উত্তরাঞ্চলে ৯৮ ভাগ কারখানায় নেই ট্রেড ইউনিয়ন বা সেইফটি কমিটি

Printed Edition

সরকার মাজহারুল মান্নান রংপুর ব্যুরো

  • মজুরি ও নিরাপত্তা ঝুঁকি এবং যৌন হয়রানি বাড়ছে
  • ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোসহ ৩ কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা

রংপুর মহানগরীসহ উত্তরাঞ্চলের ৯৮ ভাগ কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠানে নেই শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন অথবা অংশগ্রহণকারী কমিটি অথবা সেইফটি কমিটি। এ কারণে ন্যায্য মজুরি ও নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়ছে শ্রমিকদের। নারী শ্রমিকদের যৌন হয়রানির ঘটনাও ক্রমাগত বাড়ছে। অনেক কারখানায় উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে। এরই মধ্যে রংপুর বিভাগের চার জেলার হাসপাতাল-ক্লিনিকসহ ১৩০ প্রতিষ্ঠানকে শ্রম দফতর থেকে কমিটি গঠনের তাগিদ দেয়া হলেও আমলে নিচ্ছে না প্রতিষ্ঠানগুলো। বাধ্য হয়ে মামলার দিকে এগোচ্ছে দফতরটি। এরই মধ্যে ব্রিটিশ টোব্যাকো কোম্পানিসহ তিনটি কোম্পানি-প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে শ্রম দফতর। আরো ২৫টি মামলা প্রক্রিয়াধীন আছে দফতরটিতে।

শ্রম মন্ত্রণালয়ের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদফতরের লেবার ইন্সপেকশন ম্যানেজমেন্ট অ্যাপ্লিকেশন (লিমা) সর্বশেষ ২৪ অক্টোবর তথ্যানুযায়ী সারা দেশে এক লাখ ৬৬ হাজার ৩৪৫টি কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান আছে। যার মধ্যে সেইফটি কমিটি আছে মাত্র ৩২০ টিতে। দেশের উত্তরাঞ্চলে রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী বগুড়া, সিরাজগঞ্জ ও নওগাঁয় প্রতিষ্ঠানটির উপমহাপরিদর্শকের কার্যালয় আছে। এসব অফিসের অধীনে উত্তরের ১৬ জেলায় উৎপাদন কারখানাসহ হাসপাতাল, ক্লিনিক, ইটভাটা ফ্লাওয়ার মিল, বিড়ি কারখানা, হিমাগার, রেস্তোরাঁ, জুটমিল, ফাউন্ড্রি বা মেটালসহ বিভিন্ন ধরনের কারখানা আছে ২০ হাজারেও উপরে। এর মধ্যে এর মধ্যে ৯৮ ভাগের মধ্যেই কোনো শ্রমিক ইউনিয়ন বা অংশগ্রহণকারী কমিটি বা সেইফটি কমিটি নেই।

বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ (অদ্যবধি সংশোধিত)-এর ধারা ২০৫-২০৮ এবং শ্রম বিধিমালা ২০১৫ (অদ্যাবধি সংশোধিত) এর বিধি ১৮৩-২০২ মোতাবেক কোনো কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠানে ৫০ জনের বেশি শ্রমিক কর্মচারী থাকলে সেখানে মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গোপন ব্যালটের ভোটে শ্রমিক ইউনিয়ন অথবা অংশগ্রহণকারী কমিটি বা সেইফটি কমিটি গঠন করা বাধ্যমতামূলক। এর মধ্যে অংশগ্রহণকারী কমিটি শ্রম দফতর এবং সেইফটি কমিটি কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদফতর দেখভাল করবে। কিন্তু উত্তরাঞ্চলের এই আইন চরমভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ কমিটি না থাকায় কারখানা বা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মালিক-শ্রমিকদের মাসিক বা দ্বিমাসিক বৈঠক হচ্ছে না। শ্রমিকরা মালিকের কাছে তাদের সমস্যার কথা তুলে ধরতে পারছেন না।

শুধু তা-ই নয়, যেহেতু শ্রমিক ইউনিয়ন বা অংশগ্রহণকারী কমিটি কারখানা বা প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন কাজ বৃদ্ধি এবং মালিক-শ্রমিকের মধ্যে সমন্বয় করে। কারখানাগুলোতে এ ধরনের কমিটি না থাকায় উৎপাদন ও শৃঙ্খলা কার্যক্রমও বিঘিœত হচ্ছে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের পর কলকারখানাগুলোতে কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেয় রংপুর আঞ্চলিক শ্রম দফতর। তারা বিভিন্ন কারখানা ও প্রতিষ্ঠানের মালিক পক্ষের সাথে বৈঠক শুরু করে। কিন্তু বৈঠক ও চিঠি চালাচালি হলেও মালিক পক্ষ থেকে তেমন সাড়া পাচ্ছে না সংস্থাটি। এর মধ্যে বৈঠকের পর শুধু রংপুর গুড হেলথ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সাড়া দিয়ে অংশগ্রহণকারী কমিটি করেছে।

সূত্র জানায়, এরই মধ্যে আঞ্চলিক শ্রম দফতর রংপুরের আওতাধীন চার জেলায় (রংপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, লালমনিরহাট) ১০০টিরও বেশি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ৩০টিরও বেশি বিভিন্ন কলকারখানায় অংশগ্রহণকারী কমিটি গঠনের বিষয়ে শ্রম দফতর থেকে চিঠি দিয়েছে। কিন্তু কোনো সাড়া পায়নি দফতরটি। ফলে মামলার করার উদ্যোগ নিয়েছে তারা।

রংপুর বিভাগীয় শ্রম আদালত সূত্র জানায়, গেল ১৫ অক্টোবর বিভাগীয় শ্রম আদালতে শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেড বিরুদ্ধে মামলা করেছেন আঞ্চলিক শ্রম দফতরের সহকারী পরিচালক মো: আতাউর রহমান মণ্ডল। বিচারক মামলাটি গ্রহণ করে পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করেছেন ২৪ নভেম্বর। সেখানে আসামি করা হয়েছে কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মণিষা আবরাহামকে।

আদালত সূত্র জানায়, মামলায় বাদি মো: আতাউর রহমান মণ্ডল অভিযোগ করেছেন, চলতি বছর ৩ ফেব্রুয়ারি রংপুর সদরের কেল্লাবন্দ এলাকায় অবস্থিত ব্রিটিশ আমেরিকান ট্যোবাকো কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালককে শ্রম আইন, ২০০৬ (অদ্যাবধি সংশোধিত) এর ধারা ২০৫-২০৮ ও শ্রম বিধিমালা ২০১৫ (অদ্যাবধি সংশোধিত) এর বিধি ১৮৩-২০২ মোতাবেক জরুরি ভিত্তিতে মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গোপন ব্যালটের ভোটে অংশগ্রহণকারী কমিটি গঠনের জন্য চিঠি দেয় আঞ্চলিক শ্রম দফতরের উপপরিচালক। এই চিঠি পাওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটি ১২ ফেব্রুয়ারি তার দফতরে মাত্র ১৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী আছে মর্মে একটি তালিকা দিয়ে ফিরতি চিঠি দেয়। বিষয়টি সরেজমিন তদন্ত করার জন্য প্রতিষ্ঠানটিকে ১৬ মার্চ নোটিশ জারি করে শ্রম দফতর। ১৯ মার্চ সহকারী পরিচালক আতাউর রহমান মণ্ডলের নেতৃত্বে একটি টিম ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর কারখানা সরেজমিন পরিদর্শন করেন। তদন্তে ওই প্রতিষ্ঠানটিতে ৫০ জনেরও বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ থাকার বিষয়টি প্রমাণিত হয়। এ ছাড়াও শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদফতরের লেবার ইন্সপেকশন ম্যানেজমেন্ট অ্যাপ্লিকেশন (লিমার) ওয়েবসাইটে প্রতিষ্ঠানটির দেয়া নিজস্ব তথ্যেও রংপুর সদর ক্যাম্পাসে ৫০৮ জন শ্রমিক থাকার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। এতে প্রমাণিত হয় প্রতিষ্ঠানটি অংশগ্রহণকারী গঠন না করে শ্রম আইন লঙ্ঘন করেছেন।

এ বিষয়ে মামলার বাদি আঞ্চলিক শ্রম দফতরের সহকারী পরিচালক আতাউর রহমান মণ্ডল জানান, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো রংপুর সদরের অফিস কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে শ্রম আইন ২০০৬ এর ধারা ৩১৭(৪)(খ), (চ), (ছ) অনুযায়ী মামলা করা হয়েছে। টোব্যাকোটি শ্রম আইনের ২০৫-২০৮ এবং শ্রম বিধিমালার ২০১৫ (অদ্যাবধি সংশোধিত) এর বিধি ১৮৩-২০২ লঙ্ঘন করায় শ্রম আইনের ২৯২, ২৯৩, ৩০৩ এর (ঙ), ৩০৬ এর (২), ৩০৭, ৩০৯ ধারা লঙ্ঘন করেছেন। সে কারণে মামলা করা হয়েছে। আমরা চাই কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠানগুলো আইন মেনে চলুক।

এই কর্মকর্তা আরো জানান, আমরা চাই সব কারখানা প্রতিষ্ঠান যেখানে ৫০ জনের বেশি শ্রমিক কর্মচারী আছে, সেখানে এ কমিটি করা হোক। এতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হবে।

রংপুর শ্রম দফতর থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, এ ছাড়াও হারাগাছের মতি বিড়ি, ডক্টরস ডায়াগনস্টিক সেন্টার (ইউনিট-২) এর নামেও শ্রম আইন-বিধিমালা লঙ্ঘনের অভিযোগে শ্রম আদালতে মামলা করেছে শ্রম দফতর।

উত্তরাঞ্চলের রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, পাবনা ও নওগাঁ কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদফতরের উপমহাপরিদর্শক কার্যালয়গুলোর সর্বশেষ (২৪ অক্টোবর) তথ্যানুযায়ী গত ২৪ দিনে বিভিন্ন কারখানায় ৯ হাজার ৩৪৩ বিধি লঙ্ঘনের তথ্য পেয়েছেন। এর মধ্যে রংপুরে দুই হাজার ২৫২, কুড়িগ্রামে ৯৬, গাইবান্ধায় ১৬১, দিনাজপুরে এক হাজার ৮৩৩, ঠাকুরগাঁওয়ে ৪৭৭, রাজশাহীতে এক হাজার ২২১, পাবনায় ১৮, সিরাজগঞ্জে এক হাজার ১৭, বগুড়ায় এক হাজার ৮৩৫, নওগাঁয় ২৩, জয়পুরহাটে ৫১, নাটোরে ১৪২, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ২১৭টি বিধি লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। সংশ্লিষ্ট কার্যালয় থেকে পরিদর্শন করে এসব বিধি লঙ্ঘনের তথ্য উঠে এসেছে ।

রংপুর কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের উপমহাপরিদর্শক আলআমীন জানান, আমাদের নিয়মিত পরিদর্শনে প্রচুর পরিমাণে বিধি লঙ্ঘনের তথ্য উঠে আসছে। সেইফটি কমিটি না থাকায় এসব বিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে সুরাহা করা যাচ্ছে না।

আঞ্চলিক শ্রম দফতর রংপুরের উপপরিচালক তুষার কান্তি রায় জানান, যেসব কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান শ্রম আইন ও বিধিমালা লঙ্ঘন করে অংশগ্রহণ কমিটি করা থেকে বিরত থাকবেন। তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) রংপুর মহানগর সভাপতি ফখরুল আনাম বেঞ্জু বলেন- কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠানগুলোতে শ্রমিক ইউনিয়ন, অংশগ্রহণকারী কমিটি এবং সেইফটি কমিটি না থাকার সুযোগে সরকারি দফতরগুলোর কর্মকর্তারা অবৈধ সুবিধা নেয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। এতে মালিকরা লাভবান হলেও শ্রমিকরা বঞ্ছিত হচ্ছেন।

এ প্রসঙ্গে রংপুর বিভাগীয় কমিশনার শহিদুল ইসলাম জানান, ‘শ্রম আইন লঙ্ঘনের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দফতরকে আরো কঠোর হওয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যারাই শ্রম আইন ও বিধিমালা লঙ্ঘন করবেন। তাদের বিরুদ্ধে মামলাসহ যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হবে। শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা আমাদের অন্যতম উদ্দেশ্য।