শুধু স্বপ্নই দেখে যান, সুন্দর শারীরিক গঠন অর্জন করার কঠিন পথে আর পা বাড়ানো হয়ে ওঠে না। করব, করব ভাবেন শুধু, করা আর হয় না। কেউ কেউ হয়তো সাহস করে জিমে ভর্তি হয়ে যান, প্রথম প্রথম এক-দুই সপ্তাহ কোনোভাবে জিমে যাওয়া হলেও তারপর থেকে হয়ে যান অনিয়মিত। একসময় পুরোপুরি বন্ধ করে দেন জিমে যাওয়া। ভেবে দেখুন তো, আপনার পরিচিত এমন ক’জন আছেন যারা একটি ট্রেডমিল কিনেছিলেন খুব আগ্রহ নিয়ে কিন্তু তারপর সেই ট্রেডমিলে আর হাঁটা হয়নি। এমন কতজন আছেন যারা সকালে বা বিকেলে কিছু দিন পার্কে বা রাস্তায় হেঁটেছেন, কিন্তু তার পর একসময় আর মন চায়নি হাঁটতে, তাই ছেড়ে দিয়েছেন?
শরীরচর্চার জন্য নিজেকে অনুপ্রাণিত করতে পারছেন না? জেনে রাখুন, এ প্রক্রিয়ার পুরোটাই আপনার হাতে। অন্য কেউ আপনাকে অনুপ্রাণিত করতে পারবে না। আপনাকে শুধু দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিতে হবে শরীরচর্চার ব্যাপারে, অধ্যবসায়ী হতে হবে। দেখবেন শারীরিক ও মানসিকভাবে কতটা ভালো বোধ করবেন, এনার্জি পাবেন, মন থাকবে উৎফুল্ল, শরীর সুস্থ ও সুন্দর থাকবে যার ফলে আয়ুও বাড়বে। নিচের টিপসগুলো মন দিয়ে পড়ুন এবং জেনে নিন কিভাবে নিজেকে অনুপ্রাণিত করবেন শরীরচর্চার জন্য!
১. অনুধাবন করুন : প্রথমে অনুধাবন করুন। অনুধাবন করার মতো বড় শক্তি আর হয় না। জানা এবং অনুধাবন করা এক নয়। একজন ধূমপায়ী জাপ্রণ যে, ধূমপান করলে ফুসফুসের ক্ষতি হয়, ক্যান্সার হয় ইত্যাদি। কিন্তু তিনি ধূমপান ছাড়তে পারেন না, কারণ তিনি অনুধাবন করতে পারেন না। যতক্ষণ পর্যন্ত ধূমপানের ক্ষতিগুলো অনুধাবন করতে না পারবেন, তিনি ধূমপান করেই যাবেন। একইভাবে আপনার যদি বাড়তি ওজন থেকে থাকে, তাহলে আপনাকেও অনুধাবন করতে হবে ভবিষ্যতে আপনার জন্য কি কি রোগবালাই ও ভোগান্তি অপেক্ষা করছে। তাহলেই শরীরচর্চা করতে অনুপ্রাণিত হতে পারবেন। বাড়তি ওজনকে উপেক্ষা নয়, স্বীকার করে নিন আপনার ওজন একটু বাড়তি। তা হলেই মন থেকে অনুপ্রেরণা আসবে। মনে রাখতে হবে, শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র, বাড়তি ওজন না কমালে আপনার দিকে ধেয়ে আসছে বিভিন্ন ধরনের অসুখ।
২. নিজেকে প্রশ্ন করুন : প্রশ্ন করুন নিজেকে ‘আমি কি চাই না আমাকে সুন্দর দেখাক? কেন আমার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও আমি নিজেকে সুন্দর দেখানোর পথে হাঁটছি না? নিজের সৌন্দর্য, সুস্থতা ও দীর্ঘায়ুর জন্য এতটুকু কষ্ট কি আমি করতে পারি না, একটু সময় কি বের করতে পারি না?’ এই প্রশ্নের উত্তর দিন নিজেকে।
৩. খুব প্রিয় পুরনো একটি পোশাক বের করুন : আলমারি থেকে এমন একটি পোশাক বের করুন যা অতীতে আপনার খুব প্রিয় ছিল, কিন্তু এখন আর আপনার গায়ে হয় না। হতে পারে সেটি আপনার বিয়ের পোশাক, বা এমন একটি পোশাক যেটি আপনি ভার্সিটিতে পরে গিয়েছিলেন আর বন্ধুরা আপনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিল। মনে করে দেখুন, আপনাকে কী দারুণই না লাগত। এবার মনে মনে পণ করুন, আবার আগের মতো সুন্দর হয়ে আগের সেই পোশাক পরে নিজেকে নিজে দেখিয়ে দেবেন।
৪. পুরনো ছবি দেখুন : পুরনো ছবিগুলোতে নিজেকে দেখুন। আপনার ছিপছিপে শরীর, গালের উঁচু হাড়, মেদহীন চোয়াল ও থুঁতনি। নিজেকে জিজ্ঞেস করুন, আগের মতো হতে ইচ্ছে করে কি না।
৫. তুলনা করুন : আপনার কি এমন কোনো বন্ধু বা সহকর্মী বা পরিচিত কেউ আছে, যে অত্যন্ত সুঠাম দেহের অধিকারী? তার সাথে নিজেকে তুলনা করুন। চুপি চুপি রোজ নিজেকে বলুন, আপনি একদিন তার চেয়েও বেশি সুঠাম দেহের অধিকারী হবেন, সেটা হয়তো আগামী দুই বছরের মধ্যেই। ভালো কাজে সুস্থ প্রতিযোগিতা করা অপরাধ নয়, বরং প্রশংসনীয়।
৬. হাত দিয়ে নিজের মেদ পর্যবেক্ষণ করুন : আয়নার সামনে দাঁড়ান। এবার শরীরের মেদবহুল অংশগুলো হাত দিয়ে ধরুন ও পর্যবেক্ষণ করুন। তা হলে বুঝতে পারবেন, আপনি ঠিক কতটা মোটা। এখনো কি চান আরো কয়েক বছর এমনই দেখাতে নাকি শরীরচর্চা শুরু করতে চান যত দ্রুত সম্ভব?
৭. ইউটিউবে ভিডিও দেখুন : ইউটিউবে অসংখ্য বিফোর-আফটার ভিডিও আছে, যেগুলোতে আপনি দেখতে পারবেন ২০০ কেজি ওজনের নারীটি কী করে ৫০ কেজি হয়েছেন, কী করে ২৫০ কেজি ওজনের মধ্যবয়সী লোকটি নিজের ওজন ৮০ কেজিতে নামিয়ে এনেছেন। এরকম হাজার উদাহরণ আছেÑ ইউটিউবে যা দেখে আপনি বুঝতে পারবেন, চেষ্টা করলে কিছুই অসম্ভব নয়।
৮. অভিজ্ঞ কারো সাথে কথা বলুন : এমন কারো সাথে কথা বলুন, যিনি নিজে এরকম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন, যিনি কিনা একসময় ওভারওয়েট ছিলেন, কিন্তু এখন বাড়তি মেদ ঝড়িয়ে একদম ঝরঝরে। এমন একজনের সাথে কথা বললে শরীরচর্চা নিয়ে আপনার মনের অনেক অনর্থক ভয় ও অস্বস্তি কেটে যাবে।
৯. শরীরচর্চার সঙ্গী : একজন সঙ্গী খুঁজে বের করুন, যিনি আপনার সাথে শরীরচর্চা করবেন। এটা অনুপ্রেরণা হিসেবে অসাধারণ কাজ করে। আপনি ও আপনার শরীরচর্চার সঙ্গী শুধু একে অন্যকে উৎসাহিতই করবেন না, আপনাদের দু’জনের মধ্যে একটি প্রতিযোগিতার মনোভাবও কাজ করবে। ফলে দু’জনেরই ফাঁকি দেয়ার মানসিকতা কমবে।
১০. কোনো উপলক্ষকে টার্গেট করুন : ছয়-সাত মাস পরের কোনো উপলক্ষ্যকে টার্গেট করুন। হতে পারে সেটা কোনো আত্মীয়ের বিয়ে, কলেজে পুনর্মিলনী বা আপনার নিজের জন্মদিন। শপথ করুন, সেই দিনটিতে আপনাকে আজ থেকে অনেক বেশি সুন্দর ও সুঠাম দেখাবে।
১১. শরীরচর্চার পোশাক : ব্যায়াম করার জন্য সুন্দর কিছু কাপড় কিনুন যা পরে আপনি জিমে বা পার্কে শরীরচর্চা করবেন। এতে করে আপনার মনে আগ্রহ বাড়বে শরীরচর্চার প্রতি।
১২. গানের সাহায্য নিন : যদি গান শুনতে ভালো লাগে, কিছু গান বেছে নিন, যেগুলো আপনি দৌড়ানো, হাঁটা বা ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করার সময় শুনবেন। এতে আপনি বোর হওয়ার হাত থেকে বাঁচবেন।
১৩. রাতারাতি জীবন পাল্টে ফেলবেন না : আমাদের শরীর কোনো কিছুতে অভ্যস্ত হতে কিছু দিন সময় নেন, তাই শরীরকে সময় দিন। রাতারাতিই জীবনের পুরো রুটিন পাল্টে ফেলবেন না। আস্তে আস্তে শরীরচর্চা শুরু করুন। কয়েক সপ্তাহ হালকা ব্যায়াম করে নিজেকে অভ্যস্ত করুন। খুব কঠিন বা অতিরিক্ত শরীরচর্চা করবেন না। এতে চাপ সামলাতে না পেরে শরীরচর্চা জিনিসটার ওপরই বিরক্ত হয়ে যাবেন।
১৪. শরীরচর্চাকে জাদু ভাববেন না : শরীরচর্চা শুরু করার পর বেশির ভাগ লোকই এই ভুলটি করে থাকেন। মাত্র একমাস শরীরচর্চা করেই তারা আশাতীত ফল চান। যে মেদ আপনি শরীরে জমা করেছেন বছরের পর বছর, আপনি কী করে আশা করেন মাত্র চার সপ্তাহে তা দূর হয়ে যাবে? ধৈর্য ধরে লেগে থাকতে হবে।
১৫. ক্যালেন্ডারে দাগ দিন : যে দিন সুন্দরভাবে পুরোপুরি ব্যায়াম করলেন, সে দিনগুলো ক্যালেন্ডারে দাগ দিন। এতে নিয়মিত ব্যায়াম করার অনুপ্রেরণা পাবেন।
১৬. নিজের মাপের চেয়ে এক সাইজ ছোট একটি পোশাক কিনুন : নিজেকে অনুপ্রাণিত করতে শপিংমলে গিয়ে খুব সুন্দর একটি পোশাক কিনুন, তবে পোশাকটি হতে হবে আপনার গায়ের মাপের চেয়ে এক সাইজ ছোট। পোশাকটি যেকোনো কিছু হতে পারেÑ একটি জিন্স বা একটি টি-শার্ট অথবা কুর্তা, যা আপনার ভালো লাগে। প্রতি সপ্তাহে ছুটির দিন একবার করে সেটি পরে দেখুন। ধীরে ধীরে একসময় আবিষ্কার করবেন যে, পোশাকটি একসময় গায়ে তুলতেই পারতেন না, সেই পোশাকটি আপনার গায়ে ফিট হতে শুরু করেছে। হয়তো টাইট লাগছে, কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পরই একদম ঠিকঠাক লাগবে। এই অনুপ্রেরণা আপনাকে সবসময় সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
১৭. ছবি তুলুন : শরীরচর্চা শুরু করার আগে নিজের ছবি তুলুন, এক মাস পরপর নিজের ছবি তুলুন ও তুলনা করুন। কয়েক মাস পর নিজের পরিবর্তন দেখে নিজেই মুগ্ধ হবেন।
১৮. ফলাফল দেখান প্রিয়জনকে : যখন বুঝবেন আপনার শারীরিক উন্নতি হচ্ছে, খুব কাছের মানুষদের দেখান। তাদের প্রশংসা আপনাকে আরো বেশি অনুপ্রাণিত করবে। তবে সাবধান, সবাইকে দেখাবেন না। সমাজে কিছু লোক আছে যারা আপনার উন্নতি দেখে ঈর্ষাকাতর হয়ে প্রশংসা তো করবেই না, উল্টোটাও বলতে পারে।
১৯. না খেয়ে ওজন কমানোর চেষ্টা করবেন না : শরীরচর্চা করার জন্য অনেক এনার্জি প্রয়োজন হয়। না খেয়ে থাকলে সবসময় ক্লান্ত লাগবে, যার ফলে ব্যায়াম করতে আগ্রহ পাবেন না। এ ছাড়া না খেয়ে থাকলে শরীরে ক্যালরি ও পুষ্টির অভাব হয়, যার ফলে শরীরের মেদ দূর না হয়ে প্রয়োজনীয় পেশি শুকিয়ে দুর্বল হয়ে যায়। পেশি হারানোর ক্ষতি পুশিয়ে নেয়া খুবই কঠিন। এ ছাড়াও প্রয়োজনের কম ক্যালরি খেলে আপনার হজমশক্তি দুর্বল হয়ে যায়। তাই ক্রাশ ডায়েট বর্জন করুন।
২০. ক্যালরি কাউন্টার কিনুন : সম্ভব হলে একটি ক্যালরি কাউন্টার কিনুন যা শরীরচর্চার সময় হাতে বেঁধে নিলে এতে হিসাব দেখাবে; কত ক্যালরি পোড়ালেন। চোখের সামনে ক্যালরি খরচ হওয়ার হিসাব দেখলে অন্যরকম সন্তুষ্টি পাবেন।
২১. স্বাস্থ্যকর খাবার খান : প্রতিদিন কত ক্যালরি খাচ্ছেন তার হিসাব রাখুন। বেশি বেশি খান, কিন্তু সব স্বাস্থ্যকর খাবার খান। বাসার ফ্রিজ বোঝাই করে ফেলুন ফল ও শাকসব্জি দিয়ে। যত বেশি ফল ও শাকসবজি খাবেন, শারীরিকভাবে তত বেশি ভালো বোধ করবেন। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে দেখতে পাবেন, ত্বকে অন্য রকম সজীবতা।
২২. ওজন নয়, স্বাস্থ্য মাপুন : প্রতি মাসে বা প্রতি সপ্তাহে ওজন মাপার চেয়ে ভালো উপায় হলো ইঞ্চিটেপ বা মেজারমেন্ট টেপ দিয়ে শরীরের বিভিন্ন অংশের প্রস্থ মাপা। ১৫ দিন বা এক মাস পরপর মেজারমেন্ট টেপ দিয়ে নিজেকে মাপুন। শরীরচর্চা শুরু করলে আপনার শরীরের ফ্যাটগুলো পেশিতে পরিণত হবে, যা শরীরের জন্য খুব ভালো একটি ব্যাপার। কারণ পেশি শরীরের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তবে এই সময় ওজন মাপলে ওজন আগের মতোই দেখাবে কিন্তু মেজারমেন্ট টেপ দিয়ে মাপলে বুঝবেন শরীর আস্তে আস্তে কমে আসছে।