রংপুরে শিক্ষার্থী সাঈদকে লক্ষ্য করে পুলিশের গুলি, ঠিক কী ঘটেছিল?
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ১৭ জুলাই ২০২৪, ২২:০২
কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে মঙ্গলবার বাংলাদেশে যে ছয়জন নিহত হয়েছেন, তাদেরই অন্যতম হচ্ছেন আবু সাঈদ।
রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র সাঈদ কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন বলে জানা যাচ্ছে।
নিহত অন্য পাঁচজনকে ছাপিয়ে সাঈদকে নিয়ে বিভিন্ন মহলে বেশ আলোচনা হতে দেখা যাচ্ছে, যার মূলে রয়েছে ঘটনার সময় ধারণ করা কিছু ভিডিও।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ওইসব ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে যে- পুলিশের তাক করা অস্ত্রের বিপরীতে সাঈদ বুক পেতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।
এক্ষেত্রে পুলিশের অবস্থান ছিল বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকের সামনে। আর সাঈদ দাঁড়িয়ে ছিলেন ফটক থেকে সামান্য দূরে রাস্তার মাঝখানে।
এমন সময় পুলিশের সদস্যরা হঠাৎ রাবার বুলেট ছুড়তে শুরু করে।
তখন সাঈদের হাতে একটি লাঠি ছিল, যা দিয়ে তিনি গুলি ঠেকানোর চেষ্টা করেন।
এ ঘটনার পর বেশ কয়েক পা পিছিয়ে তিনি সড়কের বিভাজক পার হন এবং হঠাৎ মাটিতে বসে পড়েন।
পরে হাসপাতালে নেয়া হলে সাঈদের মৃত্যু হয় এবং তার শরীরে রাবার বুলেটের একাধিক ক্ষতচিহ্ন পাওয়া গেছে বলে জানায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওগুলোর একটি বিবিসি বাংলার হাতে এসেছে এবং সেটি আসল বলেই নিশ্চিত হওয়া গেছে।
ভিডিওতে সাঈদকে সহিংস বা আক্রমণাত্মক কোনোরূপে চোখে পড়েনি।
কিন্তু তারপরও পুলিশ কেন তাকে লক্ষ্য করে রাবার বুলেট ছুড়ল? বিকল্প কোনো উপায়ে কি তাকে সরানো বা নিবৃত্ত করা সম্ভব ছিল?
ঘটনা সম্পর্কে যা জানা যাচ্ছে
কোটা সংস্কারের দাবির সাথে সংহতি জানিয়ে গত কিছুদিন ধরেই আন্দোলন চালিয়ে আসছে রংপুরের একাধিক কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
আগের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-সহ অন্যান্য অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের উপর হামলার ঘটনার প্রতিবাদে মঙ্গলবার বেলা ৩টায় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সমবেত হওয়ার ঘোষণা দেন তারা।
মঙ্গলবার সকাল থেকেই আন্দোলনের গতিবিধির দিকে নজর রাখছিলেন রংপুরের স্থানীয় সাংবাদিক শাহরিয়ার মিম।
পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী বেলা ৩টার দিকে আন্দোলনকারীরা একযোগে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঢুকতে গেলেই পুলিশের সাথে সংঘর্ষ শুরু হয় বলে জানান তিনি।
‘পুলিশ লাঠিচার্জ শুরু করলে আন্দোলনকারীরা ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকে। পুলিশ এরপর টিয়ারশেল এবং রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন সাংবাদিক মিম।
পুলিশের কঠোর অবস্থানের মুখে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগই পিছু হটেন এবং আশপাশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেন।
‘কিন্তু কিছু শিক্ষার্থী তখনো বিশ্ববিদ্যালয় ফটকের আশপাশেই ছিল। তাদের মধ্যে আবু সাঈদ পুলিশের সামনে গিয়ে বুক পেতে দাঁড়ান,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন মিম।
পুলিশ শুরুতে আবু সাঈদকে অন্যত্র চলে যেতে অনুরোধ করে। কিন্তু সাঈদ বিষয়টি আমলে না নেয়ায় পরবর্তীতে তাকে লক্ষ্য করে রাবার বুলেট নিক্ষেপ করা হয়।
‘আহত হয়ে মাটিতে বসে পড়ার পর আন্দোলনকারীদের কয়েকজন তাকে উদ্ধার করে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয় এবং সেখানেই তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়,’ বিবিসি বাংলাকে জানান মিম।
নিহত আবু সাঈদের শরীরে একাধিক রাবার বুলেটের ক্ষত ছিল বলে বিবিসি বাংলাকে জানান রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা: মোহাম্মদ ইউনুস আলী।
‘মোর হাসিনা মোর ছেলোক মারি ফালালি’
নিহত আবু সাঈদের গ্রামের বাড়ি রংপুরে পীরগঞ্জ উপজেলার বাবনপুর গ্রামে।
তার বৃদ্ধ বাবা মকবুল হোসেন পেশায় একজন দিনমজুর, যারা ছেলে-মেয়ের সংখ্যা ৯ জন। অভাবের সংসারে এতগুলো ভাইবোনের মধ্যে একমাত্র সাঈদই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান।
‘হামরা কেউ এতদূর লেকাপড়া কইরবার পারিনে। হামার ভাইডে নিজে কষ্ট করে, টিউশনি করে পড়ছে,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন নিহতের বোন সুমি বেগম।
মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক, উভয় পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়ার পর সাঈদ ২০১৯ সালে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন।
সম্প্রতি তিনি স্নাতক পরীক্ষা শেষ করেন বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন তার বোন সুমি বেগম।
‘হামার মাও-বাপের কত আশা, হামার ছেলি একটা চাকরি করবি। ভাইডে হামার মরি গেল। হামার মাওডে এখন কেঙ্গিরি বাঁচে,’ আহাজারি করতে করতে বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
ভাইয়ের অকাল মৃত্যুর ঘটনায় আক্ষেপ করে তিনি বলছিলেন, ‘তার হাতেত কোনো অস্ত্র আছিল না। তার পাও দুডো ভাঙি দিলো না, হাত একটা ভাঙি দিল না। আমরা চিকিৎসা করি কথা বলি দুডো শান্তি পানু।’
‘ভায়োক হামার এভাবে মারাডা ঠিক হয় নাই। এর বিচার চাই,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন তিনি।
অন্যদিকে, সন্তানকে হারিয়ে পাগলপ্রায় সাঈদের মা মনোয়ারা বেগম।
আক্ষেপের সুরে তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘মোর হাসিনা মোর ছেলোক মারি ফালালি।’
উল্লেখ্য যে- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শ্বশুরবাড়ি রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলায়। ফলে স্থানীয়দের অনেকেই তাকে নিজেদের ঘরের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করেন।
‘মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন’
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে গুলি করে পুলিশ মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে বলে জানাচ্ছেন অধিকার কর্মীরা।
‘দাবি আদায়ে নিজের মত প্রকাশ করা, আন্দোলন করা- এগুলো নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার, যার স্বীকৃতি আমাদের সংবিধানেও রয়েছে,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক ফারুক ফয়সাল।
‘সেখানে আন্দোলনকারী নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের উপর পুলিশ কিভাবে গুলি চালায়! এই আক্রমণ বরদাস্ত করা যায় না। এটি করে পুলিশ মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করেছে,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন ফয়সাল।
তার মতে, গুলি না চালিয়েও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের নিবৃত্ত করার সুযোগ পুলিশের ছিল।
‘ছেলেটার কাছে যেহেতু প্রাণঘাতী কোনো অস্ত্র ছিল না, কাজেই পুলিশের সহিংস হওয়ার কোনো দরকার ছিল না,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন ফয়সাল।
এক্ষেত্রে প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা নিয়েও তাকে ঘটনাস্থল থেকে সরানো যেত বলে মনে করেন তিনি।
‘কিন্তু পুলিশ সেটি না করে গুলি ছুড়লো। নিরীহ মানুষের উপর এমন আক্রমণ মোটেও মেনে নেয়া যায় না,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক ফয়সাল।
পুলিশ কী বলছে?
বাংলাদেশে পুলিশের কার্যক্রম মূলত, পরিচালিত হয় ‘পুলিশ আইন, ১৮৬১’, ‘ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮’ এবং ‘পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল, ১৯৪৩’ নামের তিনটি আইনের মাধ্যমে।
এই আইনগুলো সবক’টিই ব্রিটিশ শাসনামালে তৈরি।
এসব আইনে বিশেষ কিছু অবস্থায় পুলিশকে শক্তি প্রয়োগ, এমনকী গুলি করারও এখতিয়ার দেয়া হয়েছে।
কিন্তু সেটি কখন?
‘গুরুত্বপূর্ণ সম্পদের নিরাপত্তা বিধান এবং আত্মরক্ষার্থে গুলি চালানোর এখতিয়ার পুলিশকে আইন দিয়েছে। তবে সেটি প্রপরশনেট লেভেল বা যৌক্তিক মাত্রায় হতে হবে,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মুহম্মদ নূরুল হুদা।
মঙ্গলবার দুপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে কি সে ধরনের কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল?
‘কোন পরিস্থিতিতে গুলি চালানো হয়েছে এবং এক্ষেত্রে আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটেছে কি না, সেটি খতিয়ে দেখার জন্য ইতোমধ্যেই আমরা চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছি এবং একটি মামলাও করা হয়েছে,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মো: মনিরুজ্জামান।
আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে তদন্ত শেষ ওই কমিটির প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা রয়েছে।
‘তদন্তে পুলিশের অভিযুক্ত সদস্যদের কারো দোষ প্রমাণিত হলে বিভাগীয় শাস্তির পাশাপাশি প্রচলিত আইনেও বিচার করা হবে,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন পুলিশ কমিশনার মনিরুজ্জামান।
সূত্র : বিবিসি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা