২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

কবি বন্দে আলী মিয়ার পৈত্রিক বাড়িটি পড়ে আছে অযত্ন অবহেলা দৈন্যদশায়

এখনো প্রকাশিত হয়নি অসংখ্য পাণ্ডুলিপি
- ছবি : নয়া দিগন্ত

‘আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর, থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর। পাড়ার সকল ছেলে মোরা ভাই ভাই, এক সাথে খেলি আর পাঠশালে যাই। আমাদের ছোট গ্রাম মায়ের সমান, আলো দিয়ে, বায়ু দিয়ে বাঁচাইছে প্রাণ।’ এই ধরনের অসংখ্য গানের রচয়িতা পাবনার কৃতি সন্তান কবি বন্দে আলী মিয়া।

পাবনায় রাধানগর-নারায়ণপুরে শিশু সাহিত্যিক ও বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন কবি বন্দে আলী মিয়ার পৈতৃক বাড়িটি যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পড়ে আছে। ভদ্র, বিনয়ী, মৃদুভাষী, ধীর বুদ্ধির ও শান্ত কবির ১১৮ বছরের পুরনো বাড়িটি প্রায় ছয় বিঘা জমিতে ঘাস-জঙ্গলে ঢাকা। ভগ্নাদশা ভবনের জানালা ও দরজা নষ্ট হয়ে গেছে। ভবনের ছাদসহ অনেক জায়গায় গাছপালা জন্মেছে। পুরো বাড়িটাই বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।

উল্লেখ্য, কবি বন্দে আলী মিয়া ১৯০৬ সালের ১৭ জানুয়ারি পাবনা জেলা শহরের রাধানগর-নারায়ণপুর মহল্লায় একটি নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ৭৩ বছর বয়সে ১৯৭৯ সালে ২৭ জুন রাজশাহীতে তিনি মারা যান। তার বাবা মুন্সী উমেদ আলী পাবনা জজকোর্টে চাকরি করতেন। কবি বন্দে আলী মিয়া সারা জীবন দারিদ্র্যের সাথে সংগ্রাম করেছেন। তিনি রাজশাহী বেতারে চাকরি করতেন। তিনি নিরলসভাবে তার সাধনায় মগ্ন ছিলেন।

কবি বন্দে আলী মিয়া গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের আচার-আচরণ ও চরিত্রের বৈশিষ্ট্য এবং গ্রামীণ দৃশ্যগুলোকে ছড়ায় আকর্ষণীয় উপায়ে চিত্রিত করেছেন।

বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন কবি বন্দে আলী মিয়া। শিশু সাহিত্যিক কবি বন্দে আলী মিয়া কোমলমতি শিশুদের জন্য অসংখ্য কবিতা, ছড়াসহ প্রবন্ধ, উপন্যাস লিখে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। কিন্তু বাংলার কবি, প্রকৃতির কবি, গণমানুষের কবি বন্দে আলী মিয়ার পৈত্রিক বাড়িটি বড়ই অবহেলা ও দৈন্যদশা পড়ে আছে।

সম্প্রতি কবির বাড়িতে গিয়ে কবির ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনিদের সাথে কথা হয় প্রতিবেদকের। তারা জানান, ‘কবি বন্দে আলী মিয়া ছিলেন মা-বাবা এক মাত্র সন্তান। তার তিন মেয়ে ও ছয় ছেলের মধ্যে জীবিত আছেন ছোট ছেলে রমিজুল ইসলাম (৬২) ও দুই মেয়ে যথাক্রমে দিলরুবা বেগম ( ৬৭) ও আফরোজা বেগম(৬৮)।

রমিজুল ইসলাম হলেন বাকপ্রতিবন্ধী। তিনি অত্যন্ত অসহায় অবস্থায় দিনাতিপাত করছেন। অস্বচ্ছলতার কারণে বাবার বাড়িটি বিক্রির জন্য তারা অনলাইনে ঘোষণা দেন। ঘোষণাটি দৃষ্টিতে আসলে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কর্মকর্তারা কবির বাড়িতে আসেন এবং পবিারের সদস্যদের সাথে কথা বলেন।

এদিকে, কবির মেয়ে আফরোজা বেগম জানান, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ বাড়িটির ঐতিহ্য রক্ষার্থে সংরক্ষণ করবে এবং এতে তার পরিবার সম্মত হয়েছেন।

আফরোজা বেগম আলাপচারিতাকালে বলেন, ‘আব্বা রাজশাহী বেতার থেকে বাড়িতে এসে কিছু খাওয়ার শেষেই কলম নিয়ে টেবিলে বসে লেখা শুরু করতেন। আমরা কখনো তার রাগ দেখিনি। মেয়েদের ডাকার আগে মা শব্দটি ব্যবহার করতেন। অত্যন্ত ধীর মস্তিস্কে যেকোনো কাজ করতেন। আমার বাবা বেশিরভাগ সময় পাঞ্জাবি পায়জামা পরিধান করতেন।’

আফরোজা বেগম ও তাদের পরিবারের সদস্যরা আরো জানান, ‘ তার (কবি) লেখা অসংখ্য পাণ্ডলিপি বাংলা একাডেমিতে পড়ে আছে। অপ্রকাশিত ওই সমস্ত লেখা প্রকাশের ব্যবস্থা, বিভিন্ন বই থেকে বিতাড়িত কবির লেখা গল্প ও কবিতা পুনরায় সংযোজন করার জন্য অনুরোধ করেছেন।’

দীর্ঘদিন ধরে কবির পরিবারসহ শিল্প সংস্কৃতিসম্পন্ন পাবনাবাসী কবির বাসভবনকে ‘কবি বন্দে আলী মিয়া স্মৃতি জাদুঘর-সংগ্রহশালা’ বা মিউজিয়াম পার্ক, লাইব্রেরী বা আর্ট কেন্দ্র অথবা অন্য কিছু করার নিরলস প্রচেষ্টা করেও কোনো সাড়া না পাওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেন।

যদিও অতি সম্প্রতি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কর্মকর্তারা বাড়িটি পরিদর্শণ করেছেন এবং কবির বাড়িটির স্মৃতির ঐতিহ্য সংরক্ষণের আশ্বাস দিয়েছেন।

অনেক দিন আগে কিছু সংস্কৃতি ভাবাসম্পন্ন ব্যক্তির সমন্বয়ে ‘কবি বন্দে আলী মিয়া স্মরণ পরিষদ’ নামে একটি কমিটি গঠন করা হয়।

কমিটির আহ্বায়ক পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘খ্যাতিমান কবি বন্দে আলী মিয়ার স্মরণ করার জন্য এই কমিটি গঠন করেছি। নিজেদের সংগৃহীত অর্থ দিয়ে অন্তত কবির জন্মবার্ষিকী ও মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা হয়। আমি কবির বাড়িটির ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।’

কবি বন্দে আলী মিয়া কবিতায় আকর্ষণীয় ছন্দে গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষের জীবন-আচরণ, গ্রামের দৃশ্যপট চিত্রিত করেছেন। বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন কবি বন্দে আলী মিয়া একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, শিশু সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও চিত্রকর ছিলেন।

তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, কবি বন্দে আলী মিয়া ১৯২৩ সালে পাবনা শহরে মজুমদার একাডেমি থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। এরপর কলকাতা আর্ট একাডেমিতে ভর্তি হন এবং প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ওই সময় তিনিই ছিলেন সেখানকার একমাত্র মুসলিম ছাত্র। ১৯২৫ সালে ‘ইসলাম দর্শন’ পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। ১৯৩০ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত কলকাতা কর্পোরেশন স্কুলে শিক্ষকতা করেন। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর তিনি কলকাতা জীবনে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সান্নিধ্য লাভ করেন।

বিভিন্ন গ্রামোফোন কোম্পানি তার পালাগান ও নাটিকা রেকর্ড করে বাজারে ছাড়ে। তার প্রায় ২০০ গ্রন্থ রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, ময়নামতির চর, অনুরাগ, পদ্মানদীর চর, মধুমতির চর, ধরিত্রী, অরণ্য, গোধূলী, ঝড়ের সংকেত। শিশুতোষ গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, চোর জামাই, মেঘকুমারী, মৃগপরী, বোকা জামাই, কামাল আতাতুর্ক, ছোটদের নজরুল।

তিনি সহজ-সরল শব্দ চয়নে কবিতা নির্মাণ করে প্রতিভার সাক্ষও রেখেছেন। তিনি শুধু একজন কবি ছিলেন না, ছিলেন চিত্রকর, ইসক্রিপ্ট লেখক। ১৯২৭ সালে কলকাতার আশুতোষ লাইব্রেরী থেকে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘চোর-জামাই’ প্রকাশিত হয়। ১৯৩১ সালে কলকাতার ডিএম লাইব্রেরি থেকে তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘ময়নামতির চর’ প্রকাশিত হয়। এই কাব্যের মাধমে তিনি তৎকালীন কবিদের মধ্যে নিজের স্থান করে নেন এবং কবি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন।

তথ্যানুসন্ধানে আরো জানা গেছে, কবি বন্দে আলী মিয়ার কাব্য প্রতিভা প্রস্ফুটিত হতে শুরু করে কিশোর বয়সেই। পাবনার মজুমদার একাডেমিতে তিনি নবম শ্রেণির ছাত্র সময়কাল থেকেই কাব্য চর্চা শুরু করেন। ‘ছিন্নপত্র’ নামে তার প্রথম কবিতা নাটোরের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সী গেজেটে ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয়।

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর কবি বন্দে আলী মিয়া কলকাতা থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। ১৯৬৪ সালে ঢাকা বেতারে এবং পরে রাজাশাহী বেতারে যোগ দেন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সেখানেই কর্মরত ছিলেন।

কবি বন্দে আলী মিয়া শিশু সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য ১৯৬২ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ১৯৬৫ সালে প্রেসিডেন্ট পুরস্কার, ১৯৬৭ সালে প্রাইড অফ পারফরম্যান্স পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৭৮ সালে রাজশাহীর উত্তরা সাহিত্য মজলিস পদক পান। তিনি মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত হন।


আরো সংবাদ



premium cement