পার্বত্য চট্টগ্রাম শুধু আঞ্চলিক নয় এটি জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্কট

ওয়েবিনারে বিশেষজ্ঞদের অভিমত

Printed Edition

নিজস্ব প্রতিবেদক

পার্বত্য চট্টগ্রামের চলমান উত্তেজনা ও সংঘাতকে শুধু আঞ্চলিক নয়, বরং বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার অন্যতম প্রধান সঙ্কট হিসেবে চিহ্নিত করেছেন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, রোহিঙ্গা ইস্যু, রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির উত্থান এবং ভারতের প্ররোচনায় নতুন করে সক্রিয় হওয়া বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে সরাসরি চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে।

গত রোববার বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ (বিডস) আয়োজিত ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের সঙ্কট ও বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা’ শীর্ষক ওয়েবিনারে এসব মত প্রকাশ করেন বিশেষজ্ঞরা। ওয়েবিনারে সভাপতিত্ব করেন বিডসের নির্বাহী পরিচালক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক ড. মোহাম্মদ ইমরান হোসাইন আনসারী। সঞ্চালনা করেন সাংবাদিক সৈয়দা জোহরা শাম্মী।

উগ্রপন্থায় তরুণ প্রজন্ম জড়াচ্ছে

আলোচনায় অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বায়েজিদ সারোয়ার বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের সাম্প্রতিক আন্দোলনে তরুণ প্রজন্মের উগ্রপন্থায় ঝুঁকে পড়ার লক্ষণ স্পষ্ট। তিনি জানান, ‘সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে যেভাবে ভ্রান্ত ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো হচ্ছে, তা বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতাকে উসকে দিচ্ছে।’ তিনি আরো বলেন, বর্তমানে পার্বত্য এলাকায় ছয়টি সশস্ত্র গ্রুপ সক্রিয় এবং তাদের রসদ আসছে ভারতের সীমান্ত এলাকা থেকে। অতীতে শান্তিবাহিনীর চেয়ে এখনকার বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর শক্তি বেড়েছে সোশ্যাল মিডিয়া, এনজিও ও আন্তর্জাতিক সমর্থনের কারণে। তিনি সতর্ক করেন, ‘এই সমন্বিত শক্তি একসময় নতুন রাষ্ট্র গঠনের প্রচেষ্টায় রূপ নিতে পারে।’

ভারত ছাড়াও বিদেশী প্রভাব সক্রিয়

অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তেজনার পেছনে শুধু ভারত নয়, বরং বাংলাদেশের বামপন্থী বুদ্ধিজীবী ও কিছু এনজিওর প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য, ইস্যুটি জিইয়ে রাখা। তিনি মনে করেন, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূরাজনৈতিক স্বার্থও এ সঙ্কটকে দীর্ঘস্থায়ী করছে।

চীন-যুক্তরাষ্ট্র প্রতিযোগিতা

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড ট্যাকটিক রিসার্চ (ওঝঞজ), প্রেসিডেন্ট আবু রুশদ বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের সঙ্কটের মূল সূত্র নাগরিকত্ব ও জাতিগত পরিচয় প্রশ্নে নিহিত। তিনি উল্লেখ করেন, ১৯৭১ সালে শেখ মুজিবুর রহমান পাহাড়িদের বাঙালি হয়ে যাওয়ার’ পরামর্শ দেয়ার পর থেকেই তাদের মধ্যে সংশয় তৈরি হয়।

আবু রুশদ বলেন, শুধু ভারত নয়, চীন, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রও এ অঞ্চলে সমভাবে সক্রিয়। তিনি সতর্ক করেন, যুক্তরাষ্ট্রের ইঁৎসধ অপঃ-এর প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশের পার্বত্য নিরাপত্তা নীতি পুনর্মূল্যায়ন করা জরুরি।

শান্তিচুক্তি কার্যকারিতা হারিয়েছে

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যান্টাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক ড. নাজমুস সাকিব নির্ঝর বলেন, পাহাড়িদের পুনরায় অস্ত্রধারণের মাধ্যমে ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তি কার্যকারিতা হারিয়েছে। তিনি মনে করেন, চুক্তি লঙ্ঘিত হওয়ায় এখন সরকার তা আর বাস্তবায়নে বাধ্য নয়।

তার মতে, পাহাড়ের অখণ্ডতা রক্ষায় বাংলাদেশকে বিদেশী রাষ্ট্রগুলোর সাথে সামরিক সমন্বয় জোরদার করতে হবে এবং যেখানে সেনাক্যাম্প ছিল সেখানে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।

জাতীয় নিরাপত্তার ইস্যু হিসেবে দেখতে হবে

স্বাগত বক্তব্যে ড. ইমরান আনসারী বলেন, আজকের পৃথিবীতে কোনো আঞ্চলিক সঙ্কট এক দেশের সার্বিক স্থিতিশীলতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। পার্বত্য চট্টগ্রাম তাই কেবল একটি আঞ্চলিক ইস্যু নয়, বরং জাতীয় সংহতি ও নিরাপত্তার প্রশ্ন।

তিনি আহ্বান জানান, সামরিক ও রাজনৈতিক উভয় উদ্যোগে সমন্বিত কৌশল গ্রহণের সময় এখন।

বিশেষজ্ঞদের সার্বিক মত, পার্বত্য চট্টগ্রামের সঙ্কটকে জাতীয় নিরাপত্তা কাঠামোর অংশ হিসেবে পুনর্মূল্যায়ন করা প্রয়োজন।

কারণ এটি এখন শুধু পাহাড়ের সমস্যা নয়, বরং বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত একটি কৌশলগত ইস্যু।