২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

হযরত পালনপুরী রহ:, জীবন ও কর্ম

হযরত মাওলানা সাঈদ আহমাদ পালনপুরী রহ: - ফাইল ছবি

হযরত মাওলানা সাঈদ আহমাদ পালনপুরী রহ: কেবল দারুল দেওবন্দের শাইখুল হাদীস এবং সদরুল মুদাররিসীনই ছিলেননা,তিনি ছিলেন একবিংশ শতাব্দীর একজন অন্যতম মুজাদ্দিদ, ইসলামী শরীয়তের সমকালীন ব্যাখ্যাকার এবং ইমাম শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী, ইমামুল কালাম হযরত কাসেম নানুতাভী, ইমামে রব্বানী হযরত রশীদ আহমাদ গোঙ্গুহী রহ: এর উলূম ও মা'আরিফের ভাষ্যকার। ভারতের গুজরাট প্রদেশের পালনপুর গ্রামে পিতা হযরত মাওলানা ইউসুফের ঔরষে সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম নেন এই কালজয়ী ক্ষণজন্মা মনীষী। জন্ম তারিখ নির্দষ্টভাবে সংরক্ষিত না হলেও হযরতের পিতার অনুমান অনুযায়ী হযরতের জন্মসন ১৩৬০ হিজরী মুতাবিক ১৯৪১ ঈসায়ী।

জন্মের সময় পিতা হযরত মাওলানা ইউসুফ রহ: ও মুহতারামা আম্মাজান তার নাম রাখেন ‘আহমাদ’। পরবর্তীকালে কোনো একসময় নিজের নামের সাথে সাঈদ যোগ করে সাঈদ আহমাদ নাম ধারণ করেন। কর্ম জীবনের শুরুতে নিজের নামের সাথে পিতার দিকে নিসবত করে ইউসুফী ব্যবহার করতেন। পরে জন্মস্থান 'পালনপুর' এর দিকে নিসবত করে পালনপুরী হয়ে যান। এরপর থেকে সাঈদ আহমদ পালনপুরী নামেই দেশে বিদেশে পরিচিত ও বিখ্যাত।

প্রাথমিক শিক্ষা 
পিতা হযরত মাওলানা ইউসুফ রহ: এর কাছেই প্রাথমিক শিক্ষা দীক্ষা অর্জন করেন। তার পিতা ছিলেন আল্লামা বদরে আলম মিরাঠি রহ: এর কাছের ছাত্র । শরহে জামী পর্যন্ত তিনি জন্মস্থান পালনপুরেই পড়াশোনা করেন।

মাযাহিরুল উলুম সাহারানপুরে ভর্তি 
১৩৭৭ হিজরী মুতাবিক ১৯৫৭ ঈসায়ীতে সাহারানপুরের ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি বিদ্যাপীঠ মাযাহিরুল উলূম সাহারানপুরে ভর্তি হন। তিন বৎসরে তিনি এখানে বিভিন্ন ফন ও কিতাবাদী পড়েন।

দারুল উলূম দেওবন্দে দাখেলা 
অতপর ১৩৮০ হিজরী মুতাবিক ১৯৬০ ঈসায়ীতে দারুল উলূম দেওবন্দে সালে শশুম [জালালাইন] জামাতে ভর্তি হন। এখানেও তিনি অত্যন্ত সুনাম সুখ্যাতির সাথে গভীর মনোযোগ সহকারে পড়াশোনা করেন। সময়ের যথাযথ মূল্যায়ণ করে জ্ঞানে গুণে সবার নজর কেড়ে নেন। জীবনের শুরু থেকেই তিনি ছিলেন নিয়মানুবর্তিতা মেনে চলা একজন আদর্শ মানুষ। ১৩৮২ হিজরী মুতাবিক ১৯৬২ ঈসায়ীতে তিনি দাওরায়ে হাদীস পড়েন।

ইফতা বিভাগে ভর্তি 
বাবার ইচ্ছা ছিলো তার ছেলে সাঈদ আহমাদ আলেম হয়ে শুধু দ্বীনের খেদমত করবে। মাদরাসায় শিক্ষকতার বিনিময়ে কোন বেতন-ভাতা গ্রহণ করবে না। তাই জীবিকা উপার্জনের জন্য ভিন্ন পেশা হিসেবে হেকিমি বা ইউনানি চিকিৎসা সেবায় কাজ করবে। দরস ও তাদরীস করবে অবৈতনিকভাবে।

এজন্য তিনি চাচ্ছিলেন হযরত মুফতী সাহেব জামিয়া তিব্বিয়াতে ভর্তি হোক। কিন্তু হযরত মুফতী সাহেব আরো অধিক জ্ঞান পিপাসা নিবারনের জন্য বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে দেওবন্দে এসে ১৩৮৩ হিজরী মুতাবিক ১৯৬৩ ঈসায়ীতে দারুল উলুম দেওবন্দের শু'বায়ে ইফতায় ভর্তি হন। তৎকালীন সময়ে দারুল উলুম দেওবন্দের প্রধান মুফতি ছিলেন হযরত সাইয়্যিদ মুফতী মাহদী হাসান সাহেব শাহজাহানপুরী রহ:। হযরতের মোতালাআহ এর শওক-যওক দেখে পরবর্তী বছর তাঁকে দারুল উলুম দেওবন্দের মুঈনে মুফতী হিসাবে রেখে দেন তিনি। এর আগে কিন্তু দারুল উলুম দেওবন্দে 'মুঈনে মুফতী' পদে নিয়োগ পদ্ধতি ছিল না।

হাফেযে কোরআন হওয়ার আগ্রহ 
শৈশবকালে তিনি হিফয পড়েননি, সুযোগ হয়নি। ইফতার বছর দারুল উলুম দেওবন্দের উস্তায জামেয়া আযহার প্রেরিত শায়েখ মাহমূদ আব্দুল ওয়াহাব মিসরী রহ: তত্বাবধানে ইফতা বিভাগের মুতালাআহ ও পড়াশোনার পাশাপাশি মাত্র দেড় বছরে হিফয সম্পন্ন করেন। হযরত শায়েখ মাহমুদ আব্দুল ওয়াহাব রহ: ছিলেন হাফেয ও কারী এবং হানাফি মাযহাবের রক্ষণশীল মুকাল্লিদ। যার কথা পালনপুরী রহ: প্রায়ই দরসে বলতেন এবং খুব প্রশংসা করতেন।

দারুল উলুম আশরাফিয়া, রান্দেড়ে খেদমত 
ইফতা শেষ করে হযরত মুফতী সাহেব গুজরাটের রান্দেড় শহরে দারুল উলুম আশরাফিয়াতে তাদরীসি খেদমত আরম্ভ করেন। দারুল উলূম আশরাফিয়া রান্দেড় গুজরাটে তিনি দরজায়ে উলিয়ার উসতায হিসাবে টানা নয় বছরে সুনানে আবু দাউদ, সুনানে নাসায়ি, তিরমিযি, মোয়াত্তাইন ইবনে মাজা ও মিশকাত ইত্যাদি হাদীসের কিতাবাদিসহ অনেক কিতাবের দরস প্রদান করেন। ঐ সময় থেকেই তিনি লেখালেখি আরম্ভ করেন। দারুল উলুম আশরাফিয়াতে থাকাকালিন সময়ে তিনি শায়েখ মুহাম্মাদ বিন তাহের পাটনী রহ: এর কিতাব আল মুগনী এর আরবী শরাহ "তাহযীবুল মুগনি" লিখেন।

দারুল উলুম দেওবন্দে নিয়োগ 
১৩৯৩ হিজরী মুতাবিক ১৯৭৩ ঈসায়ীতে তার মুহতারাম উস্তায মাও. মুহাম্মাদ হাশেম রহ: তাঁকে চিঠির মাধ্যমে জানান যে দারুল উলুম দেওবন্দে উস্তাদের একটি পদ খালি। একজন ওস্তাদ লাগবে, তুমি ইচ্ছা করলে দরখাস্ত করতে পারো। অতপর হযরত মুফতী সাহেবের আরেক উস্তাদ মাও. সা'দ রশিদ আজমিরী রহ: এর পরামর্শে রজব মাসেই দারুল উলুম দেওবন্দে দরখাস্ত করেন। শা'বানে অনুষ্ঠিত দারুল উলুম দেওবন্দের মজলিসে শুরায় হযরত আল্লামা মনযুর নোমানী রহ: হযরতের নাম প্রস্তাব করেন। ঐ মজলিসেই হযরতের নিয়োগের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পরবর্তিতে নিয়মতান্ত্রিকভাবে তাঁকে জানানোর পর তিনি রমযান মাসেই দেওবন্দে চলে আসেন। এরপর থেকে বাকি জীবন তিনি দারুল উলুম দেওবন্দেই কাটিয়েছেন।

তাদরিসী খিদমাত 
হযরতের জীবনের সবচেয়ে বড় সফলতার অন্যতম একটি হলো তিনি অর্ধ শতাধিক বছর ধরে দারস ও তাদরিসের খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন । তিনি দারুল উলুম দেওবন্দের বয়স যখন পূর্ণ এক বৎসর তথা ১৩৮২ হিজরী মুতাবিক ১৯৬২ ঈসায়ীতে দাওরা হাদিস পড়েন। ১৩৯৩ হিজরী মুতাবিক ১৯৭৩ ঈসায়ীতে দারুল উলুম দেওবন্দে তাদরিসের খেদমত আরম্ভ করেন। তিনি দরসে নিজামীর প্রায় কিতাবের পাঠদান করেছেন। বিশেষত সিহাহ সিত্তাহর সব কিতাবই পড়িয়েছেন। তিনি বিশ বছরের মত হুজ্জাতুল্লিহিল বালিগাহর দরস প্রদান করেন। তিনি দারুল উলুম দেওবন্দে প্রায় ত্রিশ বছর উম্মুস সুনান জামে তিরমিজির দরস প্রদান করেন। যা আজো সমস্ত ইলমী মহলে আলোচিত। ১৪০২ হিজরি মুতাবিক ১৯৮১ ঈসায়ীতে তিনি দারুল উলুম দেওবন্দে বুখারি সানীর দরস প্রদান করেন। ১৪০৫ হিজরী মুতাবিক ১৯৮৪ ঈসায়ীতে শায়েখ নাছির খান সাহেব রহ: অসুস্থ হয়ে চোখ অপারেশনের জন্য ছুটিতে গেলে মজলিসে তা'লীমি এর সিদ্ধান্তক্রমে তিনি ঐ বৎসর বুখারী প্রথম খন্ডের দরস দেন। হযরত নাসীর আহমাদ খান রহ: এর ইন্তেকালের পর ১৪২৯ হিজরী মুতাবিক ২০০৮ ঈসায়ীতে হযরত পালনপুরী রহ: শাইখুল হাদীস ও সদরুল মুদররিসীন মনোনিত হন। এরপর থেকে আমৃত্যু ভাবগাম্ভীর্য পূর্ণ এ পদ দুটি হযরত মুফতী সাহেব অলংকৃত করে রেখেছিলেন।

তা’লিফ তাছনিফ ও রচনা 
তিনি যেমন একজন যোগ্য একনিষ্ঠ ও রক্ষনশীল মুদাররিস ও মুকাররির তেমনি তিনি ছিলেন একজন লেখক গবেষক। তিনি প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি ছোট বড় কিতাব রচনা করেছেন।

এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
১। পবিত্র কালামে পাকের তাফসীর গ্রন্থ হেদায়াতুল কোরআন।
২। রহমাতুল্লাহিল ওয়াছিআহ শরহে হুজ্জাতুল্লিহিল বালিগাহ।
৩। তুহফাতুল কারী শরহে বুখারী
৪। ফয়যুল মুনই'ম শরহে মুকাদ্দামায়ে মুসলিম।
৫। ঈযাহুল মুসলিম শরহে সহীহ মুসলিম
৬। তুহফাতুল আলমাঈ শরহে সুনানে তিরমীযি।
৭। যুবদাতু শরহে মা'আনিল আসার।
৮। ইলমী খুতবাত।
৯। ইফাদাতে নানুতুবী।
১০। ইফাদাতে রশিদিয়াহ।
১১। তাহযীবুল মুগনী।
১২। মিফতাহুত-তাহযীব।
১৩। কেয়া মুক্তাদী কে লিয়ে ফাতেহা ওয়াজিব হ্যা? তাসহীলে তাওসীকুল কালাম(মূল : হযরত নানুতাভী রহ:)।
১৪। মাহফুযাত (ছোটদের জন্য)
১৫। তুহফাতুদ্দুরার শরহে নুখবাতিল ফিকার।
১৬। মাবাদিউল ফালসাফাহ।
১৭। মুঈনুল ফালসাফাহ।
১৮। আপ ফতোয়া কাইছে দে।
১৯। মাশাহির মুহাদ্দীসীন রুয়াতে হাদীস।
২০। হায়াতে ইমাম আবু দাউদ।
২১। হায়াতে ইমাম তহাবী।
২২। ইসলাম তাগায়য়ুর পেযীর দুনিয়া মে।
২৩। নুবওয়্যত ইনসানিয়্যাত কো কেয়া দিয়া।
২৪। দাড়ী আওর আম্বীয়া কি সুন্নতে।
২৫। তাসহীলে আদীল্লায়ে কামিলা(মূল শাইখুল হিন্দ রহ)।
২৬। হাওয়াশীয়ে ঈযাহুল আদিল্লাহ।
২৭। হাওয়াশী এমদাদুল ফতোয়া।
২৮। মাবাদিয়ুল উসূল।
২৯। তা'রীবে আল ফাউযুল কাবীর।
৩০। আল আউনুল কাবীর শরহে আল ফাউযুল কাবীর।
৩১। আসান নাহব।
৩২। আসান সরফ।
৩৩। গাঞ্জিনায়ে ছরফ শরহে পাঞ্জেগাঞ্জ।

তাযকিয়া ও আত্মশুদ্ধির মেহনত 
হযরত যেমন উলুমে জাহেরির মুহাক্কিক আলেম তেমনি তিনি একজন উলুমে বাতেনিরও আধ্যাত্মিক রাহবারে কামেল। ছাত্র জমানা থেকেই তিনি শাইখুল হাদীস আল্লামা যাকারিয়্যা রহ: এর সাথে তাযকিয়ার সম্পর্ক করেন। তিনি সাহারানপুরে থাকা কালিন আসরের পর আল্লামা আ. কাদের সাহারানপুরির মজলিসে পাবন্দির সাথে শরিক হতেন। পরবর্তীকালে মাজাহিরুল উলুম (ওয়াকফ) এর মোহতামিম আল্লামা মুযাফ্ফর হুসাইন মাযাহেরী রহ: এর থেকে খেলাফত প্রাপ্ত হন।

বাইতুল্লাহর সফর 
১৪০০ হিজরী মুতাবিক ১৯৮০ ঈসায়ীতে সর্ব প্রথম নদী পথে নিজের মুহতারামা আহলিয়াকে সাথে নিয়ে ফরয হজ্ব পালন করেন। ১৪০৬ হিজরী মুতাবিক ১৯৮৬ ঈসায়ীতে দ্বিতীয়বারের মতো বাইতুল্লাহর মুসাফির হন। ১৪১০ হিজরী মুতাবিক ১৯৮৯ ঈসায়ীতে হযরত মুফতী সাহেব তৃতীয়বারের মতো সৌদি সরকারের মেহমান হয়ে হজ্ব পালন করেন। ১৪১৪ হিজরী মুতাবিক ১৯৯৩ ঈসায়ীতে তিনি ওমরার সফর করেন।

দাওয়াত ও ইরশাদ
দাওয়াত ও ইরশাদের ময়দানেও রয়েছে তার সরব উপস্থিতি। মাদরাসার লম্বা ছুটি হলে বিশেষ করে রমযানের দীর্ঘ ছুটিতে তিনি ছুটে যেতেন দাওয়াত ও ইরশাদের মহান কাজে পৃথিবীর আনাচে কানাচে । ইউরুপ আমেরিকা, বৃটেন, কানাডা, লন্ডন, দুবাই, সুদান,আরব আমিরাত, বাংলাদেশ,বার্মা, পাকিস্তানসহ বিশ্বের বহু দেশ সফর করেছেন তিনি।

তাহাফফুজে খতমে নবুওয়াত 
১৯৮৬ ঈসায়ীতে যখন দারুল উলূম দেওবন্দে ‘আলমী মজলিসে তাহাফফুজে খতমে নবুওয়াত’ (বিশ্ব খতমে নবুওয়াত সংরক্ষণ কমিটি) গঠন করা হলো, তাঁকে এর প্রধান কার্যনির্বাহী নাযেমে আ’লা বানানো হলো। আর হযরত মাওলানা কারী উসমান মানসুরপুরী সাহেবকে নাযেম নির্ধারণ করা হলো। এরপর হযরত কারী সাহেবের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও আগ্রহ এবং হযরত মুফতী সাহেব রহ: এর পরামর্শে তাহাফফুজে খতমে নবুওয়াতের কাজ আলহামদুলিল্লাহ সারা দেশে অনেক সুন্দরভাবে চলেছে। এ কাজের লোক তৈরি করার জন্য সব জায়গায় তরবিয়তী ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। সুযোগ হলে হযরত মুফতী সাহেব নিজেই যেতেন। কাদিয়ানী ধর্মের খণ্ডনে তার বিশেষ ভঙ্গিমায় প্রামাণ্য ও প্রভাববিস্তারী আলোচনা করতেন। এ বিষয়ে হযরতের কিছু বয়ান প্রচারও করা হয়েছে।

ভাই বোন 
হযরত পালনপুরী রহ: এর পাঁচ ভাই চার বোন।
তার মধ্যে তার একজন মা-শরিক ভাই যার নাম আহমাদ। হযরতের আপন ভাই চার জন। তিনিই সবার বড়।
১। আব্দুর রহমান
২। আমজাদ
৩। হযরত আমীন পালনপুরী দা.বা. যিনি বর্তমানে দারুল উলুম দেওবন্দের সিনিয়র মুহাদ্দিস ও কায়েম মাকাম শায়খে ছানী।
৪। হাবীবুর রহমান।

হযরতের সন্তানাদি 
হযরত রহ: এর এগারো ছেলে এবং তিন মেয়ে। তার মধ্যে এক ছেলে মাও. রশিদ আহমাদ গাড়ী এক্সিডন্ট করে শাহাদাত বরন করেন । আর এক মেয়ে শৈশবেই ইন্তেকাল করেন। বর্তমানে হযরতের বারোজন সন্তান জীবিত আছে। সবাই হফেযে কোরআন। ছেলেরা সবাই আলেম হয়ে দ্বীনের খেদমতে নিয়োজিত আছে।

হযরত পালনপুরীর কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য-

এক. সময়ের হেফাযত
হযরত মুফতী সাহেবের জীবনের অনেক মূল্যবান ও উজ্জ্বল একটি দিক হলো, তিনি জীবনের সামান্য সময়ও নষ্ট হতে দেননি। এমন—সব কাজ—কর্ম থেকে নিজেকে দূরে রেখেছেন, যা তার ইলমী সফরে কোনো ধরনের বাধা সৃষ্টি করতে পারে। যারা হযরতকে কাছ থেকে দেখেছেন তারা সাক্ষ্য দেবেন, প্রাকৃতিক চাহিদা ও পার্থিব কোনো প্রয়োজন ছাড়া দিনের পুরো সময় কোনো—না—কোনো কল্যাণকর ও উপকারী কাজেই ব্যয় করতেন। মাদরাসার নির্ধারিত সময়ে দরস প্রদান অথবা প্রয়োজন পড়লে শিক্ষা ও ব্যবস্থাপনা—বিষয়ক পরামর্শে ব্যয় করতেন। এদিকে ঘরে অনেক রাত পর্যন্ত দরসের প্রস্তুতিমূলক মুতালাআ ও রচনার কাজে ব্যস্ত থাকতেন। এর মাঝে সময় পেলে ঘরের বাচ্চাদেরকেও ছোট-বড় কিতাবাদি নিজেই পড়াতেন।

মোটকথা, তিনি পুরো পরিবেশ এমন বানিয়ে নিয়েছিলেন, মুহূর্ত সময় যেন নষ্ট না হয়ে যায়। এর বরকতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁকে এমন বড় বড় কাজ সম্পন্ন করার তাওফীক দিয়েছেন, যা করতে পুরো একটি একাডেমির প্রয়োজন। হযরতুল উস্তাদের জীবন থেকে আমরা শিক্ষা পাই, যে জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করে নেয় এবং প্রাত্যহিক কাজের সময়সূচি নির্ধারণ করে একাগ্রতার সাথে কাজ করে, সে অবশ্যই সফল হয়। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সময় এবং আল্লাহপ্রদত্ত যোগ্যতার কদর করার তাওফীক দান করুন। আমীন।

দুই. পরিপূর্ণ ইস্তেদাদ বা যোগ্যতা 
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হযরতকে অসাধারণ যোগ্যতা ও ঈর্ষণীয় ইলমী দক্ষতা দান করেছিলেন। নাহু, সরফ থেকে শুরু করে ফিকহ, হাদীস, তাফসীর পর্যন্ত সব বিষয়ে তার গভীর জ্ঞান ছিল। প্রয়োজন অনুপাতে সেগুলোকে একত্র করার যোগ্যতাও তিনি লাভ করেছিলেন।
এ কথা স্পষ্ট, আসবাব ও উপকরণ—নির্ভর এই দুনিয়ায় হঠাৎ করেই এই ইলমী রুসুখ—গভীরতা অর্জিত হয়ে যায় না। এর জন্য শুরু থেকেই অনেক পরিশ্রম প্রয়োজন। তার ইস্তেদাদ কীভাবে তৈরি হলো? এ সম্পর্কে হযরত নিজেই বলেন,মাদরাসায় শুধু পড়ার মাধ্যমে ইলম হাসিল হয় না। এখন বলবে, তাহলে আমরা পড়ছি কেন? পরীক্ষা কেন দিচ্ছি?

হযরত প্রায়ই বলতেন, পড়া দুই প্রকার। এক পড়া হলো নিজের জন্য। আরেক পড়া হলো বাবার জন্য। বাবার জন্য পড়লে ইলম আসে না। আমি চাহারুম পর্যন্ত বাবার জন্য পড়েছি। শরহে জামীর বছর আমি মাজাহিরুল উলূম সাহারানপুরে ভর্তি হলাম। এরপর সাহারানপুরের এমন কোনো গলি ছিল না, যাতে আমি সাইকেল চালাইনি। একবার আমার টাইফয়েড জ্বর হলো। টেলিগ্রাম করা হলো। বাবা এসে আমাকে বাড়ি নিয়ে গেলেন। আমি খুবই দরিদ্র পরিবারের সন্তান ছিলাম। শুনলাম আব্বা তার মায়ের সাথে আমার ব্যাপারে বলছেন, এই ছেলেকে আর পড়াব না। এর অসুখ হয়ে এত টাকা খরচ হলো। আবার দিয়ে আসলে আবার এই পরিমাণ খরচ হবে। ও তো কিছু পড়েও না। দাদি এর কোনো জবাব দিতে পারলেন না। আমি এসব কথা শুনছিলাম। আমার তখন বুঝে আসল। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমাকে পড়তে হবে। সারা রাত আমার ঘুম হলো না। সকাল বেলা আম্মার কাছে গিয়ে বললাম, আমার জিনিসপত্র রেডি করে দিন। আমি মাদরাসায় চলে এলাম। সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত আমি নিজের জন্য পড়েছি এবং পড়ছি।

সময়ের প্রয়োজনে গুজরাটি এবং ইংরেজি ভাষাও তিনি প্রয়োজন পরিমাণ শিখেছিলেন। ছাত্রদেরকেও এর প্রতি উৎসাহ দিতেন। একবার তিনি বলেন, আমি ছোটবেলায় গুজরাটি ভাষা একেবারেই শিখিনি। আমার গুজরাটে থাকার কোনো ইচ্ছাও ছিল না। কিন্তু ভাগ্য আমাকে গুজরাটের একটি এলাকা রান্দেড়ে পৌঁছে দিল। আমি ভাবলাম, এখন হয়তো সারা জীবন গুজরাটেই কাটাতে হবে। দ্বীনের কাজ করার জন্য গুজরাটি ভাষা শেখা জরুরি। তাই গুজরাটি শিখলাম। শুধু শিখলামই না,বরং গুজরাটি ভাষায় পাঁচটি কিতাব‌ও রচনা করেছি। ওগুলো এখনো আছে, ছেপেছেও। এরপর আমার মনে হলো ইংলিশ শেখা উচিত। এ ছাড়া দুনিয়াতে কাজ করা যায় না। আমার এক ছাত্র ছিলো দক্ষিণ আফ্রিকার,সে ভালো ইংলিশ জানত। তাকে বললাম,তুমি আমাকে ইংরেজী পড়াও। আমি তাকে হেদায়া আউয়ালাইন পড়াতাম। সে আমাকে আসরের পর ইংরেজি শেখাত। আমি তার কাছে এতটুকু ইংরেজি শিখলাম, আমার আগ্রহ জাগল ডিগ্রির জন্য আলীগড়ে পরীক্ষা দেব। যদিও পরে পরীক্ষার সময় আর এই ভয়ে পরীক্ষা দিইনি যে,এই ডিগ্রি না আবার আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ আজ আমি ইংরেজী ভাষায় নিজের প্রয়োজন পূরণ করতে সক্ষম।

তিন. অন্যকে বোঝানোর অসাধারণ ক্ষমতা 
হযরতের বোঝানো এবং পড়ানোর এক অসাধারণ শৈলী ছিল। এই কারণে হযরত ছাত্রদের মাঝে অনেক ভালোবাসা ও মাকবুলিয়াত পেয়েছিলেন। তার দরস নিঃসন্দেহে অতুলনীয় দরস ছিল। আল্লাহর রহমতে ১৪৩১ হিজরী মোতাবেক ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে হযরতুল উস্তাদের বুখারী আওয়াল ও তিরমিযী আওয়াল এর দরসে বসার সৌভাগ্য হয়েছিল। নিয়মিত দরসে উপস্থিতি ছিল উপমা দেওয়ার মতো। সারা বছর হিসাব করলে একদিন কি দুইদিন হবে কোনো কারণে উপস্থিত হতে পারেননি। আর নাহয় প্রতিদিন নিয়মিত কোনো ক্লান্তি ছাড়াই আড়াই ঘণ্টা অত্যন্ত সারগর্ভ ও আলেমসুলভ দরস দিতেন। জটিল থেকে জটিলতর অধ্যায়গুলোও তিনি সহজ—সাবলীলভাবে উপস্থাপন করতে পারতেন। যেন শ্রোতাদেরকে তা গুলে খাইয়ে দেওয়ার যোগ্যতা আল্লাহ তাকে দান করেছিলেন। এজন্যই কম মেধাবী ছাত্ররাও তার দরসে বসে আনন্দ পেত। তিনি আসার পূর্বেই পুরো দারুল হাদীস পূর্ণ হয়ে যেত। কারও আসতে দেরি হলে দরজায় বসতে হতো। দরসে তার আলোচনার ভঙ্গি এমন মোহনীয় ছিল যে, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবাই পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে শুনত। দরসগাহে নীরবতা ছেয়ে যেত। আইম্মায়ে কেরামের ইখতেলাফসমূহ তাঁদের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা—ভক্তি রেখে এমনভাবে বর্ণনা করতেন যে, হৃদয় ছুঁয়ে যেত। কিতাবের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ইলম ও মাআরিফের যে প্রবাহ বয়ে যেত, প্রতিটি সূক্ষ্ম বিষয়ের বর্ণনা শুনে মন আনন্দিত হয়ে উঠত। হাদীসের প্রতিটি শব্দের তরজমার সাথে সাথে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো এমন সুন্দর করে উপস্থাপন করতেন, পুরো বিষয়টি খুব সহজেই বুঝে আসত। এসব বৈশিষ্ট্যের কারণে হযরতের দরস অনন্য গুরুত্ব বহন করত। বেশির ভাগ ছাত্র সহজেই তার দরস খাতায় নোট করে নিতে পারত এবং ইলমী মণি—মুক্তাগুলো সংরক্ষণের চেষ্টা করত। তার দরসে কে ইবারত পড়বে তা বছরের শুরুতেই নির্ধারিত হয়ে যেত। এমন কাউকে নির্ধারণ করা হতো, যে সহীহ ই’রাব, সহীহ উচ্চারণে হাদীস পড়তে পারবে। সাথে হযরতের মেজাযও বুঝবে, কখন পড়তে হবে আর কখন থামতে হবে।

চার. পরোপকারী ব্যক্তিসত্তা 
হযরতুল উস্তায রহ: নিজের জীবনকে আল্লাহর সৃষ্টিজগতের জন্য, বিশেষ করে তালিবে ইলম এবং উলামায়ে কেরামের জন্য উপকারী করে তোলার অব্যাহত চেষ্টা করেছেন। দরস-তাদরীসের উপকারিতা তো সবার কাছেই স্পষ্ট‌। এ ছাড়া তিনি অনেক মূল্যবান কিতাব ও ব্যাখ্যাগ্রন্থ রচনা করেছেন। তালিবে ইলম এবং আসাতিযায়ে কেরাম এ কিতাবগুলো থেকে অনেক উপকৃত হচ্ছেন। আখেরাতে নিশ্চয়ই এগুলো তার নেকি বৃদ্ধির কারণ হবে।

হযরত তো ছোট-বড় অনেক কিতাব রচনা করেছেন, কিন্তু এর মাঝে হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহর সুবিশাল উর্দু ব্যাখ্যাগ্রন্থ রাহমাতুল্লাহিল ওয়াসিআ স্বতন্ত্র মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। আহলে ইলম জানেন, এই কিতাবে অনেক উচ্চ পর্যায়ের ইলমী ও ফিকরী আলোচনা থাকায় সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা অনেক বড় বড় আলেমের জন্যেও বোঝা কঠিন হয়ে যায়। যার-তার পক্ষে তো এই কিতাব থেকে যথাযথ ফায়দা হাসিলেরও যোগ্যতাই ছিল না। যেহেতু এ কিতাবের অধিকাংশ বিষয় এমন, যা সমাধা করার জন্য নিয়মতান্ত্রিক কোনো কিতাবও পাওয়া যেত না। তাই আজ পর্যন্ত কেউ এর শরাহ—ব্যাখ্যাগ্রন্থ রচনার সাহস করেননি। কিন্তু আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই সৌভাগ্য হযরত মুফতী সাহেব রহ:—এর জন্য নির্ধারণ করে রেখেছিলেন। এই অতুলনীয় মহান খেদমত আঞ্জাম দিতে তিনি তার সাধ্যের সর্বোচ্চ ব্যয় করেছেন। এই কিতাবে তার প্রজ্ঞাপূর্ণ ইলমী রুচিবোধের প্রকাশ ঘটেছে। সন্দেহ নেই এটি এ যুগের অনেক বড় একটি কাজ এবং দারুল উলূমের সন্তানদের গৌরবময় খেদমতসমূহের অন্যতম। হযরত রহ: শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ: এর জ্ঞানভান্ডারের তাসহীল তথা সহজ-সরল সংস্করণ প্রস্তুত ও তাশরীহ তথা ব্যাখ্যা করে উলামায়ে হকের উপর যে ইহসান করেছেন, তা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই যুক্তিপূজার যুগে এমন কিতাব পাঠ করা সবার জন্য অনেক জরুরি। যেন প্রতিনিয়ত সৃষ্টি হওয়া সন্দেহ ও আপত্তিগুলোর যথাযথ জবাব দেওয়ার যোগ্যতা সৃষ্টি হয়। অনুরূপ তার তাফসীরে হেদায়াতুল কুরআনও একটি মহান কীর্তি । এতে কুরআনের বিষয়বস্তুসমূহ অনেক হৃদয়গ্রাহী ভঙ্গিতে পেশ করার চেষ্টা করেছেন। এ ছাড়াও তার বুখারী ও তিরমিযী শরীফের দরসের তাকরীর হযরতের তত্ত্বাবধানেই ছেলে মাওলানা হোসাইন আহমদ পালনপুরী সাহেব যথাক্রমে তুহফাতুল কারী ও তুহফাতুল আলমায়ী নামে ১১ ও ৮ খণ্ডে সংকলন করেছেন। এটিও তার অনেক মূল্যবান একটি খেদমত, যা থেকে ছাত্র—শিক্ষক সবাই ভরপুর ফায়দা হাসিল করেছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁকে এর উত্তম প্রতিদান দান করুন। আমীন।

পাঁচ. আলেমসুলভ ভাবগাম্ভীর্য 
হযরতুল উস্তাদ রহ: সারা জীবন পরিপূর্ণ আলেমের শান নিয়ে যাপন করেছেন। যে ইলম আল্লাহ তাকে দান করেছিলেন, তার মর্যাদা তিনি পুরোপুরি রক্ষা করেছেন। একজন সত্যিকারের আলেমের জীবন কেমন হওয়া উচিত, আমরা হযরতের জীবনে তা দেখতে পাই। অধিকাংশ সময় মাথায় পাগড়ি, উপরে সাদা রুমাল থাকত। নজর থাকত নিচের দিকে। যে—ই সামনে আসত তিনিই তাকে প্রথমে সালাম দিতেন। এটি হযরতের একটি বিশেষ গুণ ছিল। অন্যরা তাঁকে প্রথমে সালাম দেওয়ার সুযোগ খুব কমই পেত। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার মাঝে এক আশ্চর্য প্রভাব দান করেছিলেন। সবাই তার সামনে সহজে কথা বলার সাহস পেত না। প্রতিদিন আসরের পর হযরতের আম মজলিস হতো, যাতে শুধু ইলমী আলোচনা এবং নসীহতমূলক কথা হতো।

ছাত্রদেরকে নসীহত করার সময় প্রায়ই তার উস্তাদে মুহতারাম হযরত আল্লামা মুহাম্মদ ইবরাহীম বলয়াভী রহ:—এর একটি হেদায়াত বিশেষভাবে উল্লেখ করতেন। একদিন বললেন, আমি যখন উস্তাদ হিসাবে রান্দেড় যাচ্ছি, তখন হযরতুল উস্তাদ আল্লামা মুহাম্মদ ইবরাহীম বলয়াভীর কাছে কিছু নসীহতের আবেদন করলাম। হযরত বললেন, মৌলভী সাহেব! আমার কাছে সকালে এসো। আমি ভোর চারটায় হাজির হলাম। হযরত দাঁড়িয়ে থেকেই মুআনাকা করলেন এবং তিনটি নসীহত করলেন-

‘এক. কোনো কিতাব পড়ানোর সময় ফনের প্রতি লক্ষ রেখে পড়াবে, তাহলে ইলম আসবে। অর্থাৎ যখন ফিকহ পড়াবে তখন ওই ফনের সব কিতাব দেখবে, বাদায়েউস সানায়ে, ফাতাওয়া শামী থেকে শুরু করে তালীমুল ইসলাম, বেহেশতী জেওর পর্যন্ত। অনেক সময় তালীমুল ইসলাম, বেহেশতী জেওরে মাস‌আলার এমন উপস্থাপনা পাওয়া যায়, যা আমরা অনেকে খুঁজেও পাব না।
দুই. সুন্নাতের অনুসরণ করো। এতে তোমার সম্মান ও মর্যাদা অনেক বাড়বে।
তিন. ছাত্রদেরকে নিজের সন্তান মনে করবে।’
হযরত মুফতী সাহেব রহ: প্রায়ই বলতেন, এগুলো হযরত বলয়াভী রহ:—এর অনেক মূল্যবান নসীহত। এগুলো মেনে আমি অনেক ফায়দা পেয়েছি। আমি হযরতের ইহসান কখনো ভুলতে পারব না।
নিমুর্খাপেক্ষিতা ও আত্মসম্মানবোধ তার স্বভাবে মিশে ছিল। বারবার বলতেন,
‘কখনো দুনিয়া আর টাকা—পয়সার গোলাম হতে নেই। হাদীসে এর প্রতি নিষেধাজ্ঞা এসেছে।’

ছয়. মাযহাবের উপর অবিচলতা 
হযরতুল উস্তাদ নিজের ফিকহী মাসলাক অর্থাৎ ফিকহে হানাফীর উপর দৃঢ় ছিলেন। কোনো মাসআলায়‌ ফিকহের মূলনীতি ও জুযইয়্যাত—শাখাগত মাসআলা থেকে সরে যাওয়া পছন্দ করতেন না। অনুরূপ আকাবিরে উলামায়ে দেওবন্দের চিন্তা—চেতনার ব্যাপারেও তার গভীর দৃষ্টি ছিল। জেনেশুনে এর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া তার কাছে খুবই অপছন্দ ছিল। তিনি কখনোই বাতিল কোনো ফিরকার প্রতি সামান্যও আকৃষ্ট হননি; বরং যখনই এ বিষয়ে আলোচনা করতেন দৃঢ়তার সাথে কথা বলতেন এবং এ ব্যাপারে তাদের পক্ষ থেকে কোনো ক্ষতির তোয়াক্কা করতেন না। তার ছাত্রদের যেহেনও এভাবে প্রস্তুত করতেন যে, তারা হকের উপর কায়েম থাকবে, আকাবিরের পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলবে। এ ব্যাপারে যেখানেই কোনো ত্রুটি দেখতেন সাথে সাথে সতর্ক করতেন। স্বাধীন চিন্তা বা সালাফে সালেহীনের অনুসৃত পথ ও পন্থা থেকে দূরে সরে যাওয়াকে সব সমস্যার মূল মনে করতেন। এজন্যই বক্র চিন্তার মানুষদেরকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অন্তর্ভুক্ত মনে করতেন না তিনি।

সাত. প্রেরণা ও উৎসাহ প্রদান 
হযরত মুফতী সাহেব রহ: এর একটি বিশেষ গুণ ছিল, তিনি নবীন ও উঠতি তরুণদের বক্তৃতা ও রচনায় বিপুল উৎসাহ দিতেন। যার ফলে তারা সামনে অগ্রসর হওয়ার হিম্মত করতে পারত। যখনই তার কোনো ছাত্রের কোনো ইলমী ও দ্বীনি খেদমতের কথা জানতে পারতেন তখনই অনেক আনন্দ প্রকাশ করতেন।

আট. ইলমী ইখতিলাফে সৌজন্যতা রক্ষা 
দরসে এবং দরসের বাইরে ইলমী ইখতিলাফের ক্ষেত্রে নিজের মতের উপর অটল থেকেও সর্বোচ্চ সৌজন্যতা প্রদর্শন করতেন। বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত ফিকহী সম্মেলন গুলোতে তিনি সকল স্কলারদের প্রবন্ধ ও আলোচনা শুনতেন এবং পর্যালোচনাও পেশ করতেন। এতে অনেক ইখতেলাফ‌ও হতো। অনেক সময় তার ছাত্রগণও তার মতের বিপক্ষে দলীল পেশ করতেন। অধিকাংশ সময় হযরত নিজ মতে অটল থাকতেন। তার সাথে ইখতেলাফ হলেও তিনি সর্বোচ্চ সৌজন্যতা প্রদর্শন করতে কুণ্ঠাবোধ করতেন না। এ প্রসাথে হযরত বলতেন, আলেম ও জাহেলের মাঝে পার্থক্য হলো, জাহেল মতভিন্নতার কারণে সম্পর্ক ছিন্ন করে। আলেম দলীল নির্ভর ইখতেলাফকে ইখতেলাফ পর্যন্তই রাখে। এর কারণে পুরোনো সম্পর্কে কোনো পার্থক্য হয় না।

অসুস্থতা এবং ইন্তেকাল 
হযরতের শারীরিক অবস্থা যদিও এমনিতে ভালোই ছিল। তবে অনেকদিন থেকে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন। ইনসুলিন নিতে হতো। কয়েক বছর আগে একবার হৃদরোগজনিত কারণে অপারেশন করতে হয়েছিল। এরপর সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। কয়েক বছর থেকে শ্রবণশক্তিতে সামান্য সমস্যা ছিল, যা মাঝেমধ্যে দেখা দিত। কখনো কখনো কথাও বলতে পারতেন না। এমন ঘটনা ইনতিকালের বছর ২০২০ ঈসায়ীতেও ঘটেছিল। রজব মাসের মাঝামাঝি দারুল হাদীসে খতমে বুখারীর সময় অনেক কষ্ট করেও কথা বলতে পারছিলেন না। শেষে শুধু এইটুকু বলে চলে এলেন, ‘এখন আল্লাহ যা চাইবেন তা—ই হবে।’ এ দৃশ্য দেখে ছাত্রদের মাঝে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে। কান্নার রোল পড়ে যায়। পরের দিন চিকিৎসার জন্য মুম্বাই গেলেন। আল্লাহর রহমতে সুস্থ হলেন। এই অবস্থা আর রইল না। কিন্তু ২৪ মার্চ ২০২০ থেকে সারা দেশে লকডাউন শুরু হলে দেওবন্দে ফিরে আসতে পারেননি। এর মাঝেই রমযান মাস এসে গেল। হযরতের ভক্তগণ এ সুযোগকে গনীমত মনে করলেন। হযরতের কাছে ইলমী ইস্তেফাদার দরখাস্ত করলেন। হযরত তাদের আবেদন গ্রহণ করলেন। প্রতিদিন তারাবীর পর অনলাইনে সওয়াল—জওয়াবের সিলসিলা শুরু হয়। ১৫ রমযান ১৪৪১ পর্যন্ত তা অব্যাহত ছিল। এ সময় হযরত অনেক মূল্যবান কথা বলেছেন, যা এখন ইউটিউবে সংরক্ষিত আছে।

এরপর হযরতের প্রচণ্ড জ্বর উঠল। রোগ বেড়ে যাওয়ার কারণে তাকে মালাডে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রথমে অবস্থা সুস্থতার দিকে ছিল। কিন্তু ইন্তেকালের দুইদিন আগে অর্থাৎ ২৩ রমযান হঠাৎ করে অবস্থা আশঙ্কাজনক হয়ে পড়ে। তিনি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। ডাক্তাররা বললেন, ফুসফুসে ইনফেকশন হয়েছে। অবশেষে এই অবস্থায়ই ২৫ রমযানুল মোবারক ১৪৪১ হিজরী মঙ্গলবার দিন ভোরে তিনি আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ করেন।

হাসপাতালেই তাকে গোসল করানো হয় এবং কাফন পরানো হয়। পাশের মসজিদের মাঠে হযরতের সাহেবযাদা মাওলানা আব্দুল ওয়াহিদ সাহেবের ইমামতিতে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। পশ্চিম যোগেশ্বরী মুসলিম কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।

হযরত মুফতী সাহেব রহ: চান্দ্রবর্ষ হিসাবে ৮০ বছর এবং সৌরবর্ষ হিসাবে ৭৮ বছর হায়াত পেয়েছিলেন। অর্ধ শতাব্দীকাল সফলতার সাথে দারুল উলূম দেওবন্দে দরস দিয়েছেন। প্রাণভরে হাজার হাজার ইলমে নববী পিপাসু শিক্ষার্থীকে তৃপ্ত করেছেন। কেবল শিক্ষকতা নয়, মূল্যবান ও অত্যন্ত উপকারী অনেক মৌলিক রচনা এবং ব্যাখ্যাগ্রন্থ লিখে উম্মতে মুসলিমার উপর বড় ইহসান করেছেন। তার এসব কাজের মাধ্যমে তিনি আমাদের মাঝে অমর হয়ে থাকবেন, ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাআলা হযরত মুফতী সাহেব রাহিমাহুল্লাহর মর্যাদা বৃদ্ধি করুন। তাঁকে তার খেদমতসমূহের উত্তম থেকে উত্তম প্রতিদান দান করুন।

বি : দ্র : হযরত মাওলানা মুফতী আমীন পালনপুরী এবং হযরত মাওলানা মুফতী সালমান মানসূরপুরী এর প্রবন্ধ অনুকরণে প্রস্তুতকৃত। ঈসায়ী সনগুলো গুগল থেকে কনভার্ট করা।

সংকলক : মুফতী মামুন আব্দুল্লাহ কাসেমী, মুহতামিম- মারকাযুদ দিরাসাহ আল ইসলামিয়া ঢাকা।


আরো সংবাদ



premium cement