গাজায় অব্যাহত ইসরাইলি হামলায় যুদ্ধবিরতির স্থায়িত্ব নিয়ে উদ্বেগ

Printed Edition

নয়া দিগন্ত ডেস্ক

  • আরো ২ ইসরাইলি বন্দীর বিনিময়ে ৩০ ফিলিস্তিনির লাশ ফেরত
  • কয়েক সপ্তাহের মধ্যে গাজায় আন্তর্জাতিক বাহিনী মোতায়েন

দখলদার ইসরাইলি বাহিনীর টানা চতুর্থ দিনের হামলায় গাজায় তিন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এই হামলা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ঘোষিত যুদ্ধবিরতির স্থায়িত্বকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গতকাল শুক্রবার ভোরে গাজা সিটির সাবরা এলাকায় একটি বাড়িতে এবং খান ইউনুসে একটি গাড়িতে বিমান হামলা চালানো হয়। এতে তিনজন নিহত হন এবং আরো কয়েকজন আহত হন। নিহতদের মধ্যে একজন আগের দিনের হামলায় আহত হয়ে হাসপাতালে মারা যান।

এই হামলার মাত্র এক দিন আগেই ইসরাইলি বাহিনী গাজায় সবচেয়ে ভয়াবহ ২৪ ঘণ্টার হামলা চালায়, যেখানে ১০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হন- যার মধ্যে ৪৬ জন শিশু। ইসরাইলি সেনাবাহিনী এই হামলার বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়নি। তবে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এক ইসরাইলি সেনা নিহত হওয়ার ঘটনায় ‘তাৎক্ষণিক ও শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া’ জানানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন।

যুদ্ধবিরতির আওতায় ইসরাইলি বাহিনী কিছু এলাকা থেকে সরে গেলেও সেখানে আবার হামলা শুরু হওয়ায় স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকেই আশ্রয়কেন্দ্রে ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় তিন সপ্তাহ আগে এই যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। তবে হামাসের নিরস্ত্রীকরণ, ইসরাইলি সেনা প্রত্যাহার এবং মানবিক সহায়তা প্রবেশের বিষয়গুলো এখনো অনিশ্চিত রয়ে গেছে।

জাতিসঙাঘ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো গাজায় চলমান মানবিক সঙ্কট নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। অক্টোবর ২০২৩ থেকে এ পর্যন্ত গাজায় ৬৮ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন বলে স্থানীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। এ দিকে ইসরাইল ৩০ জন ফিলিস্তিনি বন্দীর লাশ গাজায় ফিরিয়ে দিয়েছে। এই পদক্ষেপটি যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ১০ অক্টোবর থেকে কার্যকর হওয়া যুদ্ধবিরতির অংশ হিসেবে নেয়া হয়েছে, যেখানে প্রতিটি মৃত ইসরাইলি বন্দীর বিনিময়ে ১৫ জন ফিলিস্তিনির লাশ ফেরত দেয়ার শর্ত রয়েছে।

এর আগে, হামাস আরো দুই নিহত ইসরাইলি বন্দীর লাশ ফেরত দিয়েছে, যাদের পরিচয় নিশ্চিত করেছে ইসরাইল। অন্য দিকে রামাল্লায় গত রাতে ইসরাইলি বাহিনীর অভিযানে ১৫ বছর বয়সী ফিলিস্তিনি কিশোর ইয়ামেন সামেদ হামেদ নিহত হয়। ওয়াফা সংবাদ সংস্থা জানায়, ইসরাইলি সেনারা সরাসরি গুলি, টিয়ার গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করেছে। নাবলুস গভর্নরেটের নাবলুস শহরে মোয়ামেন আল-তাওয়িল এবং কিবলান গ্রামে সালিম আহমেদ দাউদ আবু সানোবারকে গ্রেফতার করেছে ইসরাইলি বাহিনী। তারা নিউ আসকার শরণার্থী শিবিরেও অভিযান চালায়, যেখানে ব্যাপক টিয়ার গ্যাস ব্যবহার করা হয়।

জেনিনের কাছে কাফর দান এলাকায় ফাদি মারই ও আরো কয়েকজন তরুণকে আটক করেছে ইসরাইলি বাহিনী। রামাল্লার বুরকা এলাকায় বসতি স্থাপনকারীরা দুইটি ফিলিস্তিনি মালিকানাধীন গাড়িতে আগুন দিয়েছে। একই দিন ১৮ বছর বয়সী মোহাম্মদ ইউসুফ মাতানকে পৃথক অভিযানে গ্রেফতার করেছে ইসরাইলি বাহিনী।

গাজার বাসিন্দারা বলেছেন, যুদ্ধবিরতির মধ্যেও খাদ্য ও আশ্রয়ের সঙ্কটে তারা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন এবং ইসরাইলের পূর্ণমাত্রার বোমাবর্ষণ আবার শুরু হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন। আলজাজিরা ও তাসনিম নিউজ এজেন্সির তথ্যানুযায়ী, ইসরাইল শহরজুড়ে ধ্বংসযজ্ঞও চালিয়েছে।

লাশ শনাক্তে সঙ্কট : এ দিকে ২০১৪ সাল থেকে নিখোঁজ আরো একজনসহ ৭ অক্টোবরের হামলায় নিহত আরো ১০ জনের লাশ গাজায় রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এদের মধ্যে একজন তানজানিয়ার এবং একজন থাই নাগরিক। ইসরাইলি সরকার হামাসকে যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ করেছে এবং বন্দীদের পরিবারগুলো আরো কঠোর পদক্ষেপের দাবি জানিয়েছে।

হামাস বলছে, তারা চুক্তির প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ- তবে দুই বছরের ইসরাইলি বোমাবর্ষণে গাজার বহু স্থাপনা ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় লাশ শনাক্ত ও উদ্ধার করা কঠিন হয়ে পড়েছে। মিসরের উদ্ধারকারী দল ভারী যন্ত্রপাতি নিয়ে লাশ খুঁজে বের করার কাজে অংশ নিয়েছে।

আন্তর্জাতিক বাহিনী মোতায়েন : অন্য দিকে যুক্তরাষ্ট্র গাজায় ‘আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বাহিনী’ মোতায়েনের পরিকল্পনা করছে বলে গতকাল শুক্রবার আল আরাবিয়া জানিয়েছে। বাহিনীতে আরব ও বিদেশী সৈন্য থাকবে। প্রতিবেদনে সামরিক কর্মী পাঠানোর জন্য নির্দিষ্ট দেশগুলোর নাম উল্লেখ না করলেও, যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিনি জাতীয় কর্তৃপক্ষের পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের পরিকল্পনা করছে।

গত ২৯ সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঘোষিত ‘ব্যাপক পরিকল্পনা’তে অস্থায়ী ‘বহিরাগত শাসনব্যবস্থা’ এবং আন্তর্জাতিক বাহিনী মোতায়েনের কথা বলা হয়। গত ৯ অক্টোবর মিসরে আলোচনার পর ইসরাইল ও হামাস শান্তি পরিকল্পনার প্রথম ধাপে চুক্তিতে পৌঁছায়। ১০ অক্টোবর থেকে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। দ্বিতীয় ধাপে হামাস অস্ত্র সমর্পণ করবে এবং ইসরাইলি বাহিনী সম্পূর্ণভাবে গাজা থেকে সরে যাবে।

গাজায় ২৪ হাজার টন ত্রাণ : যুদ্ধবিরতির পর থেকে গাজায় জাতিসঙ্ঘের ২৪ হাজার টনের বেশি ত্রাণ পৌঁছেছে বলে গত বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন জাতিসঙ্ঘের মানবিক সহায়তাবিষয়ক উপসমন্বয়ক রামিজ আলাকবারভ। তিনি এনজিওগুলোকে ত্রাণ বিতরণে অংশগ্রহণের অনুমতি দেয়ার আহ্বান জানান। আলাকবারভ বলেন, ‘আমরা সব সীমান্ত দিয়ে ২৪ হাজার মেট্রিক টনের বেশি ত্রাণ এনেছি এবং কমিউনিটি-ভিত্তিক বিতরণ শুরু করেছি।’

বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির আঞ্চলিক পরিচালক সামের আবদেলজাবের জানান, ২০ দিনের কার্যক্রমে তারা ২০ হাজার মেট্রিক টন খাদ্য সংগ্রহ করেছেন। উপকূলীয় এলাকায় লুটপাট কমে যাওয়ায় বিতরণ সহজ হয়েছে। আলাকবারভ জানান, ইউনিসেফের সহায়তায় গাজার উত্তর অংশে ৮টি নতুন থেরাপিউটিক কেন্দ্রসহ ১৫টি সাইট চালু হয়েছে। তিনি বলেন, ‘২০ দফা মার্কিন শান্তি পরিকল্পনার বাস্তবায়ন আমাদের মানবিক সহায়তার কেন্দ্রীয় শর্ত।’

তিনি ইসরাইলকে এনজিওগুলোর নিবন্ধন সহজ করতে এবং ত্রাণ বিতরণে অংশগ্রহণের অনুমতি দিতে আহ্বান জানান। জাতিসঙ্ঘের মানবিকসহায়তা প্রধান টম ফ্লেচার বলেন, ‘মার্কিন মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতির ফলে আমরা আরো বেশি ত্রাণ পাঠাতে পারছি এবং ৬০ দিনের জীবনরক্ষাকারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে কাজ বাড়াচ্ছি।’

শিশুদের দুর্দশা : গাজার শিশুদের ওপর ইসরাইলি হামলার মানসিক ও শারীরিক প্রভাব আজীবন বহন করতে হবে। গতকাল আলজাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৫ বছর বয়সী আবেদ আল-আজিজ আবু হাবিশাল ইসরাইলি সেনার বন্দুক মাথায় তাক করা, বোমায় ছিন্নভিন্ন লাশের ওপর দিয়ে দৌড়ানো, মাথাবিহীন নারীর লাশ দেখার মতো ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছে। এসব মানসিক আঘাতের ফলে তার কিডনি বিকল হয়েছে।

আট বছর বয়সী লানা আল-শরীফের চুল অকালেই সাদা হয়ে গেছে, তার ত্বকে ভিটিলিগো রোগ দেখা দিয়েছে। তার বাবা জানান, ইসরাইলি হামলায় বাড়ির ছাদ ধসে পড়লেও সে বেঁচে যায়; কিন্তু প্রতিবার বিস্ফোরণের শব্দে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। থেরাপিস্ট সাবরিন আবু রহমান বলেন, গাজার ৮০ শতাংশের বেশি শিশু মানসিক আঘাতে ভুগছে। তাদের মধ্যে মাথাব্যথা, হাড়ের ব্যথা, চুল পড়া, দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দেখা যাচ্ছে।

ইউনিসেফ জানায়, গাজায় ৬৪ হাজারের বেশি শিশু নিহত বা আহত হয়েছে। ঘরবাড়ি, হাসপাতাল ও স্কুল ধ্বংস হয়েছে। গতকাল গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, মঙ্গলবার থেকে বুধবার পর্যন্ত ইসরাইলি হামলায় ৪৬ শিশু ও ২০ নারীসহ ১০৪ জন নিহত হয়েছে।

হামাসকে ২৪ ঘণ্টা সময় : গতকাল দ্য জেরুসালেম পোস্ট জানায়- যুক্তরাষ্ট্র, মিসর ও কাতারের অনুমোদনে হামাসকে হলুদ রেখার পেছন থেকে সরে যেতে ২৪ ঘণ্টা সময় দেয়া হয়েছে। সময়সীমা শেষে ইসরাইল হামলা চালাবে বলে জানানো হয়। হামাস পূর্বে রেড ক্রসের সমন্বয়ে লাশ উদ্ধারে হলুদ রেখা অতিক্রম করেছিল।