২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

রোজাদারকে বিদেশীদের সম্মান

২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচে ব্রাজিলের মারাকানা স্টেডিয়ামে লেখক - ছবি : নয়া দিগন্ত

পেশাগত কারণে বিভিন্ন সময় দেশের বাইরে রমজান মাস কাটাতে হয়েছে। বিশেষ করে খেলাধূলার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইভেন্ট রমজান মাসে অনুষ্ঠিত হলে এই অভিজ্ঞতা হয়েছে। ২০১৪ বিশ্বকাপের সময় রোজার বড় একটি অংশ কেটেছে ব্রাজিলে। এছাড়া অলিম্পিক গেমস ও বাংলাদেশ ফুটবল দলের বিভিন্ন ট্যুরের সময় বিদেশে রোজ পালনের অভিজ্ঞতা হয়েছে।

২০১১ সালে নেপাল গিয়ে ছিলাম প্রথম সাফ অনূর্ধ্ব -১৬ ফুটবল কাভার করতে। তখন ছিল রোজার মাস। খেলা ছিল না এমন একদিনে রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে রওয়ানা হলাম পর্যটন শহর নাগোরকোটের উদ্দেশ্যে। যেখান থেকে এভারেষ্ট দেখা যায়। হিমালয়ের লাং থাং রেন্ঝ তো খুব কাছ থেকেই চোখের সামনে স্পষ্ট ভেসে উঠে আকাশ পরিষ্কার থাকলে। নাগোরকোট পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল হয়ে গেল। ইফতারের সময় ছুঁই ছুঁই। থাকার হোটেলের সন্ধানে না গিয়ে ইফতারের জন্য ছুটলাম।

খুবই ছোট শহর নাগোরকোট। শহরের মর্যাদায় ফেলাটাও হবে অন্যায়। যাই হোক ছোট এটা খাবার হোটেলে ঢুকলাম ইফতার করার জন্য। ছোলা পেলাম। সাথে নুডুলস (ওরা বলে চওমিন)মহিষের মাংসের মমো (সিঙ্গারা জাতীয় ) আর পানি নিয়ে বসলাম ইফতার করতে।

খোঁজ নিয়ে জানলাম নাগোরকোটে একটি মাত্র মুসলিম পরিবার আছে। সে পরিবারের পুরুষ সদস্যটি রোজা রাখে না। আমার আশেপাশে আরও কয়েক জন নেপালি বসে খাবার গ্রহণ করছিল। আমি তখনও বসে আছি সন্ধ্যা হওয়ার জন্য। নাগোরকোটে কোন মসজিদ নেই। সুতরাং আজান শোনা যাবে না। আমার খাবার সামনে রেখে চুপচাপ বসে থাকা দেখে ওই নেপালিদের প্রশ্ন আমি কেন খাচ্ছি না।

উত্তরে জানালাম , আমি রোজাদার। সূর্য ডোবার অপেক্ষায় আছি। সূর্য ডুবলেই খাবো। আমি রোজা রেখেছি এ কথা শুনেই মদ পানরত কয়েকজন মুহুর্তেই উঠে পেছনের রুমে চলে গেল। আর কোন কারণ নেই, আমার রোজাকে সম্মান দেখিয়ে সরে পড়ল তারা। তারা হিন্দু অথবা বৌদ্ধ হবেন। তাদের এই আচরণে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম।

২০১২ সালে অলিম্পিক গেমস কাভার করতে গিয়েও খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বীদের কাছ থেকে অনেক সম্মান পেয়েছি একজন রোজাদার হিসেবে। গালফ এয়ারে ফেরার সময় মুসলিম বিমান বালার সহযোগিতাও স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ভোর রাতের দিকে সে আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দেয় সেহেরি খাওয়ার জন্য।

আর ২০১৪ সালে ব্রাজিল থেকে ফেরার সময় টার্কিশ এয়ার লাইন্সের বিমানবালার আচরণ আরো বেশি মুগ্ধ করেছিলো আমাকে। ওই ফ্লাইটে সম্ভবত আমিই একমাত্র রোজাদার ছিলাম। বিমানে ওঠার পর আমাকে যে খাবার তারা আমাকে দিয়েছিল তা ইফতার করার জন্য রেখে দিলাম। এক্ষেত্রেও কেন যথাসময়ে খাচ্ছি না এর উত্তর দিতে হলো।

দেড়-দুই ঘণ্টা পর ইফতারের সময় হতেই দেখলাম এক বিমানবালা খুব জোরে হেঁটে আমার পাশ দিয়ে চলে গেল। আমি তখন খাবারের প্যাকেট খুলছি মাত্র। আবার দ্রুত সে আমার পাশে এসে হাজির। সাথে নিয়ে আসা খেজুর আমাকে দিয়ে বলল, নিন ইফতার করুন। ঘাড় ঘুরিয়ে ওই বিমান বালাকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারলাম না। মানে তাদের কাছে খবর চলে গেছে আমি রোজা রেখেছি । এখন তাদের দায়িত্ব আমার খেদমত করা । খেজুর যে ইফতারের গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ, সেটিও সে বুঝতে পেরেছে।

অবশ্য দু’একটি ভিন্ন অভিজ্ঞতাও আছে। তবে ২০১১ সালেই নেপালের কাঠমান্ডুর সুন্দরার কাঠের মসজিদে ইফতারের সময় এবং বিশ্বকাপের সময় ব্রাজিলের সাও-পাওলোর ব্রাস মসজিদে ইফতারের সময় দুই মুসলমানের আচরণ বেশ বিস্মিত করেছে আমাকে। দু’টিই ছিল ইফতারি কম থাকার ঘটনা নিয়ে। সুন্দরার মসজিদে কিছু ইফতার সামগ্রী দেয়া হয়েছিল আমি ও আরেক জনকে ভাগাভাগি করে খাওয়ার জন্য। অথচ দেখলাম ওই রোজাদার সবটুকুই নিজে নিয়ে নিল।

আমি শুধু হাসলাম। ব্রাস মসজিদেও একই কাহিনী। বিভিন্ন দেশের প্রবাসী মুসলিমরা ইফতার করতো ওই মসজিদে। বাংলাদেশি, পাকিস্তানি, আফগান, সিরীয়, লেবাননী, মিসরীয় ও আফ্রিকান বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা একসাথে ইফতারী করতো। মসজিদ কমিটিই এই ইফতারের আয়োজক। একদিন ইফতারের প্যাকেট কম ছিল। আমার সিরিয়াল যখন এল তখন ইফতারি বিলি করা মিসরীয় নাগরিক বলল আজ প্যাকেট কম দু’জনের জন্য এক প্যাকেট। আমার সাথেই ছিল এক সিরীয়।

আমরা দু’জন মিলে পেলাম এক প্যাকেট। সে আমাকে বলল আমি টেবিলে গিয়ে বসছি, তুমি আসো। এরপর আমি সালাদের প্যাকেট নিয়ে টেবিলের কাছে গিয়ে দেখি ওই সিরীয় আর নেই। সব টেবিলেই খুঁজলাম, পেলাম না। অবাক হলাম তার আচরণ। পরে কয়েক বাংলাদেশির সাথে শেয়ার করে ইফতার পর্ব সম্পন্ন করলাম। প্রতিটি প্যাকেটে একজনের জন্য যে পরিমাণ ইফতারি দেয়া হতো তা প্রয়োজনের চেয়ে বেশী থকতো। তারপরও ওই সিরীয় লোকটি কেন লোভ সামলাতে পারলো না। অবশ্য ৫৫/৫৬ বছর বয়সী এক আরবকে দেখতাম প্রতিদিন দুই প্যাকেট করে ইফতারী খেতে।

লেখক : সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার, দৈনিক নয়া দিগন্ত


আরো সংবাদ



premium cement