কোটা আন্দোলন : জেলমুক্ত কিশোর মাহিমের বর্ণনায় সেদিনের ঘটনা
- সরকার মাজহারুল মান্নান, রংপুর অফিস
- ০১ আগস্ট ২০২৪, ২১:১৭, আপডেট: ০১ আগস্ট ২০২৪, ২১:২০
কোটা আন্দোলনে পুলিশের রাবার বুলেটে নিহত আবু সাঈদ হত্যা মামলায় কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে রংপুর পুলিশ লাইন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী আলফি শাহরিয়ার মাহিম বললেন,‘টিয়ারশেলে আহত হয়ে সেন্সলেন্স হয়ে পড়ি, জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর দেখি আমি তাজহাট থানায়। আমার হাত উল্টো করে হ্যান্ডক্যাপ দিয়ে বেঁধে রেখেছিল পুলিশ। পুলিশকে বলেছিলাম আমি পুলিশ লাইন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়ি, তারপরেও ওরা আমাকে কারাগারে পাঠিয়েছে।’
বৃহস্পতিবার (১ আগস্ট) বেলা পৌনে ১টায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনাল আদালত-১ এর বিচারক মোস্তফা কামাল তার জামিন আদেশ মঞ্জুর করলে বিকেল ৫টা ১৮ মিনিটে তাকে কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া হয়।
কারাগার থেকে বেরিয়ে এলে আলফি শাহরিয়ার মাহিম তার মা বাবা ও স্বজনদের জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। পরে মাহিম বলেন,‘টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট ছুড়েছিল পুলিশ। আমি একাই পড়ে গিয়েছিলাম। যখন আমি সেন্সলেন্স হয়ে পড়ে গেছি। তখন আমাকে ধরছে। সেন্স ফিরে দেখি আমি তাজহাট থানায়। তখন আমার হাতে হ্যান্ডক্যাপ লাগানো ছিল পেছন থেকে বাঁধা। আমি পুলিশকে বলেছিলাম, আমি পুলিশ লাইনের স্টুডেন্ট, তারপরেও পুলিশ আমাকে ছাড়েনি। রাবার বুলেট টা আমার গলায় লেগেছিল। দুই সপ্তাহ আগে লেগেছিল, এখন দাগ সেরকম নেই। আমার পড়নে তখন কলেজ ড্রেস ছিল। কলেজ ড্রেস, আমার স্কুল ব্যাগ এবং আইড কার্ড তাজহাট থানায় ছিল। পড়ে তো শুনি তাজহাট থানা নাকি পুড়িয়ে দিয়েছে‘।
এর আগে দুপুরে আদালতের পিপি রফিক হাসনাইন জানান, নথিপত্র অনুযায়ী শিক্ষার্থী মাহিমের বয়স ১৬ বছর ১০ মাস হওয়ায় এবং অপরাধের সাথে জড়িত না থাকার তথ্য প্রমাণ পাওয়ায় তাকে জামিন দিয়েছে আদালত। সব প্রসিডিউর শেষে আজই তাকে মুক্তি দেয়া হবে।
আসামি পক্ষের আইনজীবী জোবাইদুল হক জানান, মিথ্যা মামলায় ১৬ বছর ১০ মাসের কলেজছাত্র মহিমকে পুলিশ উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে বয়স ১৯ বছর দেখিয়ে আদালতে তুলেছিল। বিচারক তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছিলেন। পরে প্রমাণ দিয়ে মেট্রোপলিটন কোতয়ালী আদালত থেকে মামলাটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতে নিয়ে আসি আমরা। সেকাজটুকু করতে গিয়ে আমরা অনেক ধকল সামলাই। আদালত ৪ আগস্ট শুনানির দিন ধার্য করে। বিষয়টি গণমাধ্যমে এলে পুলিশের সহযোগিতায় পুটআপ দিয়ে আজ আমরা শুনানি করি। বিচারক মাহিমকে জামিন দিয়েছেন। তিনি বলেন, এ ঘটনায় পুলিশ দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়নি। একটি ছোট কিশোরকে গ্রেফতার করে তাকে অধিক বয়স লিখে কারাগারে পাঠানোটা বেআইনি। এজন্য সংশ্লিষ্ট পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
গত ১৯ জুলাই রংপুর জেলা পুলিশ পরিচালিত পুলিশ লাইন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী আলফি শাহরিয়ার মাহিমকে (১৬ বছর ১০ মাস) পুলিশর দায়ের করা পুলিশের কাজে বাধা দেয়া, আবু সাঈদ হত্যা মামলায় গ্রেফতার হয়ে মাহিম কারাগারে বন্দী অবস্থায় আছেন। এ নিয়ে বুধবার (৩১ জুলাই) সংবাদ প্রচার করে যমুনা টেলিভিশন ও অনলাইন ভার্ষণে।
আলফি শাহরিয়ার মাহিমের বোন মাহিগঞ্জ মহাবিদ্যালয়ের ইংরেজি তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী সানজানা আকতার স্নেহা বুধবার (৩১ জুলাই) তার নিজ ফেসবুক আইডিতে পোস্টে জানান, আমার ছোট ভাই মো: আলফি শাহরিয়ার মাহিমকে আবু সাঈদ হত্যা মামলায় গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠিয়েছে পুলিশ। তার বয়স ১৬ বছর ১০মাস। সে রংপুর পুলিশ লাইন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ (এইচএসসি ২৫)-এর ছাত্র। তার কলেজ আইডি নম্বর ১৭৬৬০। সিদ্দিক মেমোরিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রাক্তন ছাত্র ছিল সে।
সানজানা জানান, আমার ভাই অত্যন্ত মেধাবী, শান্ত ভদ্র একটা ছেলে, ১৮ জুলাই সে কলেজের উদ্দেশে বের হলে জানতে পারে পরীক্ষা স্থগিত। তখন বন্ধুদের সাথে মিছিলের মাঝে জরিয়ে যায় এবং পুলিশের টিয়ারশেলে বন্ধুদের থেকে আলাদা হয়ে যায়। পরবর্তীতে আমরা ওইদিন আনুমানিক ৪টায় ওর বন্ধুদের থেকে জানতে পারি তার পাঁয়ে রাবার বুলেট লেগেছে, সেখানকার লোকাল মানুষ কোনো এক হসপিটালে এডমিট করিয়েছে। রাত ১০টা পর্যন্ত সব হসপিটাল ক্লিনিক খুঁজেও যখন তাকে আমরা পাচ্ছিলাম না। তখন আমার বাবার কাছে পুলিশের একটা কল আসে। তারা আমার বাবাকে জানায়, আপনার ছেলে আমাদের হেফাজতে আছে, জানাজানি করিয়েন না তাতে ছেলের ক্ষতি হবে। তাকে আগামীকাল সকালে ছেড়ে দেয়া হবে চিন্তার কিছু নেই।
সানজানা আরো জানান, কিন্তু পরের দিন ১৯ জুলাই সকালে আমরা খোঁজ নিলে পুলিশ অস্বীকার করে বলে তাদের কাছে এই নামে কেউ নেই। এরপর ওইদিন আনুমানিক বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে কোর্ট থেকে কল আসে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। আমরা কোর্ট থেকে নথিপত্র নিয়ে জানলাম তাকে আবু সাঈদ ভাইয়ের হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। ওইদিন থেকে বার বার কারাগারের দরজা থেকে ফিরে এসেছি। একটা বার দেখা তো দূরের কথা তার কণ্ঠও শুনতে দেয়নি কেউ।
সানজানা আরো জানান, এরপর বিষয়টি আমরা কোর্টের মাধ্যমে মোকাবেলা করার চেষ্টা করি। কিন্তু মেট্রো পলিটন কোর্ট তার মামলা কিছুতেই শিশু কোর্টে দিতে চায়নি। অনেক চেষ্টা করে গত ৩০ জুলাই শিশু কোর্টে মামলাটি নেয়া হলে। পরবর্তী তারিখ ধার্য করেছে আগামী ৪ আগস্ট।
সানজানা জানান, ওইদিন কোর্ট কী রায় দিবে আমার জানা নেই, তবে আমি আমার ভাইকে ফিরে চাই, বেকসুর খালাস দেয়া হোক এটা চাই।
সানজানা আরো বলেন, যে ছেলেটা লিগ্যাল ডকুমেন্টস অনুযায়ী শিশু, তাকে তারা কোন হিসেবে এভাবে হ্যারাস করাচ্ছে? সব থেকে বড় কথা তার গায়ে কলেজ ড্রেস ছিল, আইডি ছিল, সে পুলিশদের ইনস্টিটিউটটের ছাত্র। এক্ষেত্রে কি তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক, সহপাঠী, আইনজীবী কারো কিছুই করার নাই? আমার ভাইকে কোন লজিকে তারা কারাগারে নিল। দেখাও করতে পারছি না আমরা। এর বিচার চাই।
বুধবার (৩১ জুলাই) সন্ধায় ৬টা ৫০ মিনিটে সানজিনা আকতার স্নেহা টেলিফোনে জানান, আমার পোস্টের পরে পুলিশ কমিশনার আমাকে ডেকেছিলেন। তিনি আমার ভাইয়ের সাথে কারাগার থেকে কথা বলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সম্ভব হয়নি। তবে পুলিশ কমিশনার আমাদের কথা দিয়েছেন। আমার ভাই নির্দোষ। তাকে কালকে ছেড়ে দেয়া হবে। এজন্য একজন পুলিশের অফিসারকে আমাদের সাথে দিয়েছেন। তাকে নিয়ে আমরা আদালতে যাচ্ছি। সেখান গিয়ে কাগজপত্র সব ঠিক করবেন ওই পুলিশ অফিসার। এখন তার সাথে আমরা আছি। তিনি বলেন, আমি আমার নিরপরাধ ভাইয়ের মুক্তি চাই।‘
সানজানা জানান, বৃহস্পতিবার শিশু আদালত-১ এর বিচারক আমার ভাইয়ের জামিন মঞ্জুর করেছেন। এখন আমরা কারাগার থেকে তার মুক্তি চাই।
মাহিমের বাবা মো: শাহজালাল জানান, আলহামদুলিল্লাহ। আমার ছেলের জামিন হয়েছে। এজন্য তিনি ফেসবুক মিডিয়া ও পুলিশ কমিশনারের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন এখন পুলিশ কমিশনার মহোদয় কথা দিয়েছেন আমার ছেলেকে অব্যাহতি দিবেন। এখন আমরা সেটা চাই।
মাহিমের মা আনজুয়ারা বেগম ময়না জানান,‘আমার ছেলের আমি পূর্ণমুক্তি চাই। তাকে যেন মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। আমার ছেলে বুয়েটে পড়বে এটাই তার ইচ্ছা। এই মামলার কারণে যদি আমার ছেলের সেই ইচ্ছা নষ্ট হয় তাহলে আমি কী করবো। আমি আমার নির্দোষ ছেলেকে যারা কলঙ্ক লাগিয়ে দিলো তার বিচার চাই।’
এ ব্যাপারে রংপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার মো: মনিরুজ্জামান জানান, ১৮ জুলাই যখন থানায় হামলা-ভাংচুর ও লুটপাট হয়। তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে জিন্সের প্যান্ট ও স্যান্ডো গেঞ্জি পরা অবস্থায় আটক হয় মাহিম। পরে তাকে পুলিশের হেফাজতে নেয়া হয়। যেহেতু ১৮ ও ১৯ তারিখে সংঘর্ষ নিয়ে পুরো ফোর্স ব্যস্ত ছিল, সেকারণে বিষয়টি যাছাই-বাছাই করা সম্ভব হয়নি।
মূলত ২০ তারিখ থেকে আমরা যাছাই-বাছাই সাপেক্ষে গ্রেফতার করছি। বিষয়টি আমাদের নলেজে আসা মাত্রই আমরা আদালতের সাথে কথা বলেছি। আদালত জামিন মঞ্জুর করেছেন। এখন প্রয়োজনীয় কাজ শেষে আইনি প্রক্রিয়ায় তাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হবে। কারণ সে ওই ঘটনার সাথে জড়িত ছিল না।’
মাহিমের বাড়ি রংপুর মহানগরীর চকবাজার এলাকায়। তার বাবা মোহাম্মদ শাহজালাল ব্যবসা করেন। ও মা আনজুমান আরা ময়না গৃহিনী। তারা এক ভাই এক বোন।
রংপুর বারের আইনজীবী রায়হান কবীর জানান, যে ছেলেটি বলছে, তার বয়স ১৬ বছর ১০ মাস, স্বপক্ষে কাগজ দেখাচ্ছে তার পরিবার। তাকে কেন মামলায় ১৮ বছর দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হলো। একবার থানা থেকে যোগাযোগে করা হলো। পরে বলা হলো আমাদের কাছে নেই। পরে দেয়া হলো কারাগারে। এটা বেআইনি।
তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যেসব সদস্য আইনের ব্যত্যয় ঘটাবেন, তাদের জবাবদিহির আওতায় এনে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়া দরকার। জবাবদিহি না থাকায় আইনের সংস্পর্শে আসা শিশুদের পূর্ণবয়স্ক দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হচ্ছে। এতে শিশুরা মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
তিনি জানান, ২০১৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়-‘শিশু নির্যাতনের ঘটনা যেখানেই ঘটুক না কেন মামলা নিয়ে অভিযোগের বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপের ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর তা না করলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। শিশুর পরিবারকে হয়রানি করা যাবে না।’
তিনি জানান, কোনো শিশু বিভিন্ন অপরাধে পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার হলে তাকে কারাগারে প্রেরণ করা যাবে না। তাকে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে প্রেরণ করতে হবে।
উল্লেখ্য গত ১৬ জুলাই পুলিশের রাবার বুলেটে মারা যায় আবু সাঈদ। ওই ঘটনায় পুলিশের এসআই বিভুতিভূষণ একটি মামলা করেন। সেই মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখায় পুলিশ।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা