চাঁপাই সীমান্তে যেভাবে জড়ো হলো হাজারো মানুষ
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১৭:০৮
সম্প্রতি চাঁপাইনবাবগঞ্জে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে দুই দেশের কয়েক হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতি, মুখোমুখী অবস্থান ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া সীমান্ত উত্তেজনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সীমান্তে বিএসএফের বেড়া দেয়ার চেষ্টা করার দুই সপ্তাহের মধ্যে একই সীমান্তে উত্তেজিত জনতার বিপুল উপস্থিতি এবং আক্রমণাত্মক অবস্থান উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
সরেজমিনে সীমান্ত এলাকা ঘুরে দেখা যায়, স্থানীয় মানুষের মধ্যেও উদ্বেগ ও আতঙ্ক রয়েছে। সীমান্ত এলাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলেও যেকোনো সময় পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে পারে এমন আশঙ্কা পুরোপুরি কাটেনি।
২০২৫ সালের শুরু থেকেই সীমান্তের বিভিন্ন জায়গায় বিএসএফ এর কাঁটাতারের বেড়া দেয়াকে কেন্দ্র উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি ভারত বাংলাদেশের রাজনীতিতেও ইস্যু হচ্ছে।
সীমান্ত নিয়ে উদ্বেগের কারণ ১৮ জানুয়ারি ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে উভয় দেশের কয়েক হাজার মানুষ উপস্থিত হয়ে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় অংশ নেয়। বিজিবির হিসেবে বাংলাদেশ অংশে ১০ থেকে ১৫ হাজার মানুষ সীমান্তে উপস্থিত হয় সেদিন।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে এবং উত্তেজিত জনতা ছত্রভঙ্গ করতে বিএসএফ -এর কয়েক রাউন্ড টিয়ার শেল ছুঁড়তে হয়।
স্থানীয়রা বলছেন, সেখানে সাউন্ড গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটায় বিএসএফ। দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর তৎপরতায় শেষ পর্যন্ত বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা ছাড়াই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ-মালদহ সীমান্তে দুই দেশের জনগণের মধ্যে এরকম অবস্থান ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়ার ঘটনা আগে কখনোই ঘটেনি।
বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী গ্রামবাসীরা বলছেন, প্রয়োজন হলে আবার তারা সীমান্তে যাবেন এবং লড়তে প্রস্তুত আছেন।
ঘটনার পর দুই দেশের সীমান্তে সাধারণ মানুষের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণে কঠোর হয়েছে সীমান্তরক্ষায় নিয়োজিত বিজিবি এবং বিএসএফ। দুই সীমান্তে নজরদারি এবং টহল বেড়েছে।
গত এক সপ্তাহে দফায় দফায় গ্রামের সাধারণ মানুষের সাথে মতবিনিময় করেছে বাংলাদেশের বর্ডার গার্ড। দু’দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর উচ্চ পর্যায়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে পতাকা বৈঠকও হয়েছে।
সীমান্তে এত মানুষ কেন, কিভাবে?
সীমান্তে উপস্থিত দুই দেশের জনগণের মধ্যেই ক্ষোভ দেখা গেছে। অনেকেই দেশীয় অস্ত্র লাঠি-সোঁটা, কাস্তে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন।
বাংলাদেশী নাগরিকরা অভিযোগ করেন, তাদের দিকে তীর ও পাথর নিক্ষেপ করা হয়। পাথরের আঘাতে কয়েকজন আহত হয়েছেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার কিরনগঞ্জ সীমান্তের কাছে ঘটনা শুরু হলেও চৌকা সীমান্তের কাছে দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কয়েক হাজার মানুষের উপস্থিতি ছিল।
স্থানীয় জনগণের পাশাপাশি দূর-দূরান্ত থেকে সাধারণ মানুষ ভিড় করেছিলেন সীমান্তের শূন্য রেখার কাছে।
সীমান্তবর্তী কালীগঞ্জ গ্রামের কৃষক, সাধারণ মানুষ এবং বেশ কয়েকজন গ্রামবাসীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাধারণ মানুষ অংশ নেয়।
সেই সাথে আশপাশের গ্রাম, উপজেলা এমনকি জেলা শহর থেকেও মানুষ হাজির হয়। ছিল উৎসুক জনতাও।
এত মানুষের উপস্থিতির পেছনে সীমান্তে শূন্য রেখার কাছে বিএসএফ'র বেড়া দেয়ার তৎপরতা নিয়ে ক্ষোভ একটা কারণ বলে জানান মুজিবর নামে একজন গ্রামবাসী।
তার ভাষায়, ‘ইস্যু হইলো আপনার তার বেড়া (কাঁটাতারের বেড়া) লিয়ে। প্রচুর ক্ষোভ। মানুষ তার বেড়া হইতে দিবে না। দেড় শ’ গজের মাপের বাইরে দিতে হবে। কিন্তু আপনার জিরো পয়েন্টে দিছে। ওই জন্যই ক্ষোভ।’
সীমান্তে বেড়া দেয়াকে কেন্দ্র করে যে ক্ষোভ তার সাথে দীর্ঘদিনের জমে থাকা নানা ক্ষোভের কথা জানান কালীগঞ্জের তরুণ কৃষক জিয়াউল হক। সীমান্তে তিনিও যোগ দিয়েছিলেন শনিবার।
‘গত ১৫ বছর থাইকাই ধরেন যে আমাদের কৃষকদেরকে মারে, সীমান্তে যাইতে দেয় না। তারপরে গুলিও করে। ওরা (বিএসএফ) গত ১৫ বছর ধরেই জ্বালায়।’
দলমত নির্বিশেষে মানুষ জড়ো হয়েছিল বলে উল্লেখ করেন স্থানীয় গ্রামবাসী মো: আব্দুর রহিম। বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘অনেক জায়গার লোক এখানে আসছে। সব মানুষ আসছে (এটা শুনে) যে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে তারা ক্ষতিসাধন চালাইছে, তো বাংলাদেশের মানুষ আমরা তো আমাদের ক্ষতি হইতে দেব না। এটাতো আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছি। আমি বুড়া মানুষ নিজেই গেছি।’
কিভাবে সাধারণ মানুষ খবর পেল সে বিষয়টি জানা যায় সীমান্তবর্তী বাখোরালী বাজারে কয়েকজনের সাথে কথা বলে।
পঞ্চাশোর্ষ মকবুল হোসেন নামে একজন গ্রামবাসী বিবিসিকে বলেন, মসজিদের মাইকিং শুনে তিনি সীমান্তে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে উপস্থিত হন।
‘মহল্লায় প্রত্যেক মসজিদে মসজিদে মাইকিং হয়েছে যে ভারতের বিএসএফ এসে গাছ কাটছে, বরই গাছ, ফসল কাটছে, অমুক কাটছে। তখন দৌঁড়ায় গেছি।’
এছাড়া সামাজিক মাধ্যমে লাইভ সম্পচার, এমনকি মোবাইলে কল করেও মানুষকে ডাকা হয়েছিল বলে তারা জানান।
ভারতের গ্রামবাসী কী বলছেন
সীমান্তে উত্তেজনার বিভিন্ন ছবি ও ভিডিওতে দেখা গেছে ভারতীয় অংশেও হাজারো মানুষ লাঠি-সোঁটা, কাস্তের মতো দেশীয় অস্ত্র হাতে উপস্থিত ছিলেন।
সীমান্তে এত মানুষ কেন জড়ো হওয়ার কারণ হিসেবে ফসলের ক্ষতি নিয়ে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ আছে দুই দেশের নাগরিকদের।
ভারতীয় নাগরিকদের ক্ষোভের পেছনে দীর্ঘদিনের সমস্যা, নিরাপত্তাহীনতা ও সীমান্ত বেড়া দেয়ার মতো কারণ রয়েছে বলে জানান গ্রামবাসীরা।
ভারতের সুখদেবপুর গ্রামের বাসীন্দা বাবলু মণ্ডল বলেন, তারকাটার বেড়ার পরে ভারতের ১২ শ’ বিঘা জমি রয়েছে। সেখানে চাষাবাদ করতে নানা সমস্যার শিকার হন তারা।
‘গম কেটে নিয়ে যায়। শুধু গম না। আম যখন ফলে, পুরা আম নিয়ে চলে যায়। তারকাঁটার ওপারে আমরা দেখতে দেখতে ওরা কেটে নিয়ে চলে যায়।
আমাদের কৃষকরা সেচ দিয়ে গিয়ে সমস্যায় পড়েছে। পাইপে বোতল ঢুকিয়ে আমাদের সাতটা মেশিন উঠিয়ে নিয়ে চলে গেছে। রাতে আমাদের বাড়িতে গরু মহিস থাকে, এগুলো জোর জবরদস্তি করে নিয়ে যায়। আমাদের সরকারের কাছে দাবি তাড়াতাড়ি যেন তারবেড়াটা হয়ে যাক।’
মালদহ জেলার সুখদেবপুর গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্য বিনয় মণ্ডল বলেন, ‘আমরা সবসময় আতঙ্কিত। আমরা চাইছি যে তাড়াতাড়ি তারের বেড়াটা হোক। না হলে আমাদের কোনো নিরাপত্তা নেই। আমাদের সবসময় রাত জেগে পাহারা দিতে হয় যে কখন বাংলাদেশ থেকে এসে আমাদের সবকিছু লুটপাট করে নিয়ে যায়। গরু-মহিষ চোরাচালানের কারবার হয়।’
১৮ জানুয়ারি সীমান্তে এত মানুষ কিভাবে জড়ো হয়েছেন এমন প্রশ্নে সুখদেবপুরে গ্রামের বাসীন্দা বিজেন মণ্ডল বলেন, ‘আমরা শুনলাম বাংলাদেশের হাজার হাজার লোক ছুটে আসছে। তারপর আমাদের গ্রামে চিৎকার করে উঠলাম সবাই যে বাংলাদেশী আমাদের সুখদেবপুরকে আক্রমণ করতে আসছে। তারপর গ্রামের লোক সজাগ হয়ে একত্রিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি আমরা।’
সীমান্তে সাধারণ মানুষ নিয়ে উদ্বেগ
ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে এরকম জনবিক্ষোভের নজির খুব একটা নেই। দুই দেশের নাগরিকদের সীমান্তে জড়ো হওয়ার বিষয়টি চিন্তার বিষয় বলে মনে করেন সাবেক কূটনীতিক এম হুমায়ুন কবির।
দুই দেশের জনগণের এরকম মুখোমুখী অবস্থান নানাদিক থেকেই বিপজ্জনক বলে অভিহিত করেন কবির।
‘এটা বিপজ্জনক এই কারণে যে সীমান্তে দুই দেশের মানুষ যখন মুখোমুখী দাঁড়ায় যেকোনো বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। কারণ একটা মানুষ মারা গেলে এটা একটা বিরাট রকমের দুই দিকে উত্তেজনা বাড়াবে। আর যেহেতু দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীও সেখানে আছে, তারাও কিন্তু এতে সম্পৃক্ত হয়ে যাওয়ার একটা আশঙ্কা এখানে থাকে।’
৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে আওয়ামী লীগের পতনের পর বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা নতুন ধরনের সচেতনতা তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন হুমায়ুন কবির।
তার মূল্যায়নে, আগে যেটা সরকারি পর্যায়ে কূটনীতিকরা আলাপ আলোচনা করতেন এখন জনগণ -এর সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যাচ্ছে দুই দিকেই। তার কারণ হলো গত সরকারের সাথে ভারতের ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার কারণে মানুষের মধ্যে যে বিরাগ, রাগ এটা সঞ্চিত। বাংলাদেশের মানুষের রাগ-ক্ষোভটা বিক্ষোভে পরিণত হয়েছে।
এবং দুই দেশের সম্পর্কটা সরকারি পর্যায় থেকে নিচের দিকে নেমে জনগণ পর্যায়ে বিস্তৃত হয়ে গেছে। গত কয়েক দিন ধরে সীমান্তে যেগুলো হচ্ছে সেটা কিন্তু দুই দেশের মানুষের এই সক্রিয়তার একটা বহিঃপ্রকাশ হিসেবে আমি দেখি।
ভারতে কাজ করা সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবির বিবিসিকে বলেন, দুই দেশের মধ্যে যে সম্পর্কের অবনতি সেটি থেকে উত্তরণ দরকার।
‘বাংলাদেশ সম্পর্কে যে ন্যারেটিভটা প্রচার করা হচ্ছে যে বাংলাদেশ ইজ অ্যা ব্যাড প্লেস, এটা উগ্রবাদী জায়গায় চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এখন আর আমাদের বন্ধু নাই- এই ন্যারেটিভটা থেকে ভারতের বেরিয়ে আসা দরকার, সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে ভারতের পক্ষ থেকে উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন।’
সূত্র : বিবিসি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা