২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

করোনাকালে এবারের হজ একেবারে ভিন্ন এক অভিজ্ঞতা

- ছবি : সংগৃহীত

ফরিদাহ বকতি ইয়াহরা এবছর যেভাবে হজ করার সুযোগ পেয়েছেন, তাকে লটারি জেতার সঙ্গেই তুলনা করা যেতে পারে। এই হজে যাওয়া ছিল তার সারাজীবনের স্বপ্ন।

স্মরণকালের ইতিহাসে এবারের মতো এত কম মানুষ আর হজ করেনি। আর সেবছরই হজে যাওয়ার সুযোগ এক বিরল সৌভাগ্যই বলতে হবে। ফরিদাহ তার এই হজের অভিজ্ঞতা তার স্মার্টফোন দিয়ে প্রতি মুহূর্তে শেয়ার করছেন তার পরিবারের সঙ্গে।

৩৯ বছর বয়সী ফরিদাহ তার স্বামী এবং তিন মেয়েকে মক্কার ফাইভ-জি নেটওয়ার্কের বদৌলতে হজের প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি আনুষ্ঠানিকতা লাইভ দেখিয়ে যাচ্ছেন।

"আমার স্বামী যে আমার সঙ্গে অনলাইনে আমার সঙ্গে যোগ দিতে পারছে, সেই সঙ্গে আমার মেয়েরাও, সেজন্যে আমি খুব খুশি।"

হজের প্রথম দিনে বেশিরভাগ মানুষই তাদের স্মার্টফোন উপরে ধরে সেলফি তুলছিলেন, পরিবার আর বন্ধুদের জন্য হজের আনুষ্ঠানিকতা লাইভ স্ট্রিম করছিলেন।

মাত্র গত বছরই মক্কায় সুপার-হাইস্পিড ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক চালু করা হয়। ফলে স্মার্টফোন থেকে এগুলো এখন করা যাচ্ছে খুবই সহজে।

চীনা হজযাত্রী নি হাওয়ু ইন্দোনেশিয়ার ফরিদাহর মতই আরেক সৌভাগ্যবান। যখন তাকে হজ করার জন্য বাছাই করা হলো, আনন্দে তার চোখে পানি চলে আসলো।

৪২ বছর বয়সী নি মাস্টার্স করছেন ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব মদিনায়। সৌদি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে মোবাইল ফোনে টেক্সট মেসেজে যখন খবরটি এলো, সেই মুহূর্তের অনুভূতি ভুলতে পারেন না তিনি।

"হজ করার জন্য যখন আমাকে বাছাই করা হলো, তারপর থেকে আমি খুশিতে আত্মহারা। আমি কান্না থামাতে পারছিলাম না, কারণ আল্লাহ আমার হজ করার বাসনা পূর্ণ করেছেন। একেবারে বিনা খরচে আমি এই হজ করছি।"

গত বছর হজে অংশ নিয়েছিল ২৫ লাখের বেশি মুসলিম। কিন্তু এবার করোনাভাইরাস মহামারির কারণে আর সব কিছুর মতো বিশ্বের মুসলিমদের সবচেয়ে বড় এই সমাবেশের ক্ষেত্রেও সৌদি কর্তৃপক্ষকে জারি করতে হয়েছে কঠোর বিধিনিষেধ।

এবছর হজে অংশ নেয়া মানুষের সংখ্যা সীমিত করে দেয়া হয়েছে কয়েক হাজারে। শুরুতে সৌদি কর্তৃপক্ষ বলেছিল, মাত্র এক হাজার মানুষকে হজ করতে দেয়া হবে। এখন অবশ্য সৌদি গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, দশ হাজার মানুষ হজ করার সুযোগ পাচ্ছেন।

আনন্দ অশ্রু
হজের প্রথম দিনে ফরিদাহ যখন সোনালি কারুকাজ করা কালো কাপড়ে আবৃত মক্কার কাবা শরিফের দিকে এগুচ্ছেন, তখন তার ফোন থেকে একটি ভিডিও কল করলেন। ফোনের অপর প্রান্তে তার স্বামী হেন্ড্রা সামোসির।

"আমার স্ত্রী যখন কাবা শরিফে ঢুকলেন এবং আমাকে কাবা দেখালেন, খুশিতে, আনন্দে আমার চোখে পানি এসে গেল", বললেন তিনি।

"আমার জন্য এটাই আসলে একরকম পবিত্র তীর্থযাত্রা, যদিও আমি সেখানে যাইনি। কিন্তু যখন আমি আমার স্ত্রীকে হজ করতে দেখছিলাম, আমার মনে হচ্ছিল আমিও সেখানে আছি।"

ইন্দোনেশিয়া থেকে প্রতিবছর সাধারণত হাজার হাজার মানুষ হজ করতে যান। অনেকে সারাজীবন ধরে সঞ্চয় করেন জীবনে একবার হজে যাওয়ার জন্য।

কিন্তু এবছর দশ-বারোজন মানুষও ইন্দোনেশিয়া থেকে হজে আসতে পারেননি।

সৌদি কর্তৃপক্ষ করোনাভাইরাসের কারণে এবার যে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে, তার কারণে মাত্র ১০ হাজার মানুষকে হজে আসার সুযোগ দেয়া হয়। একটি লটারির মাধ্যমে এদের বাছাই করা হয়। এই লটারির নিয়মকানুন কি ছিল, তা খুব স্পষ্ট নয়।

হজে আসার জন্য আগ্রহী সারা বিশ্বের লাখ লাখ মানুষকে এবার তাই আশাহত হয়ে হয়েছে।

যারা এবার হজ করছেন, তাদের ৭০ শতাংশই বিদেশি, বাকি ৩০ শতাংশ সৌদি আরবের বাসিন্দা।

সৌদি আরব থেকে তাদেরকেই হজে যেতে দেয়া হয়েছে, যারা চিকিৎসক বা নিরাপত্তা কর্মী এবং যারা করোনাভাইরাস থেকে সেরে উঠেছেন।

ভিন্ন এক অভিজ্ঞতা
হজের আনুষ্ঠানিকতায় অংশ নেয়ার সময় মুসলিমদের মাইলের পর মাইল হাঁটতে হয়, দিনে কয়েক ঘন্টা করে প্রার্থনা করতে হয়। বাইরে খোলা জায়গায় রাত্রি যাপন করতে হয়।

প্রতি বছর যখন লাখ লাখ মুসলিম এসব আনুষ্ঠানিকতায় অংশ নেন, তখন মক্কা এবং মদিনাকে ঘিরে চারপাশের এলাকা পরিণত হয় জনসমুদ্রে। মানুষের ভিড়ে পদদলিত হয়ে বহু মানুষ মারা গেছেন এর আগে হজ করার সময়। কিন্তু এবারের হজযাত্রীরা একেবারেই এক ভিন্ন অভিজ্ঞতার কথা বলছেন।

সৌদি নার্স ওয়াজদান আলি বলেন, "এবার মানুষের ভিড় নেই, তাই আমি আমার সব আনুষ্ঠানিকতা সহজে পালন করতে পারছি। এবারের পরিবেশটা তাই খুব শান্ত-সমাহিত, অনেক বেশি আধ্যাত্মিক পরিবেশ।"

২৫ বছর বয়সী ওয়াজদান আলি থাকেন লোহিত সাগর তীরের শহর জেদ্দায়। সম্প্রতি করোনাভাইরাস থেকে সেরে উঠেছেন। সেজন্যেই তাকে বাছাই করে এবার হজ করার সুযোগ দেয়া হয়েছে।

এবার প্রত্যেক হজযাত্রীর হাতে পরিয়ে দেয়া হয়েছে একটি রিস্টব্যান্ড, যাতে সৌদি কর্তৃপক্ষ সারাক্ষণ জানতে পারেন তার অবস্থান। কোয়ারেন্টিনে থাকা মানুষদের ওপর নজরদারির জন্য এই ব্যবস্থা। ওয়াজদান আলি বলছেন, এটা একটা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা।

প্রতিটি হজযাত্রীকে সৌদি কর্তৃপক্ষ করোনাভাইরাসের জন্য পরীক্ষা করেছে। তাদের মুখোশ পরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এবং পরস্পর থেকে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে বলা হয়েছে। যে পাঁচদিন ধরে হজের আনুষ্ঠানিকতা চলবে, সে কদিন তাদের শরীরের তাপমাত্রা মাপা হবে নিয়মিত।

এবছর হজে অংশগ্রহণকারীরা জানান, সৌদি কর্তৃপক্ষ তাদের যে ইহরাম দিয়েছেন (হজে অংশ নেয়ার সময় সেলাই ছাড়া যে সাদা কাপড় পরতে হয়), সেটি ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধী কাপড় দিয়ে তৈরি।

সৌদি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানাচ্ছে, এখন পর্যন্ত হজের আনুষ্ঠানিকতা ভালোভাবেই আগাচ্ছে। হজযাত্রীদের স্বাস্থ্য নিয়ে এখনো পর্যন্ত কোন উদ্বেগজনক খবর পাওয়া যায়নি, করোনাভাইরাস সংক্রমণের একটি ঘটনাও ধরা পড়েনি।

হজযাত্রীরা আজ আনুষ্ঠানিকতার অংশ হিসেবে "শয়তানের দিকে পাথর ছোঁড়ার‌' যে রীতিটিতে অংশগ্রহণ করেন, সেই পাথরগুলোও ছিল স্যানিটাইজড।

তীব্র রোদের মধ্যে তারা যখন মিনা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, তখন তাদের ওপর সতর্ক নজর রাখছিল নিরাপত্তা রক্ষীরা। হজযাত্রীদের মুখে মাস্ক, পরণে হজের সাদা কাপড়।

ডিজিটাল হজ
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হজের নানা আনুষ্ঠানিকতায় ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার অনেক বেড়েছে। কোরআন এখন পাওয়া যাচ্ছে ডিজিটাল ফরমেটে, বেরিয়েছে হজের নানা আনুষ্ঠানিকতা সহজে পালনের জন্য নানা ধরণের অ্যাপ।

হজে আসা অনেক মানুষ এখন তাদের স্মার্টফোন থেকেই কোরআন পড়েন। ফলে আগের যুগের মতো ছাপানো কোরআন শরিফ সাথে বহন করতে হয় না।

তবে শুধু কোরআন পড়া কিংবা হজের ভিডিও এবং ছবি শেয়ার করার মধ্যেই ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার থেমে নেই। অনেকে যাতে তাদের ঘরে বসেই হজের আনুষ্ঠানিকতায় অংশ নিতে পারেন, এটি সেই সুযোগও করে দিয়েছে।

এখন অনেক অনলাইন প্ল্যাটফর্ম আছে, যেখানে গিয়ে সারাবছরই ওমরাহ হজ করা যায়। একজনের পক্ষ হয়ে আরেকজনের ওমরাহ হজ করার যে ধারণা, তার ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে এধরণের সেবা। যার জন্য ওমরাহ হজ করা হচ্ছে, তিনি অনলাইনে গিয়ে হজের অভিজ্ঞতা প্রত্যক্ষ করেন যিনি সৌদি আরবে হজে শারীরিকভাবে অংশ নিচ্ছেন তার সঙ্গে। অনেকধরণের ভার্চুয়াল রিয়ালিটি টুল আছে এসব অনলাইন প্লাটফর্মে।

অনেক ধর্মীয় নেতা এরকম হজের ধারণাকে সমর্থন করেন। কিন্তু অনেকে এর বিরোধী। তারা বলছেন, কেবল খুবই অসুস্থ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেই অপর একজনের মাধ্যমে এভাবে হজ করার বিধান আছে। বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement