অর্থনৈতিক প্রতিবেদক
দেশের পুঁজিবাজার যেন চলছে এক ধরনের হুজুগের মধ্য দিয়ে। এ মুহূর্তে নিয়ন্ত্রক সংস্থা কর্তৃক বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ইতোমধ্যে বিগত সরকারের আমলে ঘটা নানা অনিয়মের উদঘাটন এবং এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনার কাজ অব্যাহত রয়েছে। অন্য দিকে বিনিয়োগকারীসহ পুঁজিবাজারের বিভিন্ন অংশীজনের কাছে ভবিষ্যতে একটি স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও টেকসই পুঁজিবাজার গঠনের প্রতিশ্রুতি পরিপালনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ প্রতিদিনের পুঁজিবাজার আচরণে তার কোনো প্রতিফলন ঘটছে না।
এ মুহূর্তে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর প্রান্তিক আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশের পাশাপাশি বিগত অর্থবছরের লভ্যাংশ ঘোষণার সময় চলছে। ইতোমধ্যে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর একটি বড় অংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। এদের মধ্যে বেশ কিছু কোম্পানি ভালো আর্থিক প্রতিবেদন যেমন প্রকাশ করেছে তেমনি বেশ কয়েকটি কোম্পানির আগের বছরের একই সময়ের চাইতে ভালো লভ্যাংশও ঘোষণা করেছে। কিন্তু এর কোনো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না বাজারে। অন্য অনেক কাম্পানির মতো ভালো আর্থিক অবস্থা ও ভালো লভ্যাংশ ঘোষণা করা কোম্পানিগুলোও প্রতিদিন দরপতনের শিকার হচ্ছে যা কোনোভাবেই পুঁজিবাজারের স্বাভাবিক আচরণের সাথে যায় না।
বাজার বিশ্লষকদের মতে, আমাদের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের কাছে আর্থিক বিবরণী ও লভ্যাংশ ঘোষণার চাইতেও মুনাফাই বেশি গুরুত্ব পায়। এক সময় এটি সাধারণ বা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের মধ্যেই বেশি প্রাধান্য পেতো। ক্যাপিটাল গেইন বা পুঁজি বৃদ্ধিতেই তারা তৎপর থাকতেন বেশি। তাই কোনো কোম্পানি ভালো লভ্যাংশ ঘোষণা করলে বাজারে তার প্রতিক্রিয়া ছিল কোম্পানির শেয়ারের মূল্যবৃদ্ধি। এ সুযোগে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করে মুনাফা তুলে নিতেন। অন্য দিকে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের একটি বড় অংশই ভালো কোম্পানিতে বিনিয়োগ করতো ভালো লভ্যাংশ পাওয়ার আশায়। বছর শেষে ভালো লভ্যাংশই তাদের আয়ের একটি বড় অংশ হয়ে ওঠে।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে গোটা পরিস্থিতি পাল্টে যায়। দীর্ঘ মন্দা বিশেষ করে ২০১০-১১ সালের পুঁজিবাজার বিপর্যয়ের পর প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়াগকারীদের একটি বড় অংশই এ বিপর্যয়ের শিকার হয়। ঋণ সুবিধা দেয়া এসব প্রতিষ্ঠান তাদের বিনিয়োগের একটি বড় অংশ ফিরে তো পায়ইনি, উপরন্তু নিজেদের সক্ষমতা ধরে রাখার জন্য বিনিয়োগের স্থলে নিজেদের ট্রেডিং মুডে নিয়ে এসেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে বাজার টেকসই আচরণ না করার পেছনে এটাকেই প্রধান কারণ মনে করেন তারা। কারণ মন্দা বাজারে প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের জনশক্তির খরচ জোগাতেই হিমশিম খাচ্ছিল। প্রতি মাসে নিজেদের খরচ মেঠাতে গিয়ে এ বাজারকেই তারা বিভিন্নভাবে ব্যবহার করেছে। সাধারণভাবে এটা কোনো অপরাধ না হলেও প্রকৃতপক্ষে পুঁজিবাজারের স্বাভাবিক গতিকে ব্যাহত করে।
এ দিকে গতকাল সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসটি শুরু হয় সূচকের অবনতি দিয়ে। গতকাল দেশের দুই পুঁজিবাজারেই সবগুলো সূচকের অবনতি ঘটে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ২২ দশমিক ৯১ পয়েন্ট হারায়। ৫ হাজার ১৪৯ দশমিক ৮৯ পয়েন্ট থেকে সকালে লেনদেন শুরু করা সূচকটি রোববার দিন শেষে নেমে আসে ৫ হাজার ১২৬ দশমিক ৯৭ পয়েন্টে। দিনের শুরুতে সূচকের বড় ধরনের উন্নতি ঘটা বাজারটি দিন শেষে তা ধরে রাখতে পারেনি। লেনদেনের মাঝামাঝি পর্যায়ে বিক্রয় চাপের মুখে পড়লে বাজার পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। এ সময় বাজারটির দুই বিশেষায়িত সূচক ডিএসই-৩০ ও ডিএসই শরিয়াহ হারায় যথাক্রমে ১১ দশমিক ৪১ ও ৪ দশমিক ৭৮ পয়েন্ট। দেশের দ্বিতীয় পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) সার্বিক মূল্যসূচক এ দিন ২৪ দশমিক ১৭ পয়েন্ট হারায়। সিএসই-৩০ ও সিএসসিএক্স সূচকের অবনতি ঘটে যথাক্রমে ১১ দশমিক ১৪ ও ১৭ দশমিক ৯৭ পয়েন্ট।
দিনের বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায়, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের দরপতনই গতকাল সূচকের এ অবনতি ঘটায়। এ দু’টি খাতে ৭০ শতাংশের বেশি কোম্পানি দরপতনের শিকার ছিল গতকাল। বীমা খাতের মূল্যবৃদ্ধি দরপতন কিছুটা ঠেকালেও অন্য খাতগুলোর মিশ্র আচরণের ফলে সূচকের পতন ঠেকানো যায়নি।
ডিএসইতে গতকাল লেনদেনের শীর্ষে উঠে আসে খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ। ১৯ কোটি ৩৬ লাখ টাকায় কোম্পানিটির ১৯ লাখ ১৫ হাজার শেয়ার হাতবদল হয় গতকাল। ১৫ কোটি ৮৮ লাখ টাকায় ২০ লাখ ৫২ হাজার শেয়ার বেচাকেনা করে বীমা খাতের সাধারণ বীমা কোম্পানি প্রগতি ইন্স্যুরেন্স ছিল দিনের দ্বিতীয় কোম্পানি। এ দিন ডিএসইর লেনদেনের শীর্ষ দশ কোম্পানির অন্যগুলো ছিল যথাক্রমে ডমিনেজ স্টিল বিল্ডিং সিস্টেমস, রবি অজিয়াটা, সিটি ব্যাংক, সোনালী পেপার অ্যান্ড বোর্ড মিলস, প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্স, সিভিও পেট্রোকেমিক্যালস রিফাইনারি, মিডল্যান্ড ব্যাংক ও ওরিয়ন ইনফিউশন।
ডিএসইতে দিনের মূল্যবৃদ্ধির শীর্ষে ছিল হাক্কানি পেপার অ্যান্ড পাল্প। কোম্পানিটির মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল ৯ দশমিক ৮৫ শতাংশ। ৯ দশমিক ৬৮ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি ঘটার মাধ্যমে এ তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসে সমতা লেদার। ডিএসইর মূল্যবৃদ্ধিতে শীর্ষ দশ কোম্পানির অন্যগুলো ছিল যথাক্রমে বিচ হ্যাচারিজ, এশিয়া ইন্স্যুরেন্স, প্রগতি ইন্স্যুরেন্স, মুন্নু ফেব্রিকস, সিএপিএম বিডি বিএল মিউচুয়াল ফান্ড, ইউনাইটেড ইন্স্যুরেন্স, মাগুরাপ্লেক্স ও পিপলস ইন্স্যুরেন্স।
ডিএসইতে দিনের দরপতনের শীর্ষে ছিল ফাস্ট ফিন্যান্স। ১০ শতাংশ দর হারায় আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের কোম্পানিটি। ৯ দশমিক ০৯ শতাংশ দর হারিয়ে এ তালিকার দ্বিতীয় কোম্পানি ছিল একই খাতের ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্স। দিনের দরপতনের শীর্ষ দশ কোম্পানির অন্যগুলো ছিল যথাক্রমে প্রিমিয়াল লিজিং, এক্সিম ব্যাংক, ইনফরমেশন সিস্টেমস নেটওয়ার্ক, ইউনিয়ন ব্যাংক, মতিন স্পিনিং, এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও ডিবিএইচ ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড।



