হেফাজতের প্রতি কৃতজ্ঞতার দায়
- সাইফ সিরাজ
- ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৭:৩১
সময়টা ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩। আব্দুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায়ের বিপক্ষে ফাঁসির রায় চেয়ে শাহবাগে একত্রিত হয় একদল মানুষ। প্রথমে অল্প কিছু মানুষ একত্রিত হয়। মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করা হয়। ধীরে ধীরে শাহবাগে মানুষ একত্রিত হতে থাকে। এক সময় জনসমাবেশে রূপ নেয় শাহবাগের অবস্থান। শাহবাগ অবরোধের দিন ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। এই অবস্থানের নাম হয়ে যায় গণজাগরণ মঞ্চ। রাস্তা বন্ধ। জনভোগান্তি চলছে। আদালত অবমাননা তো ছিলই। কিন্তু পরিস্থিতি এমন ছিল যে এই গণজাগরণ মঞ্চ নিয়ে নেগেটিভ কিছু বলা মানেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী হয়ে যাওয়া। গণজাগরণ মঞ্চের বিপরীত ভাবনা মানেই রাষ্ট্রদ্রোহী হয়ে যাওয়া। এমন একটা চৈন্তিক বন্দিত্বের কাল চলছিল।
ধীরে ধীরে এইসব গণজাগরণ মঞ্চ রাজধানী থেকে জেলা শহরগুলোতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। দিন যায়। সপ্তাহ যায়। মাস যায়। গণজাগরণ মঞ্চের শেষ আর হয় না। ওদিকে নন-অ্যাপিলেড রায় আইন বদলে অ্যাপিলেবল হয়ে আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় দেয় আদালত। তখন অবশ্য আদালত এবং আওয়ামী লীগের কেউ এটাকে আদালত অবমাননা বলেনি। রাস্তা বন্ধ নিয়ে সরকার কোনো আলাপ করেনি। বরং এই আন্দোলনকে সরকার নিজেই জিয়ে রাখতে শুরু করে। বাংলাদেশ অবাক হয়ে দেখে আদালত ও সরকার বিপক্ষে সরকারি আন্দোলন।
এই গণজাগরণ মঞ্চ রাষ্ট্রের ভেতরে আরেকটা রাষ্ট্র হয়ে উঠে। সরকার ও মিডিয়ার আনুকূল্য পেয়ে তারাও বিভিন্ন গণবিরোধী দাবি করতে থাকে। দেশ জনতার জন্য বিভিন্ন নির্দেশও তারা দিতে থাকে। তারা জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানায়। জামাতের প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধের দাবি জানায়। ইসলামী ব্যাংকে হামলা চালায়। পাশাপাশি তারা ধর্মভিত্তিক রাজনীতিও নিষিদ্ধ করার দাবি জানায়। তারা জামাত, ধর্ম ও মাদরাসাকে গুলিয়ে ফেলে।
পুরো দেশ তখন বন্দীদশায়। বাম-আওয়ামী ব্লেন্ডেড এক উগ্র ন্যারেটিভে সকল এন্টি আওয়ামী শিবির কোণঠাসা হয়ে যায়। মিডিয়া এবং আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের এপ্রোচের কারণে গণজাগরণ মঞ্চ তো দূর কি বাত; সরকারে বিপক্ষে কিংবা ন্যায্য কোনো দাবি দাওয়া নিয়েও রাজপথে নামার সব পথ বন্ধ হয়ে যায়। মানুষের আবেগ আর চেতনার ন্যারেটিভ নিয়ে আওয়ামী লীগ আরেকটা বাকশালের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল এই শাহবাগের কাঁধে ভর করে।
বিএনপি কথা বলতে পারছিল না নির্বাচন নিয়ে। জামাত কথা বলতে পারছিল না তাদের নেতাদের মামলা নিয়ে। অন্য কোনো রাজনৈতিক দল কথা বলতে পারছিল না আওয়ামী লীগের অপরাজনীতি নিয়ে। বরং একটা শাহবাগের অনুমতির মুখাপেক্ষী হয়ে গিয়েছিল পুরো রাজনৈতিক অঙ্গন। ফাঁকা রাজপথ। বিরোধী দলহীন অনুকূল আন্দোলন। বামপন্থা ও আওয়ামী পন্থার পলিটিক্যাল মিথস্ক্রিয়া। এইসব মিলিয়ে রাজনীতিহীন একদলীয় একটা বাংলাদেশ তৈরির সকল আয়োজন তখন সম্পন্ন। নয়া বাকশালের দিকে বাংলাদেশ।
পুরো মিডিয়া ও সরকার যখন শাহবাগের অনুকূলে, দৈনিক আমার দেশ তখন সত্য বলার হিম্মত নিয়ে ওয়ানম্যান আর্মির মতো কথা বলে চলছিল। ইনকিলাব ও নয়া দিগন্তও বলার চেষ্টায় ছিল। সেই সময়ে যেসব ব্লগারদের নেতৃত্বে এই গণজাগরণ মঞ্চ তাদের পেছনের আমলনা বের হতে থাকল। যেগুলোকে তারা নাস্তিকতা, মুক্তচিন্তা কিংবা বিজ্ঞানমনস্কতা বলে চালাতো। যদিও সেগুলো কোনোভাবেই নাস্তিকতা, মুক্তচিন্তা কিংবা বিজ্ঞানমনস্কতা বলার সুযোগ ছিল না। এসব ছিল স্পষ্টত ইসলামবিদ্বেষ এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিকতার নামে বুদ্ধিহীন গুণ্ডামি।
রাজীব হায়দার নামের ‘থাবা বাবা’ ছদ্মনামের ভয়ঙ্কর নোংরামিপূর্ণ আমলনামা আমার দেশ ছাপিয়ে দেয়। সঙ্গে ইনকিলাবও ছাপে। ধীরে ধীরে সেলাই করা মুখগুলো কথা বলার সুযোগ পায়। মানুষ সংক্ষুব্ধ হতে থাকে। আওয়ামী লীগ ও বামেরা তাদের প্রচারণা চালাতেই থাকে। কয়েকটা পত্রিকা ছাড়া বাকি সবাই গণজাগরণ মঞ্চের গুণাগুণ গাইতেই থাকে। একটা অন্যায় অবস্থান ও আদালত অবমাননাকে কোনভাবেই তারা অবৈধ ও অন্যায় বলতে রাজি না।
পুরো দেশের জামায়াত পছন্দ করা, আলেম পছন্দ করা ও বাম-আওয়ামী লীগ অপছন্দ করা মানুষগুলো অবগুণ্ঠিত হয়ে যায়। আলেমদের ফাঁসি। রাজনীতিহীনতা। একদলীয় বাংলাদেশ যখন চূড়ান্ত। ঠিক তখনই নতুন আলোর প্রত্যাশা উঁকি দেয়। বাংলাদেশের আলেম সমাজ জেগে উঠতে থাকেন। চট্টগ্রামের হাটহাজারি মাদরাসার এক বর্ষীয়ান আলেমে দ্বীন শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বে আলেমগণ কর্মপরিকল্পনা শুরু করেন।
বাংলাদেশের মানুষ হাঁফ ছেড়ে বাঁচার একটা উপলক্ষ পায়। নাস্তিক ও ইসলাম বিদ্বেষীদের বিচারের দাবি নিয়ে অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম সক্রিয় হয়। ধীরে ধীরে সারা দেশের সংক্ষুব্ধ মানুষ হেফাজতের মিছিল মিটিংয়ে নামতে থাকেন। যে জামাত বিএনপি কোণঠাসা হয়ে প্রায় বাকহীন ছিল, তারাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে মাঠে নেমে আসেন হেফাজতের পেছনে। ধীরে ধীরে হেফাজতের আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে।
লংমার্চ
৬ এপ্রিল ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলাম ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ কর্মসূচী দেয়। এক এগারোর পরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই লংমার্চ একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। যখন কোনো রাজনৈতিক দল রাজপথে নামার সুযোগ অথবা সাহস পেতো না; তখন অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম রাজপথ কাঁপিয়ে দেয়।
প্রত্যক্ষ দর্শীদের মতে ঢাকার মানুষ অতীতে কখনো এতো মানুষের সমাবেশ দেখেনি। এই লংমার্চের বিপরীতে আওয়ামী লীগ, তাদের দোসর এবং গণজাগরণ মঞ্চ এমন কোনো পদক্ষেপ বাকি রাখেনি, যাতে মানুষ ঢাকা না আসতে পারে। আমির হোসেন আমু ও শাহরিয়ার কবিররা গজারির লাঠি দিয়ে হেফাজতকে প্রতিহতের ঘোষণা দিয়েছিল। গণজাগরণ মঞ্চ ২২ ঘণ্টার অবরোধ ডেকেছিল। ঘাদানিক ২২ ঘণ্টার হরতাল দিয়েছিল। বিভিন্ন স্থানে লংমার্চকারীদের আটকে দিয়েছিল। যেখানেই আটকে দিয়েছিল সেখানেই আন্দোলনকারীরা সমাবেশ করেছিল। চট্টগ্রামের বাসগুলো আটকে দিলে চট্টলার বীর জনতা ওয়াশা মোড়ে সমাবেশ করেছিল।
সেদিন যদি সরকারি অবরোধ, হরতাল ও প্রতিরোধ না চলতো তাহলে জনমানুষের চাপে ঢাকা অচল হয়ে যেতো। মানুষ তাদের ক্ষোভ ও অস্বস্তির চূড়ান্ত প্রদর্শন করেছিল ছয় এপ্রিলের লংমার্চে।
ঢাকা অবরোধ
আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ ঔদ্ধত্য ভরে বললেন, ‘হেফাজত লেজ গুটিয়ে চট্টগ্রাম চলে গেছে।’ দাবি আদায় না হওয়ায় হেফাজত ৫ মে ২০১৩ তারিখে ঢাকা অবরোধের কর্মসূচি দেয়। ঢাকা প্রবেশের আটটি পয়েন্ট অবরোধ করবে হেফাজত। এরপরে নানা ঘটনার ভেতর দিয়ে সেই অবরোধ শাপলা চত্বরের সমাবেশে রূপান্তরিত হয়। এই অবরোধেও আওয়ামী লীগ হরতাল, অবরোধ ও বাধার রাজনীতি করে। মানুষ যে যেভাবে পেরেছে এমনকি পায়ে হেঁটেও ঢাকা এসেছিল সেই দিন।
সকাল থেকে পল্টন এলাকা পুলিশের অতি উৎসাহের কারণে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। যদিও আট পয়েন্টে অবরোধের কথা ছিল; তবুও পল্টন কেনো রণক্ষেত্র হলো সকাল থেকে সেই প্রশ্ন আজও রহস্য হয়েই আছে।
এরপর যা ঘটেছে বাংলাদেশের প্রতিটি সচেতন মানুষ সেই ইতিহাস জানেন। জানেন আওয়ামী নৃশংসতার কথাও। হেফাজত শাপলা চত্বরের সমাবেশকে অবরোধে রূপান্তরিত করে রাতে অবস্থানের সিদ্ধান্ত নেয়।
সৈয়দ আশরাফ বলেছিলেন, ‘আমাদের সরলতাকে দুর্বলতা ভাববেন না, রাতের মধ্যেই আপনারা ঘরে ফিরে যাবেন এবং ভবিষ্যতে আপনাদের আর ঘর থেকে বের হতে দেওয়া হবে না।’
এরপর রাতের গণহত্যা। হেফাজত তাদের অসংখ্য কর্মী হারায়। আহত হয় অগণিত মানুষ। মামলা, হামলা ও গ্রেফতারে বিপর্যস্ত হয়ে উঠে হেফাজতের নেতা কর্মীরা। মানবাধিকার সংস্থা অধিকার ৬৩ জন শহীদের তালিকা দিয়েছে। আল্লামা শাহ আহমদ শফীর খাদেম হাসান আনহার ৮০ জনের একটা তালিকা তৈরি করেছেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, শহীদের সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি হবে।
সেদিন যদি বাংলাদেশের সবগুলো রাজনৈতিক শক্তি হেফাজতের পাশে দাঁড়াতো, তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাস ভিন্নভাবে লেখা হতো।
ভাস্কর্যবিরোধী আন্দোলন
তেরো সালের হেফাজতের গণহত্যার পরে মানুষ ভেবেছিল, মাদরাসাভিত্তিক রাজনীতি মনে হয় এখানেই শেষ। এমনকি মাদরাসার মানুষদের কেউ কেউ আলেম উলামাদের বিপক্ষে জনমত গঠনের চেষ্টা করেছে। কিন্তু ভাস্কর্যবিরোধী আন্দোলনে আবারো জনতা মাঠে নেমেছে। তা-ও আবার আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় প্রতীক বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন।
মোদিবিরোধী আন্দোলন
মুজিববর্ষে বাংলাদেশে আমন্ত্রিত হন ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নরেন্দ্র দামোদর মোদি। বাংলাদেশের জনগণ গুজরাটের এই কসাইয়ের আমন্ত্রণ এবং আগমণের বিরোধিতা করে। আন্দোলন শুরু হয় দেশের বিভিন্ন জায়গায়।
বায়তুল মোকাররম, হাটহাজারী ও ব্রাহ্মণ বাড়িয়ায় পুলিশ সরাসরি গুলি চালায়। সেই গুলিতেও শহীদ হোন অনেক কর্মী। দৈনিক ইনকিলাবের তথ্য মতে, ১৭ জন শহীদ ও পাঁচ শতাধিক আহত হয়েছিলেন ২১ এর এই আন্দোলনে।
এই আন্দোলনগুলোতে বাংলাদেশের শীর্ষ আলেমগণের প্রায় সবাই গ্রেফতার হোন এবং জেল কাটেন।
সুদূর অতীতের ফ্ল্যাশব্যাক
বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস দীর্ঘ। অগণিত বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়েছে। ব্যর্থ হয়েছে অনেকের লড়াই। কেউ কেউ জীবন দিয়ে অমর হয়ে রয়েছেন। কেউ কেউ বিশ্বাস ঘাতকতা করে চিরঘৃণিত হয়ে আছে। আমরা যদি ইংরেজবিরোধী আন্দোলনের ক্রনোলজিকে সাজাই তাহলে বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের একটা সিনোপসিস পেয়ে যাব।
১৭৫৭ সাল
২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে প্রহসনের যুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা এবং ছলচাতুরির মাধ্যমে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে পরাজিত করে ইংরেজ শাসকরা ভারতবর্ষে তাদের উপনিবেশের সূচনা করে।
১৭৬৪ সাল
বকঘারের যুদ্ধে মীর কাসিম, অযোধ্যার নবাব সুজা-উদ-দৌলা ও দিল্লীর পলাতক বাদশাহ শাহ আলমের যৌথবাহিনী পরাজিত হয় ইংরেজদের কাছে।
১৮০০ সাল
ফকির মজনু শাহ ও ভবানি পাঠকের ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহ।
১৭৯৮-৯৯ সাল
মেদিনীপুর ও বাঁচুড়ার চুয়াড় বিদ্রোহ। ১৭৯৯ সালে বড়লাট ওয়েলেসলি চুয়াড় বিদ্রোহের নেতাদের ফাঁসি দিয়ে বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণ করে।
১৭৯৩ সাল
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হয়। রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য বড়লাট কর্নওয়ালিস সমগ্র বাংলা প্রেসিডেন্সিতে প্রবর্তন করেন নতুন ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। মেহনতী চাষীর সর্বনাশ হয়ে এক ধরনের ভূঁইফোড় জমিদার গোষ্ঠীর জন্ম হয় এই আইনে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছিল সর্বত্র।
১৭৯৯ সাল
পিতা হারদার আলী ও পুত্র টিপু সুলতানের ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে দক্ষিণ ভারতে ইংরেজের সাম্রাজ্য বিস্তারের পথে প্রধান বাধা হয়ে উঠে। এক সেনাপতির বিশ্বাসঘাতকতায় রাজধানী শ্রীরঙ্গপত্তনের দখল নেয় ইংরেজরা। বীরের মতো লড়তে লড়তে রণক্ষেত্রেই শহীদ হন টিপু সুলতান।
এভাবে ১৭৯৯-১৮০১ সালে পলিগার বিদ্রোহ, ১৮১৭-২৫ সালে উড়িষ্যার পাঠক অভ্যুত্থান, ১৮২৪-৩০ সালে কিট্টরের রানী চান্নাম্মা ও সাঙ্গোলির রায়ান্নার বিদ্রোহ, ১৮২৪-২৫ মধ্যভারতের বুন্দেলখণ্ডে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে হিন্দু-মুসলমান চাষীদের বিদ্রোহ, ১৮৩৯ থেকে ১৮৪৫ সাল পর্যন্ত সমগ্র গুজরাটে সংঘটিত হয় বোল বিদ্রোহ, ১৮৪৫ সালে মহারাষ্ট্রের সামন্তওয়াড়ি ও কোলাপুরে বিদ্রোহ, ১৮২৯-৩৩ সালে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের মেঘালয়ের অধিবাসীদের খাসী বিদ্রোহ, তেমনই ১৮৩০-১৮৩৩ সালে ছোটনাগপুরের উপজাতি অঞ্চল জুড়ে আদিবাসী বিদ্রোহ, ১৮৫৫ সালে সাঁওতাল বিদ্রোহ, ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ, ১৮৫৯-৬০ সালে নীল বিদ্রোহ, ১৮৭২ সালে কুকা বিদ্রোহসহ একাধিক ইংরেজ বিরোধী বিদ্রোহ ও স্বাধীনতা সংগ্রাম সংগঠিত হয়।
১৮৪৭-১৮৭০ সাল
এই সময়টাতে ওয়াহাবি আন্দোলন নামে একটি আন্দোলন ভারতে প্রভাব বিস্তার করে। শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী ও তাঁর ছেলে আব্দুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলভীর মাধ্যমে ভারতে ইসলামের যে সংস্কার আন্দোলন শুরু হয় তাকে ইতিহাস ওয়াবি আন্দোলন বলে আখ্যায়িত করে। এই আন্দোলনের সূত্র ধরেই আব্দুল আজিজ ও তাঁর শিষ্য সৈয়দ আহমদ ভেরেলভী ভারতকে দারুল হরব ঘোষণা করে ফতোয়া জারি করেন।
১৮২৭ সাল
মীর নিসার আলী তিতুমীর শুরু করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার লড়াই। ১৮৩১ সালে কর্নেল স্টুয়ার্টের আক্রমণে তিতুমীরে নারিকেলবাড়িয়ার বাঁশের কেল্লার পতন হয়।
১৮৩১ সাল
৬ মে মানশেরা জেলার বালাকোটে মহারাজা রঞ্জিত সিং ও সাইয়েদ আহমাদ বেরেলভী বাহিনীর মধ্যে বালাকোটের লড়াই হয়। বেরেলভী রহ: শিখদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে বালাকোটে একটি দুর্গ স্থাপন করেছিলেন। শাহ ইসমাইল দেহলভি এবং ৬০০ উপজাতির সাথে তিনি ভোরে শিখদের আক্রমণ করেন। যুদ্ধ চলে সারাদিন। শিখ সৈন্যরা শেষ পর্যন্ত সাইয়েদ আহমাদ বেরেলভীকে শহীদ করে এবং তার শত শত অনুসারীকে হত্যা করে।
১৮৪২ সাল
ফরায়েজি আন্দোলন শুরু করেন হাজি শরীয়তুল্লাহ। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে দুদু মিয়া এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন।
এছাড়াও ইংরেজবিরোধী লড়াইয়ে মাওলানা ফজলে হক খায়রাবাদী, মাওলানা বেলায়েত আলী, মাওলানা ইয়াহহিয়া আলী, মাওলানা জাফর থানেশ্বরী, মাওলানা আহমদুল্লাহ, মাওলানা মুহাম্মদ হোসাইন আজিমাবাদী, মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধী, শায়খুল হিন্দু মাওলানা মাহমুদুল হাসান, মাওলানা শাববীর আহমদ ওসমানী, মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী, মাওলানা আজাদ সোবহানী, মাওলানা হাসরাত মুহানী, মাওলানা আতাউল্লাহ শাহ বুখারী, মাওলানা আবদুল্লাহিল বাকী, মাওলানা আবদুল্লাহিল কাফী, পীর দুদু মিঞা, পীর বাদশাহ মিঞা, মাওলানা রুহুল আমীন, ফুরফুরার পীর মাওলানা আবুবকর সিদ্দিক, শর্শিনার পীর মাওলানা নেছারুদ্দীন সাহেব, মাওলানা আবদুল হামীদ খান ভাষানী প্রমুখ আলেমের নাম সর্বাগ্রে স্মরণীয়। এই লড়িয়ের শেষে এসে বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের শেষভাগ হতে যে বহু ইংরেজি শিক্ষিত মুসলিম নেতা এ সংগ্রামে শরীক হয়ে একে অধিকতর জোরদার করে তুলেছিলেন, তাদের মধ্যে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
আমরা যদি দেখি আযাদী আন্দোলনের সূচনা থেকেই আলেমগণের অবদান ছিলো উল্লেখযোগ্য। দেওবন্দ প্রতিষ্ঠাও ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য সৈনিক ও পরিবেশ তৈরির জন্যই।
বৃটিশবিরোধী লড়াইয়ে মঙ্গল পাণ্ডে, নেতাজি সুবাস চন্দ্র বসু, ক্ষুদিরাম ও প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের নামও ইতিহাসের পাতায় লিখা থাকবে।
এতোগুলো লড়াই, বিদ্রোহ ও সংগ্রামের পরে ১৯৪৭ সালে আসে কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। পৃথিবীর মানচিত্রে নতুন করে ঠাঁই করে নেয় ভারত ও পাকিস্তান নামের দু’টি দেশ।
দূর অতীতের ফ্ল্যাশব্যাক
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান নামের ১২০০ কিলোমিটার দূরের দু’টি ভূখণ্ড নিয়ে। যদিও ধর্মীয় আবেগ ও প্রয়োজনের দিক থেকে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়, তবুও দু’টি ভূখণ্ডের মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপিত হয়নি সেইভাবে। ফলে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন। আগরতলা মামলা। উণসত্তরের গণঅভ্যূত্থান। সত্তরের নির্বাচন। ছয় দফা। সত্তরের নির্বাচন। ক্ষমতা প্রদানে পশ্চিম পাকিস্তানের ডার্টি গেম। সবকিছু মিলিয়ে একাত্তরের লড়াই।
সাতে মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ। পঁচিশে মার্চের কালরাত। ২৬ মার্চে জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা। নয় মাস লড়াই। ষোল ডিসেম্বরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রের অভ্যুদয়।
নিকট অতীতের ফ্ল্যাশব্যাক
স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলন শুরু হয় ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চে যখন রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারকে ক্ষমতাচ্যুত করে সেনাপ্রধান লে: জে: হুসাইন মুহাম্মাদ এরশাদ ক্ষমতা গ্রহণ করে সামরিক শাসন জারি করে।
১৯৮৩ ও ১৯৮৪ সালে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে গড়ে উঠা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মিছিলে সেনাবাহিনীর হামলায় জাফর, জয়নাল, কাঞ্চন, দীপালী সাহাসহ অনেক শিক্ষার্থী নিহত হয়।
এরপর ছাত্রদল ও ছাত্রলীগ এরশাদবিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে। ১৯৯০ সালের দশ অক্টোবর জেহাদ নামে একজন শিক্ষার্থী পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। জেহাদের লাশকে কেন্দ্র করে তৎকালীন সক্রিয়তা সকল ছাত্র সংগঠনের নেতারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে উপস্থিত হয়। ২৪টি ছাত্র সংগঠনের নেতাদের উপস্থিতিতে গড়ে উঠে ‘সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য’।
দীর্ঘ নয় বছর আন্দোলনের পর ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে ৬ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয় স্বৈরশাসক এরশাদ।
দীর্ঘ ফ্ল্যাশব্যাকের পরে
গতো দেড় দশকে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ও আওয়মী-ভারত রেজিমের বিরুদ্ধে আপামর বাংলাদেশের মানুষের লড়াই চলছিল তীব্রভাবে।
২০১৩ সালের হেফাজতের আন্দোলন। একই সময়ে ২০১৩ সালে ৬ জুন থেকে ১৮ জুলাই পর্যন্ত কোটাবিরোধী আন্দোলন। ১১ এপ্রিল ২০১৭ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গণে ন্যয়বিচারের প্রতীক গ্রিক দেবী থেমিসের আদলে গড়া একটি ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে আলেমদের আন্দোলন। ২০১৮ সালে ৮ জুলাই শুরু হয়ে ২৯ জুলাই শেষ হওয়া কিশোর-কিশোরীদের নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন। ২০২০ সালে ঢাকার ধোলাইপাড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতায় নভেম্বরের শেষের দিকে শুরুর হয় ভাস্কর্যবিরোধী আন্দোলন। এই আন্দোলনে সরকার আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী, মাওলানা মামুনুল হক ও সৈয়দ ফয়জুল করীমের নামে মামলা করে। ২০১৮ সাল ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৮ জুলাই পর্যন্ত ফের কোটাবিরোধী আন্দোলন। ২০২১ সালে মোদির আগমনবিরোধী আন্দোলন। এরপর ২০২৪ সালে জুলাই মাসে কোটাবিরোধী পুণান্দোলন। সরকার খামখেয়ালি। পুলিশের গুলি। নয় দফা। এক দফা। সব শেষে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার পতন।
কেনো এই দীর্ঘ ইতিহাস
প্রতিটা আন্দোলনেই আমরা দেখছি, শুরু থেকে একাধিক আন্দোলন একাধিক মোটিভে শুরু হয়। কিন্তু সবগুলো লড়াই, আন্দোলন ও বিদ্রোহ সত্য-সুন্দর-স্বাধীনতার জন্যই।
আমরা এখানে যে দীর্ঘ ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত পাঠ দেখে এসেছি, সেখানে ভালো করে খেয়াল করলে দেখব যে চূড়ান্ত আন্দোলনের আগে প্রায় সবগুলো ইনিশিয়েটিভই দমন করা হয়েছে। আন্দোলনকারীরা আপাত দৃষ্টিতে পরাজিত হয়েছেন। তাই বলে বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে নেহেরু, জিন্না, শাব্বীর আহমদ উসমানী, মাওলানা আবুল কালাম আযাদ প্রমুখ শেষ সময়ের তথা স্বাধীনতা লাভের সময়ের নেতাদের পূর্বসূরী কোনো নেতাকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের লড়াইয়ে যে যেভাবেই ইংরেজ বিরোধিতা করেছেন, সবাই স্বাধীনতা সংগ্রামের অংশ।
ঠিক তেমনইভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের যে লড়াই ভাষা আন্দোলনের শহীদদের রক্তের শপথে শুরু হয়েছিল সেখান থেকে একাত্তরের আগে যারা আন্দোলন করেছেন জীবন দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের সফলতার পর তাদের অবদান কখনো অস্বীকার করা সম্ভব না। যদিও একক কৃতিত্ব শেখ মুজিবুর রহমানকে দিয়ে আওয়ামী লীগ অনেকের অবদানকেই মাটিচাপা দিতে চেয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে একাত্তরের আগের এবং বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কাউকেই যেনো স্বীকার করার দায় নেই কিছু মানুষের।
নব্বইয়ে এরশাদের নয় বছরের শাসন শেষ করার গণআন্দোলনেও আমরা এমন একটা ঘটনার পরম্পরা ও আন্দোলনের ঘটনা প্রবাহের ক্রনোলোজিই দেখতে পাবো ইতিহাসের পাতায়।
আজ এই ২৪ সালে এসে যখন আমরা স্বৈরাচার তাড়িয়ে একটা বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে চাইছি, তখন যদি দীর্ঘ ১৫ বছরের লড়াই সংগ্রামে যারা অত্যাচার জুলুম নির্যাতন সয়েছেন, যারা জেল কেটেছেন, যে পরিবারগুলো পিতাহারা, সন্তানহারা, ভাইহারা, স্বামীহারা এবং স্বজনহারা হয়েছেন তাদেরকে উপেক্ষা করি, তাদের অবদান স্বীকার না করি, তাহলে আরেকটা বৈষম্যের শাসনই শুরু হবে। আবারো একটা ইতিহাস বিকৃতির শুরু হবে।
তাই আজকের এই সফল আন্দোলনের পরে হেজতের প্রতি বাংলাদেশের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। ‘হুজুররা কোথায় ছিলেন এতোদিন’ এই প্রশ্ন এলেই বরং বৈষম্যের নতুন মাত্রা শুরু হবে।
আশা করি দীর্ঘ দেড় যুগের লড়াইয়ে হেফাজত, বিএনপি, জামায়াতসহ যারাই যেভাবে স্বৈরতন্ত্র ও আওয়মী-ভারত রেজিমের বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রাম জারি রেখেছেন, সবাইকেই যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা দিলেই কেবল আজকের বিজয় ফলপ্রসূ হবে।
হেফাজতের কিছু কিছু জটিলতা তৈরি হয়েছে নেতৃত্বে। ক্ষমতাহীন একটা অরাজনৈতিক আন্দোলনে কিছু অস্বস্তি থাকতেই পারে। কিন্তু যে অবগুণ্ঠন ভেঙে ১৩ সালে মানুষের কথা বলা ও রাজপথে নামার অধিকার হেফাজত ফিরিয়ে এনেছিল, তার কৃতিত্ব তাকে দেয়া উচিৎ।
আসুন হেফাজতের প্রতিও কৃতজ্ঞ হই। হেফাজতকেও হেফাজত করি আগামী কোনো দুঃসময়ের জন্য।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা