বাড়তি গরমে গত বছর অর্থনীতিতে ক্ষতি সাড়ে ২১ হাজার কোটি টাকা

Printed Edition

বিশেষ সংবাদদাতা

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন

  • শুধু তাপজনিত অসুস্থতায় ২৫ কোটি কর্মদিবস নষ্ট হয়েছে
  • প্রচণ্ড তাপমাত্রার ঝুঁঁকিতে বিশ্বে ২য় অবস্থানে বাংলাদেশ

ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার কারণে বাংলাদেশ শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁঁকির পাশাপাশি উৎপাদনশীলতা হ্রাস এবং অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। ২০২৪ সালে শুধু তাপজনিত অসুস্থতার কারণে ২৫ কোটি কর্মদিবস নষ্ট হয়েছে। যার ফলে দেশের অর্থনীতিতে প্রায় ১ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি তাদের এক প্রতিবেদনে বলছে, এ ক্ষতি দেশের মোট জিডিপির শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। প্রতি ডলার সমান ১২১ টাকা ধরলে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ২১ হাজার ৬৫৫ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। বাংলাদেশের মানুষ প্রচণ্ড তাপমাত্রার ঝুঁঁকিতে বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে।

বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত গতকাল ‘অ্যান আনসাস্টেইনেবল লাইফ : ‘দ্য ইমপ্যাক্ট অব হিট অন হেলথ অ্যান্ড দ্য ইকোনমি অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক এ প্রতিবেদনে ১৯৭৬-২০২৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার প্রবণতা বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে সংস্থাটি। ঢাকা অফিস থেকে এ তথ্য জানানো হয়।

বিশ্বব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ১৯৮০ সাল থেকে বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ‘অনুভূত’ তাপমাত্রা ৪.৫ ডিগ্রি সে. বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে ডায়রিয়া, দীর্ঘস্থায়ী কাশি, শ্বাসতন্ত্রের রোগ, ক্লান্তিজনিত অসুস্থতা, এমনকি বিষণœতা ও উদ্বেগের মতো মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। ঢাকার তাপমাত্রার প্রভাব জাতীয় গড়ের তুলনায় ৬৫ শতাংশ বেশি। মহিলারা গরমজনিত অসুস্থতায় বেশি ভোগেন। ফলে হিট স্ট্রোকসহ ক্লান্তি বোধ করেন। গরমকালে ডায়রিয়া ও কাশি দ্বিগুণ হয় শীতের তুলনায়।

প্রতিবেদনে বলা হয়ে বাংলাদেশে তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রবণতা এবং এর ফলে জনগণের স্বাস্থ্য ও সমৃদ্ধির ওপর ক্ষতির প্রভাব তাৎপর্যপূর্ণ এবং উদ্বেগজনক। এ সমস্যায় বাংলাদেশ একা নয়; এবং বিশ্বজুড়ে ব্যবহৃত সেরা অনুশীলনগুলো থেকে এটি শিক্ষা নিতে পারে। তাপপ্রবাহ প্রশমিত করার জন্য পদক্ষেপ এবং ব্যক্তিদের প্রভাব নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করতে পারে এমন হস্তক্ষেপ জরুরি। যথাযথ মনোযোগ সহকারে বাংলাদেশের সামর্থ্যের মধ্যে রয়েছে।

বিশ্ব¦ব্যাংক জানায়, বাড়তি তাপমাত্রার কারণে বয়স বাড়ার সাথে সাথে হতাশা ক্রমশ বৃদ্ধি পায়, অন্য দিকে উদ্বেগ ৫০-৬৫ বছর বয়সীদের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। শীতকালের তুলনায় গ্রীষ্মকালে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থার কারণে উৎপাদনশীলতা কমে যায়।

বিশ্বব্যাংক কিছু সুপারিশ দিয়ে বলছে, তাপপ্রবাহ মোকাবেলায় সমন্বিত জাতীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করা জরুরি। স্বাস্থ্যখাতে বিশেষ ব্যবস্থা নিয়ে গরমজনিত রোগ মোকাবেলা করা। শহরে সবুজ এলাকা তৈরি, সঠিক আবহাওয়া ও স্বাস্থ্যতথ্য সংগ্রহ। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও অর্থায়নের মাধ্যমে প্রতিরোধ ও অভিযোজনমূলক পদক্ষেপ জোরদার করা। স্থানীয় প্রমাণ এবং বিশ্বব্যাপী অন্তর্দৃষ্টি উভয়কেই কাজে লাগিয়ে, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের মুখোমুখি আরও স্থিতিশীল ভবিষ্যত তৈরি করতে পারে। সুপারিশে আরো বলা হয়, সমন্বিত বহুক্ষেত্রীয় পদ্ধতি ব্যবহার করে তাপপ্রবাহ মোকাবেলায় জাতীয় প্রস্তুতি ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। তাপজনিত অসুস্থতা এবং মৃত্যুহার মোকাবেলায় স্বাস্থ্য খাতের কার্যক্রম জোরদার করা। স্বাস্থ্যের ওপর তাপের প্রতিকূল প্রভাব মোকাবেলায় উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে পর্যাপ্ত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য আবহাওয়ার তথ্যের মান উন্নত করার জন্য দানাদার এবং নির্ভুল তথ্য সংগ্রহ করা। বাংলাদেশের ওপর বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাব প্রশমনের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং অর্থায়ন চাওয়া।

বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞদের মতে, সঠিক নীতি ও বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশ এ সঙ্কট মোকাবেলা করতে পারবে এবং একটি টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে।

বিশ্ব¦ব্যাংকের বাংলাদেশ ও ভুটান বিভাগের পরিচালক জ্যাঁ পেসমে বলেন, তীব্র গরম কেবল একটি মৌসুমি অস্বস্তি নয়, এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। জলবায়ু অভিযোজনে তার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এবং বিভিন্ন খাতে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ তাপপ্রবাহের প্রভাব মোকাবেলা করতে পারে।

বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র অপারেশনস অফিসার ইফফাত মাহমুদ বলেন, আমাদের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাড়তি তাপের সংস্পর্শে আসার সাথে সাথে স্বাস্থ্যগত অবস্থার অবনতি এবং উৎপাদনশীলতার উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হচ্ছে। অন্যান্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশও মানবসম্পদ ও উৎপাদনশীলতা হারানোর প্রকৃত ঝুঁঁকির মুখোমুখি।