নিজস্ব প্রতিবেদক
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া তরুণদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বর্তমানে প্রচলিত প্রধান দুই রাজনৈতিক বলয়ের বাইরে গিয়ে গণঅধিকার পরিষদ, এবি পার্টিসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে একটি স্বতন্ত্র ‘তৃতীয় শক্তি’ হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার চেষ্টা করছে বলে রাজনৈতিক মহলে গুঞ্জন উঠেছে। দলটির এই সিদ্ধান্তের গুঞ্জন রাজনৈতিক মহলে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
এনসিপি তাদের আদর্শকে ‘বাংলাদেশপন্থী’ হিসেবে আখ্যায়িত করে একটি মধ্যপন্থী ও আদর্শনির্ভর রাজনৈতিক জোট গঠনের লক্ষ্যে এগোচ্ছে। দলটির একাধিক সূত্র জানিয়েছে, তারা দেশের প্রচলিত ধারার কোনো বৃহৎ দলের সাথে জোটবদ্ধ নাও হতে পারে। পাশাপাশি আলোচনা রয়েছে, এই জোট গঠন না করতে পারলে আগামী নির্বাচনে বিএনপির সাথে জোটে যেতে পারে তারা। জানা গেছে, আসন ভাগাভাগি নিয়ে দু’দলের আলোচনা হয়েছে। যদিও দলটির আহ্বায়ক সম্প্রতি গণমাধ্যমে দেয়া এক বক্তব্যে জানিয়েছেন, অভ্যুত্থানের পরে সংস্কারে যারা বাধা দিয়েছে, আবার যাদের ইতিহাসের দায় আছে তাদের সাথে জোটে যাবে না এনসিপি। নাহিদ ইসলামের এমন বক্তব্যের পর সবার ধারণা ও রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ অনেকাংশে পাল্টে গেছে। বর্তমানে দলটির পরিকল্পনা বিএনপি ও জামায়াত ইসলামী- এই দুই দলের বাইরে একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে জাতীয় রাজনীতিতে একটি বিকল্প শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করা। এক্ষেত্রে গণঅধিকার পরিষদ, এবি পার্টি, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনসহ অন্যান্য ছোট রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে একটি তৃতীয় বলয় সৃষ্টি করা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এনসিপির এই কৌশল অত্যন্ত সময়োপযোগী। বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক দূরত্বের প্রেক্ষাপটে এনসিপির এই উদ্যোগ একটি নতুন ভারসাম্য সৃষ্টি করতে পারে। তবে তাদের এক্ষেত্রে আগামী নির্বাচনের আগে দূরদর্শী চিন্তার মধ্য নিজেদের প্রস্তুত করতে হবে। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে তরুণ ভোটারদের মধ্যে এনসিপির যে গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি হয়েছিল তাকে পুঁজি করে দলটি একটি উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে সক্ষম হতে পারে। এবারের নির্বাচনে জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ ও সমর্থনকারী তরুণ ভোটারের সংখ্যা অনেক বেশি। ইতোমধ্যে তৃতীয় শক্তি গঠনের এই প্রক্রিয়ায় দৃশ্যমান অগ্রগতিও লক্ষ করা গেছে। গত সেপ্টেম্বরে এনসিপিসহ গণঅধিকার পরিষদ, গণসংহতি আন্দোলন, নাগরিক ঐক্য, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, জেএসডি এবং নয়টি দল এক বৈঠকে মিলিত হয়। এরপর জোট নিয়ে নানা গুঞ্জন শুরু হয়।
এনসিপির একাধিক সিনিয়র নেতৃবৃন্দ নিশ্চিত করেছেন, গণঅধিকার পরিষদ, গণতন্ত্র মঞ্চ এবং কয়েকটি ইসলামিক দলের সাথে তাদের প্রাথমিক আলোচনা চলমান। বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের জোট হতে পারে।
তবে এ ধরনের জোট গঠন কতটা ফলপ্রসূ হবে তা নিয়ে সংশয়ও রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেছেন, যদি মধ্যপন্থী দলগুলো একই মতাদর্শে ঐক্যবদ্ধ হয়, তবে একটি কার্যকর জোট গঠন সম্ভব। তবে তাদের আদর্শিক ঐক্য ও রাজনৈতিক কর্মসূচির সামঞ্জস্য থাকতে হবে।
এ দিকে দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, এনসিপি কোনো জোটে যাবে কি যাবে না তা নিয়ে আলোচনা আমরা শুনতে পাচ্ছি। যদি আমাদের জোটে যেতে হয় তা অবশ্যই একটা নীতিগত জায়গা থেকে আসবে। জুলাই সনদ বা সংস্কার বিষয়ে কারা বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়াচ্ছে, আমাদের সহযোগিতা করছে, সেই জায়গা থেকে জোটের বিষয়ে চিন্তা করছি। যদি সংস্কারের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় বা যাদের ইতিহাসের অনেক দায়ভার রয়েছে, তাদের সাথে জোটে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের অনেকবার ভাবতে হবে। কারণ আমাদের কাছে জনগণের অনেক প্রত্যাশা। আমরা নিজেদের শক্তিতেই দাঁড়াতে চাই।
এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন জানান, এখনো কোনো কিছুই চূড়ান্ত নয়। জোট বা আসন ভাগাভাগির আলোচনা হয়নি। সব দলের জন্য এনসিপির দরজা খোলা।
সব মিলিয়ে, এনসিপির নেতৃত্বে একটি মধ্যপন্থী জোট গঠনের এই গুঞ্জন যদি বাস্তব রূপ নেয়, তবে তা বাংলাদেশের চিরাচরিত দ্বিদলীয় রাজনীতির সমীকরণকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে এবং জাতীয় নির্বাচনে এক নতুন মাত্রা যোগ করবে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের।



