২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

হাওরের মুগ্ধতা

-


তারিখটি ছিল ৬ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাত। আদি ঢাকার বংশাল থেকে মাইক্রো স্টার্ট। পথের মাঝে বিভিন্ন জায়গায় টি-ব্রেক দিতে দিতে ভোর ৫টায় পৌঁছাই কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার মরিচখালী। ফোন পেয়ে আগেই বাজারে এসে অপেক্ষায় ছিল দে-ছুট ভ্রমণ সংঘের অন্যতম সদস্য তরিকুল। তাকে সাথে করে চলে যাই ইন্দা গ্রামের নৌঘাটে। বাজার-সদাই চুলাপাতিল নিয়ে চড়ি ট্রলারে। সব ঠিকঠাক, মাঝি ট্রলার ভাসালো নরসুন্দা নদীর খালে। ট্রলার চলতে চলতে খাল পেরিয়ে ঘোড়া উতরা নদী ছাড়িয়ে নিকলীর ছাতিরচর পানে। এরই মধ্যে সকালের নাশতার জন্য খিচুড়ি রান্নার কসরত শুরু।
যেতে যেতে এক সময় দূর থেকেই চোখে ধরা দেয় ডুবোচরে জেগে থাকা সারি সারি হিজল-কড়চ গাছ। এ এক অনিন্দ্য ভালো লাগার হাতছানি। সামনে যেতেই চোখ সবার কপালে। বাঁকাত্যাড়া শত শত গাছ। বছরের ছয় মাস প্রায় ডুবে থেকেও বেঁচে থাকার নামই হিজল-কড়চ গাছ। চরটা অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা। আকাশপানে তাকিয়ে দেখি, নীলের বদলে ফিরোজা। দূরের শুভ্র মেঘমালা দেখে মনে হয়, এ যেন কোনো পর্বতচূড়া। সব মিলিয়ে ভোরের হাওয়ায়, নিকলী হাওরের আকাশটা অন্য রকম মায়াবী। এ রকম নয়নাভিরাম পরিবেশে, গাছের ফাঁকফোকরে হাঁটুপানিতে হেঁটে বেড়াই। হাওরের ঝিরঝির বাতাসে হ্যামোক ঝুলিয়ে দোল খাই। কথায় আছে না সকালের হাওয়া-লাখ টাকার দাওয়া। কে চায়? বিনে পয়সায় সেই সুযোগ ছাড়তে। জীবনের মানে খুঁজে পেতে চাইলে ছাতিরচরের জুড়ি নেই।
ইতোমধ্যে কলাপাতায় খিচুড়ি রেডি। ইচ্ছামতো গোগ্রাস করে ছুটলাম এবার অষ্টগ্রাম হাওরের পথে। নিকলী বেড়িবাঁধ পাশ কেটে ট্রলার চলে মোজনা বিলে। ভাসতে ভাসতে বিশাল হাওরের বুকে। কূল নেই, কিনার নেইÑ নেই কোনো জনমানবের বসতি। সাগর আর হাওরÑ এ দুইয়ের পার্থক্য যেন বোঝা দায়। কিশোরগঞ্জে রয়েছে প্রায় ৯৭টি ছোট-বড় হাওর। এসব হাওর নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও বি-বাড়িয়া জেলার বিভিন্ন বিল-হাওরের সাথে মিশে একাকার। দেশের মিঠাপানির মাছের চাহিদা অনেকাংশেই মিটে এসব হাওরের জলাশয় থেকে। হাওরের মুগ্ধতায় ভর করে ট্রলার চলছে। প্রায় আড়াই ঘণ্টা লাগবে অষ্টগ্রাম পৌঁছতে। এই দীর্ঘ সময়ে দে-ছুট ভ্রমণ সংঘের দামালেরা নেচে-গেয়ে উল্লাস করে। দুপুরের রান্নার জন্য রফিক-নাজমুল হাঁসের চামড়া ছিলে। মাঝে মধ্যে জেলে নৌকার দেখা মিলে। তাদের কাছ থেকে কেনা হাওরের টাটকা চিংড়ি ভাজায় রসনা মিটে। পানকৌড়ির ঝাঁক ভ্রমণান্দের আনন্দ বাড়ায়। ভাসতে ভাসতে ট্রলার পড়ল ধলেশ্বরীর বুকে। প্রমত্তা ধলেশ্বরী নদী, অথচ নারায়ণগঞ্জে এসে চরম মার খেয়েছে।
ঘড়ির কাঁটা প্রায় ১২টা। চোখে আটকায় অষ্টগ্রামের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সেতুর ওপরে। নজরকাড়া সৌন্দর্যমণ্ডিত সেতুটি দেখেই চোখ জুড়াল। ট্রলার ভিড়ে থানাঘাটে। নেমে যাই পানিতে। দে-ছুটের দামালেরা ডুবসাঁতারে মেতে ওঠে। জুমার নামাজের তাড়া। যেতে হবে প্রায় দুই কিলো দূরে হজরত কুতুব শাহ জামে মসজিদে। আর দেরি নয়।
নামাজের প্রস্তুতি নিয়ে ছুটলাম অটোতে। মসজিদটি প্রথম দর্শনেই তৃপ্তিবোধ হলো। ইমাম সাহেবের বয়ান চলছে। যাওয়ার সময় অটো চালক জানিয়েছিলেন, মসজিদে বসলে নাকি চোখে ঘুম চলে আসে। তার কথায় মুচকি হেসে মিথ ভেবেছিলাম। কিন্তু একি হায়! আমার চোখেও যে, যাক আর না লিখলাম। নামাজ শেষে সুলতানি আমলের তৈরি মসজিদটি ঘুরে ঘুরে দেখি। ১৬ শতকের তৈরি এ মসজিদটি বিখ্যাত দরবেশ হজরত কুতুব শাহ রহ:-এর নামে রাখা হয়েছে। তৎকালীন বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন সুলতানি স্থাপনা এই কুতুবশাহ মসজিদ। প্রায় সাড়ে চার শ’ বছরের অনন্য স্থাপত্য। মসজিদটির নির্মাণকাল লেখা কোনো শিলালিপি না পাওয়ায় এর সঠিক সময়কাল জানা যায় না। তবে বেশির ভাগ প্রতœতত্ত্ববিদ মসজিদটির স্থাপত্য রীতি ও নির্মাণশৈলী দেখে ১৬ শতকে সুলতানি আমলের হবে বলেই ঐকমত্য পোষণ করেন। মসজিদটির ৫টি সুদৃশ্য গম্বুজ রয়েছে। এর দেয়ালে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন কারুকার্য। মসজিদের পাশেই রয়েছে একটি কবর। ধারণা করা হয়, এটি হজরত কুতুব শাহ রহ:-এর কবর। মসজিদটির রয়েছে চারটি মিনার। পাঁচটি প্রবেশপথ। ১৯০৯ সালে তৎকালীন প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর, কুতুব শাহ মসজিদটি সংরক্ষিত হিসেবে নথিভুক্ত করে। এরপর চলে যাই অষ্টগ্রামের বিখ্যাত পনির চেখে, ইকুরদি গ্রামের সুস্বাদু মুড়লি খেতে। এই মুড়লির বিশেষত্ব সাত ইঞ্চি লম্বা, যা দেশের অন্য কোথাও মেলে না। মুড়লি আর গাছপকা চাম্পা কলা খেয়েদেয়ে সাথে নিয়ে ফিরলাম আবার ট্রলারে। মাঝি মোটর চালু করে। হাওরে ভেসে ভেসে দুপুরের আহার চলে। সাদাভাতের সাথে আইড় মাছের টলটলে ঝোল। আহ কী টেস্ট! ট্রলার চলতে চলতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। সারা দিনের তেজোদীপ্ত সূর্যটা রক্তবর্ণ আভা ছড়িয়ে পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে। ঠিক ভরসন্ধ্যায় সূর্য মামার নিলীমায় মিলিয়ে যাওয়ার চমৎকার দৃশ্য আপনার হাওর ভ্রমণের পরিপূর্ণতা এনে দেবে নিশ্চিত।

চলেন যাই : মহাখালী ও সায়েদাবাদ থেকে কিশোরগঞ্জগামী বিভিন্ন পরিবহন চলাচল করে। সেখান থেকে সিএনজিতে মরিচখালী/চামড়াবন্দর/নিকলী বেড়িবাঁধ। বাস ভাড়া পরিবহন ভেদে ২২০ থেকে ৪০০ টাকা।

ভ্রমণ তথ্য : অষ্টগ্রাম হাওর দেখতে হলে আগের রাতেই কিশোরগঞ্জ চলে যাবেন। কারণ কাকডাকা ভোরে ট্রলারে না চড়লে ফেরা যাবে না। শুধু ছাতিরচর দেখতে চাইলে মরিচখালী যাওয়ার প্রয়োজন নেই। সকালে নিকলী গিয়ে ট্রলারে আসা-যাওয়া ঘোরা, সব মিলিয়ে তিন ঘণ্টাতেই সেরে ঢাকা ফেরা যাবে। অষ্টগ্রাম রাত থাকতে হলে জেলা পরিষদের ডাকবাংলো আগেই বুকিং দিয়ে যেতে হবে।

ছবি : দে-ছুট ভ্রমণ সঙ্ঘ


আরো সংবাদ



premium cement
সিলেট সীমান্তে ৬৩ লাখ টাকার চোরাই পণ্যসহ আটক ২ ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে নিয়োগ করা হবে অবসরপ্রাপ্তদের : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হাসপাতালে ‘ভুল চিকিৎসায়’ মৃত্যু : ভাংচুর পুরান ঢাকার ২ কলেজে পুতুলের সূচনা ফাউন্ডেশনের লেনদেন স্থগিত সাগর থেকে টুনা মাছ আহরণে সহযোগিতা দেবে মালদ্বীপ সরাসরি ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কেন আলোচনায় ২৩ দিনে রেমিট্যান্স এসেছে ১৭২ কোটি ৬৩ লাখ ডলার বান্দরবানের গহীন জঙ্গলে কেএনএ’র গোপন আস্তানার সন্ধান হত্যা মামলায় গ্রেফতার হয়ে ডিসি মশিউর ও এডিসি জুয়েল বরখাস্ত গাজীপুরে আরো এক মামলায় খালাস পেলেন তারেক রহমান রাজশাহীর ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে আইসিইউ ইউনিট উদ্বোধন

সকল