- ইসরাইলের সব বন্দীকে মুক্তি দিলো হামাস
- ১০ মাস পর গাজায় পৌঁছাল জ্বালানিবাহী ট্রাক
- শৃঙ্খলা রক্ষায় হামাসকে অস্ত্র বহনের অনুমতি দিয়েছেন ট্রাম্পই
- নেসেটে ট্রাম্পের ভাষণের সময় ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতির দাবি
নয়া দিগন্ত ডেস্ক
হামাস-ইসরাইল চুক্তি অনুযায়ী ইসরাইলের কারাগারগুলো থেকে ফিলিস্তিনি বন্দীদের মুক্তি দেয়া হয়েছে। ইসরাইল জানিয়েছে, এসব বন্দীর মধ্যে ২৫০ জন হত্যা, আক্রমণসহ বিভিন্ন অপরাধে ইসরাইলি আদালত কর্তৃক এক বা একাধিক যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত ছিলেন, তাদের পাশাপাশি গত দুই বছর ধরে গাজায় যুদ্ধ চলাকালে আটক এক হাজার ৭১৮ জন ফিলিস্তিনিকেও মুক্তি দেয়া হয়েছে।
আলজাজিরা জানিয়েছে, ইসরাইল অধিকৃত পশ্চিমতীরের ওফার কারাগার থেকে বাসে করে ফিলিস্তিনি বন্দীদের রামাল্লায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তারা বাস থেকে নামতে শুরু করার সাথে সাথে সেখানে জড়ো হওয়া হাজার হাজার ফিলিস্তিনি আনন্দে ফেটে পড়ে। কারামুক্তরা বাস থেকে নেমে আসার পর তাদের পরিবারের সদস্যরা ও বন্ধুরা তাদের জড়িয়ে ধরেন। বন্দীদের বাবা ও মায়েরা তাদের জড়িয়ে ধরে আনন্দে কেঁদে ফেলেন। সেখানে থাকা অন্যরা বন্দীদের কাঁধে নিয়ে উল্লাস করতে থাকেন। মুক্তি পাওয়া বন্দীদের অনেককেই দুর্বল দেখাচ্ছিল আর তাদের কারো কারো শরীরে দৃশ্যমান জখমের চিহ্ন ছিল। গণমাধ্যমে আসা ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, রামাল্লায় আসার সময় বাসের ভেতরে থাকা ফিলিস্তিনি বন্দীরা দুই আঙুল তুলে জয়ের চিহ্ন দেখাচ্ছেন ও হাসছেন।
এসব বাসের চার পাশে প্রচুর মানুষ ছিল যারা তাদের ফোনে দৃশ্যগুলো ভিডিও করছিল। তাদের অনেকেই হাতেই ছিল ফিলিস্তিনের পতাকা। ফিলিস্তিনি কর্তৃপরে নিরাপত্তা বাহিনী রাস্তা থেকে লোকজনকে সরিয়ে দিচ্ছিল যেন বাসগুলো নিরাপদে গন্তব্যে যেতে পারে। ইসরাইল প্রাথমিকভাবে জানিয়েছিল, তাদের সব বন্দীকে মুক্তি না দেয়া পর্যন্ত তারা অপো করবে। কিন্তু হামাস জীবিত ২০ বন্দীর সবাইকে সোমবার সকালে মুক্তি দেয়ার পর ইসরাইল ফিলিস্তিনি বন্দীদের মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
ইসরাইলি বাহিনীর হামলায় ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত গাজায় ৬৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত এবং প্রায় এক লাখ ৭০ হাজার আহত হয়েছেন বলে তথ্য প্রকাশ করেছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ইউনিসেফের তথ্য মতে, এ যুদ্ধে ২০ হাজারের বেশি শিশুর মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে ৪২ হাজারের বেশি শিশু; যাদের মধ্যে অন্তত ২১ হাজার শিশু স্থায়ীভাবে পাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।
ইসরাইলের সব বন্দীকে মুক্তি দিলো হামাস
ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস ইসরাইলের সব অর্থাৎ ২০ জন বন্দীকে মুক্তি দিয়েছে। এর মধ্যে প্রথম ধাপে মুক্তি দেয়া সাতজন বন্দী ইতোমধ্যেই ইসরাইলে পৌঁছেছেন এবং বাকি ১৩ জন বর্তমানে আন্তর্জাতিক রেড ক্রসের হেফাজতে আছেন।
দ্য গার্ডিয়ান ও আলজাজিরার খবরে বলা হয়েছে, প্রথম ধাপে মুক্তি পাওয়া সাত ইসরাইলি বর্তমানে দণি ইসরাইলের প্রাথমিক অভ্যর্থনা কেন্দ্রে অবস্থান করছেন। এখানে তারা তাদের পরিবারের সাথে মিলিত হবেন। ইসরাইলি সরকারি রেডিওর তথ্যানুসারে, হামাস দ্বিতীয় ধাপে আরো ১৩ জন ইসরাইলি বন্দীকে রেড ক্রসের কাছে হস্তান্তর করেছে। হামাস নিশ্চিত করেছে, এভাবে বর্তমানে জীবিত সব ইসরাইলি বন্দী মুক্তি পেয়েছেন।
১০ মাস পর গাজায় পৌঁছাল জ্বালানিবাহী ট্রাক
দীর্ঘ দুই বছর ধরে চলা গণহত্যা বন্ধে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর গ্যাস ও জ্বালানিবাহী ত্রাণের ট্রাক গাজায় প্রবেশ করেছে। টানা ১০ মাস অবরোধ থাকার পর গতকাল সোমবার প্রথমবারের মতো ত্রাণ নিয়ে সীমিতসংখ্যক ট্রাক গাজায় প্রবেশ করেছে। তুরস্কের বার্তা সংস্থা আনাদোলু এজেন্সির তথ্য মতে, গ্যাস ও জ্বালানিতে ভর্তি কয়েকটি ট্রাক ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণাধীন দণি গাজার কেরেম শালোম সীমান্তপথ দিয়ে প্রবেশ করেছে। যুদ্ধবিরতি চুক্তির অংশ হিসেবে এসব জ্বালানিবাহী ট্রাক প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়েছে। ইসরাইলের অনুমতি নিয়ে গত দুই মাস ধরে প্রতিদিন গড়ে ৬০-৭০টি ত্রাণের ট্রাক গাজায় প্রবেশ করা শুরু হলেও এসব ত্রাণের মধ্যে কোনো জ্বালানি বা গ্যাস অন্তর্ভুক্ত ছিল না। গাজার স্থানীয় কর্তৃপ জানিয়েছে, সোমবার থেকে রান্নার গ্যাস বিতরণ শুরু হবে। প্রত্যেক ব্যক্তি ৬০ শেকেল মূল্যে আট কিলোগ্রাম গ্যাসযুক্ত একটি সিলিন্ডার পাবেন।
মিসরে ‘গাজা শান্তি সম্মেলনে’ অংশ নিচ্ছেন না নেতানিয়াহু
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু মিসরের শারম আল-শেখে আয়োজিত ‘গাজা শান্তি সম্মেলনে’ অংশ নিচ্ছেন না। গতকাল সোমবার এক বিবৃতিতে এই তথ্য নিশ্চিত করেছে নেতানিয়াহুর কার্যালয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেয়া বিবৃতিতে জানানো হয়, প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এই সম্মেলনে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ পেয়েছেন এবং এজন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তবে ছুটি শুরুর ঠিক আগ মুহূর্তে সময় সঙ্কটের কারণে তিনি সম্মেলনে উপস্থিত থাকতে পারছেন না। এর আগে হোয়াইট হাউজ এবং মিসরের প্রেসিডেন্টের কার্যালয় জানিয়েছিল, নেতানিয়াহু সম্মেলনে অংশ নেবেন।
শৃঙ্খলা রক্ষায় হামাসকে অস্ত্র বহনের অনুমতি দিয়েছেন ট্রাম্পই
আলজাজিরা জানায়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র জানে যে হামাস গাজায় আবার অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হচ্ছে। তিনি দাবি করেন, এই প্রক্রিয়ার জন্য কিছু সময়ের জন্য যুক্তরাষ্ট্র তাদের অনুমতি দিয়েছে। ইসরাইল সফরের পথে এয়ার ফোর্স ওয়ানে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, হামাস যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, ‘তারা বিষয়টি খোলাখুলিভাবে করছে এবং আমরা তাদের কিছু সময়ের জন্য অনুমতি দিয়েছি। বুঝতে হবে- তারা প্রায় ৬০ হাজার মানুষ হারিয়েছে। এটা অনেক বড় পাওনা।’ ট্রাম্প আরো বলেন, যুক্তরাষ্ট্র চায় ফিরে আসা গাজার বাসিন্দারা যেন নিরাপদে পুনর্গঠন করতে পারেন। তিনি গাজাকে ‘সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত’ বলে উল্লেখ করেন এবং সতর্ক করেন, ‘মানুষ ফিরে আসার সময় অনেক বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।’ হামাসের অস্ত্র সমর্পণ বা নিরস্ত্রীকরণের সময়সূচি এখন যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রধান বিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আলোচকরা বিভক্ত - কিভাবে এবং কখন এই নিরস্ত্রীকরণ প্রক্রিয়া শুরু হবে তা নিয়ে।
নেসেটে ট্রাম্পের ভাষণের সময় ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতির দাবি
আলজাজিরা আরো জানায়, ইসরাইলের পার্লামেন্ট নেসেটে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্য চলাকালে কিছু সময়ের জন্য হট্টগোল সৃষ্টি হয়। পরে নিশ্চিত হওয়া গেছে, ট্রাম্পের বক্তৃতা থামিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন আইনপ্রণেতা আয়মান ওদেহ। ভাষণের মধ্যে তিনি ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়ার দাবি জানিয়ে একটি কাগজ উঁচুতে তুলে ধরেন। সেখানে লেখা ছিল, ‘আগে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিন।’
পরে নেসেট স্পিকার আমির ওহানা হট্টগোল থামানোর জন্য আইনপ্রণেতাদের প্রতি আহ্বান জানান। এ সময় প্রতিবাদ জানানো আইনপ্রণেতাকে দ্রুত পার্লামেন্ট থেকে বের করে দেয়া হয়। বক্তৃতার আগেই আয়মান ওদেহ তার এক্স (সাবেক টুইটার) অ্যাকাউন্টে পোস্ট করে জানান, ‘পার্লামেন্টের ভেতরে যে পরিমাণ ভণ্ডামি চলছে, তা অসহনীয়। এক সমন্বিত নাটকীয় উপায়ে নেতানিয়াহুকে প্রশংসার বন্যায় ভাসানো-যা আগে কখনো দেখা যায়নি-তাতে গাজায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায় কিংবা লাখো ফিলিস্তিনি ও হাজারো ইসরাইলি নাগরিকের রক্তের দায় থেকে তিনি (নেতানিয়াহু) এবং তার সরকার মুক্ত হতে পারেন না।’ তিনি আরো লেখেন, ‘আমি আজ এখানে আছি শুধু যুদ্ধবিরতি এবং সামগ্রিক চুক্তির কারণে।’ ওদেহ তার বক্তব্যে জোর দিয়ে বলেন, ‘শুধুমাত্র দখলদারিত্বের অবসান এবং ইসরাইলের পাশাপাশি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়ার মাধ্যমেই ন্যায়বিচার, শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব।’
ট্রাম্পের বক্তৃতা বাধাগ্রস্ত হওয়ার ঘটনায় নেসেট অধিবেশনে স্বল্প সময়ের জন্য উত্তেজনা দেখা দেয়। তবে নিরাপত্তাকর্মীরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন এবং ট্রাম্প পরে তার বক্তব্য চালিয়ে যান। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আয়মান ওদেহর এই প্রতিবাদ বর্তমান আঞ্চলিক বাস্তবতায় এক সাহসী পদক্ষেপ, যা ইসরাইলি রাজনীতিতে ফিলিস্তিন প্রশ্নে ভিন্নমতের নতুন আলোচনার জন্ম দিতে পারে।
গাজায় ফিলিস্তিনি সাংবাদিক নিহত
গাজা উপত্যকায় হামাস ও দুগমুশ গোত্রের সংঘর্ষে ফিলিস্তিনি সাংবাদিক সালেহ আলজাফারাবি নিহত হয়েছেন। নগরীর সাবরা এলাকায় সংঘর্ষের খবর সংগ্রহ করছিলেন তিনি। ওই সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তিনি। গত রোববার সকাল থেকে নিখোঁজ ছিলেন সালেহ। ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই গাজায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটল।
ফিলিস্তিনি সূত্রগুলো আলজাজিরা আরবিকে জানায়, ২৮ বছর বয়সী সালেহ গাজা উপত্যকায় হামাস ও ইসরাইলের যুদ্ধের ভিডিও ধারণ ও প্রচার করে পরিচিতি পেয়েছিলেন। সাংবাদিক ও অধিকারকর্মীদের প্রকাশ করা ভিডিও ফুটেজ আলজাজিরার পক্ষ থেকে যাচাই করা হয়েছে। তাতে দেখা যায়, ‘প্রেস’ লেখা জ্যাকেট পরিহিত সালেহর লাশ একটি ট্রাকের পেছনের অংশে পড়ে আছে।
গাজায় হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে সাময়িক যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার দিন কয়েক আগে, গত জানুয়ারিতে আলজাজিরার সাথে আলাপ করেছিলেন ফিলিস্তিনি সাংবাদিক সালেহ। আল জাজিরাকে তার উত্তর গাজা থেকে বাস্তুচ্যুত হওয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে বলেছিলেন তিনি।
সালেহ বলেছিলেন, ‘এই ৪৬৭ দিনের যুদ্ধে আমি যেসব দৃশ্য দেখেছি ও যেসব পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছি, সেসব আমার স্মৃতি থেকে মুছে যাবে না। আমরা যেসব পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি, কখনোই সেগুলো ভুলতে পারব না।’ সংবাদ পরিবেশনের কারণে তিনি ইসরাইলের কাছ থেকে বহুবার হুমকি পেয়েছিলেন বলে আল জাজিরাকে জানিয়েছিলেন সালেহ।
তিনি বলেন, ‘সত্যি বলতে, আমি প্রতিটি সেকেন্ড ভয়ের মধ্যে বসবাস করি। বিশেষ করে ইসরাইলি দখলদার বাহিনী আমার সম্পর্কে কী বলছে, সেসব শোনার পর। আমি জীবনের প্রতিটি সেকেন্ড কাটাচ্ছিলাম, কিন্তু জানতাম না যে পরের সেকেন্ডটি আমার জন্য কী বয়ে আনছে।’



