পরীক্ষায় নকল : পরিণাম ও কুফল
- মাওলানা আবু সাঈদ
- ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২১:৫০
নকল শব্দটি আসল এর বিপরীত। আসল মানে খাঁটি, আসল মানে মূল। আর নকল মানে ভুয়া, নকল মানে ভেজালযুক্ত। নকল জিনিস গুনগত দিক থেকে হয় নিম্নমানের। যেখানেই নকলের অনুপ্রবেশ ঘটে সেখানেই রোপিত হয় মন্দের বীজ। এই মন্দত্ব সংশ্লিষ্ট জায়গার উপযুক্ততা ও সম্ভাবনাকে নষ্ট করে। ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র, সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। আর নকলের অনুপ্রবেশ যদি পরীক্ষাব্যবস্থায় ঘটে তাহলে এর ভয়াবহতা কী হতে পারে তা অনুমান করার জন্য আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন মেন্ডেলার একটি কথা এখানে তুলে ধরতে চাই। তিনি বলেন, ‘কোনো জাতিকে ধ্বংস করার জন্য পারমাণবিক হামলা কিংবা ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের দরকার নেই। বরং সেই জাতির শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় প্রতারণার সুযোগ দিলেই হবে। কারণ এভাবে পরীক্ষা দিয়ে তৈরি হওয়া ডাক্তারদের হাতে রোগীর মৃত্যু হবে। ইঞ্জিনিয়ারদের দ্বারা নির্মিত দালান-কোঠা, ইমারত ধ্বংস হবে এবং অর্থনীতিবীদের দ্বারা দেশের আর্থিক খাত দেউলিয়া হবে। বিচারকদের হাতে বিচারব্যবস্থার কবর রচিত হবে। অতএব, শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়া মানে একটি জাতির অবলুপ্তি।’ আফ্রিকার সবচেয়ে নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় ‘ইউনির্ভাসিটি অব সাউথ আফ্রিকা’ এর প্রবেশদ্বারে বাণীটি লেখা রয়েছে।
এজন্য মানুষ মাত্রই ঘৃণা করে নকলকে। চাই সেটি কাজ হোক বা বস্তু। ঘৃণা করে নকলকারীকেও। কারণ সে দেশ ও জাতির শত্রু। কল্যাণের দুশমন। অকল্যাণের মিত্র।
পরীক্ষা আমানত
পরীক্ষা একটি আমানত। শরীয়তের দৃষ্টিতে আমানত লেনদেন তথা মুআমালার আওতাভুক্ত। লেনদেনে যেমনিভাবে প্রতারণা ও ধোঁকার আশ্রয় নেওয়া গুনাহ, পরীক্ষায়ও নকল কিংবা যেকোনো ধরণের অসদুপায় অবলম্বন করা প্রতারণার শামিল এবং কবীরা গুনাহ। চাই তা অন্য কারো কাছ থেকে দেখে লেখা হোক বা কারো কাছ থেকে শুনে লেখা হোক বা গোপনে নিজের কাছে থাকা লেখা কাগজ বা বই দেখে দেখে লেখা হোক অথবা অন্য যেকোনো অসদুপায় অবলম্বন করেই হোক না কেন। পরীক্ষা অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে পরীক্ষক, পরীক্ষার্থী ও পরীক্ষা সংশ্লিষ্ট প্রত্যেক ব্যক্তিই আমানত রক্ষার জিম্মাদারিতে নিয়োজিত থাকে।
আর আমানতের খেয়ানত না করের নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা জেনে-শুনে খেয়ানত করো না আল্লাহ ও রসূলের সঙ্গে এবং খেয়ানত করো না নিজেদের পারস্পরিক আমানতের ক্ষেত্রে’। [সূরা: আনফাল, আয়াত: ২৭]
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমাদের সাথে প্রতারণা করে সে আমাদের দলভুক্ত নয়’। [সহিহ মুসলিম]
পরীক্ষার উদ্দেশ্য
পরীক্ষা প্রদান ও গ্রহণের উদ্দেশ্য পরীক্ষার্থীকে পরখ করা, যাচাই করা। অনেক সময় পরীক্ষার্থী নিজেই নিজেকে পরীক্ষা করে নিজের যোগ্যতা ও প্রস্তুতি যাচাইয়ের জন্য। অবশ্য বেশিরভাগ সময় পরীক্ষার্থী এবং পরীক্ষক ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি হয়ে থাকেন। উদ্দেশ্য থাকে নির্দিষ্ট বিষয়ে পরীক্ষার্থীর যোগ্যতা, দক্ষতা, জানাশোনার পরিধি, বোধশক্তি মেধার তীক্ষèতা ও উপযুক্ততা যাচাই। পরীক্ষায় নকল উভয়বিদ পরীক্ষারই উদ্দেশ্যের পরিপন্থি। উপরন্তু এটি আত্মপ্রবঞ্চনা ও প্রতারণা।
আল্লাহ তাআলা মানুষকে সৃষ্টিই করেছেন পরীক্ষা করার জন্য। কে ভালো কাজ করে আর কে করে মন্দ, যাচাই করার জন্য। মানুষ হিসেবে আমরা প্রতিনিয়তই আল্লাহর কাছে আমলের পরীক্ষা দিচ্ছি। প্রতিটি বিষয়েই পরীক্ষা দিচ্ছি। এসব পরীক্ষার ফলাফল একদিন আমলনামা আকারে আমাদের হাতে দেওয়া হবে। উত্তীর্ণরা হবে পুরস্কৃত। অকৃতকার্যরা হবে তিরস্কৃত। আমাদের বিদ্যালয়ের পরীক্ষা, পাঠ্যবইয়ের পরীক্ষা বা চাকরির জন্য নিয়োগ পরীক্ষাগুলো একদিক থেকে জাগতিক পরীক্ষা। অপরদিক থেকে পরকালীন পরীক্ষাও বটে। এসকল পরীক্ষায় খেয়ানত করা দ্বিগুণ গুনাহের কাজ। এক. আল্লাহর হক নষ্ট করার গুনাহ। দুই. বান্দার হক নষ্ট করার গুনাহ।
তাই পরীক্ষার্থীদের উচিৎ পরীক্ষায় নকল কিংবা যেকোনো ধরণের অসদুপায় অবলম্বন থেকে সচেতনভাবে বিরত থাকা। অন্যদেরও বিরত রাখা। এসব কাজে কারো সহযোগী না হওয়া।
পরীক্ষায় নকল করা সম্পর্কে শায়েখ আবদুল্লাহ বিন বাজ এর ফতোয়া
পরীক্ষায় নকলের ব্যাপারে সৌদি আরবের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতি মরুহুম শাইখ অবদুল্লাহ বিন বাজ রহ: বলেন, ‘পরীক্ষায় নকল করা মানুষের সঙ্গে লেনদেনের ক্ষেত্রে প্রতারণার মতোই হারাম ও ন্যাক্কারজনক। বরং সাধারণ লেনদেনের চেয়ে পরীক্ষায় নকল করা- বেশি ভয়ানক। কারণ, নকলের মাধ্যমে সে হয়ত বড় বড় চাকরি লাভ করবে। সুতরাং পড়াশোনার সব ক্ষেত্রে নকলের আশ্রয় নেয়া হারাম।
তাছাড়া এটি একটি খেয়ানত বা বিশ্বাসঘাতকতা। আর আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা জেনে-শুনে খেয়ানত করো না আল্লাহ ও রসূলের সঙ্গে এবং খেয়ানত করো না নিজেদের পারস্পরিক আমানতের ক্ষেত্রে’। (সূরা: আনফাল, আয়াত: ২৭)
সুতরাং শিক্ষার্থীদের জন্য আবশ্যক হলো- তারা যেন কোনো পাঠ্য বিষয়েই নকলের আশ্রয় না নেয়। বরং তারা যেন প্রস্তুতি নেওয়ার ক্ষেত্রে কঠোর অধ্যবসায় ও পরিশ্রম করে বৈধভাবে উত্তীর্ণ হয়।’ [শাইখের অফিসিয়াল ওয়েব সাইট]
নৈতিক অবক্ষয় ও প্রস্তুতির স্বল্পতা নকল প্রবণতার কারণ
একটি জাতির উত্থানের জন্য প্রধানত দুটি শর্ত :
১। নৈতিক শক্তি ২। বস্তুগত উন্নতি
কারো মাঝে নৈতিক শক্তি পরিপূর্ণভাবে থাকলে তা বস্তুগত উপকরণের অনেক ঘাটতি পূরণ করতে সক্ষম। কিন্তু কোনো জাতির যদি নৈতিক স্খলন ঘটে বস্তুগত উপকরণ সেটির শূন্যতা কিছুতেই পূরণ করতে পারে না। বিখ্যাত কবি আহমদ শাওকি তার এক কবিতায় বলেন,
إنما الأمم الأخلاق ما بقيت # فإن هم ذهبت أخلاقهم ذهبوا
‘জাতিসমূহ টিকে থাকে তাদের নৈতিকতার উপর ভিত্তি করে। যখনই কোনো জাতির নৈতিক স্খলন ঘটে সে জাতি ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে যায়।’
পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের ক্ষেত্রে প্রধানত অনুঘটক হলো নৈতিক অবক্ষয়। যা একটি জাতিকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। দ্বিতীয়ত পড়াশোনায় অমনোযোগিতা ও প্রস্তুতির স্বল্পতাও নকল প্রবণতার অন্যতম কারণ।
পরীক্ষার্থীদের শ্রেণিবিন্যাস
পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন করা না করার দিক বিবেচনায় পরীক্ষার্থীরা সাধারণত তিন ধরণের হয়ে থাকে।
১। নীতিবান শিক্ষার্থী। এই শ্রেণির শিক্ষার্থীরা পরিশ্রমী হোক বা না হোক, প্রশ্ন কমন পড়–ক বা না পড়–ক; কোনো অবস্থাতেই পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন করে না। নীতির প্রশ্নে তারা স্বার্থের সাথে আপোস করে না।
২। খুব বেশি নীতিবান নয়; তবে প্রতিভাবান, পরিশ্রমী ও অধ্যাবসায়ী। এসকল শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতি ভালো থাকার কারণে নকলের প্রয়োজন পড়ে না বিধায় তারাও খুব বেশি একটা নকল প্রবণ নয়। তবে প্রয়োজন পড়লে এরাও সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না।
৩। অমনোযোগী ও উদাসীন শিক্ষার্থী। এধরণের শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতি পর্যাপ্ত না থাকায় সবসময় অসদুপায়ে পাস করার কিংবা নম্বর ওঠানোর নেশায় থাকে। ‘অভাবে স্বভাব নষ্ট’ এই প্রবাদ কথার মতই প্রস্তুতির অভাব এদেরকে নীতি নৈতিকতা ভুলিয়ে দেয়। এরাই বেশিরভাগ সময় পরীক্ষার সুন্দর পরিবেশ নষ্ট করে।
নকল প্রতিরোধে বিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষের উচিত শিক্ষার্থীদের নৈতিক মানোন্নয়ন করা এবং দুর্বল ও অমনোযোগী ছাত্রদের পড়াশোনার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি নিবদ্ধ করা।
নকলের কিছু কুফল
নকল করে পাশ করা, সার্টিফিকেট নেওয়া, পদ-পদবি ভাগিয়ে নেওয়া আগাগোড়াই একটা প্রতারণা। আত্মপ্রবঞ্চনা ও চৌর্যবৃত্তি। নকল করে পাশ করা লোকটি কেমন যেন দাবি করছে, আমি যোগ্য; অথচ সে অযোগ্য। দাবি করছে, আমি জানি; অথচ সে জানে না। দাবি করছে আমি সার্টিফিকেটের বা পদের হকদার; অথচ সে হকদার নয়। এমন কর্মের নিন্দা করে এবং জঘন্যতা তুলে ধরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
اَلمُتَشبِّعُ بما لم يُعطَ، كَلابِسِ ثوبي زور
‘যা তোমাকে দেওয়া হয়নি তা দেওয়া হয়েছে বলা ঐরূপ প্রতারকের কাজ যে প্রতারণার জন্য দুপ্রস্থ মিথ্যার পোশাক পরিধান করল। [মুসলিম শরীফ]
المُتَشبِّعُ অর্থ যে নিজেকে দাবি করছে পরিতৃপ্ত, অথচ পরিতৃপ্ত নয়। অর্থাৎ যে নিজের জন্য এমন গুণ, যোগ্যতা ও শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করছে যেটি বাস্তবে তার মাঝে নেই।
এই হাদিস আমাদের আচরণে সৎ ও সত্যবাদী হওয়ার প্রতি উদ্বুদ্ধ করে। এমন কাজ করার বিরুদ্ধে সতর্ক করে, যা মিথ্যা ধারণা তৈরি করতে পারে। যা নিজের মাঝে নেই তা থাকার দাবি করার জঘন্যতা তুলে ধরে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন কাজকে মিথ্যার দুটি পোশাক পরার সাথে তুলনা করেছেন। অর্থাৎ এটি এমন একটি কাজ যা সর্বৈব মিথ্যা এবং সম্পূর্ণরূপে অগ্রহণযোগ্য। একজন মুসলমান হিসেবে যা সবসময় এড়িয়ে চলা উচিত।
এ ব্যাপারে আবু আমর ইবনুল আলা রহ. বলেন, من تحلى بغير ما هو فيه فضحته شواهد الامتحان যে ব্যক্তি নিজের ভেতরে যা আছে তা ছাড়া কৃত্রিমতা করে অন্য কিছু প্রদর্শন করবে, বাস্তবতা তাকে লাঞ্চিত করবে।
এছাড়াও নকলের নানাবিধ মন্দ প্রভাব রয়েছে। যেমন :
১। নকল পরীক্ষা ব্যবস্থার উদ্দেশ্যের পরিপন্থি।
২। নকল পরিশ্রম ও অধ্যাবসায়ের প্রতিবন্ধক।
৩। নকল প্রবণতা ব্যক্তির সত্তাগত যোগ্যতা বিকাশের অন্তরায়।
৪। নকল ব্যক্তিকে পরনির্ভরশীল করে তোলে। পরগাছা বানায়।
৫। নকল ব্যক্তির মাঝে স্থবিরতা তৈরি করে। সৃজনশীলতা বিনাশ করে।
৬। নকল করা কবীরা গুনাহ। দুনিয়া ও আখেরাতে দণ্ডনীয় অপরাধ।
৭। নকল করলে দুনিয়াতেই বেইজ্জতি হওয়ার প্রবল আশঙ্কা থাকে।
৮। নকল করা মুনাফেকি চরিত্রের অন্তর্ভুক্ত।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা