রংপুরে নেসকোর সভায় মুজিববর্ষের ছবি নিয়ে তুমুল হট্টগোল
তদন্ত কমিটি গঠন, মিটার স্থাপন বন্ধ- সরকার মাজহারুল মান্নান, রংপুর ব্যুরো
- ১৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১৭:৩০
রংপুরে নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাইয়ের (নেসকো) প্রি-পেমেন্ট মিটার স্থাপনবিষয়ক মতবিনিময় সভার প্রেজেন্টেশনে বঙ্গবন্ধুর ছবিসহ মুজিব শতবর্ষের লোগো ব্যবহার করা নিয়ে তুমুল হট্টগোলের পর সভা পণ্ড হয়ে গেছে।
সোমবার (১৩ জানুয়ারি) রংপুর ডিসি অফিসের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় এ ঘটনা ঘটে।
সভাকক্ষেই তীব্র প্রতিবাদ করে উপস্থিত অংশীজনরা বলেন, পরিকল্পিতভাবে ফ্যাসিবাদ পুনর্বাসনের নকশা বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে প্রশাসন।
ডিসি জানান, সমাধান না হওয়া পর্যন্ত রংপুরে প্রি-পেমেন্ট মিটার লাগানোর কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। অভিযুক্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগ্রহণের জন্য লিখিত অভিযোগ জানানো হবে।
এরই মধ্যে নেসকো দুঃখ প্রকাশ করে তদন্ত কমিটি গঠনের ঘোষণা দিয়েছে।
উল্লেখ্য, প্রি-পেমেন্ট মিটারের নানা অসঙ্গতি তুলে ধরে তা স্থাপন বন্ধের দাবিতে এক সপ্তাহ থেকেই প্রতিবাদমুখর রংপুর। রোববার দাবি আদায়ের জন্য সাত দিনের আল্টিমেটাম দেয়া হয়। তবে সব দাবি উপেক্ষা করেই নেসকো বিভিন্ন স্থানে মিটার স্থাপনের কাজ শুরু করেছে।
এ অবস্থায় নেসকো সোমবার বেলা সোয়া ১১টায় রংপুর ডিসি অফিস হলরুমে বিষয়টি নিয়ে অংশীজনদের সাথে একটি মতবিনিময় সভার আয়োজন করে। সভায় ডিসি মোহাম্মদ রবিউল ফয়সাল সভাপতি হিসেবে স্বাগত বক্তব্য রাখেন। এরপর রংপুর ও রাজশাহী বিভাগে নেসকোর আওতাধীন এলাকায় স্মার্ট প্রি-পেমেন্ট মিটার স্থাপন প্রকল্পের প্রেজেন্টেশন দেন প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী সাইদুল মুরসালিন। তিনি প্রেজেন্টেশন শুরুতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবিসহ মুজিবর্ষের লোগো সংবলিত পেপার। চোখে পড়া মাত্রই প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে পুরো হলরুম।
এ সময় উপস্থিত জাতীয় নাগরিক কমিটি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং প্রি-পেমেন্ট মিটার স্থাপন প্রকল্প বাতিলের সাথে যুক্ত আন্দোলনের নেতারা তীব্র প্রতিবাদ জানান। এ ঘটনাকে পরিকল্পিতভাবে ফ্যাসিবাদ পুনর্বাসনের নকশা হিসেবে উল্লেখ করেন তারা।
রংপুর মহানগর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক ইমতিয়াজ আহমেদ ইমতি বলেন, ‘নেসকো প্রি-পেমেন্ট মিটার স্থাপন বিষয়ে মতবিনিময় সভার প্রেজেন্টেশনে মুজিববর্ষের লোগো ব্যবহার করে অন্তর্বর্তী সরকার ও ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। এটা কোনো ভুল নয় বরং পূর্বপরিকল্পিত। তারা ফ্যাসিবাদের সুবিধাভোগী। তারা ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে প্রমোট করতে চাইছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘নেসকোর সব ফ্যাসিবাদী কর্মকর্তাকে অপসারণ করতে হবে। বিভিন্ন প্রকল্পের দুর্নীতির তদন্ত করতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করে শাস্তি দিতে হবে। তা না হলে আমরা মাঠে নামতে বাধ্য হবো।’
রংপুর জাতীয় নাগরিক কমিটির সংগঠক আলমগীর নয়ন বলেন, ’নেসকো সুকৌশলে সভায় মুজিববাদ বহালের অপচেষ্টা করেছে। এর সাথে উপস্থাপনকারী নেসকোর প্রধান প্রকৌশলীসহ অন্য সবাই জড়িত। আমাদের কাছে তথ্য আছে নিয়োগের সময় তিনি ১০ নম্বরে ছিলেন। সেখান থেকে লাফ দিয়ে ১ নম্বর হয়ে নিয়োগ পেয়েছেন। আওয়ামী লীগের সরাসরি মেকানিজমে তিনি নিয়োগ পেয়েছেন। তাকে দ্রুত অপসারণ করতে হবে।’
এ সময় তিনি জেলা প্রশাসককে উদ্দেশ করে বলেন, ‘অবশ্যই ডিসিকে এসব বিষয়ে সচেতন হতে হবে। এ ধরনের ঘটনা বারবার হচ্ছে। এতে আমাদের ২৪-এর আন্দোলনকে খাটো করা হচ্ছে। এটা আমরা মেনে নেব না।’
সভাকক্ষে উপস্থিত স্থানীয় সংগঠন রংপুর মহানগর নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব পলাশকান্তি নাগ এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেন, ‘প্রি-পেমেন্ট মিটার প্রকল্পটি ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলের অর্থ লোপাটের একটি প্রকল্প। এর মাধ্যমে বিদেশে হাজার হাজার কোটি পাচার করেছে পতিত সরকার। আমরা গত এক সপ্তাহ থেকে আন্দোলন করছি এই মিটার স্থাপন না করার জন্য। কিন্তু তারপরেও নেসকো প্রকল্পের নামে অর্থ তছরুপের জন্যই জনগণের দাবি উপেক্ষা করে মিটার লাগাচ্ছিল। তারা যে ফ্যাসিস্টের অনুসারী সেটা প্রমাণ হলো সভায় মুজিববর্ষের লোগো ব্যবহার করে। আমরা এই মিটার স্থাপন বন্ধের পাশাপাশি যারা ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে পুনর্বাসনের চেষ্টা করছেন নেসকো থেকে তাদের অপসারণ চাই।’
এদিকে প্রতিবাদের মুখে পণ্ড হয়ে যায় সভা।
পরে নেসকো তদন্ত কমিটি গঠনের কথা জানায়।
ডিসি জানান, এই ঘটনার সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ বন্ধ থাকবে।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত নেসকো রংপুরের প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল ইসলাম মন্ডল বলেন, ’এই ঘটনা অনাকাঙ্ক্ষিত। আমি দুঃখ প্রকাশ করছি। কিভাবে এটা হলো তা জানার জন্য আমরা তদন্ত কমিটি গঠন করে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিব।’
সভার সভাপতি রংপুরের ডিসি মোহাম্মদ রবিউল ফয়সাল বলেন, ’প্রি-পেমেন্ট মিটার স্থাপন নিয়ে জনগণের দাবির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতেই আমরা সভাটির আয়োজন করেছিলাম। কিন্তু সভায় তাদের প্রেজেন্টেশনে মুজিবর্ষের লোগো ছিল। এটা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। সকলেই আমরা এটার প্রতিবাদ করেছি। আমরা মনে করছি সভাটাকে বিতর্কিত করার জন্যই এটা করা হয়েছে। আমরা আর সভা করতে পারিনি। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি এ বিষয়ে সমাধান না হওয়া পর্যন্ত রংপুরে প্রি-পেমেন্ট মিটার লাগানো কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। একই সাথে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগ্রহণের জন্য চিঠি দিয়েছি। এছাড়াও প্রি-প্রেমেন্ট মিটার কার্যক্রম বন্ধের জন্যও আমরা সংশ্লিষ্ট দফতরে চিঠি দিয়েছি।’
এদিকে, মিঠাপুকুরে জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মেলায় ছাত্র-ছাত্রীদের পরিচয়পত্রেও মুজিববর্ষের লোগো ব্যবহার করায় তোলপাড় চলছে।
এর আগে গত ২২ ডিসেম্বর তথ্যমেলায় শেখ হাসিনা ও শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি সংবলিত লিফলেট বিতরণ করার ঘটনায় জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি দফতরের সহকারী পরিচালক মালিক মোহাম্মদ তৈমুর গোফরানকে বরগুনায়, জেলা সঞ্চয় ব্যুরোর সহকারী পরিচালক মো: মোক্তারুজ্জামানকে ঠাকুরগাঁওয়ে বদলি এবং জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. মুহাম্মদ সালাহ উদ্দিন কবিরকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।