হিন্দু পল্লীতে আগুন : মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে মানববন্ধন
আ’লীগ নেত্রী ববি, পুলিশসহ জড়িদের গ্রেফতার দাবি- সরকার মাজহারুল মান্নান, রংপুর ব্যুরো
- ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২০:৩১, আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২০:৩৮
হিন্দু পল্লীতে আগুনের ঘটনায় হওয়া মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে মানববন্ধন করেছে জামিনে থাকা চার্জশিটভুক্ত ২৮৮ জন আসামি ও তাদের পরিবার। এ সময় রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন এবং মামলা বাণিজ্যের অভিযোগ করেন তারা।
বৃহস্পতিবার (২৮ নভেম্বর) বিকেলে রংপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে এ মানববন্ধন করে তারা।
এ সময় বক্তব্য রাখেন মামলার চার্জশিটভুক্ত জামিনে থাকা আসামি রংপুর জেলা পরিষদের সাবেক প্রকৌশলী ফজলার রহমান, রংপুর মডেল কলেজের সাবেক উপাধ্যক্ষ তৌহিদুর রহমান রাজু, পীরগাছা উপজেলার ইসরাফিল ইসলাম, তারাগঞ্জের হাফেজ মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসাইন, কাজি মাওলানা রফিকুল ইসলাম, মুসাব্বিরুল প্রামানিক রুবেল প্রমুখ।
এ সময় ফজলার রহমান বলেন, ‘২০১৭ সালের ১০ নভেম্বর ঠাকুরপাড়ার পরিকল্পিত ঘটনায় মামলা দিয়ে পরবর্তী সময়ে আমাদের ২৮৮ জনের নামে মিথ্যা চার্জশিট দেয়া হয়। আমার স্ত্রী ইউনিয়ন চেয়ারম্যান হওয়ার কারণে তৎকালীন উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেত্রী ঘটনাস্থলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসুদুজ্জামান খান কামালকে নিয়ে এসে প্রকাশ্যে ওই ঘটনার সাথে আমাকে অভিযুক্ত করে বক্তব্য দেন। এরপর পুলিশ ওই মামলায় আমাকে আসামি করে। ৪৬ দিন নিজের বাড়ি-ঘর ছেড়ে বিভিন্ন জায়গায় আমি লুকিয়ে থাকি। এরপর পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করে অন্যায়ভাবে ২৪ দিনের রিমান্ডে নেয়। রিমান্ডে নিয়ে হাইকোর্টের নির্দেশনা না মেনে আমার ওপর শারীরিক ও মানসিক অবর্ণনীয় নির্যাতন করে। যার কারণে এখনো আমি স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারছি না। এখনো আমার পা ব্যথায় টনটন করে। ঘুমাতে পারি না। নির্যাতনের কারণে আমার হাইড্রোসেল অপরাশন করতে হয়েছে। শুধু তাই নয়, রিমান্ডে নির্যাতন করবে না মর্মে ওই সময় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মোহাম্মদ আলী আমার স্ত্রী, ভাই ও মামার কাছ থেকে তৎকালীন এসপি মিজানুর রহমান, এডিশনাল এসপি মারুফ, সহকারী পুলিশ সুপার সাইফুর রহমানকে দেয়ার নাম করে ২০ লাখ টাকা নিয়েছে। কিন্তু রিমান্ডে আমাকে সর্বোচ্চ নির্যাতন করেছে।’
ফজলার রহমান কাঁদদে কাঁদতে বলেন, ‘আমি জেলা পরিষদে ৩৩ বছর সুনামের সাথে চাকরি করেছি। কিন্তু এই মামলার কারণে এখনো আমি পেনশনসহ সরকারি কোনো ভাতা পাচ্ছি না। এসব কিছু করেছে আওয়ামী লীগ নেত্রী নাছিমা জামান ববি। উপজেলা চেয়ারম্যান পদে আমার স্ত্রীর সাথে ভোট কারচুপির মাধ্যমে জয়লাভ করে। এর প্রতিবাদ করায় ভবিষ্যতে তার ভোটের মাঠে আমার স্ত্রী এবং আমাকে প্রতিপক্ষ মনে করায় আমাদেরকে ধ্বংস করে দিতেই ববি তার সন্ত্রাসী বাহিনীর সহযোগিতায় আমাকে এ মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়।’
ফজলার বলেন, ‘মহানবী স:-কে নিয়ে ফেসবুকে হিন্দু যুবক টিটু রায়ের আপত্তিকর পোস্টকে ঘিরে ওইদিন জুমআর নামাজ শেষে শান্তিপূর্ণ মিছিল করে এলাকার মুসল্লিরা। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেত্রী নাছিমা জামান ববির নির্দেশে তার কর্মী পলাশ, নুপুর, হৃদয়, স্বাধীন, মিন্টু ও বিকাশ টিটু রায়ের বাড়িতে আগুন দিয়ে তা মুসল্লিদের ওপর চাপিয়ে দেয়। নয়া দিগন্ত পত্রিকার ইউটিউবে ওই ঘটনার ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে তাতে বিষয়টি ধরা পড়ে। শুধু তাই নয়, ঘটনার সময় মুসল্লিদের ওপর আলী নামের এক এসআইয়ের নেতৃত্বে গুলি করে হাবিবুর রহমান নামের এক ভ্যানচালককে হত্যা করে। অপর ভ্যানচালক মাহবুবুল ইসলামের চোখ পুলিশের গুলিতে অন্ধ হয়ে যায়। ওই সময় আওয়ামী লীগ নেত্রী ববি ও পুলিশ হাবিবুর রহমানের পরিবারকে চাপ দিয়ে মামলা থেকে বিরত রাখে।’
ফজলার বলেন, ‘হয়রানিমূলক ওই মিথ্যা মামলা আমি প্রত্যাহার চাই। একইসাথে হাবিবুর রহমান হত্যার বিচার এবং ওইদিনের ঘটনার প্রকৃত তদন্ত করে জড়িতদের গ্রেফতার ও বিচার দাবি করছি।’
পীরগাছা উপজেলার সদর ইউনিয়নের ইসরাফিল মিয়া জানান, ‘আমার বাড়ি ঘটনাস্থল থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে। আমি আজ পর্যন্ত ঘটনাস্থল চিনি না। অথচ আমাকে পীরগাছা থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে এসে আমাকে ওই মামলায় আসামি বানিয়েছে। আমি অনেক দিন কারাগারে ছিলাম। আমার ব্যবসা বাণিজ্য ধ্বংস হয়ে গেছে।
পরবর্তী সময়ে আমি জানতে পারি, আ’লীগ নেত্রী নাছিমা জামান ববি ও তার সন্ত্রাসী বাহিনী ও পুলিশ টিটুর বাড়ি-ঘর থেকে মালামাল সরিয়ে দিয়ে পলাশ ও নুপুরসহ কয়েকজনকে দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ ঘটনায় পীরগাছা, কাউনিয়া, তারাগঞ্জ, পীরগঞ্জসহ পাশের জেলার বিএনপি ও জামায়াত নেতাকর্মী ও সাধারণ মুসল্লিদের ধরে এনে মামলায় ফাঁসিয়ে দেয় এবং মামলা বাণিজ্য করে।
মানববন্ধনে ইসরাফিল দাবি করেন, ‘আওয়ামী লীগ নেত্রী নাছিমা জামান ববি ও তার সন্ত্রাসী বাহিনীর লিডার পলাশকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিলেই ওই দিনের ঘটনার প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে। কারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের জন্য এ ঘটনা ঘটেছে সেটা স্পস্ট হয়ে যাবে। এ ঘটনায় করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারেরও দাবি জানান তিনি।’
তারাগঞ্জ উপজেলার হাড়িয়ারকুঠি ইউনিয়নের বাসিন্দা জামায়াত কর্মী হাফেজ মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসাইন বলেন, ‘আমি ওইদিন সেখানে মিছিলেই যাইনি। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেত্রী নাছিমা জামান ববির মাধ্যমে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতারা আমার নাম ঢুকিয়ে দেয় মামলায়। আমাকে গ্রেফতার করে ১৪ দিনের রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করে। এখনো আমি স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারছি না। এছাড়াও মামলা থেকে নাম কাটানোর জন্য এ ঘটনায় করা দু’টি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কোতয়ালী থানার এসআই ফেরদৌস এবং গঙ্গাচড়া থানার এসআই আলী অনেক টাকাও নেয়। ওই সময় কথা বলার কোনো উপায় ছিল না। এখন আমরা চাই ওই ঘটনায় যারা আগুন দিয়েছে। তাদেরকে যারা নির্দেশ দিয়েছে। নিরপেক্ষ তদন্ত করলেই সেটি বের হয়ে যাবে। ওই ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও আছে। তদন্ত করে মূল অপরাধীদের গ্রেফতার এবং বিচার চাই। আমাদের নিরাপরাধ মানুষদের নামে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার চাই।’
মানববন্ধনের সভাপতি রংপুর মডেল কলেজের সাবেক উপাধ্যক্ষ তৌহিদুর রহমান রাজু বলেন, ‘ঘটনার দিন আমি ছিলাম আমার রংপুর শহরের বাসায়। আমার সাথে ওই সময়কার কলেজ অধ্যক্ষের ঝামেলা চলছিল। তখন কলেজের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতির মাধ্যমে আমাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর ওই মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আসামি করা হয়েছে। এই ঘটনার সাথে আওয়ামী লীগ নেত্রী ববিসহ যারা জড়িত তারা এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের গ্রেফতার করতে হবে এবং মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করে সংশ্লিষ্টদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। তা না হলে আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাবো।’
পরে তারা ডিসির কাছে একই দাবিতে স্মারকলিপি দেন।
উল্লেখ্য: ২০১৭ সালের ২৯ অক্টোবর মহানবী স: ও পবিত্র মক্কা শরীফকে অবমাননা করে ফেসবুকে ছবি আপলোড ও স্ট্যাটস দেয় গঙ্গাচড়ার খলেয়া ইউনিয়নের ঠাকুরটারি গ্রামের খগেন্দ্র নাথের ছেলে টিটো নাথ। এ ঘটনায় টিটোর বিরুদ্ধে গঙ্গাচড়া থানায় মামলা করেন লালচাঁদপুর গ্রামের মুদি দোকানি আলমগীর হোসেন। কিন্তু তাকে পুলিশ গ্রেফতার না করায় ১০ নভেম্বর শুক্রবার ওই যুবককে গ্রেফতারের দাবিতে জুমআর নামাজের পর স্থানীয় হরকলি বাজারে মানববন্ধন করে এলাকাবাসি। মানববন্ধন শেষে বিক্ষোভ চলাকালে টিটুর বাড়িতে আগুন দেয়ার অভিযোগ উঠে মুসল্লিদের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে পুলিশের গুলিতে নিহত হন হাবিবুর রহমান নামের মুসল্লি। গুলিবিদ্ধসহ আহত হন অন্তত ২০ জন। গুলিবিদ্ধ মাহবুবুর রহমান নামের এক মুসল্লির চোখ অন্ধ হয়ে যায়। এই ঘটনায় গঙ্গাচড়া ও কোতয়ালী থানায় ১৫৯ জনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাত আরো দুই হাজারের অধিক লোককে আসামি করে দু’টি মামলা হয়। পরবর্তী সময়ে ২৮৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হয়। তাদের সবাই জামিনে আছেন। এরমধ্যে তিনজন মারা গেছেন।
ওই ঘটনা নিয়ে ২০১৭ সালের ১৩ নভেম্বর নয়া দিগন্তের ইউটিউব চ্যানেলে (https://www.youtube.com/watch?v=r_vG8uazMK4) একটি ভিডিও প্রকাশ ও ১৪ নভেম্বর নয়া দিগন্তে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। তাতে উঠে আসে পলাশ ও নুপুর নামের দু’জন নারী ও পুরুষ হিন্দু যুবক টিটো রায়ের বাড়িতে আগুন দেয়ার সাথে যুক্ত। এ নিয়ে তখন নয়া দিগন্তের প্রতিবেদককেও চাপে রাখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগ নেতারা প্রচণ্ড চাপে রাখে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা