তাওবাহ : সুখী মুসলমানের উন্নতির সোপান
- আশরাফ জিয়া
- ০৩ জানুয়ারি ২০২৫, ২২:১৮
১. বনী ইসরাঈলে একবার ভীষণ দুর্ভিক্ষ ও অনাবৃষ্টি দেখা দিল। নারী, শিশু, বৃদ্ধসহ সকলেই এই দুর্ভিক্ষে মারা যেতে লাগলো। একপর্যায়ে লোকজন সকলে মিলে হযরত মুসা আলাইহিস সালামের দরবারে এসে উপস্থিত হলো এবং নিবেদন করল, ‘হে কালীমুল্লাহ, হে আল্লাহর নবী, আমাদের জন্য আপনার রবের নিকট দোয়া করুন, তিনি যেন আমাদের বৃষ্টি দান করেন। রহমতের বৃষ্টি।’
মুসা আলাইহিস সালাম তাদের সকলকে নিয়ে একটি খোলা প্রান্তরে গিয়ে উপস্থিত হলেন। তাদের সংখ্যা ছিল ৭০ হাজার কিংবা তারো বেশি। মুসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর দরবারে দোয়া করলেন, ‘হে আল্লাহ, আপনি আমাদের বৃষ্টি দান করুন। আমাদের ওপর আপনার রহমত নাজিল করুন। আমাদের দুগ্ধপোষ্য শিশুদের ওপর দয়া করুন। তৃণভোজী প্রাণীদের ওপর করুণা করুন। আমাদের মধ্যে যারা বয়সের ভারে ন্যুব্জ ও কুঁজো হয়ে গেছে, তাদের ওপর দয়া করুন।’
এভাবে মুসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর দরবারে দোয়া করছিলেন। কিন্তু আকাশ থেকে বৃষ্টি তো বর্ষিত হচ্ছিলই না, উল্টো যতটুকু মেঘ আকাশে দেখা যাচ্ছিল তা-ও দূরে সরে যাচ্ছিল। সূর্যের উত্তাপ ও প্রখরতা আরো বৃদ্ধি পাচ্ছিল। মুসা আলাইহিস সালাম দোয়া করে যাচ্ছিলেন, ‘হে আমাদের রব, হে আমাদের প্রভু, আপনি আমাদের ওপর বৃষ্টি বর্ষণ করুন। আমাদের ওপর আপনার রহমত নাজিল করুন।
আল্লাহ মুসা আলাইহিস সালামের দোয়ার জবাবে আল্লাহ অহি পাঠালেন। ‘হে মুসা, কীভাবে আমি তোমাদের বৃষ্টি দান করব, অথচ তোমাদের মাঝে এমন এক লোক রয়েছে, যে বিগত চল্লিশ বছর ধরে নানা অন্যায় ও পাপাচার করে করে আমার নাফরমানি করে যাচ্ছে। যেন আমার অবাধ্যতা আর বিরুদ্ধাচারণই তার কাজ। সুতরাং, আমি কীভাবে তোমাদের বৃষ্টি দান করব? বরং তুমি সকলের মাঝে ঘোষণা করে দাও সে যেন তোমাদের মাঝ থেকে বের হয়ে যায়। তার কারণেই আমি তোমাদের বৃষ্টি বন্ধ রেখেছি।’
মুসা উঁচু আওয়াজে সমবেত মানুষের মাঝে ঘোষণা করলেন, ‘যে গুনাহগার ও পাপী বান্দা দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে আল্লাহর অবাধ্যতা ও নাফরমানি করে আসছ, তুমি আমাদের মধ্য থেকে বের হয়ে যাও। তোমার কারণেই আল্লাহ আমাদের বৃষ্টি বন্ধ করে রেখেছেন।’
ঘোষণা শুনে গুনাহগার লোকটি এদিক-সেদিক তাকাল। ডানে-বামে দেখল। কিন্তু কাউকেই সে বেরিয়ে যেতে দেখল না। সে নিশ্চিত বুঝে নিল সেই উদ্দিষ্ট ব্যক্তি। তাকেই বেরিয়ে যেতে বলা হচ্ছে। সে ভাবতে লাগল, আজ যদি আমি এখান থেকে বের হই, তা হলে পুরো বনী ইসরাঈলের মাঝে আমার অন্যায় ও অপরাধ প্রকাশ হয়ে যাবে। আর যদি আমি এখানে তাদের সাথে থেকে যাই, তাহলে আমার কারণে তাদেরকে বৃষ্টি থেকে বঞ্চিত করা হবে। এমতাবস্থায় সে ভেতরে ভেতরে অনুতপ্ত হল। আক্ষেপ ও অনুশোচনায় দগ্ধ হল। চোখ থেকে অঝোর ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল। একপর্যায়ে সে লজ্জায় ও অনুশোচনায় কাপড়ের নীচে মাথা লুকাল। মনে মনে আল্লাহর দরবারে ক্ষমাপ্রার্থনা করে বলল, ‘হে আমার রব, হে আমার মাওলা, দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে আমি আপনার অবাধ্যতা ও নাফরমানি করে আসছি। এ দীর্ঘ সময় আপনি আমাকে অবকাশ দিয়েছেন। কখনো আমার অপরাধ মানুষের সামনে প্রকাশ করেননি। হে আল্লাহ, আমি আমার সারা জীবনের সমস্ত গুনাহ থেকে তাওবা করছি। আজ আমি পূর্ণ অনুগত হয়ে আপনার দরবারে হাজির হচ্ছি। দয়া করে আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। আমাকে কবুল করুন। আমাকে ফিরিয়ে দেবেন না। এভাবে সে আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করতে থাকল।’
এদিকে তার কথা তখনো পূর্ণ হয়নি, এরই মধ্যে আকাশে মেঘের আনাগোনা দেখা গেল এবং তৎক্ষণাৎ বৃষ্টি বর্ষিত হতে শুরু করল। এমনকি বৃষ্টির ফোটা মশকের মুখের মতো হয়ে পড়তে লাগল।
এ দেখে মুসা যারপরনাই বিস্মিত হলেন। আল্লাহর দরবারে নিবেদন করলেন, ‘ইয়া আল্লাহ, আপনি আমাদের ওপর বৃষ্টি বর্ষণ করতে শুরু করেছেন, অথচ এখনো তো আমাদের মধ্য থেকে কেউ বের হল না।’
আল্লাহ বললেন, ‘মুসা, আমি যার কারণে এতদিন তোমাদের ওপর বৃষ্টি বন্ধ রেখেছিলাম, এখন তার কারণেই তোমাদের বৃষ্টি দিচ্ছি।’ এ কথা শুনে মুসা আরো আশ্চর্য হলেন। বললেন, ‘হে আল্লাহ, আমি আপনার সেই বান্দাকে দেখতে চাই ‘
আল্লাহ বললেন, ‘মুসা, যখন সে আমার না-ফরমানি ও অবাধ্যতা করত তখনই আমি তাকে প্রকাশ করিনি, আর আজ যখন সে আমার অনুগত হয়ে গেছে, তখন কি আমি তাকে প্রকাশ করে দিব?’
২. একদিন জুহায়নাহ গোত্রের এক নারী আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর নিকট হাজির হলো। সে জিনার কারণে গর্ভবতী ছিল। সে বলল, ‘হে আল্লাহর রাসূল, আমি অনেক বড় অপরাধ করে ফেলেছি। তাই আপনি আমাকে শাস্তি দিন। আমি শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে জিনায় লিপ্ত হয়ে পড়েছি। নবীজী (সা.) সে মহিলার আত্মীয়কে ডেকে বললেন, ‘তুমি তাকে নিজের কাছে যত্ন সহকারে রাখো এবং সন্তান প্রসবের পর তাকে আমার নিকট নিয়ে এসো। সুতরাং সে তাই করল। অর্থাৎ প্রসবের পর তাকে নবীজী (সা.)-এর কাছে নিয়ে এল। নবীজী (সা.) শাস্তিস্বরূপ তার কাপড় তার শরীরের ওপর মজবুত করে বেঁধে দেয়ার আদেশ দিলেন। অতঃপর তাকে পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলার আদেশ দিলেন। মৃত্যুর পর তিনি তার জানাযার নামাজ আদায় করলেন।
নামাজ আদায় শেষে উমর তাকে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল, আপনি এই মহিলার জানাজার নামাজ আদায় করলেন, অথচ সে ব্যভিচার করেছিল?’ তিনি বললেন, ‘উমর, তুমি জানো না যে, এই মহিলাটি এমন বিশুদ্ধ তাওবাহ করেছে, যদি তা মদীনার ৭০ জন লোকের মধ্যে বণ্টন করা হত তাহলে তা তাদের সকলের জন্য যথেষ্ট হত। এর চেয়ে কি তুমি কোন উত্তম কাজ পেয়েছ যে, সে আল্লাহর জন্য নিজের প্রাণকে কুরবান করে দিল?’
৩. একদিন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাদেরকে নিয়ে বসেছিলেন। এমন সময় একজন বৃদ্ধ অতিকষ্টে লাঠির ওপর ভর করে পা টেনে টেনে তার কাছে এলেন। বার্ধক্যে তার পিঠ বাঁকা হয়ে গেছে। হাড়গোড় দুর্বল হয়ে গেছে। বয়সের ভারে তার ভ্রুযুগল চোখের ওপর ঝুলে পড়েছিল। তিনি এগিয়ে এসে দাঁড়ালেন নবীজীর সামনে। অতঃপর বললেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ, ওই ব্যক্তির ব্যাপারে আপনি কী বলেন, যে সব ধরনের গুনাহই করেছে। কোনো গুনাহই বাদ রাখেনি। ছোট-বড় এমন কোনো গুনাহ নেই, যা সে করেনি। তার গুনাহগুলো যদি সমস্ত জমিনবাসীর মাঝে বণ্টন করে দেয়া হয়, তা হলে তা সকলকেই বরবাদ করে দিবে। ইয়া রাসূলুল্লাহ, এমন ব্যক্তির জন্য কি তাওবার কোনো সুযোগ আছে?’
আগন্তুকের কথা শুনে রাসূলুল্লাহ তার দিকে চোখ তুলে তাকালেন। দেখলেন, অতিশয় বৃদ্ধ এক লোক যে জীবনের একেবারে শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে।
রাসূলুল্লাহ তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কি ইসলাম গ্রহণ করেছ?
লোকটি জবাব দিলেন, আমি এ কথার সাক্ষ্য দেই যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং আপনি আল্লাহর রাসূল।’
রাসূলুল্লাহ বললেন, তা হলে তুমি তাওবাহ করে নেক ও কল্যাণের কাজ করে যাও, গুনাহ পরিত্যাগ কর, আল্লাহ তোমার সেসবকে নেকী দ্বারা পরিবর্তন করে দেবেন।’
বৃদ্ধ বললেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমার যত ধোঁকাবাজি, অন্যায়-অবিচার ও পাপাচার সবই?’
নবীজী বললেন, ‘হ্যাঁ।’
এ কথা শুনে বৃদ্ধ চিৎকার করে উঠলেন-‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার।’ এভাবে চিৎকার করতে করতে তিনি চলে গেলেন।
আমরা এতোক্ষণ তিনটি তাওবাহর গল্প শুনলাম। ইতিহাস ও সীরাতে চোখ বুলালে আমরা এজাতীয় আরো অনেক ঘটনা দেখতে পাব। পবিত্র কোরআন এবং হাদিস শরীফে অনেক জায়গায় তাওবাহর প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তোমরা প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য গুনাহ ছেড়ে দাও। নিশ্চয়ই যারা গুনাহ করে, অচিরেই তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের বদলা দেয়া হবে। (সুরা আনআম, আয়াত : ১২০)
তিনি আরো ইরশাদ করেন, ‘আমি বলেছি, তোমরা আপন রবের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয় তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের ওপর আকাশ থেকে মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষণ করবেন।
এবং তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে উন্নতি দান করবেন এবং তোমাদের জন্য সৃষ্টি করবেন উদ্যান আর তোমাদের জন্য নদ-নদীর ব্যবস্থা করে দিবেন।
(সূরা নূহ, আয়াত ১০-১২)
রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ মরুভূমিতে হারিয়ে যাওয়া উট খুঁজে পেয়ে যতটা খুশি হও, আল্লাহ তায়ালা তার বান্দার তাওবাতে এরচেয়েও বেশি খুশি হন। (বুখারি, হাদিস নং : ৬৭০৯)
তাওবাহ হলো, অতীতে কৃত অপরাধ ও ভুলের কারণে অনুতপ্ত ও লজ্জিত হওয়া। ভবিষ্যতে এমন ভুল না করার ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করা। সেই সাথে কারো হক-পাওনা বিনষ্ট করে থাকলে, তার ক্ষতিপূরণ দেয়া ও কাউকে কষ্ট দিয়ে থাকলে তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয়া। তাওবাহ করলে অনাবৃষ্টি-অতিবৃষ্টি দূর হয়। পৃথিবীতে বরকত বর্ষণ হয়। আল্লাহ তায়ালা সম্পদ বাড়িয়ে দেন এবং দোয়া কবুল করেন।
তাই প্রিয় পাঠক, আসুন না-আমরা আমাদের কৃত ভুলত্রুটির জন্য আল্লাহর দরবারে তাওবাহ করি। খাঁটি তাওবাহ আমাদের জীবনকে বরকতময় ও সুন্দর করে তুলবে। আমরা হতে পারব সুখী মুসলমান।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা